ড. মো. আনোয়ারুল ইসলাম
১৯৭১ সালের মার্চ মাস। ঢাকাসহ উত্তাল সারা পূর্ব বাংলা। পাকিস্তান অখণ্ড থাকবে কি না, এ নিয়ে সব মহলের সংশয়। ঢাকায় পরিস্থিতি দেখার জন্য বিশ্বের প্রায় সব দেশেরই সাংবাদিক অবস্থান নিয়েছিলেন মার্চ মাসজুড়েই। ১৯৭১ সালের ৩ মার্চ পাকিস্তান জাতীয় পরিষদের অধিবেশন স্থগিত হয়ে যাওয়ার পর থেকেই পূর্ব বাংলার রাজনৈতিক পরিস্থিতি দ্রুত বদলাতে থাকে। রেডিওতে ইয়াহিয়া খানের জাতীয় পরিষদের অধিবেশন অনির্দিষ্টকালের জন্য স্থগিত ঘোষণা করার প্রতিবাদে ঢাকাসহ সমগ্র পূর্ব পাকিস্তানে প্রচণ্ড বিক্ষোভ দেখা দেয়।
উত্তপ্ত হয়ে ওঠে রাজনৈতিক অঙ্গন। একদিকে রাজনৈতিক দলগুলোর হরতাল, অন্যদিকে সামরিক শাসনের মাধ্যমে দেওয়া হয় কারফিউ বা জরুরি অবস্থা। এহেন পরিস্থিতির মধ্যে ৭ মার্চ দেওয়া বঙ্গবন্ধুর রেসকোর্সের ভাষণ এবং পূর্ব পাকিস্তানের পরিস্থিতি অবলোকনের জন্য দেশি-বিদেশি সাংবাদিকেরা ঢাকায় আসতে থাকেন।
বিবিসি, রয়টার্স, টেলিগ্রাফ, নিউজউইক, অবজারভারসহ অনেক গণমাধ্যমকর্মী মার্চের শুরুর দিকেই ঢাকায় তাঁদের অ্যাসাইনমেন্ট নিয়ে চলে আসেন। অবস্থান নেন তদানীন্তন হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টাল হোটেলে। ১৯৭১ সালের মার্চের ঘটনাবলির মধ্যে তাঁরা প্রত্যক্ষ করলেন ২৫ মার্চের গণহত্যা। বিদেশি সাংবাদিকদের গতিবিধি নিয়ন্ত্রিত থাকলেও তাঁরা ঢাকায় পাকিস্তানি বাহিনীর নৃশংসতার বিবরণ গণমাধ্যমে পাঠিয়েছিলেন। সমগ্র বিশ্ব জানতে পারল পাকিস্তানি বাহিনীর নৃশংসতার ঘটনাবলি।
সেদিন ঢাকায় অবস্থান করছিলেন একজন জাপানি সাংবাদিক—ওসামু তাকেদা। জাপানের বহুল প্রচারিত দৈনিক ইয়েমুরি শিম্বুন ঢাকার পরিস্থিতি জানার জন্য সংবাদদাতা হিসেবে ওসামু তাকেদাকে পাঠায়। ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী নিরীহ বাঙালির ওপর হামলা চালানোর পর ঢাকায় প্রত্যক্ষদর্শী জাপানি সাংবাদিক ওসামু তাকেদার রিপোর্টের ভিত্তিতে ১৯৭১ সালের ডেইলি ইয়েমুরি ২৯ মার্চের সংখ্যার হেডলাইন ছিল: আন আর্মড সিটিজেনস শট ইন কোল্ড ব্লাড ইন ব্লেজিং ঢাকা।
১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ মধ্যরাতে পাকিস্তানি সামরিক বাহিনী অপারেশন সার্চলাইট শুরু করার আগেই ঢাকায় অবস্থানরত সব বিদেশি সাংবাদিককে হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টালে অবরুদ্ধ করে ফেলা হয়। পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর অপারেশন সার্চ লাইট নামে গণহত্যা মিশনে বিদেশি সাংবাদিকেরা যাতে টের না পান, এ কারণেই তাঁদের সেখানে অবরুদ্ধ করে রাখার নির্দেশ জারি হয়। সেদিন ওসামু তাকেদা হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টালের নবম তলায় অবস্থান করছিলেন। প্রাণের ঝুঁকি নিয়ে একসময় তিনি ঘর থেকে বের হয়ে হোটেলের ছাদে ওঠেন। বারান্দায় যাওয়ার সময় একটি বুলেট তাঁর কাছাকাছি এসে পড়ে, যেটি একটি বড় জানালার কাচ ছিদ্র করে।
অবরুদ্ধ বাকি বিদেশি সাংবাদিকের মতো ওসামু তাকেদাও সারা রাত গোলাগুলির শব্দ শুনতে পান। ঢাকা শহরে আগুনের লেলিহান শিখা দেখতে পান। তিনি দেখতে পান পাকিস্তানি সেনাবাহিনী মশাল হাতে হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টালে রাখা বাংলাদেশের পতাকা নামিয়ে পুড়িয়ে ফেলছে। ২৫ মার্চ সকালের দিকে হোটেলের কর্মচারীরা এই পতাকা উত্তোলন করেছিলেন। তাকেদা তাঁর প্রতিবেদনে উল্লেখ করেন, ২৫ মার্চ বৃহস্পতিবার মধ্যরাতের কাছাকাছি সময়েই পাকিস্তানি সেনারা ধ্বংসযজ্ঞে লিপ্ত হয় এবং নিরীহ বাঙালির ওপর স্বয়ংক্রিয় অস্ত্র, ট্যাংক, কামান, এমনকি রকেট লাঞ্চার ব্যবহার করেছে।
ওসামু তাকেদা যেটুকু প্রত্যক্ষ করেছেন, এর বিবরণে তিনি জানাচ্ছেন: ‘আমি যখন আমার নয়তলা হোটেলের ছাদে উঠেছিলাম, আমি ট্রেসারের বুলেটের রেখা দেখতে পেলাম। কেন্দ্রীয় ঢাকা স্টেশনের আলো শিগগিরই নিভে গেল। তারপর শহরের অসংখ্য জায়গায় রাস্তার লড়াইয়ের মাধ্যমে আগুনের সূত্রপাতের সঙ্গে সঙ্গে আগুনের শিখা রাতের আকাশকে আলোকিত করে।’
হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টালের পাশে বেতারের সম্প্রচার কেন্দ্রের ছাদ থেকে পশ্চিম পাকিস্তানি সেনারা গুলি চালায়। এতে করে হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টালের নির্মাণাধীন একটি অংশের তিনজন শ্রমিক নিহত হন। ওসামু তাকেদা তাঁর প্রতিবেদনে উল্লেখ করেন, ঢাকা ব্রডকাস্টিং স্টেশন পশ্চিম পাকিস্তানি সেনাদের দখলে ছিল।
২৫ মার্চের রাতের গণহত্যা বা নৃশংস হত্যাকাণ্ডের ভয়াবহতা কেমন ছিল, সেটার বিবরণে তিনি বলেছেন, পরের দিন রাস্তায় সারা দিন লাশ পড়ে ছিল। ২৫ মার্চ সারা রাত ধরে গোলাগুলির প্রচণ্ড আওয়াজ, ২৬ মার্চ সারা দিন বিক্ষিপ্তভাবে গুলির শব্দ—এতেই মনে হয় ঢাকায় নিহতের সংখ্যা কয়েক হাজারে গিয়ে দাঁড়ায়। রাস্তায় তিনি ট্রাকের সারি দেখেছিলেন এবং প্রতিটি ট্রাকে প্রায় ১০ জনের মতো পশ্চিম পাকিস্তানি সেনা টহল দিচ্ছিল।
তাকেদার বিবরণে জানা যায়, অপারেশন সার্চলাইটের পর পাকিস্তানি সৈনিকদের হাতে বিদেশি নাগরিকেরাও হেনস্তা হয়েছেন। বিদেশি সাংবাদিকদের অনেকেরই ক্যামেরার ফিল্ম এবং নোট কেড়ে নিয়ে ২৭ মার্চ সকালে তাঁদের ঢাকা থেকে বহিষ্কার করা হয়। তাকেদা তাঁর রিপোর্টে লেখেন, ‘সেনাবাহিনীর সেন্সরশিপের কারণে আমি কোনো কিছু পাঠাতে পারিনি, যা ১৯৭১ সালের ২৭ মার্চ শনিবার সকাল পর্যন্ত চলেছিল, যখন আমাকে অন্যান্য বিদেশি সংবাদকর্মীর সঙ্গে ঢাকা ছেড়ে যাওয়ার নির্দেশ দেওয়া হয়েছিল।’
এএফপির প্রতিনিধি তাঁর পাঠানো সংবাদে জানিয়েছিলেন, সামরিক সেন্সরব্যবস্থা সেখান থেকে কোনো প্রকারের সংবাদ পাঠানো দুঃসাধ্য করে তোলে। তাঁর ও অন্যান্য সাংবাদিকের ফিল্ম ও নোট কেড়ে নেওয়া হয়। বহিষ্কার করার আগে তাঁদের জামাকাপড় খুলে তল্লাশি করা হয়। রয়টার্সের সাংবাদিকও একই অভিযোগ করেন। নিউইয়র্ক টাইমস পত্রিকার সিডনি শানবার্গসহ আরও প্রায় ৩০ জনের বেশি সাংবাদিককে ঢাকা থেকে বহিষ্কার করা হয়।
নিউইয়র্ক টাইমস পত্রিকার কর্তৃপক্ষ এ জন্য এক তারবার্তার মাধ্যমে পাকিস্তানের তদানীন্তন প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়ার কাছে প্রতিবাদ জানায়। ওসামু তাকেদাকে দিল্লি যাওয়ার পথে ঢাকা এয়ারপোর্টে কয়েকবার সার্চ করা হয়েছে। পাকিস্তানি সৈনিকদের স্পর্ধিত এ বিষয়টি ওসামু তাকেদা জাপানি পত্রিকা ডেইলি ইয়েমুরিতে লিখেছেন, ‘... বিফোর লিভিং ঢাকা এয়ারপোর্ট, আই ওয়াজ সার্চড টুয়াইস অ্যান্ড মেমোজ অ্যান্ড ফিল্ম, এক্সপোজড অর নট, ওয়্যার সিজড।’
ওসামু তাকেদার বিবরণ জাপান থেকে প্রকাশিত বিখ্যাত সংবাদপত্র দৈনিক ইয়েমুরির ১৯৭১ সালের ২৯ মার্চ সংখ্যায় ছাপানো হয়।উল্লেখ্য, ওই সংখ্যায় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান কর্তৃক বাংলাদেশের স্বাধীনতার ঘোষণার কথাও পত্রিকায় লেখা হয়েছিল।
ডেইলি ইয়েমুরির রিপোর্টে বলা হয়েছিল: ‘নিউ দিল্লি, মার্চ ২৮ (বাই ইয়েমুরি করেসপনডেন্ট ওসামু তাকেদা)—হেভি ফাইটিং, ইনক্লুডিং দ্য কোল্ড-ব্লাডেড শুটিং অব আন আর্মড সিটিজেনস, ইরাপটেড ইন ঢাকা লাস্ট থার্সডে নাইট উইদিন টু আওয়ারস অব শেখ মুজিবুর রহমানস কল ফর আ ফাইট ফর ইস্ট পাকিস্তানস ইনডিপেনডেন্টস।’
ঢাকায় দখলদার পাকিস্তানি বাহিনীর চালানো প্রথম দফার গণহত্যা ও ধ্বংসযজ্ঞের প্রত্যক্ষ চিত্র উঠে আসে ওসামু তাকেদার ওই প্রতিবেদনে। এই প্রতিবেদন থেকেই জাপানিরা জানতে পারে পাকিস্তানি বাহিনীর সেদিনের বর্বরতার কথা। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে জাপানের জনমত সঞ্চারের প্রাথমিক মুহূর্ত ছিল সেটি।
লেখক: অধ্যাপক, ইতিহাস বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়
১৯৭১ সালের মার্চ মাস। ঢাকাসহ উত্তাল সারা পূর্ব বাংলা। পাকিস্তান অখণ্ড থাকবে কি না, এ নিয়ে সব মহলের সংশয়। ঢাকায় পরিস্থিতি দেখার জন্য বিশ্বের প্রায় সব দেশেরই সাংবাদিক অবস্থান নিয়েছিলেন মার্চ মাসজুড়েই। ১৯৭১ সালের ৩ মার্চ পাকিস্তান জাতীয় পরিষদের অধিবেশন স্থগিত হয়ে যাওয়ার পর থেকেই পূর্ব বাংলার রাজনৈতিক পরিস্থিতি দ্রুত বদলাতে থাকে। রেডিওতে ইয়াহিয়া খানের জাতীয় পরিষদের অধিবেশন অনির্দিষ্টকালের জন্য স্থগিত ঘোষণা করার প্রতিবাদে ঢাকাসহ সমগ্র পূর্ব পাকিস্তানে প্রচণ্ড বিক্ষোভ দেখা দেয়।
উত্তপ্ত হয়ে ওঠে রাজনৈতিক অঙ্গন। একদিকে রাজনৈতিক দলগুলোর হরতাল, অন্যদিকে সামরিক শাসনের মাধ্যমে দেওয়া হয় কারফিউ বা জরুরি অবস্থা। এহেন পরিস্থিতির মধ্যে ৭ মার্চ দেওয়া বঙ্গবন্ধুর রেসকোর্সের ভাষণ এবং পূর্ব পাকিস্তানের পরিস্থিতি অবলোকনের জন্য দেশি-বিদেশি সাংবাদিকেরা ঢাকায় আসতে থাকেন।
বিবিসি, রয়টার্স, টেলিগ্রাফ, নিউজউইক, অবজারভারসহ অনেক গণমাধ্যমকর্মী মার্চের শুরুর দিকেই ঢাকায় তাঁদের অ্যাসাইনমেন্ট নিয়ে চলে আসেন। অবস্থান নেন তদানীন্তন হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টাল হোটেলে। ১৯৭১ সালের মার্চের ঘটনাবলির মধ্যে তাঁরা প্রত্যক্ষ করলেন ২৫ মার্চের গণহত্যা। বিদেশি সাংবাদিকদের গতিবিধি নিয়ন্ত্রিত থাকলেও তাঁরা ঢাকায় পাকিস্তানি বাহিনীর নৃশংসতার বিবরণ গণমাধ্যমে পাঠিয়েছিলেন। সমগ্র বিশ্ব জানতে পারল পাকিস্তানি বাহিনীর নৃশংসতার ঘটনাবলি।
সেদিন ঢাকায় অবস্থান করছিলেন একজন জাপানি সাংবাদিক—ওসামু তাকেদা। জাপানের বহুল প্রচারিত দৈনিক ইয়েমুরি শিম্বুন ঢাকার পরিস্থিতি জানার জন্য সংবাদদাতা হিসেবে ওসামু তাকেদাকে পাঠায়। ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী নিরীহ বাঙালির ওপর হামলা চালানোর পর ঢাকায় প্রত্যক্ষদর্শী জাপানি সাংবাদিক ওসামু তাকেদার রিপোর্টের ভিত্তিতে ১৯৭১ সালের ডেইলি ইয়েমুরি ২৯ মার্চের সংখ্যার হেডলাইন ছিল: আন আর্মড সিটিজেনস শট ইন কোল্ড ব্লাড ইন ব্লেজিং ঢাকা।
১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ মধ্যরাতে পাকিস্তানি সামরিক বাহিনী অপারেশন সার্চলাইট শুরু করার আগেই ঢাকায় অবস্থানরত সব বিদেশি সাংবাদিককে হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টালে অবরুদ্ধ করে ফেলা হয়। পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর অপারেশন সার্চ লাইট নামে গণহত্যা মিশনে বিদেশি সাংবাদিকেরা যাতে টের না পান, এ কারণেই তাঁদের সেখানে অবরুদ্ধ করে রাখার নির্দেশ জারি হয়। সেদিন ওসামু তাকেদা হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টালের নবম তলায় অবস্থান করছিলেন। প্রাণের ঝুঁকি নিয়ে একসময় তিনি ঘর থেকে বের হয়ে হোটেলের ছাদে ওঠেন। বারান্দায় যাওয়ার সময় একটি বুলেট তাঁর কাছাকাছি এসে পড়ে, যেটি একটি বড় জানালার কাচ ছিদ্র করে।
অবরুদ্ধ বাকি বিদেশি সাংবাদিকের মতো ওসামু তাকেদাও সারা রাত গোলাগুলির শব্দ শুনতে পান। ঢাকা শহরে আগুনের লেলিহান শিখা দেখতে পান। তিনি দেখতে পান পাকিস্তানি সেনাবাহিনী মশাল হাতে হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টালে রাখা বাংলাদেশের পতাকা নামিয়ে পুড়িয়ে ফেলছে। ২৫ মার্চ সকালের দিকে হোটেলের কর্মচারীরা এই পতাকা উত্তোলন করেছিলেন। তাকেদা তাঁর প্রতিবেদনে উল্লেখ করেন, ২৫ মার্চ বৃহস্পতিবার মধ্যরাতের কাছাকাছি সময়েই পাকিস্তানি সেনারা ধ্বংসযজ্ঞে লিপ্ত হয় এবং নিরীহ বাঙালির ওপর স্বয়ংক্রিয় অস্ত্র, ট্যাংক, কামান, এমনকি রকেট লাঞ্চার ব্যবহার করেছে।
ওসামু তাকেদা যেটুকু প্রত্যক্ষ করেছেন, এর বিবরণে তিনি জানাচ্ছেন: ‘আমি যখন আমার নয়তলা হোটেলের ছাদে উঠেছিলাম, আমি ট্রেসারের বুলেটের রেখা দেখতে পেলাম। কেন্দ্রীয় ঢাকা স্টেশনের আলো শিগগিরই নিভে গেল। তারপর শহরের অসংখ্য জায়গায় রাস্তার লড়াইয়ের মাধ্যমে আগুনের সূত্রপাতের সঙ্গে সঙ্গে আগুনের শিখা রাতের আকাশকে আলোকিত করে।’
হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টালের পাশে বেতারের সম্প্রচার কেন্দ্রের ছাদ থেকে পশ্চিম পাকিস্তানি সেনারা গুলি চালায়। এতে করে হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টালের নির্মাণাধীন একটি অংশের তিনজন শ্রমিক নিহত হন। ওসামু তাকেদা তাঁর প্রতিবেদনে উল্লেখ করেন, ঢাকা ব্রডকাস্টিং স্টেশন পশ্চিম পাকিস্তানি সেনাদের দখলে ছিল।
২৫ মার্চের রাতের গণহত্যা বা নৃশংস হত্যাকাণ্ডের ভয়াবহতা কেমন ছিল, সেটার বিবরণে তিনি বলেছেন, পরের দিন রাস্তায় সারা দিন লাশ পড়ে ছিল। ২৫ মার্চ সারা রাত ধরে গোলাগুলির প্রচণ্ড আওয়াজ, ২৬ মার্চ সারা দিন বিক্ষিপ্তভাবে গুলির শব্দ—এতেই মনে হয় ঢাকায় নিহতের সংখ্যা কয়েক হাজারে গিয়ে দাঁড়ায়। রাস্তায় তিনি ট্রাকের সারি দেখেছিলেন এবং প্রতিটি ট্রাকে প্রায় ১০ জনের মতো পশ্চিম পাকিস্তানি সেনা টহল দিচ্ছিল।
তাকেদার বিবরণে জানা যায়, অপারেশন সার্চলাইটের পর পাকিস্তানি সৈনিকদের হাতে বিদেশি নাগরিকেরাও হেনস্তা হয়েছেন। বিদেশি সাংবাদিকদের অনেকেরই ক্যামেরার ফিল্ম এবং নোট কেড়ে নিয়ে ২৭ মার্চ সকালে তাঁদের ঢাকা থেকে বহিষ্কার করা হয়। তাকেদা তাঁর রিপোর্টে লেখেন, ‘সেনাবাহিনীর সেন্সরশিপের কারণে আমি কোনো কিছু পাঠাতে পারিনি, যা ১৯৭১ সালের ২৭ মার্চ শনিবার সকাল পর্যন্ত চলেছিল, যখন আমাকে অন্যান্য বিদেশি সংবাদকর্মীর সঙ্গে ঢাকা ছেড়ে যাওয়ার নির্দেশ দেওয়া হয়েছিল।’
এএফপির প্রতিনিধি তাঁর পাঠানো সংবাদে জানিয়েছিলেন, সামরিক সেন্সরব্যবস্থা সেখান থেকে কোনো প্রকারের সংবাদ পাঠানো দুঃসাধ্য করে তোলে। তাঁর ও অন্যান্য সাংবাদিকের ফিল্ম ও নোট কেড়ে নেওয়া হয়। বহিষ্কার করার আগে তাঁদের জামাকাপড় খুলে তল্লাশি করা হয়। রয়টার্সের সাংবাদিকও একই অভিযোগ করেন। নিউইয়র্ক টাইমস পত্রিকার সিডনি শানবার্গসহ আরও প্রায় ৩০ জনের বেশি সাংবাদিককে ঢাকা থেকে বহিষ্কার করা হয়।
নিউইয়র্ক টাইমস পত্রিকার কর্তৃপক্ষ এ জন্য এক তারবার্তার মাধ্যমে পাকিস্তানের তদানীন্তন প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়ার কাছে প্রতিবাদ জানায়। ওসামু তাকেদাকে দিল্লি যাওয়ার পথে ঢাকা এয়ারপোর্টে কয়েকবার সার্চ করা হয়েছে। পাকিস্তানি সৈনিকদের স্পর্ধিত এ বিষয়টি ওসামু তাকেদা জাপানি পত্রিকা ডেইলি ইয়েমুরিতে লিখেছেন, ‘... বিফোর লিভিং ঢাকা এয়ারপোর্ট, আই ওয়াজ সার্চড টুয়াইস অ্যান্ড মেমোজ অ্যান্ড ফিল্ম, এক্সপোজড অর নট, ওয়্যার সিজড।’
ওসামু তাকেদার বিবরণ জাপান থেকে প্রকাশিত বিখ্যাত সংবাদপত্র দৈনিক ইয়েমুরির ১৯৭১ সালের ২৯ মার্চ সংখ্যায় ছাপানো হয়।উল্লেখ্য, ওই সংখ্যায় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান কর্তৃক বাংলাদেশের স্বাধীনতার ঘোষণার কথাও পত্রিকায় লেখা হয়েছিল।
ডেইলি ইয়েমুরির রিপোর্টে বলা হয়েছিল: ‘নিউ দিল্লি, মার্চ ২৮ (বাই ইয়েমুরি করেসপনডেন্ট ওসামু তাকেদা)—হেভি ফাইটিং, ইনক্লুডিং দ্য কোল্ড-ব্লাডেড শুটিং অব আন আর্মড সিটিজেনস, ইরাপটেড ইন ঢাকা লাস্ট থার্সডে নাইট উইদিন টু আওয়ারস অব শেখ মুজিবুর রহমানস কল ফর আ ফাইট ফর ইস্ট পাকিস্তানস ইনডিপেনডেন্টস।’
ঢাকায় দখলদার পাকিস্তানি বাহিনীর চালানো প্রথম দফার গণহত্যা ও ধ্বংসযজ্ঞের প্রত্যক্ষ চিত্র উঠে আসে ওসামু তাকেদার ওই প্রতিবেদনে। এই প্রতিবেদন থেকেই জাপানিরা জানতে পারে পাকিস্তানি বাহিনীর সেদিনের বর্বরতার কথা। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে জাপানের জনমত সঞ্চারের প্রাথমিক মুহূর্ত ছিল সেটি।
লেখক: অধ্যাপক, ইতিহাস বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়
ঝড়-জলোচ্ছ্বাস থেকে রক্ষায় সন্দ্বীপের ব্লক বেড়িবাঁধসহ একাধিক প্রকল্প হাতে নিয়েছে সরকার। এ লক্ষ্যে বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে ৫৬২ কোটি টাকা। এ জন্য টেন্ডারও হয়েছে। প্রায় এক বছর পেরিয়ে গেলেও ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানগুলো কাজ শুরু করছে না। পানি উন্নয়ন বোর্ডের (পাউবো) তাগাদায়ও কোনো কাজ হচ্ছে না বলে জানিয়েছেন...
৩ দিন আগেদেশের পরিবহন খাতের অন্যতম নিয়ন্ত্রণকারী ঢাকা সড়ক পরিবহন মালিক সমিতির কমিটির বৈধতা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। সাইফুল আলমের নেতৃত্বাধীন এ কমিটিকে নিবন্ধন দেয়নি শ্রম অধিদপ্তর। তবে এটি কার্যক্রম চালাচ্ছে। কমিটির নেতারা অংশ নিচ্ছেন ঢাকা পরিবহন সমন্বয় কর্তৃপক্ষ (ডিটিসিএ) ও বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষের...
৩ দিন আগেআলুর দাম নিয়ন্ত্রণে ব্যর্থ হয়ে এবার নিজেই বিক্রির উদ্যোগ নিয়েছে সরকার। বাজার স্থিতিশীল রাখতে ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশের (টিসিবি) মাধ্যমে রাজধানীতে ভ্রাম্যমাণ ট্রাকের মাধ্যমে ভর্তুকি মূল্যে আলু বিক্রি করা হবে। একজন গ্রাহক ৪০ টাকা দরে সর্বোচ্চ তিন কেজি আলু কিনতে পারবেন...
৩ দিন আগেসপ্তাহখানেক আগে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকে অনেকের ওয়াল বিষাদময় হয়ে উঠেছিল ফুলের মতো ছোট্ট শিশু মুনতাহাকে হত্যার ঘটনায়। ৫ বছর বয়সী সিলেটের এই শিশুকে অপহরণের পর হত্যা করে লাশ গুম করতে ডোবায় ফেলে রাখা হয়েছিল। প্রতিবেশী গৃহশিক্ষকের পরিকল্পনায় অপহরণের পর তাকে নির্মমভাবে হত্যা করা হয়...
৩ দিন আগে