জাহীদ রেজা নূর
আজ ১৫ জুন। চীনের প্রেসিডেন্ট সি চিন পিংয়ের বয়স হলো ৭০। শুধু এই কারণে তাঁকে নিয়ে একটা প্রবন্ধ লিখে ফেলব, তা নয়। কিন্তু বিশ্বরাজনীতি নিয়ে কথা বলতে হলে তাঁকে এড়িয়ে যাওয়ারও কোনো পথ নেই। বর্তমান দুনিয়ায় সি চিন পিং যে একজন গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব, সে ব্যাপারে কারও মনে কোনো প্রশ্ন থাকতে পারে না। বিংশ শতাব্দীর রাজনীতি যুক্তরাষ্ট্র ও সোভিয়েত ইউনিয়নকে পেয়েছিল সর্বাত্মক প্রতিদ্বন্দ্বীরূপে। একবিংশ শতাব্দীতে এসে পৃথিবী দেখছে চীনের সর্বৈব উত্থান। বিশ্ব মোড়লির যুদ্ধে সোভিয়েত ইউনিয়ন এখন অতীতের ছায়ামাত্র, মার্কিনি প্রভাবও অচিরেই ক্ষয়িষ্ণু হবে বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা, সেই শূন্যস্থান পূরণ করবে চীন—এমনটাই ভাবা হচ্ছে আজকাল।
ভাবার কোনো কারণ নেই, বিশ্ব মোড়লিপনা করার ইচ্ছে নিয়ে যারা রাজনীতি করে, তারা বিশ্বের মানুষের কাছে মানবতার ত্রাতা হিসেবে আবির্ভূত হয়; বরং বাজার অর্থনীতির বাস্তবতায় ‘যাহা পুঁজিবাদ, তাহাই সমাজতন্ত্র’—এই মূলমন্ত্রে দীক্ষিত হয়েই এগিয়ে চলে রাজনীতির পথ। পণ্য এবং মুনাফাই সবচেয়ে জরুরি বিষয় এই মোড়লিপনায়। রাশিয়া আর ইউক্রেনের মধ্যে যে যুদ্ধ চলছে, তাতে চীনকে রাশিয়া পাশে পেয়েছে বটে, কিন্তু চীন নিজের স্বার্থ ছাড়া রাশিয়ার দিকে বন্ধুত্বের হাত প্রসারিত করেছে, এমনটা ভাবা ঠিক হবে না। সবকিছুর মধ্যেই রয়েছে রাজনীতি।
স্বল্প পরিসরে আমরা চীনের এই উত্থান সম্পর্কে কিছুটা আলোচনা করার চেষ্টা করব। অনেকের মনে পড়ে যাবে, ২০০৯ সালে মার্কিন প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা এসেছিলেন চীনে। একবিংশ শতাব্দীর শুরু থেকেই যুক্তরাষ্ট্র টের পাচ্ছিল, চীন অর্থনৈতিক বলয়ে ভয়ংকর শক্তি নিয়ে হাজির হতে যাচ্ছে। তখনই বারাক ওবামা চীনের প্রেসিডেন্টের কাছে প্রস্তাব রেখেছিলেন জি-২ করবেন বলে। জি-৭-এর জায়গায় জি-২; অর্থাৎ বিশ্ব মোড়লির ক্ষেত্রে যুক্তরাষ্ট্র আর চীন হবে দুজনে দুজনার। পুরো পৃথিবী শাসন করবে এই দুই দেশ। তবে ওবামা ছোট্ট একটা শর্ত দিয়েছিলেন। শর্তটা হলো, এই সম্পর্কে যুক্তরাষ্ট্র হবে বড় ভাই, চীন হবে ছোট ভাই। স্বভাবতই চীন ছোট ভাই হওয়ার প্রস্তাবে সাড়া দেয়নি। কেন সাড়া দেবে? মাও সে-তুংয়ের মৃত্যুর পর প্রাথমিক অরাজকতা কাটিয়ে ওঠার পর থেকে পরিকল্পিতভাবেই তো এগোচ্ছে চীন। তাদের স্বপ্ন, একাই চালাবে পৃথিবী। বনের রাজা তো দুজন হয় না, একজনই হয়। তাই ছোট ভাই-বড় ভাই ফর্মুলাকে পাত্তাই দেয়নি তারা।
একটু অতীত ভ্রমণে আমরা দেখতে পাব, চীনের অর্থনৈতিক পুনরুজ্জীবনের শুরু হয়েছিল ১৯৭৮ সাল থেকে। এর দুই বছর আগে মাও মারা যান। সে সময় চীনের সর্বেসর্বা হয়ে উঠেছিলেন দেং জিয়াও পিং। তাঁর দলে ছিলেন একজন টাকাওয়ালা মানুষ, চ্যাং ইউন ছিল তাঁর নাম। তিনি বলেছিলেন, ‘পাখিটাকে রাখতে হবে সোনার খাঁচায়’। এর মানে সহজ। পাখি হচ্ছে বাজার অর্থনীতি। সোনার খাঁচা হচ্ছে চীনের কমিউনিস্ট পার্টি। এই ফর্মুলাই চীনে এনে দিয়েছিল সাফল্য। সংস্কার চলল পুরোদমে, তবে দুর্নীতিকে ভয় দেখানো হলো দারুণভাবে। দুর্নীতিবাজে ছেয়ে যাওয়া প্রশাসনকে ধীরে ধীরে আয়ত্তে আনার চেষ্টা চলল।
সবচেয়ে মজার ব্যাপার হলো, এই যে সংস্কার শুরু হলো চীনে, তা কিন্তু সোভিয়েত ইউনিয়নে যে নয়া অর্থনৈতিক ব্যবস্থার জন্ম হয়েছিল, তারই পথ অনুসরণ করে করা হলো। ১৯২৬ সালে দেং জিয়াও পিং পড়াশোনার জন্য ছিলেন মস্কোয়। তিনি নয়া অর্থনৈতিক ব্যবস্থার সেই প্রবল সম্ভাবনাময় সময়টিতেই ছিলেন সোভিয়েত ইউনিয়নে। শুনেছেন রুশ কমিউনিস্ট পার্টির অন্যতম শ্রেষ্ঠ সন্তান নিকোলাই বুখারিনের বক্তৃতা। ৫০ বছর পর চীনে এল সেই মডেল। ব্যাংক, ভারী শিল্প, বিদ্যুৎ, রেলব্যবস্থা—এই সবকিছুই এল রাষ্ট্রের হাতে। তবে তার পাশাপাশি চলল ব্যক্তি উদ্যোগের বিকাশ। তবে তা ঘটল কমিউনিস্ট পার্টির নিয়ন্ত্রিত পথে।
আর যেহেতু সোভিয়েত ইউনিয়ন তখন আর চীনের বন্ধু নয়, তাই পশ্চিমা জগৎ চীনের দিকে বাড়িয়ে দিল সাহায্যের হাত।
চীন তো সোভিয়েত ইউনিয়নের কাছ থেকেও সাহায্য চেয়েছিল। কিন্তু সোভিয়েতরা উদাসীন থেকেছে। সে সময় দুই সমাজতান্ত্রিক দেশ আদর্শগত সংঘাতের পথে না গিয়ে একসঙ্গে এগিয়ে চললে আজকের দুনিয়ার সমীকরণগুলো পাল্টে যেত হয়তোবা। ১৯৭৯ সালে দেং জিয়াও পিং গিয়েছিলেন ওয়াশিংটনে। দেখা করেছিলেন তখনকার মার্কিন প্রেসিডেন্ট জিমি কার্টারের সঙ্গে এবং কার্টারকে প্রস্তাব দিয়েছিলেন ‘আন্তর্জাতিক আধিপত্যবাদবিরোধী ফ্রন্ট’ গঠন করার জন্য। ‘আধিপত্যবাদী’ বলতে বোঝানো হয়েছিল সোভিয়েত ইউনিয়নকে। প্রস্তাবটি যে শুধু কথার কথা নয়, তা বোঝাতে দেশে ফিরেই কয়েক সপ্তাহ বাদে তিনি সোভিয়েতদের বন্ধু কমিউনিস্ট ভিয়েতনামে হামলা চালিয়েছিলেন। এই ঘটনার পর চীনের জন্য পশ্চিমা সাহায্য আর থেমে থাকেনি। প্রায় ৩০ বছর চীন সেই সহযোগিতা পেয়ে এসেছে। আরেক
টি জরুরি কথা। চীনের সংস্কার মূলত এগিয়েছে সমুদ্রতীরবর্তী শহরগুলোর হাত ধরে। সাংহাই, ক্যান্টন, সেনজেন, সিয়ামেনে ইত্যাদি শহর বদলেছে সবার আগে। এসব শহরে জার্মানি, যুক্তরাষ্ট্র, জাপান, তাইওয়ান এসে শিল্পকারখানা গড়েছে। সেখানে ঢুকেছে নতুন পুঁজি, এসেছে কারিগরি সফলতা। নতুন শিল্পকারখানা তখন গড়ে তুলছে চীনের মেরুদণ্ড। তাইওয়ান থেকে ধনকুবেররা ছুটে এসেছেন চীনে, লগ্নি করেছেন তাঁদের অর্থ। একসময় দেখা গেল একের পর এক গড়ে উঠছে কারখানা, দোকান-পাট, ব্যাংক। এরপর কুয়োর প্রাচীন যুগ থেকে যখন আধুনিক জল সরবরাহ নেটওয়ার্কে উত্তীর্ণ হলো চীন, তখন তো বড় বড় মার্কিন ও ইউরোপীয় প্রতিষ্ঠান অবিশ্বাস্য পরিমাণ অর্থ নিয়ে হাজির হলো চীনের বাজারে। ১৯৮৪ সালেই ফক্স ওয়াগনের কারখানা তৈরি হয়ে গেল। তখন বিশ্বমানে পৌঁছে গেছে চীনের প্রবৃদ্ধির হার। ঠেকল ১০ শতাংশে।
সে সময় থেকেই চীন বুঝতে শুরু করেছে, ‘যৌতুকের বিয়ে’ বেশি দিন টিকবে না; অর্থাৎ পশ্চিমা বিশ্ব আজীবন চীনকে আগলে রাখবে না। আর সে কথা ভেবেই নিজস্ব অর্থনৈতিক ব্যবস্থা তৈরি করে নিয়েছে তারা। রপ্তানি থেকে যে অতিরিক্ত মুনাফা অর্জিত হয়েছে, তা শুধু মার্কিন ফেডারেল রিজার্ভ সিস্টেমেই রাখেনি, নিজ দেশে উচ্চগতির রেলপথ তৈরি, যানবাহন তৈরি, রেলওয়ে স্টেশন, হাসপাতাল নির্মাণের জন্য বিনিয়োগ করতে শুরু করেছে। এ রকম একটা সময়েই মার্কিনিদের টনক নড়েছিল এবং আগেই উল্লেখ করেছি, বারাক ওবামা চীনে গিয়েছিলেন তাদের ছোট ভাই হিসেবে গ্রহণ করার জন্য। চীন রাজি না হওয়ায় এত দিনের আদর-সোহাগ ফিরিয়ে নেয় যুক্তরাষ্ট্র। কঠোর হয় চীনের ব্যাপারে। সারা বিশ্ব থেকে দৃষ্টি সরিয়ে চীনের দিকে সশস্ত্র বাহিনীকে কেন্দ্রীভূত করে। আর চীনের বিরুদ্ধে অর্থনৈতিক ব্লক তৈরি করে প্রশান্ত মহাসাগরীয় বাণিজ্য অংশীদারত্বের মাধ্যমে। চীন আগেভাগেই এই চাল বুঝতে পেরেছিল। তারা এবার সি চিন পিংয়ের নেতৃত্বে তাদের প্ল্যান বি নিয়ে এগিয়ে যেতে শুরু করে।
তাতে কী ফল হয়? সি চিন পিং দারিদ্র্য দূরীকরণের যুদ্ধে জয়ী হন, রাষ্ট্রে মধ্যবিত্ত শ্রেণি বিকশিত হয়, বহিঃবাণিজ্যে পশ্চিমা বিশ্বকে চীন নিজের পণ্য দিয়ে জয় করে ফেলে।
