জাহীদ রেজা নূর
কেউ যদি মনে করে থাকেন, বাংলাদেশের অজপাড়াগাঁয়ের নিঃস্ব কোনো আমেনা কিংবা রামের কথা ভেবে বিশ্ব রাজনৈতিক মোড়লেরা সিদ্ধান্ত নেন, তাহলে ভুল করবেন। বিশ্বরাজনীতি এখন সে সবের ধার ধারে না। কে কার মিত্র হয়ে অন্যকে চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি করবে, কে কার ওপর নিষেধাজ্ঞা জারি করবে, কে কার কাছে কত টাকার অস্ত্র বিক্রি করবে—এ ধরনের বিষয়েই বিশ্ব মোড়লদের আগ্রহ। তাদের অর্থনীতিতে অর্থ সঞ্চার করার জন্য বিভেদ টিকিয়ে রাখার মন্ত্র খুবই উপকারী। সেই মন্ত্র জপতে পারলে নিজের অবস্থান পোক্ত করা যায়।
সারা বিশ্বের অর্থনীতি রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ শুরু হওয়ার পর যেভাবে থাপ্পড় খেয়েছে, তা নিয়ে এখনো শেষ কথা বলার সময় আসেনি। তবে এটা বোঝা যাচ্ছে, সারা বিশ্ব এই যুদ্ধের প্রভাবে নাকাল হচ্ছে, সবচেয়ে বেশি আঘাত আসছে গরিব দেশগুলোর অর্থনীতিতে। ইউরোপীয় ইউনিয়ন, ন্যাটো বুঝিয়ে দিচ্ছে আমেরিকাকে নাটের গুরু হিসেবে মেনে নিয়ে তারা কতটা চেপে ধরতে পারে রাশিয়াকে; আবার ভারত, চীন, ইরানসহ আরও কয়েকটি দেশের সহযোগিতায় রাশিয়ার মোড়লিপনায় শুরু হয়েছে ডলারের আধিপত্যবিরোধী ভাবনা-চিন্তা। বড়লোক দেশগুলোর এই যুদ্ধংদেহী মনোভাবের কাছে ‘উলুখাগড়ার প্রাণ যায়’।
২ . এই সংকটময় পরিস্থিতির মধ্যেও যে যা-ই বলুক, উজবেকিস্তানের সমরখন্দে সাংহাই কো-অপারেশন অর্গানাইজেশনের (এসসিও) দুই দিনব্যাপী যে সম্মেলন হয়ে গেল, তা নানা কারণেই গুরুত্বপূর্ণ। ১৫ ও ১৬ সেপ্টেম্বর অনুষ্ঠিত সেই সম্মেলনের আলোচনায় যাওয়ার আগে একটি ব্যাপারে কথা বলে নেওয়া ভালো।
পশ্চিমা প্রচারণা মেশিনের কাছে আমাদের সাংবাদিকতা আটকা পড়ে আছে। তাদের সংবাদমাধ্যমগুলো থেকে আসা সংবাদের প্রতিই আমাদের নির্ভর করতে হয়। ফলে ঘটনার অন্য দিকটা আর দেখা হয় না। পশ্চিমা প্রচারণার এমন ক্ষমতা যে তারা তাদের আদর্শ থেকে শুরু করে চেইন শপের বার্গারও ঢুকিয়ে দিতে পারে তৃতীয় বিশ্বের যেকোনো মানুষের মাথায় এবং তার খাওয়ার প্লেটে।
অন্যদিকে, সমাজতান্ত্রিক দুনিয়াও একসময় সারা বিশ্বে নিজেদের আদর্শবাদ প্রচার করার কাজে অনেকটাই সফল হয়েছিল। তারা যে খবর পরিবেশন করত, তা-ও বিনা প্রশ্নে মেনে নেওয়ার প্রবণতা তৈরি হয়েছিল শোষিত মানুষের মনে। ঠান্ডা যুদ্ধের সময় খেয়ালই করা হয়নি যে পুঁজিবাদ বা সমাজতন্ত্র—যে দিক থেকেই খবর আসুক না কেন, প্রথমেই বুঝতে হবে, এ খবরগুলোয় অন্য পক্ষের শুধু সমালোচনাই আছে। সুতরাং সত্যের কাছাকাছি পৌঁছাতে হলে দুদিকের কথাই শুনতে হবে। তারপর বুঝে নিতে হবে সত্য আসলে ঠিক কোন জায়গায় রয়েছে। কিন্তু প্রচারণাময় বিশ্বে এই ভারসাম্য বুঝে নিজের সিদ্ধান্ত নেওয়া খুব সহজ নয়।
