পরিবারতন্ত্রের ‘সেরা কীর্তি’ শ্রীলঙ্কার হাম্বানটোটা

রাশেদ নিজাম, হাম্বানটোটা (শ্রীলঙ্কা) থেকে
প্রকাশ : ২৬ জুলাই ২০২২, ০৬: ৪১
আপডেট : ২৬ জুলাই ২০২২, ১১: ২৬

শ্যামদেশের (থাইল্যান্ড) এক রাজা ছিলেন, যিনি প্রতিদ্বন্দ্বী রাজ্যের রাজাদের সাদা হাতি বা শ্বেতহস্তী উপহার দিতেন। যাতে সেই হাতি পুষতেই রাজার রাজকোষ খালি হয়ে যায়। নিষ্কর্মা সেই শ্বেতহস্তীর একমাত্র কাজই ছিল আরাম-আয়েশে খাওয়া-দাওয়া করে রাজভান্ডার উজাড় করা। এত দিনের সেই জানা গল্পটা মিলিয়ে দেখতে চাইলে হাম্বানটোটায় আসতেই হবে।

শ্রীলঙ্কার একেবারে দক্ষিণে সমুদ্রঘেঁষা অসম্ভব সুন্দর এক জনপদ। পৃথিবীর অন্যতম বৃহৎ সাফারি পার্ক (প্রাণীর অভয়ারণ্য) বললেও ভুল হবে না। এখানেই বিলিয়ন বিলিয়ন ডলার ব্যয়ে স্থাপনা তৈরি করেছেন রাজাপক্ষে পরিবারের সদস্যরা। যাঁরা একসময় পুরো শ্রীলঙ্কাকে নিজেদের মতো করে শাসন করেছেন। তাঁদের সেই সাধের স্থাপনা এখন সত্যিকারেই শ্বেতহস্তী। এটা করে আর্থিকভাবে কোনো লাভবানই হতে পারেনি দেশটি, উল্টো বিদেশি ঋণের বোঝা বাড়িয়েছে। আমদানিনির্ভর রাষ্ট্রটির রিজার্ভ শেষ হয়ে গেছে। একপর্যায়ে দেউলিয়া হয়ে পড়েছে দক্ষিণ এশিয়ার সবচেয়ে বেশি অর্থনৈতিক সম্ভাবনার দ্বীপরাষ্ট্রটি।

রাজধানী কলম্বো থেকে দূরত্ব ২৫৮ কিলোমিটার। আয়তনে প্রায় চারগুণ বড় (২ হাজার ২০৯ বর্গ কিমি)। ২০১২ সালের শুমারিতে জনসংখ্যা ছিল ৫৮ হাজারের কাছাকাছি। ১০ বছরে দ্বিগুণ হওয়ার কথা নয়। সে হিসাবে এক লাখের কম লোকের বাস বাংলাদেশের রাজধানী ঢাকার (২ হাজার ১৬১ বর্গ কিমি) চেয়েও বড় এই এলাকায়। হাম্বানটোটা মূলত হাতি আর ময়ূরের জন্য বিখ্যাত। প্রায় পুরো জেলাই এদের বিচরণ। রাজাপক্ষে পরিবারের উত্থানও এখান থেকে।

কলম্বো থেকে মহাসড়ক ধরে গল, মাতারা হয়ে হাম্বানটোটায় ঢোকার পর দুই দিকেই রাস্তা চলে গেছে। বাঁয়ে শহর আর ডানে সমুদ্রবন্দরের রাস্তা। প্রথমে সমুদ্রের দিকেই যাত্রা। জনমানবহীন পুরোটাই। দেখে মনে হতে পারে কোনো মৃত্যুপুরী।

হাম্বানটোটা আন্তর্জাতিক বন্দরের প্রধান ফটকের সামনে সেনা পাহারা, যা শুরু হয়েছে মাস চারেক আগে যখন সরকারবিরোধী আন্দোলন শুরু হয়। চেক পয়েন্টগুলো বন্ধ। রাস্তা দেখে মনে হয় বহুদিন কোনো টায়ারের ছাপ পড়েনি। কোনো কথা বলবেন না দায়িত্বরত সদস্যরা।

শ্রীলঙ্কার দক্ষিণ অঞ্চলের সবচেয়ে বড় প্রকল্প এই বন্দর, বিতর্কিতও। খরচ হয়েছে ১৫০ কোটি ডলার, যার মধ্যে চীনের একার ঋণ আছে ১৩০ কোটি। ২০০৮ সালে মাহিন্দা রাজাপক্ষের সময়ে কাজ শুরু হয়, ৭ বছর পর শেষ হয় কাজ।

২০১৬ সালে মালিকানা পায় শ্রীলঙ্কা পোর্ট অথরিটি (এসএলপিএ)। প্রথম বছরেই প্রায় ৫ হাজার কোটি রুপি লোকসান গোনার পর টনক নড়ে তাদের। যদিও ২০৩৬ সালের মধ্যে চীনকে ঋণের সুদ-আসলসহ মোট ১৭০ কোটি ডলার পরিশোধ করার কথা। প্রতিবছর প্রায় ১০ কোটি ডলার শোধ করতে হয়েছে শ্রীলঙ্কাকে। তাই ঋণের বোঝা কমাতে ২০১৭ সালে একটি চীনা প্রতিষ্ঠানকে ৯৯ বছরের জন্য ইজারা দেওয়া হয় মাহিন্দার স্বপ্নের বন্দর।

গতকাল দুপুরে মাগাম রুহুনাপুরা আন্তর্জাতিক কনফারেন্স সেন্টারে পৌঁছে দেখা গেল বিশাল এক স্থাপনা। বাইরে মূল দরজায় এক নারী বসে আছেন, আরেকজন নিরাপত্তাপ্রহরী। শ্মশানের মতো অবস্থা। গা হিম করা পরিবেশ! কথা বলতে চাইলে নিরাপত্তার দায়িত্বে থাকা সেনাসদস্যকে ডেকে আনলেন তাঁরা। তিনি বললেন, কোনো আয়োজন নেই এখানে। ভেতরে যাওয়ার অনুমতি নিতে হবে জেলা কমান্ডারের কাছ থেকে। সব মিলিয়ে ২০ জন মানুষ এখানে রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্ব পালন করছেন বলে জানালেন ওই নারী। প্রথমে মাহিন্দা রাজাপক্ষে নাম রাখা হলেও পরে একই রকম শব্দে মাগাম রুহুনাপুরা রাখা হয়।

চীন থেকে ১৫ দশমিক ৫ মিলিয়ন ডলার ঋণ নিয়ে এই সেন্টার তৈরি করেছিলেন মাহিন্দা রাজাপক্ষে। কেউ ফিরেও তাকায়নি এর দিকে। অন্তত ২০ মিনিটে যে যানবাহন এর পাশ দিয়ে গেছে, তা দেখে মনে হলো আমরাই একমাত্র উৎসাহী।

সেখান থেকে ১৬ কিলোমিটার দূরে মাত্তালা রাজাপক্ষে আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর। যাওয়ার পথে অন্তত ২০ স্থানে মিলল হাতি চলাচলের সতর্কবার্তা। যাওয়ার সময় হাতির পাল ভেঙে গেছে আশপাশের সবকিছু, সে চিহ্নও দৃশ্যমান। রাস্তার ওপর বিভিন্ন স্থানে রয়েছে হাতির মল। পৌঁছানোর পর দেখা গেল নীরব এক এলাকা। শুধু নিরাপত্তাকর্মীরা দাঁড়িয়ে আছেন।

আধুনিক বিমানবন্দরের সবই আছে, শুধু বিমান ওড়ে না। কোনো ফ্লাইট নেই। একসময় ফ্লাই দুবাই চলাচল করত, তাও বন্ধ।

মাত্তালা বিমানবন্দরে খরচ হয়েছে প্রায় ২৫ কোটি ডলার। চীনই দিয়েছে ৯০ শতাংশ। কিন্তু সুন্দর ফুল ফুটে আছে। পরিষ্কার রাস্তা। বিশাল রানওয়ে। কোনো মানুষ নেই। বিকেল ৫টার দিকে দেখা গেল, দায়িত্ব শেষে বাসে বেরিয়ে যাচ্ছেন সকালের শিফটের কর্মকর্তারা।

আরেক সাদা হাতি দেখতে যেতে সন্ধ্যা হয়ে যায়। বিমানবন্দর থেকে প্রায় ৩৫ কিলোমিটার দূরে মাহিন্দা রাজাপক্ষে আন্তর্জাতিক ক্রিকেট স্টেডিয়াম। যার আসনসংখ্যা ৩৫ হাজার। তবে এখন পর্যন্ত আন্তর্জাতিক ম্যাচ হয়েছে হাতে গোনা। কোনোমতে রাতের অন্ধকারে নিজের অবস্থান জানান দিচ্ছে স্থাপনাটি। ওই এলাকার নামাল কুলু দোদোল নামের দোকানের মালিকের ছেলে বিজয় বললেন, আমাদের কথা যদি ভাবত রাজাপক্ষে পরিবার, তবে মানুষের উন্নয়ন করত। এত টাকা দিয়ে এই এলাকায় এমন সব ভবন বানাত না। তাদের কাছে হিসাব নেওয়া উচিত, জনগণের কষ্টের অর্থ কেন এভাবে খরচ করা হলো?

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
খুঁজুন

সম্পর্কিত