আপাতত এটুকুতেই থামতে হবে। ২০১২ সালে প্রেসিডেন্ট সি ২০৪৯ সালের মধ্যে, অর্থাৎ চীনে কমিউনিস্ট ক্ষমতার এক শ বছরে কী কী স্বপ্নের বাস্তবায়ন করবেন, তা ঠিক করেছিলেন। সে পথ ধরেই এগোচ্ছে চীন।
কোনোভাবেই আমাদের দেশের সঙ্গে চীনের তুলনা হয় না। কিন্তু কোনো কোনো ব্যাপারে চীনের প্রসঙ্গ আনতে হয়। যেমন দুর্নীতি দমন। চীনের চার কুচক্রীসহ আরও কত দুর্নীতিবাজের গল্প আমরা শুনেছি। এখন যা বোঝার ব্যাপার তা হলো, শুধু স্লোগানে দুর্নীতি দূর হয় না, স্বপ্ন বাস্তবায়ন হয় না। এ জন্য বাস্তবে কাজ করে দেখাতে হয়। কী করে চীন পরিকল্পিত অর্থনীতি এবং ব্যক্তিমালিকানাধীন বাজার অর্থনীতির শিং একই সঙ্গে ধরে রেখেছে, তা থেকে শিক্ষা নেওয়া প্রয়োজন।
একসময় শোনা যেত, দুর্নীতিবাজদের ধরে স্টেডিয়ামে নিয়ে গিয়ে গুলি করে মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা হয়েছে। এখন সে রকম কথা শোনা যায় না। এখন শুধু খুনের আসামি, ধর্ষক বা দেশদ্রোহীদের এভাবে মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা হয়। একসময় চীনে কাজ করতে বলা হয়েছে এবং বলা হয়েছে, ‘বড়লোক হও।’ শুধু ব্যাংকার আর শিল্পপতিদের উদ্দেশে এ কথা বলা হয়নি, বলা হয়েছে পার্টিসদস্য, সেনা কর্মকর্তাদের জন্যও এবং এই বড়লোক হওয়ার দৌড়ের ব্যাপারে রাষ্ট্র থেকেছে চোখ বন্ধ করে। সেই দুর্নীতি সমাজে বড় বড় সমস্যার সৃষ্টি করেছিল। সরকারি আমলারাও দুর্নীতিকে নিজেদের ধ্যান-জ্ঞানে পরিণত করে নিয়েছিলেন। তাতে ব্যবসার হচ্ছিল ক্ষতি। স্বাভাবিকভাবে কিছু হচ্ছিল না। ‘ফেলো কড়ি, মাখো তেল’ হয়ে পড়ছিল ব্যবসার নিয়ামক শক্তি। এরপর কঠোর হাতে সেই দুর্নীতিবাজদের বিচার শুরু করা হয়েছিল।
সি ক্ষমতায় আসার পর বলেছিলেন, ‘হয় পার্টি দুর্নীতি দূর করবে, অথবা দুর্নীতি পার্টিকে দূর করবে’। এটাই ছিল তাঁর চ্যালেঞ্জ। এরপরই তিনি দুর্নীতির বিরুদ্ধে সত্যিকারের জিহাদ ঘোষণা করেছিলেন। আমাদের দেশে পরতে পরতে দুর্নীতির যে বীজ রয়েছে, তা দূর করার মতো শক্তি কোনো পার্টির আছে বলে মনে হয় না। রাজনীতি ধীরে ধীরে চলে গেছে পুঁজিপতিদের অধিকারে। কোনো না কোনো দল সরকার চালায়, সেটা ঠিক, কিন্তু সরকারকে চালায় কে—এ রকম একটা প্রশ্নও তো ঘুরে বেড়ায় বাতাসে। উত্তর খুব একটা অজানা নয়, কিন্তু তা নিয়ে কি কারও মাথাব্যথা আছে?
লেখক: উপসম্পাদক, আজকের পত্রিকা
আজ ১৫ জুন। চীনের প্রেসিডেন্ট সি চিন পিংয়ের বয়স হলো ৭০। শুধু এই কারণে তাঁকে নিয়ে একটা প্রবন্ধ লিখে ফেলব, তা নয়। কিন্তু বিশ্বরাজনীতি নিয়ে কথা বলতে হলে তাঁকে এড়িয়ে যাওয়ারও কোনো পথ নেই। বর্তমান দুনিয়ায় সি চিন পিং যে একজন গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব, সে ব্যাপারে কারও মনে কোনো প্রশ্ন থাকতে পারে না। বিংশ শতাব্দীর রাজনীতি যুক্তরাষ্ট্র ও সোভিয়েত ইউনিয়নকে পেয়েছিল সর্বাত্মক প্রতিদ্বন্দ্বীরূপে। একবিংশ শতাব্দীতে এসে পৃথিবী দেখছে চীনের সর্বৈব উত্থান। বিশ্ব মোড়লির যুদ্ধে সোভিয়েত ইউনিয়ন এখন অতীতের ছায়ামাত্র, মার্কিনি প্রভাবও অচিরেই ক্ষয়িষ্ণু হবে বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা, সেই শূন্যস্থান পূরণ করবে চীন—এমনটাই ভাবা হচ্ছে আজকাল।
ভাবার কোনো কারণ নেই, বিশ্ব মোড়লিপনা করার ইচ্ছে নিয়ে যারা রাজনীতি করে, তারা বিশ্বের মানুষের কাছে মানবতার ত্রাতা হিসেবে আবির্ভূত হয়; বরং বাজার অর্থনীতির বাস্তবতায় ‘যাহা পুঁজিবাদ, তাহাই সমাজতন্ত্র’—এই মূলমন্ত্রে দীক্ষিত হয়েই এগিয়ে চলে রাজনীতির পথ। পণ্য এবং মুনাফাই সবচেয়ে জরুরি বিষয় এই মোড়লিপনায়। রাশিয়া আর ইউক্রেনের মধ্যে যে যুদ্ধ চলছে, তাতে চীনকে রাশিয়া পাশে পেয়েছে বটে, কিন্তু চীন নিজের স্বার্থ ছাড়া রাশিয়ার দিকে বন্ধুত্বের হাত প্রসারিত করেছে, এমনটা ভাবা ঠিক হবে না। সবকিছুর মধ্যেই রয়েছে রাজনীতি।
স্বল্প পরিসরে আমরা চীনের এই উত্থান সম্পর্কে কিছুটা আলোচনা করার চেষ্টা করব। অনেকের মনে পড়ে যাবে, ২০০৯ সালে মার্কিন প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা এসেছিলেন চীনে। একবিংশ শতাব্দীর শুরু থেকেই যুক্তরাষ্ট্র টের পাচ্ছিল, চীন অর্থনৈতিক বলয়ে ভয়ংকর শক্তি নিয়ে হাজির হতে যাচ্ছে। তখনই বারাক ওবামা চীনের প্রেসিডেন্টের কাছে প্রস্তাব রেখেছিলেন জি-২ করবেন বলে। জি-৭-এর জায়গায় জি-২; অর্থাৎ বিশ্ব মোড়লির ক্ষেত্রে যুক্তরাষ্ট্র আর চীন হবে দুজনে দুজনার। পুরো পৃথিবী শাসন করবে এই দুই দেশ। তবে ওবামা ছোট্ট একটা শর্ত দিয়েছিলেন। শর্তটা হলো, এই সম্পর্কে যুক্তরাষ্ট্র হবে বড় ভাই, চীন হবে ছোট ভাই। স্বভাবতই চীন ছোট ভাই হওয়ার প্রস্তাবে সাড়া দেয়নি। কেন সাড়া দেবে? মাও সে-তুংয়ের মৃত্যুর পর প্রাথমিক অরাজকতা কাটিয়ে ওঠার পর থেকে পরিকল্পিতভাবেই তো এগোচ্ছে চীন। তাদের স্বপ্ন, একাই চালাবে পৃথিবী। বনের রাজা তো দুজন হয় না, একজনই হয়। তাই ছোট ভাই-বড় ভাই ফর্মুলাকে পাত্তাই দেয়নি তারা।
একটু অতীত ভ্রমণে আমরা দেখতে পাব, চীনের অর্থনৈতিক পুনরুজ্জীবনের শুরু হয়েছিল ১৯৭৮ সাল থেকে। এর দুই বছর আগে মাও মারা যান। সে সময় চীনের সর্বেসর্বা হয়ে উঠেছিলেন দেং জিয়াও পিং। তাঁর দলে ছিলেন একজন টাকাওয়ালা মানুষ, চ্যাং ইউন ছিল তাঁর নাম। তিনি বলেছিলেন, ‘পাখিটাকে রাখতে হবে সোনার খাঁচায়’। এর মানে সহজ। পাখি হচ্ছে বাজার অর্থনীতি। সোনার খাঁচা হচ্ছে চীনের কমিউনিস্ট পার্টি। এই ফর্মুলাই চীনে এনে দিয়েছিল সাফল্য। সংস্কার চলল পুরোদমে, তবে দুর্নীতিকে ভয় দেখানো হলো দারুণভাবে। দুর্নীতিবাজে ছেয়ে যাওয়া প্রশাসনকে ধীরে ধীরে আয়ত্তে আনার চেষ্টা চলল।
সবচেয়ে মজার ব্যাপার হলো, এই যে সংস্কার শুরু হলো চীনে, তা কিন্তু সোভিয়েত ইউনিয়নে যে নয়া অর্থনৈতিক ব্যবস্থার জন্ম হয়েছিল, তারই পথ অনুসরণ করে করা হলো। ১৯২৬ সালে দেং জিয়াও পিং পড়াশোনার জন্য ছিলেন মস্কোয়। তিনি নয়া অর্থনৈতিক ব্যবস্থার সেই প্রবল সম্ভাবনাময় সময়টিতেই ছিলেন সোভিয়েত ইউনিয়নে। শুনেছেন রুশ কমিউনিস্ট পার্টির অন্যতম শ্রেষ্ঠ সন্তান নিকোলাই বুখারিনের বক্তৃতা। ৫০ বছর পর চীনে এল সেই মডেল। ব্যাংক, ভারী শিল্প, বিদ্যুৎ, রেলব্যবস্থা—এই সবকিছুই এল রাষ্ট্রের হাতে। তবে তার পাশাপাশি চলল ব্যক্তি উদ্যোগের বিকাশ। তবে তা ঘটল কমিউনিস্ট পার্টির নিয়ন্ত্রিত পথে।
আর যেহেতু সোভিয়েত ইউনিয়ন তখন আর চীনের বন্ধু নয়, তাই পশ্চিমা জগৎ চীনের দিকে বাড়িয়ে দিল সাহায্যের হাত।
চীন তো সোভিয়েত ইউনিয়নের কাছ থেকেও সাহায্য চেয়েছিল। কিন্তু সোভিয়েতরা উদাসীন থেকেছে। সে সময় দুই সমাজতান্ত্রিক দেশ আদর্শগত সংঘাতের পথে না গিয়ে একসঙ্গে এগিয়ে চললে আজকের দুনিয়ার সমীকরণগুলো পাল্টে যেত হয়তোবা। ১৯৭৯ সালে দেং জিয়াও পিং গিয়েছিলেন ওয়াশিংটনে। দেখা করেছিলেন তখনকার মার্কিন প্রেসিডেন্ট জিমি কার্টারের সঙ্গে এবং কার্টারকে প্রস্তাব দিয়েছিলেন ‘আন্তর্জাতিক আধিপত্যবাদবিরোধী ফ্রন্ট’ গঠন করার জন্য। ‘আধিপত্যবাদী’ বলতে বোঝানো হয়েছিল সোভিয়েত ইউনিয়নকে। প্রস্তাবটি যে শুধু কথার কথা নয়, তা বোঝাতে দেশে ফিরেই কয়েক সপ্তাহ বাদে তিনি সোভিয়েতদের বন্ধু কমিউনিস্ট ভিয়েতনামে হামলা চালিয়েছিলেন। এই ঘটনার পর চীনের জন্য পশ্চিমা সাহায্য আর থেমে থাকেনি। প্রায় ৩০ বছর চীন সেই সহযোগিতা পেয়ে এসেছে। আরেক
টি জরুরি কথা। চীনের সংস্কার মূলত এগিয়েছে সমুদ্রতীরবর্তী শহরগুলোর হাত ধরে। সাংহাই, ক্যান্টন, সেনজেন, সিয়ামেনে ইত্যাদি শহর বদলেছে সবার আগে। এসব শহরে জার্মানি, যুক্তরাষ্ট্র, জাপান, তাইওয়ান এসে শিল্পকারখানা গড়েছে। সেখানে ঢুকেছে নতুন পুঁজি, এসেছে কারিগরি সফলতা। নতুন শিল্পকারখানা তখন গড়ে তুলছে চীনের মেরুদণ্ড। তাইওয়ান থেকে ধনকুবেররা ছুটে এসেছেন চীনে, লগ্নি করেছেন তাঁদের অর্থ। একসময় দেখা গেল একের পর এক গড়ে উঠছে কারখানা, দোকান-পাট, ব্যাংক। এরপর কুয়োর প্রাচীন যুগ থেকে যখন আধুনিক জল সরবরাহ নেটওয়ার্কে উত্তীর্ণ হলো চীন, তখন তো বড় বড় মার্কিন ও ইউরোপীয় প্রতিষ্ঠান অবিশ্বাস্য পরিমাণ অর্থ নিয়ে হাজির হলো চীনের বাজারে। ১৯৮৪ সালেই ফক্স ওয়াগনের কারখানা তৈরি হয়ে গেল। তখন বিশ্বমানে পৌঁছে গেছে চীনের প্রবৃদ্ধির হার। ঠেকল ১০ শতাংশে।
সে সময় থেকেই চীন বুঝতে শুরু করেছে, ‘যৌতুকের বিয়ে’ বেশি দিন টিকবে না; অর্থাৎ পশ্চিমা বিশ্ব আজীবন চীনকে আগলে রাখবে না। আর সে কথা ভেবেই নিজস্ব অর্থনৈতিক ব্যবস্থা তৈরি করে নিয়েছে তারা। রপ্তানি থেকে যে অতিরিক্ত মুনাফা অর্জিত হয়েছে, তা শুধু মার্কিন ফেডারেল রিজার্ভ সিস্টেমেই রাখেনি, নিজ দেশে উচ্চগতির রেলপথ তৈরি, যানবাহন তৈরি, রেলওয়ে স্টেশন, হাসপাতাল নির্মাণের জন্য বিনিয়োগ করতে শুরু করেছে। এ রকম একটা সময়েই মার্কিনিদের টনক নড়েছিল এবং আগেই উল্লেখ করেছি, বারাক ওবামা চীনে গিয়েছিলেন তাদের ছোট ভাই হিসেবে গ্রহণ করার জন্য। চীন রাজি না হওয়ায় এত দিনের আদর-সোহাগ ফিরিয়ে নেয় যুক্তরাষ্ট্র। কঠোর হয় চীনের ব্যাপারে। সারা বিশ্ব থেকে দৃষ্টি সরিয়ে চীনের দিকে সশস্ত্র বাহিনীকে কেন্দ্রীভূত করে। আর চীনের বিরুদ্ধে অর্থনৈতিক ব্লক তৈরি করে প্রশান্ত মহাসাগরীয় বাণিজ্য অংশীদারত্বের মাধ্যমে। চীন আগেভাগেই এই চাল বুঝতে পেরেছিল। তারা এবার সি চিন পিংয়ের নেতৃত্বে তাদের প্ল্যান বি নিয়ে এগিয়ে যেতে শুরু করে।
তাতে কী ফল হয়? সি চিন পিং দারিদ্র্য দূরীকরণের যুদ্ধে জয়ী হন, রাষ্ট্রে মধ্যবিত্ত শ্রেণি বিকশিত হয়, বহিঃবাণিজ্যে পশ্চিমা বিশ্বকে চীন নিজের পণ্য দিয়ে জয় করে ফেলে।
আপাতত এটুকুতেই থামতে হবে। ২০১২ সালে প্রেসিডেন্ট সি ২০৪৯ সালের মধ্যে, অর্থাৎ চীনে কমিউনিস্ট ক্ষমতার এক শ বছরে কী কী স্বপ্নের বাস্তবায়ন করবেন, তা ঠিক করেছিলেন। সে পথ ধরেই এগোচ্ছে চীন।
কোনোভাবেই আমাদের দেশের সঙ্গে চীনের তুলনা হয় না। কিন্তু কোনো কোনো ব্যাপারে চীনের প্রসঙ্গ আনতে হয়। যেমন দুর্নীতি দমন। চীনের চার কুচক্রীসহ আরও কত দুর্নীতিবাজের গল্প আমরা শুনেছি। এখন যা বোঝার ব্যাপার তা হলো, শুধু স্লোগানে দুর্নীতি দূর হয় না, স্বপ্ন বাস্তবায়ন হয় না। এ জন্য বাস্তবে কাজ করে দেখাতে হয়। কী করে চীন পরিকল্পিত অর্থনীতি এবং ব্যক্তিমালিকানাধীন বাজার অর্থনীতির শিং একই সঙ্গে ধরে রেখেছে, তা থেকে শিক্ষা নেওয়া প্রয়োজন।
একসময় শোনা যেত, দুর্নীতিবাজদের ধরে স্টেডিয়ামে নিয়ে গিয়ে গুলি করে মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা হয়েছে। এখন সে রকম কথা শোনা যায় না। এখন শুধু খুনের আসামি, ধর্ষক বা দেশদ্রোহীদের এভাবে মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা হয়। একসময় চীনে কাজ করতে বলা হয়েছে এবং বলা হয়েছে, ‘বড়লোক হও।’ শুধু ব্যাংকার আর শিল্পপতিদের উদ্দেশে এ কথা বলা হয়নি, বলা হয়েছে পার্টিসদস্য, সেনা কর্মকর্তাদের জন্যও এবং এই বড়লোক হওয়ার দৌড়ের ব্যাপারে রাষ্ট্র থেকেছে চোখ বন্ধ করে। সেই দুর্নীতি সমাজে বড় বড় সমস্যার সৃষ্টি করেছিল। সরকারি আমলারাও দুর্নীতিকে নিজেদের ধ্যান-জ্ঞানে পরিণত করে নিয়েছিলেন। তাতে ব্যবসার হচ্ছিল ক্ষতি। স্বাভাবিকভাবে কিছু হচ্ছিল না। ‘ফেলো কড়ি, মাখো তেল’ হয়ে পড়ছিল ব্যবসার নিয়ামক শক্তি। এরপর কঠোর হাতে সেই দুর্নীতিবাজদের বিচার শুরু করা হয়েছিল।
সি ক্ষমতায় আসার পর বলেছিলেন, ‘হয় পার্টি দুর্নীতি দূর করবে, অথবা দুর্নীতি পার্টিকে দূর করবে’। এটাই ছিল তাঁর চ্যালেঞ্জ। এরপরই তিনি দুর্নীতির বিরুদ্ধে সত্যিকারের জিহাদ ঘোষণা করেছিলেন। আমাদের দেশে পরতে পরতে দুর্নীতির যে বীজ রয়েছে, তা দূর করার মতো শক্তি কোনো পার্টির আছে বলে মনে হয় না। রাজনীতি ধীরে ধীরে চলে গেছে পুঁজিপতিদের অধিকারে। কোনো না কোনো দল সরকার চালায়, সেটা ঠিক, কিন্তু সরকারকে চালায় কে—এ রকম একটা প্রশ্নও তো ঘুরে বেড়ায় বাতাসে। উত্তর খুব একটা অজানা নয়, কিন্তু তা নিয়ে কি কারও মাথাব্যথা আছে?
লেখক: উপসম্পাদক, আজকের পত্রিকা
ঝড়-জলোচ্ছ্বাস থেকে রক্ষায় সন্দ্বীপের ব্লক বেড়িবাঁধসহ একাধিক প্রকল্প হাতে নিয়েছে সরকার। এ লক্ষ্যে বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে ৫৬২ কোটি টাকা। এ জন্য টেন্ডারও হয়েছে। প্রায় এক বছর পেরিয়ে গেলেও ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানগুলো কাজ শুরু করছে না। পানি উন্নয়ন বোর্ডের (পাউবো) তাগাদায়ও কোনো কাজ হচ্ছে না বলে জানিয়েছেন...
৩ দিন আগেদেশের পরিবহন খাতের অন্যতম নিয়ন্ত্রণকারী ঢাকা সড়ক পরিবহন মালিক সমিতির কমিটির বৈধতা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। সাইফুল আলমের নেতৃত্বাধীন এ কমিটিকে নিবন্ধন দেয়নি শ্রম অধিদপ্তর। তবে এটি কার্যক্রম চালাচ্ছে। কমিটির নেতারা অংশ নিচ্ছেন ঢাকা পরিবহন সমন্বয় কর্তৃপক্ষ (ডিটিসিএ) ও বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষের...
৩ দিন আগেআলুর দাম নিয়ন্ত্রণে ব্যর্থ হয়ে এবার নিজেই বিক্রির উদ্যোগ নিয়েছে সরকার। বাজার স্থিতিশীল রাখতে ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশের (টিসিবি) মাধ্যমে রাজধানীতে ভ্রাম্যমাণ ট্রাকের মাধ্যমে ভর্তুকি মূল্যে আলু বিক্রি করা হবে। একজন গ্রাহক ৪০ টাকা দরে সর্বোচ্চ তিন কেজি আলু কিনতে পারবেন...
৩ দিন আগেসপ্তাহখানেক আগে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকে অনেকের ওয়াল বিষাদময় হয়ে উঠেছিল ফুলের মতো ছোট্ট শিশু মুনতাহাকে হত্যার ঘটনায়। ৫ বছর বয়সী সিলেটের এই শিশুকে অপহরণের পর হত্যা করে লাশ গুম করতে ডোবায় ফেলে রাখা হয়েছিল। প্রতিবেশী গৃহশিক্ষকের পরিকল্পনায় অপহরণের পর তাকে নির্মমভাবে হত্যা করা হয়...
৩ দিন আগে