৩.তাই রাশিয়া, চীনের মতো দেশগুলোর অংশগ্রহণে রোমের মতোই পৃথিবীর প্রাচীনতম একটি শহর সমরখন্দে অনুষ্ঠিত এই সম্মেলনে আসলে কী নিয়ে আলোচনা হলো, সেটা আমাদের জানা দরকার। সেটা ভালো কি মন্দ, তা বিশ্লেষণ করে বুঝতে হবে। এসসিওর সম্মেলনটি সমরখন্দে আয়োজন করার একটা মাজেজা আছে। প্রাচীন এই শহর নিয়ে কথা বলতে গেলে বিশ্বজয়ী আলেকজান্ডারের কথা যেমন আসবে, তেমনি আসবে বীর যোদ্ধা তৈমুর লংয়ের কথা। পৃথিবীর নানা জাতির ঐতিহাসিক মিলন ঘটেছিল এই শহরে। এ কারণেই সম্মেলনের জন্য এ শহরটিকে বেছে নেওয়ার একটা প্রতীকী অর্থ আছে।
বলে রাখা ভালো, এই সম্মেলনে অংশ নিয়েছেন ১৪ জন বিশ্বনেতা। সংগঠনের আট সদস্য রাশিয়া, চীন, ভারত, কাজাখস্তান, কিরগিজস্তান, উজবেকিস্তান, তাজিকিস্তান ও পাকিস্তান উপস্থিত ছিল সম্মেলনে। সঙ্গে পর্যবেক্ষক হিসেবে ছিল বেলারুশ, ইরান ও মঙ্গোলিয়া। সঙ্গে ছিল আজারবাইজান আর তুরস্ক।
এ কারণেই রুশ নেতা পুতিন বলেছেন, এসসিও হচ্ছে পৃথিবীর সবচেয়ে বড় আঞ্চলিক সংস্থা। এর কারণ হিসেবে তিনি বলেছেন, এই সম্মেলনে অংশগ্রহণকারী দেশগুলোয় পৃথিবীতে বসবাসকারী অর্ধেকেরও বেশি মানুষ বাস করে, পৃথিবীর মোট দেশজ উৎপাদনের এক-চতুর্থাংশের উৎপাদন হয় এ দেশগুলোয়। বৌদ্ধিক ও কারিগরি দক্ষতার অধিকারী এ দেশগুলো পৃথিবীর উল্লেখযোগ্য প্রাকৃতিক সম্পদের অধিকারী।
ভ্লাদিমির পুতিনের এ কথার রেশ ধরেই বুঝতে হবে, কেন তিনি এই এসসিওকে এতটা জায়গা দিচ্ছেন। আসলে রাশিয়া এখন আন্তর্জাতিক বাজার থেকে প্রায় বিচ্ছিন্ন হয়ে আছে, তাই নিজের উৎপাদিত পণ্যের জন্য তাকে খুঁজতে হবে বাজার। পৃথিবীর অর্ধেকের বেশি মানুষ যে ভূখণ্ডগুলোয় বসবাস করে, তারাই হয়ে উঠতে পারে রাশিয়ার দুর্দিনের সহায়। তাই এই বৈঠক রাশিয়ার পরিপ্রেক্ষিতে খুবই গুরুত্বপূর্ণ।
সম্মেলনে অংশ নেওয়া নেতারা সমরখন্দ ঘোষণায় স্বাক্ষর করেছেন। তাঁদের ঘোষণার গুরুত্বপূর্ণ একটি জায়গা হচ্ছে, ডলারের প্রতি নির্ভরতা কমিয়ে জাতীয় মুদ্রাকে শক্তিশালী করার উদ্যোগ। ডলারের মতো একটি প্রধান মুদ্রা থাকলে অর্থনৈতিকভাবে যেকোনো দেশ স্বচ্ছন্দ থাকে। কিন্তু যুদ্ধ আর নিষেধাজ্ঞা ডলারে লেনদেনের ক্ষেত্রে রাশিয়াকে সংকটে ফেলে দিয়েছে। তাই নতুন ব্যবস্থায় বাজার-ডলার ইত্যাদির কারণে রাশিয়ার বাণিজ্যব্যবস্থা কিঞ্চিৎ ব্যাহত হলেও ডলারবিহীন পারস্পরিক লেনদেনে দেশগুলোর জাতীয় মুদ্রা শক্তিশালী হবে এবং বাণিজ্যঝুঁকি কমবে।
আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্তের দিকেও চোখ রাখা যাক। ঘোষণাপত্রে উল্লেখ করা হয়েছে, এসসিওর সদস্যপদে ইরানকে বরণ করে নেওয়া। পর্যবেক্ষক হিসেবে সম্মেলনে এসেছিল ইরান। এখন দেশটি এই সংস্থার সদস্য হলো। এসসিওভুক্ত দেশগুলোতে পারমাণবিক অস্ত্র কমানো এবং নিরস্ত্রীকরণ অব্যাহত রাখার কথা বলেছে সম্মেলন। সন্ত্রাসবাদ মোকাবিলার অজুহাতে যারা অন্য রাষ্ট্রের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে নাক গলায়, তাদের ব্যাপারে আপসহীন হওয়ার কথাও রয়েছে ঘোষণাপত্রে। আফগানিস্তানও রয়েছে সদস্যপদে। গোটা অঞ্চলের জন্য আফগানিস্তানের স্থিতিশীলতা জরুরি, সেটাও জানিয়েছে সম্মেলন।
৪. এবার রাশিয়া আর চীনের এই নৈকট্যের বিষয়টি নিয়ে কিছু কথা হোক। আগেই বলা হয়েছে, পরাশক্তি কিংবা তাদের গণমাধ্যম সত্য প্রকাশের চেয়ে সত্যের ব্যাপারে তাদের নিজস্ব অবস্থানটিকেই ব্যাখ্যা করে। সুতরাং এখন যা বলা হবে, তা যে চীন বা রাশিয়ার দৃষ্টিকোণ থেকে বলা, সেটাও পাঠককে বুঝে নিতে হবে। তবে, এর মধ্যে ‘পাইলেও পাইতে পারো অমূল্য রতন’।
রাশিয়া আর চীন একে অন্যের সবচেয়ে বড় প্রতিবেশী, দুই দেশের মধ্যে যৌথ সীমান্ত চার হাজার কিলোমিটারের চেয়েও বেশি। দুই দেশই জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদের স্থায়ী সদস্য। পরাশক্তি হওয়ার জন্য দুটো দেশই উদ্গ্রীব।
রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ইউক্রেনের পক্ষ নেওয়ায় রাশিয়া আর চীন তাদের অবস্থান অনেকটাই খোলাসা করে। চীন ও রাশিয়ার মধ্যে যে স্বাভাবিক ও বৈধ সহযোগিতা বিদ্যমান ছিল, তার ওপরও আক্রমণ চালায় যুক্তরাষ্ট্র। যুক্তরাষ্ট্র বা ইউরোপীয় ইউনিয়ন রাশিয়ার ওপর যে নিষেধাজ্ঞা দিয়েছে, তাতে চীনও শরিক হবে—এ রকম একটা আশা ছিল যুক্তরাষ্ট্রের। কিন্তু রাশিয়া ও চীন তাদের কৌশলগত অবস্থান পরিষ্কার রাখে। মার্কিনদের চাওয়া-পাওয়ার সঙ্গে সংগতি রেখে নিজেদের হিসাব-নিকাশ মেলায়নি তারা। চীন ও রাশিয়া দুটো দেশই তাদের শক্তিমত্তার ব্যাপারে ওয়াকিবহাল, ফলে তৃতীয় কোনো শক্তির চাপে তারা হঠাৎ করেই নিজের চলা পথটি পরিবর্তন করে ফেলবে—এ রকম ভাবার কোনো কারণ নেই; বিশেষ করে রাশিয়া আর চীনের নেতারা নিজেদের মধ্যে কৌশলগত যোগাযোগ অব্যাহত রাখায় তা আন্তর্জাতিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে একটি নতুন পথও তৈরি করছে। পশ্চিমা বিশ্ব রাশিয়া আর চীনের মধ্যে বড় ধরনের বিরোধ বা সংঘর্ষের আশা করছে, তাদের সম্পর্কে ভাঙন ধরেছে বলে প্রচার করছে, কিন্তু এখন পর্যন্ত সে প্রচারণা সাফল্যের মুখ দেখেনি।
