Ajker Patrika

শেখ হাসিনার নিয়ন্ত্রণেই রাজনীতি

আপডেট : ২৪ জানুয়ারি ২০২৪, ১১: ০৯
শেখ হাসিনার নিয়ন্ত্রণেই রাজনীতি

বিএনপির শীর্ষ নেতৃত্ব এখনো আন্দোলন ও সরকার পতন নিয়ে একধরনের কল্পনার জগতে আছেন বলে মনে হয়। কিছু ফেসবুক বিপ্লবীর অবাস্তব গল্পকথায় যে দেশে গণ-অভ্যুত্থান হবে না, এটা বিএনপি যত দিন উপলব্ধিতে না নেবে, তত দিন দলটি কোনো সঠিক পথের সন্ধান পাবে না।

দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন শেষ হয়েছে। নতুন মন্ত্রিসভা কাজ শুরু করেছে। নতুন সরকারকে বিভিন্ন দেশ ও আন্তর্জাতিক সংস্থার পক্ষ থেকে অভিনন্দন জানানো হচ্ছে। যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রদূত পিটার হাসও আগের অবস্থানে নেই। দৃশ্যত সবকিছু ঠিকঠাক আছে বলেই মনে হচ্ছে। কিন্তু সাদা চোখে যা দেখা যাচ্ছে, তার বাইরেও কিছু বিষয় আছে, যে বিষয়গুলো আগামী দিনগুলোতে সরকার, সংসদের বিরোধী দল ও রাজপথের বিরোধী দলকে অস্বস্তিতে ফেলবে।

৭ জানুয়ারির নির্বাচন কতটা সুষ্ঠু হয়েছে তা নিয়ে সরকারি দল ও সরকারের মিত্রদের বক্তব্য নির্বাচনবিরোধী পক্ষের মতকেই জোরালো করছে।

‘সূক্ষ্ম কারচুপি করে মাদারীপুর-৩ আসনে নৌকাকে হারানো হয়েছে’—এমন অভিযোগ করেছেন আবদুস সোবহান গোলাপ। তিনি আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় প্রচার সম্পাদক। গোলাপের অভিযোগ, ভোটকেন্দ্র থেকে নৌকার এজেন্ট বের করে দেওয়া হয়েছে। লিখিত অভিযোগ করেও সুরাহা পাননি। নৌকায় ভোট দেওয়ায় তিন শতাধিক বাড়িঘর ভাঙচুর করা হয়েছে, জ্বালিয়ে দেওয়া হয়েছে, লুটপাট করা হয়েছে। প্রায় ৩৫ থেকে ৪০টি গ্রামের অনেক লোককে মারধর করা হয়েছে। ৩০ থেকে ৪০ জন গুরুতর আহত হয়ে বিভিন্ন হাসপাতালে চিকিৎসাধীন।

কেন্দ্রীয় কৃষক লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক বিশ্বনাথ সরকার বিটু। ট্রাক প্রতীকে স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেছেন রংপুর-২ আসনে। এখানে জয়ী হয়েছেন নৌকার প্রার্থী আহসানুল হক চৌধুরী ডিউক। পরাজিত হওয়ার দিন থেকেই নানা অনিয়মের অভিযোগ করে আসছেন বিটু। বদরগঞ্জের একটি কর্মিসমাবেশে তিনি অভিযোগ করেন, নির্বাচনে তাঁকে জোর করে হারানো হয়েছে। প্রশাসন কথা রাখেনি। নির্বাচনের আগের দিবাগত রাত ৩টার দিকেই সিল মেরে ব্যালট বাক্স ভর্তি করা হয়। বিভিন্ন কেন্দ্র থেকে বের করে দেওয়া হয় তাঁর এজেন্টদের।

কুষ্টিয়া-২ আসনে নৌকা প্রতীকে ১৪ দলীয় জোটের প্রার্থী হিসেবে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেছেন জাসদের সভাপতি হাসানুল হক ইনু। এই আসন থেকে তিনি টানা তিনবার নৌকা প্রতীকে বিজয়ী হন। এবার তিনি হেরেছেন আওয়ামী লীগের স্বতন্ত্র প্রার্থী কামারুল আরেফিনের কাছে। পরাজয়ের পর ইনুর অভিযোগ, ‘জনগণের ভোটে নয়, আমাকে কারচুপির ভোটে হারানো হয়েছে। ১৮টি ভোটকেন্দ্রে অস্বাভাবিক ভোট পড়েছে। আওয়ামী লীগের একটা অংশ প্রশাসনের সহযোগিতায় নৌকার বিরুদ্ধে কাজ করেছে, যা দুঃখজনক।’ অবশ্য তিনি বলেছেন, ৯৫ শতাংশ জায়গায় নির্বাচন অবাধ ও সুষ্ঠু হয়েছে, ৫ শতাংশ জায়গায় হয়নি।

শুধু নৌকার প্রার্থী আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় নেতা গোলাপ, স্বতন্ত্র প্রার্থী কৃষক লীগের বিশ্বনাথ সরকার ও ১৪ দলীয় জোটের প্রার্থী জাসদের ইনু নন; হেরে যাওয়ায় এমন অভিযোগ করেছেন ‘নৌকা ও স্বতন্ত্র’র বেশ কয়েকজন প্রার্থী। যাঁরা সবাই ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগেরই নেতা। অবশ্য হেরে যাওয়ার বিষয়ে এসব প্রার্থী শুধু নিজ নিজ নির্বাচনী আসনেই এমনটা হয়েছে বলে দাবি করেছেন। সামগ্রিকভাবে তাঁরা দেশের অন্যান্য আসনে অবাধ ও সুষ্ঠু ভোটের প্রশংসা করেছেন।

অর্থাৎ এককথায় বললে এর অর্থ, জিতলে ভালো ভোট, হারলে খারাপ। তবে ৭ জানুয়ারির নির্বাচন নিয়ে এসব বক্তব্য অমোচনীয় কালো দাগ হয়েই থাকবে।

আবার একই দলের নৌকা ও স্বতন্ত্র প্রার্থীদের মধ্যে নির্বাচন ঘিরে যে বিরোধ দেখা দিয়েছে, তা দলের ঐক্যের জন্য ক্ষতিকর। দলের ভেতরের দ্বন্দ্ব-কোন্দল নিরসনের জন্য কেন্দ্র থেকে বিশেষ উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। অন্যদিকে উপজেলা নির্বাচনে নৌকা প্রতীক বরাদ্দ না দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে আওয়ামী লীগ।

নির্বাচনে জাতীয় পার্টি মাত্র ১১টি আসন পেয়েছে। বলা যায়, আওয়ামী লীগের অনুগ্রহভাজন হতে গিয়ে দলটির ভরাডুবি ঘটেছে। মানুষ এ টিম রেখে কেন বি টিমের দিকে ঝুঁকবে? নির্বাচনের পর জাতীয় পার্টির অভ্যন্তরেও দেখা দিয়েছে ক্ষোভ-অসন্তোষ। নির্বাচনের পর বিক্ষুব্ধ নেতারা এক সমাবেশে মিলিত হয়ে দলের চেয়ারম্যান জি এম কাদের ও মহাসচিব মুজিবুল হক চুন্নুর বিরুদ্ধে কামান দেগেছেন এই ভাষায়: ‘নির্বাচন এলে আমাদের মাথা বিক্রি করেন, আমাদের মাথা বিক্রি করা টাকা আত্মসাৎ করেন। আর মাথা বিক্রি করবেন না। সংসার, দোকানপাট বিক্রি করে নির্বাচন করেছি, নিঃস্ব হয়ে গেছি। নৌকা-স্বতন্ত্র প্রার্থীদের হামলার মুখে নির্বাচনী মাঠে ছিলাম। কথা দিয়েও আমাদের একটা টাকাও দিলেন না। চেয়ারম্যান-মহাসচিব একটিবার ফোনও ধরলেন না। আপনাদের সহযোগিতা তো চাইনি। কিন্তু আমাদের জন্য যে টাকা এল, সেটা কোথায় গেল, এর জবাব আপনাদের দিতে হবে।’

নির্বাচনে ভরাডুবি, দলীয় ও নির্বাচনী ফান্ড কুক্ষিগত করে রাখা, জি এম কাদেরের স্ত্রী শেরিফা কাদেরের আসনের বিনিময়ে সিনিয়র নেতাদের বাদ দেওয়া, নির্বাচনে অসহযোগিতার অভিযোগ এনে জাতীয় পার্টির প্রার্থী ও তৃণমূল নেতা-কর্মীদের অসন্তোষের পরিণতিতে জাতীয় পার্টি আরেক দফা ভাঙনের শিকার হয় কি না, দেখার বিষয় সেটাই। সংসদে বিরোধী দলের আসনে বসার সুযোগ জাতীয় পার্টি পাচ্ছে, কিন্তু এই দল ও নেতৃত্বের পক্ষে প্রকৃত বিরোধী দলের ভূমিকা পালন কতটুকু সম্ভব, সে প্রশ্ন থাকছেই।

এবার দেখা যাক রাজপথের বিরোধী দল বিএনপির কী অবস্থা। গণমাধ্যমে প্রকাশিত খবর অনুযায়ী, নবগঠিত সরকারের কর্মকাণ্ডকে ‘প্রশ্নবিদ্ধ’ করা ও আগামী পাঁচ বছরের মেয়াদ পূরণের পথে বাধা সৃষ্টির লক্ষ্যকে প্রাধান্য দিয়েই ভবিষ্যৎ কর্মকৌশল ঠিক করছে বিএনপি। এ জন্য ঘুমিয়ে পড়া আন্দোলনকে জাগিয়ে তোলার প্রস্তুতি চলছে দলটিতে। তবে কাজটি সহজ নয়। বিএনপি যে আন্দোলনের দল নয় তা এর মধ্যেই মানুষ বুঝে নিয়েছে। আগামী দিনে কারাবন্দী নেতা-কর্মীদের মুক্ত করা, দলের গুরুত্বপূর্ণ পদে রদবদল, সর্বদলীয় ঐক্য গঠন, কূটনৈতিক তৎপরতা জোরদার, সাংগঠনিক শৃঙ্খলা ধরে রাখা, আন্দোলনে জনসম্পৃক্ততা বাড়ানোর উপায়সহ অনেক কিছুই নতুন করে ভাবতে হবে দলের নেতাদের। বিএনপির সামনে চ্যালেঞ্জ অনেক। দলের অধিকাংশ মিত্র জনসমর্থনহীন। আবার কিছুটা জনসমর্থন আছে যে জামায়াতের, তাদের সঙ্গে ঐক্য করা নিয়ে দলের ভেতরে-বাইরে বিরোধিতা আছে। তবে ভোট ঠেকাতে না পারলেও ভোটকেন্দ্রে ভোটারের কম উপস্থিতি নিয়ে বিএনপির নেতারা তৃপ্তির ঢেকুর তুললেও বাস্তবে এর কোনো মূল্য নেই। সরকার গঠনে এটা কোনো বাধা তৈরি করেনি। নির্বাচন বর্জনের রাজনীতির কারণে জনসমর্থন ধরে রাখা এবং নির্দলীয় সরকারের অধীনে সব দলের অংশগ্রহণে অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচনের দাবি আদায়ের বিষয়টি বিএনপির জন্য শক্ত চ্যালেঞ্জ। নির্বাচনকালীন নির্দলীয় সরকারব্যবস্থা ফিরিয়ে আনা কার্যত অসম্ভব বলেই মনে করা হয়।

লক্ষ্য অর্জনে রাজপথের আন্দোলনের বিকল্প কিছু ভাবছেন না দলটির নেতারা। তাঁদের ভাষ্য, বড় আন্দোলনের জন্য নতুন করে প্রস্তুতি প্রয়োজন। তবে দেশের অর্থনৈতিক যে পরিস্থিতি, তাতে যেকোনো সময় গণ-আন্দোলন হয়ে যেতেও পারে। বিশ্বের অনেক দেশেই আকস্মিক আন্দোলনে ‘কর্তৃত্ববাদী’ সরকারকে বিদায় নিতে হয়।

বিএনপির শীর্ষ নেতৃত্ব এখনো আন্দোলন ও সরকার পতন নিয়ে একধরনের কল্পনার জগতে আছেন বলে মনে হয়। কিছু ফেসবুক বিপ্লবীর অবাস্তব গল্পকথায় যে দেশে গণ-অভ্যুত্থান হবে না, এটা বিএনপি যত দিন উপলব্ধিতে না নেবে, তত দিন দলটি কোনো সঠিক পথের সন্ধান পাবে না। শুধু সরকারের ওপর অসন্তুষ্টি গণ-আন্দোলনের নিয়ামক শক্তি নয়। বিভিন্ন সামাজিক শক্তি, আমলাতন্ত্র, প্রশাসন ও বৈদেশিক শক্তির একমুখী অবস্থান না হলে বড় ধরনের রাজনৈতিক পটপরিবর্তন ঘটে না।

ওয়ার্ল্ড ইকোনমিক ফোরামের সতর্কবাণীতে বাংলাদেশে জ্বালানি-সংকটসহ পাঁচটি ঝুঁকির কথা বলা হয়েছে। এ ছাড়া আন্তর্জাতিক অঙ্গনে দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের গ্রহণযোগ্যতা নিয়ে প্রশ্ন আছে। বিএনপি মনে করছে, বাংলাদেশের নির্বাচন নিয়ে যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, কানাডা, অস্ট্রেলিয়া, জাতিসংঘ ও ইউরোপীয় ইউনিয়নের নেতিবাচক বিবৃতিগুলো দলটির মূল দাবির সঙ্গে সংগতিপূর্ণ হওয়ায় তা আগামী দিনের আন্দোলনে সহায়ক হবে।

বিএনপির বিদেশনির্ভর রাজনৈতিক কৌশল নিয়েও প্রশ্ন আছে। যুক্তরাষ্ট্র বা পশ্চিমা দেশগুলো নিজ নিজ স্বার্থেই অবস্থান গ্রহণ করে। বাংলাদেশে বিএনপির জন্য অনুকূল পরিবেশ তৈরি করা তাদের অ্যাজেন্ডা নয়।

সরকার অনেকটা নির্বিঘ্নেই নির্বাচনী বৈতরণি পার হয়েছে। বিএনপিকে মোকাবিলা করার কৌশল সরকারের আয়ত্তে। পরবর্তী সময়ে বিএনপি অহিংস আন্দোলনের পথে না হাঁটলে কী হবে তা স্পষ্ট করেই বলেছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। নির্বাচনের আগে যারা জ্বালাও-পোড়াও করেছে, তাদের ছাড় দেওয়া হবে না বলে হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করে তিনি বলেছেন, ‘এখন ডিজিটাল বাংলাদেশ, সবার হাতে মোবাইল ফোন, সব জায়গায় সিসি ক্যামেরা আছে। যারা জ্বালাও-পোড়াও করেছে, তাদের খুঁজে বের করা হবে। ইতিমধ্যে অনেককে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। যারা জ্বালাও-পোড়াওয়ের জন্য হুকুম দিয়েছে, তাদেরও আমরা গ্রেপ্তার করছি। তাদের বিরুদ্ধেও ব্যবস্থা নেওয়া হবে। আর যেন কেউ এ ধরনের জঘন্য কাজ করতে না পারে, এটাই আমরা চাই।’

রাজনীতি খুব শিগগিরই শেখ হাসিনার নিয়ন্ত্রণের বাইরে যাওয়ার কোনো কারণ ও লক্ষণ নেই।

লেখক: বিভুরঞ্জন সরকার, জ্যেষ্ঠ সহকারী সম্পাদক আজকের পত্রিকা

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

প্রধান উপদেষ্টার বিশেষ সহকারী হলেন ক্যালিফোর্নিয়ার পরিবহন বিশেষজ্ঞ

‘তল্লাশির’ জন্য উসকানি দিয়েছে গুলশানের ওই বাসার সাবেক কেয়ারটেকার: প্রেস উইং

প্রধান উপদেষ্টার আরও দুই বিশেষ সহকারী নিয়োগ

খালেদা জিয়ার উপদেষ্টা মাসুদ আহমেদের সব পদ স্থগিত

টিআইএন নেওয়ার পরে কিন্তু ঘুমাইতে পারবেন না: এনবিআর চেয়ারম্যান

এলাকার খবর
খুঁজুন

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত