সেতুর পথে নেতাদের কাঁটা

তৌফিকুল ইসলাম, ঢাকা
প্রকাশ : ০৬ জুলাই ২০২২, ০৮: ২৪
আপডেট : ০৬ জুলাই ২০২২, ০৯: ৫৭

পেরিয়ে গেছে ১০ দিন। কথা ছিল, পদ্মা সেতু উদ্বোধনের পর ২১ জেলার সঙ্গে রাজধানীসহ দেশের অন্যান্য অঞ্চলের যাতায়াত সহজ হবে, পূরণ হবে দীর্ঘদিনের স্বপ্ন। কিন্তু সেই স্বপ্ন বাস্তব করার সামনে মূর্তিমান বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছেন খোদ ক্ষমতাসীন দলের নেতারাই। নিজেদের ব্যবসা টিকিয়ে রাখতে ঢুকতে দিচ্ছেন না অন্য কোম্পানির বাস। এমনকি ফিরিয়ে দেওয়া হচ্ছে সরকারি পরিবহন সংস্থা বাংলাদেশ রোড ট্রান্সপোর্ট করপোরেশনের (বিআরটিসি) বাসও।

বিআরটিসির মতিঝিল বাস ডিপোর মহাব্যবস্থাপক মো. মাসুদ তালুকদার বলছেন, ‘মাদারীপুরের শিবচর ও চান্দেরচরে বিআরটিসির বাস চালাতে দিচ্ছেন না ওখানকার পরিবহনমালিক ও স্থানীয় পৌরসভার মেয়র। আমাদের বাস গেলে চালককে বাসসহ ঢাকায় ঘুরিয়ে দিচ্ছে। বাধ্য হয়ে আমরা বাস বন্ধ করে দিয়েছি। এ বিষয়ে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়কে অবগত করেছি, কারা কারা আমাদের বাস চলতে বাধা দিচ্ছে। সাবেক মন্ত্রী শাজাহান খানের দুটি কোম্পানির গাড়ি এই রাস্তায় চলাচল করে। উনি চান না অন্য কোনো গাড়ি ঢুকুক।’

এ বিষয়ে বক্তব্য নেওয়ার জন্য সাবেক নৌপরিবহনমন্ত্রী ও সংসদ সদস্য শাজাহান খানের সঙ্গে বেশ কয়েকবার যোগাযোগ করা হলেও তাঁর কোনো মন্তব্য পাওয়া যায়নি। তাঁর ভাই হাফিজুর রহমান খান (যাচ্চু), যিনি মাদারীপুর চেম্বার অব কমার্সের সভাপতি, তাঁকেও কয়েকবার ফোনে চেষ্টা করে বক্তব্য পাওয়া যায়নি।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, খান পরিবারের পুরোনো ব্যবসার মধ্যে মাদারীপুর থেকে ঢাকায় চলাচল করা সার্বিক পরিবহন অন্যতম। যার দায়িত্বে আছেন হাফিজুর রহমান খান। আরেক ভাই মাদারীপুর সদর উপজেলা চেয়ারম্যান ওবায়দুর রহমান খান এবং চাচাতো ভাই ফারুক খানের প্রভাবে অন্য কোনো গাড়ি ঢুকতে পারছে না পদ্মা সেতু হয়ে।

পদ্মা সেতু উদ্বোধনের পর ঢাকা থেকে শরীয়তপুর, ফরিদপুর, মাদারীপুর জেলার বিভিন্ন উপজেলা পর্যন্ত বাস চলাচল শুরু হয়েছিল। কম সময়ে সরাসরি ঢাকায় আসবেন এসব জেলার মানুষ—সেই স্বপ্ন ভঙ্গ হতে লেগেছিল তিন দিন। নিজেদের ব্যবসা টেকাতে ওই সব জেলার স্থানীয় বাসমালিকদের বাধায় তা বন্ধ হয়ে গেছে।

ঢাকা থেকে যে পরিবহনগুলো এসব জায়গায় যেত, তাদের মালিকেরা সঙ্গে স্থানীয় বাসমালিকদের তথাকথিত বনিবনা না হওয়ায় বাস চলাচল বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে বলে জানান ভুক্তভোগীরা। পরিবহন খাতে এই অব্যবস্থাপনার কারণে পদ্মা সেতুর সুফল থেকে শুরুতেই বঞ্চিত হচ্ছে সাধারণ মানুষ।

