Ajker Patrika

তলে তলে আপস এবং বিএনপির ‘ভগবান’ দেখা

তলে তলে আপস এবং বিএনপির ‘ভগবান’ দেখা

আমাদের দেশের রাজনীতিতে সংলাপ শব্দটি নতুন নয়। মাঝে মাঝে এ শব্দটি সামনে আসে, আবার হারিয়ে যায়। সংকট নিরসনে দলগুলোর মধ্যে আলোচনা বা সংলাপের বিকল্প নেই বলা হলেও বিষয়টি উপেক্ষা করতেই রাজনৈতিক নেতারা পছন্দ করেন। এবারও দেশের প্রধান দুটি রাজনৈতিক দল আগামী নির্বাচন কোন সরকারের অধীনে হবে তা নিয়ে যখন মুখোমুখি অবস্থানে, তখন আবার সংলাপের বিষয়টি সামনে এসেছে যুক্তরাষ্ট্রের প্রাক্‌-নির্বাচন পর্যবেক্ষক দলের একটি বিবৃতিকে কেন্দ্র করে। সংলাপ প্রসঙ্গটি নিয়ে আলোচনা চললেও সংলাপ যে হবেই তা নিশ্চিত করে বলা যায় না। বিএনপি সরকার পতনের চূড়ান্ত আন্দোলনের হুমকি দিচ্ছে। আর আওয়ামী লীগ বলছে, বিএনপির পরিণতি শাপলা চত্বরের থেকে করুণ হবে। আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের তলে তলে আপস হওয়ার কথা জানিয়েছেন। আবার বিএনপির একজন নেতা ঢাকায় নিযুক্ত মার্কিন রাষ্ট্রদূত পিটার হাসের মধ্যে ‘ভগবান’কে দেখতে পেয়েছেন। এই অবস্থায় দেশের মানুষ বুঝতে পারছে না, তারা আসলে কী করবে!

সপ্তাহখানেক বাংলাদেশ সফর শেষে আমেরিকার প্রাক্‌-নির্বাচন প্রতিনিধিদলের পক্ষ থেকে ১৪ অক্টোবর ওয়াশিংটন থেকে একটি বিবৃতি প্রচার করা হয়েছে। বিবৃতিতে বর্তমান রাজনৈতিক অচলাবস্থার সমাধান এবং বাস্তবসম্মত, দীর্ঘস্থায়ী ও বিশ্বাসযোগ্য পরিবর্তনের লক্ষ্যে রাজনৈতিক দলগুলোকে খোলামনে আলোচনার আহ্বান জানানো হয়েছে। এর মধ্যেই আবার ঢাকায় এসেছেন আমেরিকার পররাষ্ট্র দপ্তরের দক্ষিণ ও মধ্য এশিয়াবিষয়ক ডেপুটি অ্যাসিস্ট্যান্ট সেক্রেটারি আফরিন আখতার। তিনিও আগের প্রতিনিধিদলের দেওয়া সুপারিশের প্রতি সমর্থন জানিয়েছেন। প্রাক্‌-নির্বাচন প্রতিনিধিদলের বিবৃতিতে বাংলাদেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ও গণতান্ত্রিক মূল্যবোধের প্রশংসা করে একটি অংশগ্রহণমূলক, বিশ্বাসযোগ্য ও শান্তিপূর্ণ নির্বাচন আয়োজনের জন্য অর্থবহ সংলাপের ওপর গুরুত্ব দিয়ে পাঁচ দফা সুপারিশ করা হয়েছে। তবে সুপারিশগুলো কখন বাস্তবায়ন করতে হবে এবং না করলে কী হবে, সে সম্পর্কে ওই বিবৃতিতে কিছু বলা হয়নি।

ঢাকায় বিভিন্ন মহলের সঙ্গে ৮ থেকে ১২ অক্টোবর সংলাপ করে যুক্তরাষ্ট্রের প্রাক্‌-নির্বাচনী পর্যালোচনা মিশন (পিইএম)। ওই দলে ছিলেন ইন্টারন্যাশনাল রিপাবলিকান ইনস্টিটিউট (আইআরআই) এবং ন্যাশনাল ডেমোক্রেটিক ইনস্টিটিউটের (এনডিআই) ছয় সদস্য।