৫. রাশিয়া আর চীনের বর্তমান সম্পর্কের একটা বৈশিষ্ট্য হলো, তারা কিন্তু তথাকথিত ‘আমেরিকাবিরোধী জোট’ তৈরি করেনি। রাষ্ট্র দুটি যে কাজটি করছে তা হলো, পশ্চিমা রাজনীতির ভাইরাস মোকাবিলা করার সঙ্গে সঙ্গে তাদের আধিপত্যবাদের বিরুদ্ধে লড়াই করা। এটা তাদের ভাষ্য। আর এ কারণেই রাশিয়া আর চীন পরিবর্তিত আন্তর্জাতিক পরিস্থিতিতে স্বাধীন দেশগুলোয় যেন ন্যায়বিচারের কণ্ঠস্বর হয়ে উঠতে পারে, তারই চেষ্টা করে যাচ্ছে। রাশিয়া আর চীন দুই দেশই ‘জোট’ গঠন করার দিকে না গিয়ে ‘অংশীদারত্ব’র প্রতি বেশি আগ্রহী।
জোট গঠন করে অন্য দেশের প্রতি চড়াও হওয়া কোনো কাজের কথা নয়। কিন্তু যে দেশগুলোকে কাছে পাচ্ছে যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বে পশ্চিমা দেশগুলো কিংবা রাশিয়া-চীনের নেতৃত্বে অতীত ঐতিহ্যবাহী দেশগুলো, তাদের বাইরেও রয়েছে অসংখ্য দেশ। এগুলোর মধ্যে এশিয়া ও আফ্রিকার অনেক দেশ আছে, যারা ইতিমধ্যেই অর্থনৈতিকভাবে পঙ্গু হওয়ার দ্বারপ্রান্তে পৌঁছে গেছে। যুদ্ধ চলতে থাকলে পরিস্থিতি কতটা খারাপ হবে, তা এখনই বলা যাচ্ছে না।
তাই, বাংলাদেশে বসে যখন ডলারের পাগলা ঘোড়ার মতো আচরণ দেখি, ডিমের দামে অস্থিরতা দেখি, রেস্তোরাঁয় খেতে গেলে দ্বিগুণ টাকা গুনতে হয়, পরিবহন ভাড়া পকেট কাটে, এ রকম অসংখ্য ঘটনার যোগফলে বুঝতে পারি, বিশ্ব মোড়লেরা জোট গঠন করুক আর না-ই করুক, আসলে বিশ্বব্যাপী শোষিত মানুষের বন্ধু হওয়ার জন্য এদের কোনো গরজ নেই। এই মুহূর্তে এটাই সম্ভবত বিশ্ব ব্যবস্থাপনার সবচেয়ে বড় ট্র্যাজেডি।
কেউ যদি মনে করে থাকেন, বাংলাদেশের অজপাড়াগাঁয়ের নিঃস্ব কোনো আমেনা কিংবা রামের কথা ভেবে বিশ্ব রাজনৈতিক মোড়লেরা সিদ্ধান্ত নেন, তাহলে ভুল করবেন। বিশ্বরাজনীতি এখন সে সবের ধার ধারে না। কে কার মিত্র হয়ে অন্যকে চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি করবে, কে কার ওপর নিষেধাজ্ঞা জারি করবে, কে কার কাছে কত টাকার অস্ত্র বিক্রি করবে—এ ধরনের বিষয়েই বিশ্ব মোড়লদের আগ্রহ। তাদের অর্থনীতিতে অর্থ সঞ্চার করার জন্য বিভেদ টিকিয়ে রাখার মন্ত্র খুবই উপকারী। সেই মন্ত্র জপতে পারলে নিজের অবস্থান পোক্ত করা যায়।
সারা বিশ্বের অর্থনীতি রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ শুরু হওয়ার পর যেভাবে থাপ্পড় খেয়েছে, তা নিয়ে এখনো শেষ কথা বলার সময় আসেনি। তবে এটা বোঝা যাচ্ছে, সারা বিশ্ব এই যুদ্ধের প্রভাবে নাকাল হচ্ছে, সবচেয়ে বেশি আঘাত আসছে গরিব দেশগুলোর অর্থনীতিতে। ইউরোপীয় ইউনিয়ন, ন্যাটো বুঝিয়ে দিচ্ছে আমেরিকাকে নাটের গুরু হিসেবে মেনে নিয়ে তারা কতটা চেপে ধরতে পারে রাশিয়াকে; আবার ভারত, চীন, ইরানসহ আরও কয়েকটি দেশের সহযোগিতায় রাশিয়ার মোড়লিপনায় শুরু হয়েছে ডলারের আধিপত্যবিরোধী ভাবনা-চিন্তা। বড়লোক দেশগুলোর এই যুদ্ধংদেহী মনোভাবের কাছে ‘উলুখাগড়ার প্রাণ যায়’।
২ . এই সংকটময় পরিস্থিতির মধ্যেও যে যা-ই বলুক, উজবেকিস্তানের সমরখন্দে সাংহাই কো-অপারেশন অর্গানাইজেশনের (এসসিও) দুই দিনব্যাপী যে সম্মেলন হয়ে গেল, তা নানা কারণেই গুরুত্বপূর্ণ। ১৫ ও ১৬ সেপ্টেম্বর অনুষ্ঠিত সেই সম্মেলনের আলোচনায় যাওয়ার আগে একটি ব্যাপারে কথা বলে নেওয়া ভালো।
পশ্চিমা প্রচারণা মেশিনের কাছে আমাদের সাংবাদিকতা আটকা পড়ে আছে। তাদের সংবাদমাধ্যমগুলো থেকে আসা সংবাদের প্রতিই আমাদের নির্ভর করতে হয়। ফলে ঘটনার অন্য দিকটা আর দেখা হয় না। পশ্চিমা প্রচারণার এমন ক্ষমতা যে তারা তাদের আদর্শ থেকে শুরু করে চেইন শপের বার্গারও ঢুকিয়ে দিতে পারে তৃতীয় বিশ্বের যেকোনো মানুষের মাথায় এবং তার খাওয়ার প্লেটে।
অন্যদিকে, সমাজতান্ত্রিক দুনিয়াও একসময় সারা বিশ্বে নিজেদের আদর্শবাদ প্রচার করার কাজে অনেকটাই সফল হয়েছিল। তারা যে খবর পরিবেশন করত, তা-ও বিনা প্রশ্নে মেনে নেওয়ার প্রবণতা তৈরি হয়েছিল শোষিত মানুষের মনে। ঠান্ডা যুদ্ধের সময় খেয়ালই করা হয়নি যে পুঁজিবাদ বা সমাজতন্ত্র—যে দিক থেকেই খবর আসুক না কেন, প্রথমেই বুঝতে হবে, এ খবরগুলোয় অন্য পক্ষের শুধু সমালোচনাই আছে। সুতরাং সত্যের কাছাকাছি পৌঁছাতে হলে দুদিকের কথাই শুনতে হবে। তারপর বুঝে নিতে হবে সত্য আসলে ঠিক কোন জায়গায় রয়েছে। কিন্তু প্রচারণাময় বিশ্বে এই ভারসাম্য বুঝে নিজের সিদ্ধান্ত নেওয়া খুব সহজ নয়।
৩.তাই রাশিয়া, চীনের মতো দেশগুলোর অংশগ্রহণে রোমের মতোই পৃথিবীর প্রাচীনতম একটি শহর সমরখন্দে অনুষ্ঠিত এই সম্মেলনে আসলে কী নিয়ে আলোচনা হলো, সেটা আমাদের জানা দরকার। সেটা ভালো কি মন্দ, তা বিশ্লেষণ করে বুঝতে হবে। এসসিওর সম্মেলনটি সমরখন্দে আয়োজন করার একটা মাজেজা আছে। প্রাচীন এই শহর নিয়ে কথা বলতে গেলে বিশ্বজয়ী আলেকজান্ডারের কথা যেমন আসবে, তেমনি আসবে বীর যোদ্ধা তৈমুর লংয়ের কথা। পৃথিবীর নানা জাতির ঐতিহাসিক মিলন ঘটেছিল এই শহরে। এ কারণেই সম্মেলনের জন্য এ শহরটিকে বেছে নেওয়ার একটা প্রতীকী অর্থ আছে।
বলে রাখা ভালো, এই সম্মেলনে অংশ নিয়েছেন ১৪ জন বিশ্বনেতা। সংগঠনের আট সদস্য রাশিয়া, চীন, ভারত, কাজাখস্তান, কিরগিজস্তান, উজবেকিস্তান, তাজিকিস্তান ও পাকিস্তান উপস্থিত ছিল সম্মেলনে। সঙ্গে পর্যবেক্ষক হিসেবে ছিল বেলারুশ, ইরান ও মঙ্গোলিয়া। সঙ্গে ছিল আজারবাইজান আর তুরস্ক।
এ কারণেই রুশ নেতা পুতিন বলেছেন, এসসিও হচ্ছে পৃথিবীর সবচেয়ে বড় আঞ্চলিক সংস্থা। এর কারণ হিসেবে তিনি বলেছেন, এই সম্মেলনে অংশগ্রহণকারী দেশগুলোয় পৃথিবীতে বসবাসকারী অর্ধেকেরও বেশি মানুষ বাস করে, পৃথিবীর মোট দেশজ উৎপাদনের এক-চতুর্থাংশের উৎপাদন হয় এ দেশগুলোয়। বৌদ্ধিক ও কারিগরি দক্ষতার অধিকারী এ দেশগুলো পৃথিবীর উল্লেখযোগ্য প্রাকৃতিক সম্পদের অধিকারী।
ভ্লাদিমির পুতিনের এ কথার রেশ ধরেই বুঝতে হবে, কেন তিনি এই এসসিওকে এতটা জায়গা দিচ্ছেন। আসলে রাশিয়া এখন আন্তর্জাতিক বাজার থেকে প্রায় বিচ্ছিন্ন হয়ে আছে, তাই নিজের উৎপাদিত পণ্যের জন্য তাকে খুঁজতে হবে বাজার। পৃথিবীর অর্ধেকের বেশি মানুষ যে ভূখণ্ডগুলোয় বসবাস করে, তারাই হয়ে উঠতে পারে রাশিয়ার দুর্দিনের সহায়। তাই এই বৈঠক রাশিয়ার পরিপ্রেক্ষিতে খুবই গুরুত্বপূর্ণ।
সম্মেলনে অংশ নেওয়া নেতারা সমরখন্দ ঘোষণায় স্বাক্ষর করেছেন। তাঁদের ঘোষণার গুরুত্বপূর্ণ একটি জায়গা হচ্ছে, ডলারের প্রতি নির্ভরতা কমিয়ে জাতীয় মুদ্রাকে শক্তিশালী করার উদ্যোগ। ডলারের মতো একটি প্রধান মুদ্রা থাকলে অর্থনৈতিকভাবে যেকোনো দেশ স্বচ্ছন্দ থাকে। কিন্তু যুদ্ধ আর নিষেধাজ্ঞা ডলারে লেনদেনের ক্ষেত্রে রাশিয়াকে সংকটে ফেলে দিয়েছে। তাই নতুন ব্যবস্থায় বাজার-ডলার ইত্যাদির কারণে রাশিয়ার বাণিজ্যব্যবস্থা কিঞ্চিৎ ব্যাহত হলেও ডলারবিহীন পারস্পরিক লেনদেনে দেশগুলোর জাতীয় মুদ্রা শক্তিশালী হবে এবং বাণিজ্যঝুঁকি কমবে।
আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্তের দিকেও চোখ রাখা যাক। ঘোষণাপত্রে উল্লেখ করা হয়েছে, এসসিওর সদস্যপদে ইরানকে বরণ করে নেওয়া। পর্যবেক্ষক হিসেবে সম্মেলনে এসেছিল ইরান। এখন দেশটি এই সংস্থার সদস্য হলো। এসসিওভুক্ত দেশগুলোতে পারমাণবিক অস্ত্র কমানো এবং নিরস্ত্রীকরণ অব্যাহত রাখার কথা বলেছে সম্মেলন। সন্ত্রাসবাদ মোকাবিলার অজুহাতে যারা অন্য রাষ্ট্রের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে নাক গলায়, তাদের ব্যাপারে আপসহীন হওয়ার কথাও রয়েছে ঘোষণাপত্রে। আফগানিস্তানও রয়েছে সদস্যপদে। গোটা অঞ্চলের জন্য আফগানিস্তানের স্থিতিশীলতা জরুরি, সেটাও জানিয়েছে সম্মেলন।
৪. এবার রাশিয়া আর চীনের এই নৈকট্যের বিষয়টি নিয়ে কিছু কথা হোক। আগেই বলা হয়েছে, পরাশক্তি কিংবা তাদের গণমাধ্যম সত্য প্রকাশের চেয়ে সত্যের ব্যাপারে তাদের নিজস্ব অবস্থানটিকেই ব্যাখ্যা করে। সুতরাং এখন যা বলা হবে, তা যে চীন বা রাশিয়ার দৃষ্টিকোণ থেকে বলা, সেটাও পাঠককে বুঝে নিতে হবে। তবে, এর মধ্যে ‘পাইলেও পাইতে পারো অমূল্য রতন’।
রাশিয়া আর চীন একে অন্যের সবচেয়ে বড় প্রতিবেশী, দুই দেশের মধ্যে যৌথ সীমান্ত চার হাজার কিলোমিটারের চেয়েও বেশি। দুই দেশই জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদের স্থায়ী সদস্য। পরাশক্তি হওয়ার জন্য দুটো দেশই উদ্গ্রীব।
রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ইউক্রেনের পক্ষ নেওয়ায় রাশিয়া আর চীন তাদের অবস্থান অনেকটাই খোলাসা করে। চীন ও রাশিয়ার মধ্যে যে স্বাভাবিক ও বৈধ সহযোগিতা বিদ্যমান ছিল, তার ওপরও আক্রমণ চালায় যুক্তরাষ্ট্র। যুক্তরাষ্ট্র বা ইউরোপীয় ইউনিয়ন রাশিয়ার ওপর যে নিষেধাজ্ঞা দিয়েছে, তাতে চীনও শরিক হবে—এ রকম একটা আশা ছিল যুক্তরাষ্ট্রের। কিন্তু রাশিয়া ও চীন তাদের কৌশলগত অবস্থান পরিষ্কার রাখে। মার্কিনদের চাওয়া-পাওয়ার সঙ্গে সংগতি রেখে নিজেদের হিসাব-নিকাশ মেলায়নি তারা। চীন ও রাশিয়া দুটো দেশই তাদের শক্তিমত্তার ব্যাপারে ওয়াকিবহাল, ফলে তৃতীয় কোনো শক্তির চাপে তারা হঠাৎ করেই নিজের চলা পথটি পরিবর্তন করে ফেলবে—এ রকম ভাবার কোনো কারণ নেই; বিশেষ করে রাশিয়া আর চীনের নেতারা নিজেদের মধ্যে কৌশলগত যোগাযোগ অব্যাহত রাখায় তা আন্তর্জাতিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে একটি নতুন পথও তৈরি করছে। পশ্চিমা বিশ্ব রাশিয়া আর চীনের মধ্যে বড় ধরনের বিরোধ বা সংঘর্ষের আশা করছে, তাদের সম্পর্কে ভাঙন ধরেছে বলে প্রচার করছে, কিন্তু এখন পর্যন্ত সে প্রচারণা সাফল্যের মুখ দেখেনি।
৫. রাশিয়া আর চীনের বর্তমান সম্পর্কের একটা বৈশিষ্ট্য হলো, তারা কিন্তু তথাকথিত ‘আমেরিকাবিরোধী জোট’ তৈরি করেনি। রাষ্ট্র দুটি যে কাজটি করছে তা হলো, পশ্চিমা রাজনীতির ভাইরাস মোকাবিলা করার সঙ্গে সঙ্গে তাদের আধিপত্যবাদের বিরুদ্ধে লড়াই করা। এটা তাদের ভাষ্য। আর এ কারণেই রাশিয়া আর চীন পরিবর্তিত আন্তর্জাতিক পরিস্থিতিতে স্বাধীন দেশগুলোয় যেন ন্যায়বিচারের কণ্ঠস্বর হয়ে উঠতে পারে, তারই চেষ্টা করে যাচ্ছে। রাশিয়া আর চীন দুই দেশই ‘জোট’ গঠন করার দিকে না গিয়ে ‘অংশীদারত্ব’র প্রতি বেশি আগ্রহী।
জোট গঠন করে অন্য দেশের প্রতি চড়াও হওয়া কোনো কাজের কথা নয়। কিন্তু যে দেশগুলোকে কাছে পাচ্ছে যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বে পশ্চিমা দেশগুলো কিংবা রাশিয়া-চীনের নেতৃত্বে অতীত ঐতিহ্যবাহী দেশগুলো, তাদের বাইরেও রয়েছে অসংখ্য দেশ। এগুলোর মধ্যে এশিয়া ও আফ্রিকার অনেক দেশ আছে, যারা ইতিমধ্যেই অর্থনৈতিকভাবে পঙ্গু হওয়ার দ্বারপ্রান্তে পৌঁছে গেছে। যুদ্ধ চলতে থাকলে পরিস্থিতি কতটা খারাপ হবে, তা এখনই বলা যাচ্ছে না।
তাই, বাংলাদেশে বসে যখন ডলারের পাগলা ঘোড়ার মতো আচরণ দেখি, ডিমের দামে অস্থিরতা দেখি, রেস্তোরাঁয় খেতে গেলে দ্বিগুণ টাকা গুনতে হয়, পরিবহন ভাড়া পকেট কাটে, এ রকম অসংখ্য ঘটনার যোগফলে বুঝতে পারি, বিশ্ব মোড়লেরা জোট গঠন করুক আর না-ই করুক, আসলে বিশ্বব্যাপী শোষিত মানুষের বন্ধু হওয়ার জন্য এদের কোনো গরজ নেই। এই মুহূর্তে এটাই সম্ভবত বিশ্ব ব্যবস্থাপনার সবচেয়ে বড় ট্র্যাজেডি।
ঝড়-জলোচ্ছ্বাস থেকে রক্ষায় সন্দ্বীপের ব্লক বেড়িবাঁধসহ একাধিক প্রকল্প হাতে নিয়েছে সরকার। এ লক্ষ্যে বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে ৫৬২ কোটি টাকা। এ জন্য টেন্ডারও হয়েছে। প্রায় এক বছর পেরিয়ে গেলেও ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানগুলো কাজ শুরু করছে না। পানি উন্নয়ন বোর্ডের (পাউবো) তাগাদায়ও কোনো কাজ হচ্ছে না বলে জানিয়েছেন...
৩ দিন আগেদেশের পরিবহন খাতের অন্যতম নিয়ন্ত্রণকারী ঢাকা সড়ক পরিবহন মালিক সমিতির কমিটির বৈধতা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। সাইফুল আলমের নেতৃত্বাধীন এ কমিটিকে নিবন্ধন দেয়নি শ্রম অধিদপ্তর। তবে এটি কার্যক্রম চালাচ্ছে। কমিটির নেতারা অংশ নিচ্ছেন ঢাকা পরিবহন সমন্বয় কর্তৃপক্ষ (ডিটিসিএ) ও বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষের...
৩ দিন আগেআলুর দাম নিয়ন্ত্রণে ব্যর্থ হয়ে এবার নিজেই বিক্রির উদ্যোগ নিয়েছে সরকার। বাজার স্থিতিশীল রাখতে ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশের (টিসিবি) মাধ্যমে রাজধানীতে ভ্রাম্যমাণ ট্রাকের মাধ্যমে ভর্তুকি মূল্যে আলু বিক্রি করা হবে। একজন গ্রাহক ৪০ টাকা দরে সর্বোচ্চ তিন কেজি আলু কিনতে পারবেন...
৩ দিন আগেসপ্তাহখানেক আগে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকে অনেকের ওয়াল বিষাদময় হয়ে উঠেছিল ফুলের মতো ছোট্ট শিশু মুনতাহাকে হত্যার ঘটনায়। ৫ বছর বয়সী সিলেটের এই শিশুকে অপহরণের পর হত্যা করে লাশ গুম করতে ডোবায় ফেলে রাখা হয়েছিল। প্রতিবেশী গৃহশিক্ষকের পরিকল্পনায় অপহরণের পর তাকে নির্মমভাবে হত্যা করা হয়...
৩ দিন আগে