বাস চলাচলে বাধা দেওয়ার বিষয়ে ইলিশ পরিবহনের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) আলী আকবর বলেন, ‘ঢাকা থেকে ফরিদপুর গেলে আমাদের গাড়ি ভাঙ্গায় আটকে দেওয়া হয়। আর যেতে দেওয়া হয় না। ভাঙ্গার স্থানীয় বাসমালিকেরা এই কাজ করেন।’ কেন বাধা দেন—জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘আমাদের গাড়ি ওদের চেয়ে অনেক ভালো, আমাদের রুট পারমিট আছে। ওদের গাড়ির কোনো রুট পারমিট নেই। ফলে তারা ভাঙ্গা থেকে ঢাকায় আসতে পারছে না গাড়ি নিয়ে, এ জন্য আমাদের গাড়িকে বাধা দিচ্ছে।’

পদ্মা সেতু হয়ে দক্ষিণাঞ্চলে কী কী রুট হবে, কোন মালিকের কয়টা গাড়ি চলবে, সেই হিসাবনিকাশের খাতায় লাল ফিতা বেঁধেছেন নেতারা। ফলে গাড়ি চলছে কম। স্বপ্নপূরণের আশায় থাকা ওই সব জেলার যাত্রীরা পড়েছেন ভোগান্তিতে।

জানা গেছে, পদ্মা সেতু চালুর আগে ঢাকা থেকে ইলিশ, স্বাধীন, প্রচেষ্টা, বসুমতিসহ আরও কিছু বাস মাওয়া পর্যন্ত চলাচল করত। সেতু হওয়ার পরে কিছু গাড়ি পদ্মা সেতু হয়ে দূরপাল্লায় যাচ্ছে। আবার কিছু গাড়ি স্বল্প দূরত্বে অর্থাৎ ভাঙ্গা ও শিবচর পর্যন্ত চলাচল করছিল। স্থানীয় পরিবহনমালিকদের দাবি, ঢাকা থেকে এত উপজেলায় বাস ঢুকতে পারবে না। বাস দূরপাল্লায় চলাচল করুক। উপজেলার গাড়ি ঢুকলে স্থানীয় পরিবহন ব্যবসায়ীরা ক্ষতিগ্রস্ত হবেন। সুতরাং এখন স্থানীয় বাসমালিকদের সঙ্গে দ্বন্দ্ব চলছে ঢাকার বাসমালিকদের।

কারা বাধা দিচ্ছেন চলাচলে? খোঁজ নিয়ে দেখা গেছে, শিবচরের পুরোনো জেলখানা এলাকায় কর্মী-সমর্থকদের নিয়ে বিআরটিসিসহ অন্য বাস আটকে দিচ্ছেন উপজেলা যুবলীগের সভাপতি ইলিয়াস শাহ। স্থানীয়ভাবে তিনি জাতীয় সংসদের চিফ হুইপ নূর-ই-আলম চৌধুরীর আশীর্বাদপুষ্ট বলে পরিচিত। এ বিষয়ে গতকাল মঙ্গলবার তাঁর সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে সব অভিযোগ অস্বীকার করেন তিনি। দাবি করেন, এ বিষয়ে তিনি কিছু জানেন না।

শিবচর বাসমালিক সমিতির সাধারণ সম্পাদক বাচ্চু খলিফা বলেন, ‘বাসমালিকদের ঝামেলার কারণে এখনো বিক্ষিপ্তভাবে গাড়ি চলছে। তবে সমস্যার সমাধান হলে সব জায়গা থেকেই গাড়ি ঢাকায় যাবে। ঢাকার বাসমালিকেরা পদ্মা সেতু চালু হওয়ার পরের দিনই ভাঙ্গা হয়ে আমাদের উপজেলায় গাড়ি নিয়ে এসেছে, আমাদের সঙ্গে কোনো আলোচনা না করে। আমাদেরও তো গাড়ি আছে। রুট পারমিট না পাওয়াই আমরা গাড়ি চালাতে পারছি না।’

এদিকে এসব রুটে বাস চলাচলে সমাধানের বিষয়ে গত রোববার ফরিদপুর-৪ আসনের সংসদ সদস্য মজিবুর রহমান চৌধুরী ওরফে নিক্সন চৌধুরীর সঙ্গে স্থানীয় বাস মালিক সমিতির আলোচনা হয়েছে। আজ বুধবার এ বিষয়ে ফরিদপুরে আরেকটি বৈঠক হওয়ার কথা রয়েছে।

দক্ষিণাঞ্চলে বাস চালাতে যাওয়া ঢাকার এক পরিবহনমালিক নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, ‘প্রতিটি জেলার পরিবহনমালিকদের ম্যানেজ না করলে গাড়ি চলতে নানা ধরনের বাধা দেওয়া হয়। কিন্তু সরকার যখন একটা বাসের লাইসেন্স দেয়, তখন কিন্তু সব সড়কে চালানোর অনুমতি থাকে।’ তাঁর প্রশ্ন, ‘তবে সড়কে চলতে গেলেই জেলার পরিবহন মালিক সমিতির নেতাদের সঙ্গে আলোচনা করে খুশি করতে হবে কেন? এটা না করলে তাঁরা বাধা দেন।’

ফরিদপুর জেলা বাসমালিক গ্রুপের সভাপতি খন্দকার আব্দুর রাশেদ বলেন, ‘বাস চালানোর দ্বন্দ্বের বিষয়টি সমাধান হতে চলছে। কোন মালিকের কটা গাড়ি চলবে, সেটি ঠিক করে দেওয়া হবে। সেই অনুযায়ী এসব রুটে গাড়ি চলবে। আমরা খোঁজ পেয়েছি, ঢাকার কিছু পরিবহন ব্যবসায়ী দক্ষিণাঞ্চলের বিভিন্ন লোকজন ধরে টাকাপয়সা দিয়ে আগেই গাড়ি নামিয়েছেন আমাদের (স্থানীয় পরিবহন ব্যবসায়ী) সঙ্গে কথা না বলে। সেই জন্যই এই সমস্যা তৈরি হয়েছে।’

পরিবহন ব্যবসার সঙ্গে জড়িতরা বলছেন, সারা দেশে নতুন বাস নামানোর ক্ষেত্রে বড় বাধা হচ্ছে পরিবহন মালিক সমিতির চাঁদাবাজি। বাস নামাতে গেলেই আগে সমিতির সদস্যপদ নিতে হয়। তা না হলে বাস চালাতে পারে না কেউ। সদস্য হতে গুনতে হয় চাঁদা। নতুন রুটে গাড়ি চালাতে গেলে বিআরটিএ থেকে নিতে হবে রুট পারমিট। রুট পারমিট থাকলেও বিভিন্ন জেলার পরিবহন মালিক সমিতির বাধায় সাধারণত বাসমালিকেরা বাস চালাতে পারেন না।

বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন মালিক সমিতির মহাসচিব খোন্দকার এনায়েত উল্যাহর দাবি, কোনো গাড়ি চলতে বাধা দেওয়া হয়নি দক্ষিণাঞ্চলে, সব গাড়িই চলেছে। রুট পারমিট নিয়ে যে কেউ বাস চালাতে পারবে। এখানে কারও বাধা দেওয়ার কিছু নেই। আর বিআরটিএ থেকে রুট পারমিট পেতেও কোনো ঝামেলা হচ্ছে না।

পরিবহন খাতের নৈরাজ্য দীর্ঘদিন চলছে বলে দাবি বাংলাদেশ যাত্রী কল্যাণ সমিতির মহাসচিব মোজাম্মেল হক চৌধুরীর। তিনি বলেন, সরকারের কোনো হস্তক্ষেপ নেই দেখেই এমন নৈরাজ্য চালিয়ে যাচ্ছেন তাঁরা। আমরাও খবর পেয়েছি, পদ্মা সেতু চালুর পরে শরীয়তপুর, গোপালগঞ্জ, বরিশালসহ বিভিন্ন জায়গায় পরিবহননেতারা বাস বন্ধ করে দিয়েছিলেন। এই সাহস কোথা থেকে পান তাঁরা?’

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
খুঁজুন

সম্পর্কিত