পর্যবেক্ষক দলটি মনে করে, বাংলাদেশ এখন এক সন্ধিক্ষণে রয়েছে। এ দেশের আসন্ন জাতীয় নির্বাচন গণতান্ত্রিক, অংশগ্রহণমূলক ও প্রতিযোগিতামূলক রাজনৈতিক প্রক্রিয়ার প্রতি দেশটির অঙ্গীকারের ক্ষেত্রে একটি ‘লিটমাস টেস্ট’। রাজনীতিতে ‘লিটমাস টেস্ট’ বলতে বোঝায় এমন একটি প্রশ্নকে, যার উত্তরের ওপর উত্তীর্ণ অথবা অনুত্তীর্ণ হওয়ার বিষয়টি নির্ভর করে।

বিবৃতিতে বলা হয়, বাংলাদেশের শক্তিশালী অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ও গণতান্ত্রিক মূল্যবোধের ঐতিহ্য ২০৪১ সালে উন্নত রাষ্ট্রে পরিণত হওয়ার রূপকল্প অর্জনের ক্ষেত্রে একটি শক্তিশালী ভিত্তি স্থাপন করেছে। তারপরও বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক অভিযাত্রা বেশ কিছু চ্যালেঞ্জের মুখে রয়েছে। চ্যালেঞ্জের মধ্যে রয়েছে আপসহীন রাজনৈতিক মানসিকতা, আক্রমণাত্মক বক্তৃতা, রাজনৈতিক সহিংসতা, অনিশ্চয়তা, ভয়ের একটি বিস্তৃত পরিবেশ, নাগরিক সমাজ ও মতপ্রকাশের স্বাধীনতার ক্ষেত্র সংকুচিত হওয়া, নাগরিক, রাজনৈতিক নেতা ও অন্য অংশীজনদের মধ্যে আস্থার ঘাটতি। গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় অংশগ্রহণের ক্ষেত্রে নারী, যুবক ও অন্যান্য প্রান্তিক গোষ্ঠীও উল্লেখযোগ্য বাধার সম্মুখীন হয়। চ্যালেঞ্জগুলো গণতান্ত্রিক মূল্যবোধের জন্য হুমকি হয়ে দাঁড়িয়েছে, যা টেকসই উন্নয়নের দিকে বাংলাদেশের ইতিবাচক অগ্রযাত্রাকে বিঘ্নিত করতে পারে।

পর্যবেক্ষক দলের সুপারিশগুলো হলো: ১. বক্তব্যের ক্ষেত্রে সহনশীলতা ও নির্বাচনী মুখ্য বিষয়ে খোলামেলা ও অর্থবহ সংলাপে বসা; ২. মতপ্রকাশের স্বাধীনতা রক্ষা ও নাগরিকদের জন্য খোলামেলা পরিবেশ নিশ্চিত করা, যেখানে ভিন্নমতকে সম্মান করা হয়; ৩. সহিংসতার বিরুদ্ধে অঙ্গীকার ও রাজনৈতিক সহিংসতায় জড়িত ব্যক্তিদের জবাবদিহি নিশ্চিত করা; ৪. স্বাধীনভাবে নির্বাচন পরিচালনাকে শক্তিশালী করাসহ সব দলের অর্থবহ রাজনৈতিক প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণের ক্ষেত্র তৈরি করা এবং ৫. নাগরিকদের মধ্যে অন্তর্ভুক্তিমূলক ও সক্রিয় নির্বাচনী অংশগ্রহণের সংস্কৃতি উৎসাহিত করা।

প্রতিনিধিদলটি মনে করেছে, সুপারিশগুলো 
একটি পথনকশা তৈরি করবে। এই পথনকশা নির্বাচনের আগের বাকি সময়টুকু এবং নির্বাচনের পরে নেওয়া হলে বাংলাদেশের গণতন্ত্রকে এগিয়ে নিতে পারে এমন বিশ্বাসযোগ্য, অন্তর্ভুক্তিমূলক, অংশগ্রহণমূলক এবং সহিংসতামুক্ত নির্বাচনের লক্ষ্য অর্জনে সহায়তা করতে পারে।

কিন্তু আলোচনার মাধ্যমে সমস্যা সমাধানের রাজনৈতিক বাস্তবতা বাংলাদেশে আছে কি না, সেটাই এখন বড় প্রশ্ন। আওয়ামী লীগ ও বিএনপি পরস্পরের প্রতি এতটাই বিদ্বিষ্ট যে আলোচনায় বসে সমাধানে পৌঁছানো খুবই কঠিন বলে মনে হয়। তা ছাড়া অতীতেও বিদেশি মধ্যস্থতায় দুই দলের সংলাপে কোনো কিছু অর্জন না হওয়ার রেকর্ড আছে। বিএনপির দাবি মেনে শেখ হাসিনা তত্ত্বাবধায়ক বা নির্বাচনকালীন সরকারের কাছে পদত্যাগ করবেন না। আবার বিএনপিও আওয়ামী লীগ সরকারের অধীনে নির্বাচনে অংশ নেবে না।

আওয়ামী লীগ ও বিএনপি মাঠের শক্তি পরীক্ষার জন্য নেমে পড়েছে। এ মাসের মধ্যে আন্দোলনের চূড়ান্ত পরিণতি দেখতে চায় বিএনপি। আর আওয়ামী লীগ নির্বাচনী প্রচারণা শুরু করে দিয়েছে। আওয়ামী লীগ সভাপতি ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ১৪ অক্টোবর এক সভায় স্পষ্ট করেই বলেছেন, যেভাবে হোক নির্বাচন এ দেশে হবেই এবং জনগণ স্বাধীনভাবে ভোট দেবে। বিএনপি আগামী নির্বাচন বানচালের চেষ্টা করছে বলেও তিনি অভিযোগ করেছেন।

প্রধান নির্বাচন কমিশনার কাজী হাবিবুল আউয়ালের বক্তব্যেও একতরফা নির্বাচনের ইঙ্গিত আছে। তিনি ১৪ অক্টোবর নির্বাচন কর্মকর্তাদের এক প্রশিক্ষণ কর্মশালায় বলেছেন, ‘জনগণকে দেখাতে হবে নির্বাচন সুষ্ঠু ছিল, ভোটাররা নির্বিঘ্নে ভোটকেন্দ্রে প্রবেশ করতে পেরেছেন, প্রবেশ করে তাঁরা ভোটাধিকার প্রয়োগ করতে পেরেছেন। এটুকু যদি আমরা দেখাতে পারি, তাহলে কে নির্বাচনে এল না এল, জনগণ যদি আসে, ভোটাররা যদি আসেন, ভোট প্রয়োগ করেন, তাহলেই নির্বাচনের বড় সফলতা।’

সিইসির এই বক্তব্য থেকে বোঝা যায়, বিএনপিকে নির্বাচনে আনার গরজ নির্বাচন কমিশনের সেভাবে নেই। আবার বিএনপিও সাধারণ মানুষের ওপর ভরসা করে নয়, বিদেশিদের ওপর ভরসা করেই সরকার পতনের আন্দোলনের পরিকল্পনা করেছে, সেটাও দলের নেতারাই প্রকাশ্যে স্বীকার করেছেন। বিএনপির একজন নেতা মার্কিন রাষ্ট্রদূত পিটার হাসকে নিজেদের ‘ভগবান’ বলে দাবি করেছেন। ১৫ অক্টোবর গুলশানে লেকশোর হোটেলে বিএনপির উদ্যোগে ‘বাংলাদেশের গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারে দেশীয়-আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের ভূমিকা’ শীর্ষক সেমিনারে বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান ব্যারিস্টার শাহজাহান ওমর বলেন, ‘মার্কিন রাষ্ট্রদূত পিটার হাসকে ধন্যবাদ জানাই। তিনি আমাদের জন্য অবতার হয়ে এসেছেন। তাঁর তো আমাদের আরও সাহস দেওয়া দরকার, বাবারে, তুই আমাদের বাঁচা, রক্ষা কর। তার বলতে হবে—আমি আছি তোমাদের সঙ্গে, তোমরাও ডেমোক্রেটিক কান্ট্রি, আমরাও ডেমোক্রেটিক কান্ট্রি। পিটার হাস—বাবা ভগবান, আসসালামু আলাইকুম।’

দলের মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলামও বলেছেন, ‘গণতন্ত্রের প্রতি পশ্চিমা বিশ্বের যে অঙ্গীকার, তা সাহস জোগাচ্ছে।’ তিনি বলেন, ‘আমরা একা নই। পশ্চিমা বিশ্ব গণতন্ত্রের পক্ষে কমিটেড। এই অঙ্গীকার আমাদের সাহস জোগাচ্ছে। সামনের দিকে এগিয়ে যেতে সাহায্য করছে, এটি অস্বীকার করার তো উপায় নেই।’

বিএনপির মিত্র নাগরিক ঐক্যের মাহমুদুর রহমান মান্না বলেছেন, ‘সামনে যেতে পারছিলাম না। সেই আটকে থাকা দরজা খুলে দিয়েছে মার্কিন ভিসা নীতি।’

