অপরাধের স্বর্গে ভূগোল আর ইতিহাস একাকার

আমানুর রহমান রনি, ঢাকা
প্রকাশ : ১৭ নভেম্বর ২০২২, ০০: ০৫
আপডেট : ১৭ নভেম্বর ২০২২, ০০: ০৬

ঢাকা-সিলেট মহাসড়ক ধরে ডেমরা স্টাফ কোয়ার্টার রোড পেরোলেই বাঁ হাতে মাঝারি প্রশস্তের সড়ক নেমে গেছে বালু নদের দিকে। নদীর ওপরে পুরোনো ব্রিজ। ব্রিজ পার হলেই ছোট ছোট ঘরের বিশাল এক জনবসতি। কবীর সুমনের গানের মতো, ‘যদিও বাসার আসল ঠিকানা, দশ ফুট বাই দশ ফুট’। এর নাম চনপাড়া বস্তি।

চনপাড়া বস্তি এত দিন ছিল সবার চোখের আড়ালে। সম্প্রতি বুয়েটের শিক্ষার্থী ফারদিন খুন হওয়ার পর আলোচনায় এসেছে। অনেকেই বলছেন, মাদক কেনা নিয়ে কথা-কাটাকাটির জের ধরেই নাকি ফারদিন খুন হয়েছেন, যদিও ফারদিনের বাবা ছেলের মাদক গ্রহণের কথার প্রতিবাদ করেছেন।

তবে স্বাধীনতার পর থেকে যাঁরা ঢাকায় বাস করছেন, তাঁরা চনপাড়ার ইতিহাস জানেন। তাঁদের কাছে চনপাড়া হচ্ছে ‘অপরাধের ডেরা’।

স্থানীয় লোকজন বলছেন, স্বাধীনতার পর রাজধানীতে ভাসমান মানুষের সংখ্যা বেড়ে যায়। এই মানুষেরা চুরি-ডাকাতিসহ নানা অপরাধে জড়িয়ে পড়ে। তখন এই ভাসমানদের পুনর্বাসনের জন্য বেছে নেওয়া হয় চনপাড়াকে। নাম দেওয়া হয় ‘চনপাড়া পুনর্বাসন কেন্দ্র’।

রূপগঞ্জের কায়েতপাড়া ইউনিয়নের ৯ নম্বর ওয়ার্ডে পড়েছে চনপাড়া। পূর্ব-উত্তরে শীতলক্ষ্যা, দক্ষিণে বালু নদ, পশ্চিমে বিশাল খাল। নারায়ণগঞ্জের রূপগঞ্জ উপজেলার মূল ভূখণ্ড থেকে প্রায় যোগাযোগবিচ্ছিন্ন জনপদ। শুরুতে ৩ হাজার পরিবারকে ১২ হাত বাই ১৬ হাত করে জায়গা বরাদ্দ দেওয়া হয়। এখন সেখানে ৯টি ব্লকে ৭ হাজার পরিবার বসবাস করে। ভোটার ২২ হাজারের বেশি।

বস্তিতে কারও নামে বরাদ্দ হওয়া জায়গা বিক্রির সুযোগ নেই। তারপরও অনেকে স্ট্যাম্পে লিখিত দিয়ে পজিশন বিক্রি করে চলে গেছেন। কাউকে ভয়ভীতি দেখিয়ে তাড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। অভিযোগ রয়েছে, এসব ঘর দখল করে নিয়েছে প্রভাবশালী চক্র।

গত সোমবার সকাল থেকে রাত পর্যন্ত এই বস্তি ঘুরে মাদক কেনাবেচার নানা অপরাধের গল্প শোনা গেছে, কিছু প্রমাণও মিলেছে।

আসলে রাজধানী থেকে ‘দুই পা ফেলিয়া’ হলেও ভৌগোলিকভাবে চনপাড়া দুর্গম। এখানে যাওয়ার একটি মাত্র রাস্তা, তাও এক দিকে। আর তিন দিকে পানি। নদী ও জলাশয় সন্ত্রাসীদের জীবন বাঁচাতে ‘পরিখার’ মতো কাজ করে। স্বাভাবিকভাবেই এটা অপরাধীদের স্বর্গরাজ্য।

এখানে অপরাধ করে সহজে নৌকা নিয়ে মাঝনদীতে চলে গেলেই আর তাঁকে খুঁজে পাওয়া সম্ভব নয়। এখানকার মূল কারবার মাদকের। এ নিয়ে বিভিন্ন দলের মধ্যে প্রায়ই সংঘর্ষ হয়। মাদক নিয়ে এ পর্যন্ত ২৩ জন খুন হয়েছে চনপাড়ায়। খুন হওয়া মানুষের লাশ খুব সহজেই বালু নদ অথবা শীতলক্ষ্যা নদীতে ভেসে গেছে। শীতলক্ষ্যায় মিলেছিল বুয়েট শিক্ষার্থী ফারদিন নূরের লাশও।

ফারদিন খুনের পর চনপাড়া জায়গাটা আলোচনায় আসে। এ ঘটনায় জড়িত সন্দেহে উঠে আসে ইউপি সদস্য বজলুর রহমান, মনু বেগম ও ময়না বেগমের নাম। চনপাড়ায় গিয়ে ময়নাকে পাওয়া গেলেও মনুর দেখা মেলেনি। অভিযোগ রয়েছে, এই মনুর বাড়িতেই নাকি ফারদিনকে পিটিয়ে হত্যা করা হয়েছে।

মনু বেগম ৮ নম্বর ব্লকের রাস্তার পাশের একটি বাসায় থাকেন। তাঁর স্বামী জুলহাস ঢাকায় দৈনিক মজুরিতে বিভিন্ন কাজ করেন। তাঁদের এক মেয়ে ও প্রতিবন্ধী এক ছেলে রয়েছে। মেয়ের বিয়ে হয়েছে বস্তিতেই।

মনুর বাড়ি ৮ নম্বর ব্লকের প্রধান সড়কের মাঝামাঝি ছোট সরু গলির ভেতরে ইটের উঁচু সীমানা দেয়াল দিয়ে ঘেরা। লোহার গেট বন্ধ করে দিলে কিছুই দেখা যায় না।

প্রতিবেশীরাও তাঁকে নিয়ে কিছু বলতে চান না। তবে তাঁর বাসায় মাদক কেনাবেচা ও অপরিচিত মানুষের আড্ডার কথা বলেছেন সবাই।

মনুর বাড়িতে ৪ নভেম্বর দিবাগত রাতে কোনো হট্টগোল হয়েছিল কি না জানতে চাইলে তাঁর এক প্রতিবেশী বলেন, ওই বাড়িতে প্রতি রাতেই নানা শব্দ হয়। সেটা কিসের তা বলতে পারব না। সন্ত্রাসী সিটি শাহীন ৮ নভেম্বর বন্দুকযুদ্ধে মারা যাওয়ার পর মনুও বাড়িতে তালা দিয়ে পালিয়েছেন।

আর ময়না বেগম বস্তির ৬ নম্বর ব্লকে থাকেন। তাঁর বিরুদ্ধে ইয়াবা বিক্রির অভিযোগ রয়েছে। তিনি নিজেও আজকের পত্রিকার কাছে ইয়াবা বিক্রির কথা স্বীকার করেছেন।

ময়না বেগম বলেন, ‘আমি নিজের ইচ্ছায় মাদক ব্যবসা করি না। আমাকে জোর করে বজলু মেম্বার মাদক বিক্রি করায়। আমি একবার ভয়ে পালিয়েছিলাম, ধরে এনে আমাকে মারধর করেছে। রায়হান, শাহীন আমাকে রাস্তায় ফেলে মেরেছে।’

চনপাড়া বস্তির সেই আলোচিত বজলুর রহমানকে অবশ্য পাওয়া গেল না। তাঁর তিন মেয়ে। দুই মেয়ের স্বামী বস্তিতে মাদকের কারবার করেন বলে অভিযোগ আছে। বস্তির লোকজন বললেন, নিহত সিটি শাহীন, রায়হান, শাওন, রাজা, সাব্বির—এরা সবাই বজলুর লোক। সবার বিরুদ্ধে মাদকের মামলা রয়েছে। বস্তিতে জায়গা দখল করে বহুতল ভবন নির্মাণ করেছেন প্রত্যেকে। তাঁদের কোনো পেশা নেই। অথচ সবাই একাধিক বাড়ির মালিক। এসব বাড়ি তাঁরা ভাড়া দেন।

বজলুর স্ত্রী শিরিন বস্তিতে খুব ক্ষমতাবান। বজলু পলাতক হলেও শিরিন বাসিন্দাদের মুখ না খুলতে ভয়ভীতি দেখাচ্ছেন। একটি এনজিওর অফিস দখল করে বস্তিতে নিজের অফিস বানিয়েছেন বজলু মেম্বার। অনেকে সেটিকে ‘টর্চার সেল’ বলেন।

বস্তির লোকজনের সঙ্গে কথা বলে জানা গেল, চনপাড়া বস্তিতে প্রভাবশালী দুটি চক্র সক্রিয়। একটির নেতৃত্বে বজলুর রহমানের অনুসারী রাশেদুল ইসলাম শাহীন ওরফে সিটি শাহীন, ফাহাদ আহমেদ শাওন, রাজু আহমেদ রাজা, রায়হান, রবিন, রিপন, সাব্বির, তালুকদার মুজাহিদ ও সায়েম। তাঁদের মধ্যে সিটি শাহীন র‍্যাবের সঙ্গে বন্দুকযুদ্ধে মারা যান। বাকিদের কয়েকজন র‍্যাব হেফাজতে রয়েছেন। শাওন বজলু মেম্বারের আপন ভাতিজির স্বামী, রিপন তাঁর জামাতা। তাঁরা প্রত্যেকেই বস্তিতে দুইতলা তিনতলা বাড়ি করেছেন।

অন্য চক্রের নেতৃত্বে আছেন জয়নাল আবেদীন। তাঁর অনুসারীরা হলেন রাব্বি, জয়, বিজয়, মাজেদ, হাসিবসহ আরও অনেকে।

র‍্যাবের মুখপাত্র খন্দকার আল মঈন আজকের পত্রিকাকে বলেছেন, চনপাড়ার অপরাধীদের তাঁরা শনাক্ত করেছেন। বস্তির সব অপরাধের তথ্য র‍্যাবের কাছে আছে। তাঁদের ধরতে অভিযান হচ্ছে।

তবে বস্তিবাসীরা বলছেন, কোনো ঘটনা ঘটলেই শুধু অভিযান হয়। এরপর সব হয়ে যায় আগের মতো। সন্ত্রাসীরা আবার রাজা বনে যায়।

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
খুঁজুন

সম্পর্কিত