তাহলে কি আমাদের এটা মেনে নিতে হবে যে যুক্তরাষ্ট্রের সহযোগিতায় বাংলাদেশে গণতন্ত্র আসবে? কিন্তু প্রশ্ন হলো, আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় থাকলে আমেরিকার সমস্যা কোথায়? বিএনপি ক্ষমতায় এলেই-বা তাদের লাভ কী? আওয়ামী লীগ যদি অগণতান্ত্রিক দল হয়ে থাকে তাহলে বিএনপি কীভাবে গণতান্ত্রিক দল? যদি উভয় দলই লুটেরাদের স্বার্থ রক্ষাকারী হয়ে থাকে, তাহলে বিএনপির প্রতি পিটার হাস তথা আমেরিকার এত দরদ কেন? মার্কিনিরা কি বিএনপিকে বিনা স্বার্থে এমনি এমনি ক্ষমতায় বসাতে চায়? বিএনপি নেতাদের উচিত, এসব প্রশ্নের সন্তোষজনক জবাব দেওয়া।

এটা অস্বীকার করা যাবে না, আমেরিকা নিজের স্বার্থে ও প্রয়োজনেই বাংলাদেশে ‘গণতন্ত্র উদ্ধারে’ দৌড়ঝাঁপ করছে। যদি 
তারা সত্যি আন্তরিকভাবে দেশে দেশে গণতন্ত্র ও মানবাধিকার প্রতিষ্ঠার কথা ভাবত, তাহলে তারা ফিলিস্তিনের পক্ষে 
থাকত, ইসরায়েলের পক্ষে নয়।

গণতন্ত্র ও মানবাধিকার রক্ষার নামে আমেরিকা ইন্দো-প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলে চীনের আধিপত্য খর্ব করতে চায়। আকাশ, স্থল ও সমুদ্রপথে চীনের প্রবেশ নিয়ন্ত্রণ ও বাধা প্রদান করা তাদের পরিকল্পনার অংশ। চীন-মিয়ানমার অর্থনৈতিক করিডর, চীন-পাকিস্তান অর্থনৈতিক করিডর, মার্কিনিরা উভয় করিডরই বন্ধ করতে চায়। এ জন্য তারা সামরিক চুক্তির জন্য বাংলাদেশকে চাপ দিচ্ছে বলে 
শোনা যায়। এটি বাংলাদেশের জন্য অত্যন্ত স্পর্শকাতর, গুরুত্বপূর্ণ, জাতীয় স্বার্থ ও নিরাপত্তারও বিষয়। বিএনপি কি মার্কিনিদের এসব অভিসন্ধির সহযোগী হতে চায়? এগুলো তাদের পরিষ্কার করতে হবে।

বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর হঁশিয়ারি দিয়ে বলেছেন, প্রধানমন্ত্রী চাইলেও এবার ভোটারবিহীন নির্বাচন করতে পারবেন না। তিনি বলেছেন, ‘শেখ হাসিনা যদি ভেবে থাকেন বিনা ভোটে তিনি নির্বাচিত হবেন, সেটা এবার হবে না। ২০১৪ সালে যা করতে পেরেছেন, ২০১৮ সালে যেটা করতে পেরেছেন, এবার ২০২৩ সালে সেই নির্বাচন আপনি করতে পারবেন না। কারণ এবার মানুষ যেভাবে ঘুরে দাঁড়িয়েছে, তাতে করে সেটা সম্ভব হবে না।’

আগামী নির্বাচন যে ২০১৪ কিংবা ২০১৮ সালের মতো হবে না, সেটা শেখ হাসিনাও একাধিকবার বলেছেন। প্রশ্ন হলো, বিএনপি কেন নির্বাচনটাকে চ্যালেঞ্জ হিসেবে গ্রহণ করার সাহস দেখাচ্ছে না? ‘এবার মানুষ ঘুরে দাঁড়িয়েছে’—জানার পরও কেন বিএনপি নির্দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচন অনুষ্ঠানের গোঁ ধরে আছে?

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

চীন সফরে সেভেন সিস্টার্স নিয়ে ড. ইউনূসের বক্তব্যে ভারতে তোলপাড়

বাংলাদেশের ১৮ বছরের সেই অপেক্ষা তবে ফুরোচ্ছে

খাবারে চেতনানাশক মিশিয়ে সিঁধ কেটে চুরির সময় গৃহবধূকে ধর্ষণের অভিযোগ

জুলাই আন্দোলনের নারীদের সম্মাননা নিয়ে প্রশ্নে যা বলল মার্কিন পররাষ্ট্র দপ্তর

চোর সন্দেহে যুবককে পিটুনি, প্রতিবাদ করায় দুই ভাইকে পিটিয়ে হত্যা

এলাকার খবর
খুঁজুন

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত