Ajker Patrika

মধুসূদন দত্তের জন্ম দ্বিশতবার্ষিকী পালন কেন জরুরি

আবু তাহের খান
মধুসূদন দত্তের জন্ম দ্বিশতবার্ষিকী পালন কেন জরুরি

২৫ জানুয়ারি ছিল বাংলা সাহিত্যের মেধাবী, অনুসন্ধানী ব্যক্তিত্ব এবং একাধিক ক্ষেত্রে পুরোধা, পথিকৃৎ ও প্রবর্তক সাহিত্যপুরুষ মাইকেল মধুসূদন দত্তের জন্ম দ্বিশতবার্ষিকী। তবে এই নিবন্ধের উদ্দেশ্য কোনোভাবেই মধুসূদন দত্তের সাহিত্যকৃতি নিয়ে আলোচনা নয়। এই নিবন্ধের মূল উদ্দেশ্য, সমাজ, সংস্কৃতি, সাহিত্য ও ভাষাচর্চার ক্ষেত্রে বাংলাদেশ বর্তমানে যে ভগ্নদশার ভেতর দিয়ে যাচ্ছে, সেটা নিয়ে কিছুটা আলোকপাত করা। এ ক্ষেত্রে মধুসূদন দত্তকে উদাহরণ হিসেবে ধরে নিয়ে বর্তমান দেশের সমাজ ও সংস্কৃতির গতিপথের দিশাদানে সহায়ক ভূমিকা পালন করা। তবে এ সূত্রে এটাও উল্লেখ করা প্রাসঙ্গিক হবে, সমাজ, সাহিত্য ও সংস্কৃতির চর্চা কখনো রাষ্ট্রনিরপেক্ষ কোনো ঘটনা নয়। রাষ্ট্রের চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যের সূত্র ধরেই সমাজ ও সংস্কৃতির গতিপথও নির্ধারিত হয়ে থাকে। ফলে মধুসূদনের উদাহরণ যদি সমাজ-সংস্কৃতির গতিপথ নির্ধারণে সহায়ক ভূমিকা পালন রাখতে পারে, তবে সেটি রাষ্ট্রকে সুপথে ফিরিয়ে আনতেও বহুলাংশে সহায়ক বলে আশা করা যায়।

মধুসূদন দত্তের ব্যাপারে প্রধান সমালোচনা এই যে তিনি নিজ ভাষার পরিবর্তে অন্য ভাষায় সাহিত্যচর্চায় মনোনিবেশ করেছিলেন, স্বধর্ম ত্যাগ করেছিলেন, স্বদেশের সমাজকে উপহাস করে নাটক লিখেছিলেন এবং দুজন বিদেশিনীকে বিয়ে করেছিলেন। আপাতদৃষ্টে এগুলোকে সমালোচনামূলক কাজ মনে হলেও দৃষ্টির গভীরতা দিয়ে উপলব্ধি করতে পারলে এর প্রতিটি বিষয়কেই ইতিবাচকভাবে দেখার সুযোগ রয়েছে। এগুলো থেকে শিক্ষা নিয়ে বর্তমান সময়ের রাষ্ট্র ও সমাজের অনেক দুর্বলতাই এসবের মাধ্যমে বহুলাংশে কাটিয়ে ওঠা সম্ভব বলে মনে করি। মধুসূদন দত্ত যে সময়ে সাহিত্যচর্চায় আগ্রহী হয়ে উঠেছিলেন, সেটি খ্রিষ্টীয় উনিশ শতকের তৃতীয় দশকের কথা। বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় তখন পর্যন্ত জন্মই গ্রহণ করেননি, আর রবীন্দ্রনাথ জন্মেছেন আরও দুই দশকের বেশি সময় পরে। ফলে বাংলা ভাষায় সাহিত্যচর্চার জায়গাটি তখন পর্যন্ত একেবারেই অকর্ষিত এক বিরানভূমি। আর সেই শূন্যতা দেখে অসাধারণ মেধাবী ও সাহিত্যচর্চায় উচ্চাকাঙ্ক্ষী বায়রনভক্ত (রোমান্টিক ইংরেজ কবি লর্ড বায়রন) মধুসূদন যে বাংলার পরিবর্তে ইংরেজিতে সাহিত্যচর্চার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন, সেটিকে দোষণীয় না ভেবে বরং তাঁর সামর্থ্য, আত্মবিশ্বাস, স্বপ্নবানতা ও সৃজনশীল আকাঙ্ক্ষার বহিঃপ্রকাশ হিসেবেই গণ্য করা যেতে পারে। আমাদের আজকের শিক্ষিত তরুণদের মধ্যে এই স্বপ্নবানতা ও সৃজনশীল আকাঙ্ক্ষার যে বিশাল ঘাটতি, মধুসূদনকে দেখে তারা তা বহুলাংশে পূরণ করতে পারে বলে মনে করি। তবে তরুণদের বাংলা ভাষা ত্যাগ করতে বলা হচ্ছে না।

মধুসূদন কেন সনাতন হিন্দুধর্ম ত্যাগ করে খ্রিষ্টধর্ম গ্রহণ করেছিলেন, এর একাধিক ব্যাখ্যা রয়েছে। সে সময় পর্যন্ত তিনি হিন্দুধর্মের মধ্যে যেসব গোঁড়ামি ও রক্ষণশীলতা (সতীদাহ প্রথা তখন সবেমাত্র রহিত হয়েছে মধুসূদনের জন্মের প্রায় ছয় বছর পর ১৮৩৮ সালে এবং বিধবাবিয়ে না হওয়া ও কট্টর বর্ণপ্রথা তখনো রয়ে গেছে) দেখেছিলেন, তাতে করে উদারতাপূর্ণ ও অগ্রসর আচরণসম্পন্ন খ্রিষ্টধর্মের প্রতি তার আগ্রহী হওয়ার পেছনে যথেষ্ট যুক্তি ছিল বলেই মনে করি। বস্তুত এটি ছিল গোঁড়ামি, রক্ষণশীলতা ও বর্ণপ্রথার বিরুদ্ধে তাঁর সচেতন প্রতিবাদেরই অংশ। বলা প্রয়োজন, সেই বর্ণপ্রথা এখনো এ সমাজে কম-বেশি রয়েই গেছে, যে বিষয়ে মধুসূদনকে দেখে এ সমাজ বহুলাংশে সংশোধন ও সচেতন হতে পারে বলে মনে করি।

স্বদেশি সমাজের উচ্চশ্রেণির মানুষদের মধ্যকার প্রতারণাপূর্ণ আচরণ, ভোগবাদী জীবনযাপন ও ভণ্ডামির বিরুদ্ধেই ছিল মধুসূদনের প্রহসনমূলক নাটকগুলোর (একেই কি বলে সভ্যতা, বুড় সালিকের ঘাড়ে রোঁ ইত্যাদি) মূল সুর। কিন্তু সৈয়দ শামসুল হকের ‘নূরলদীনের সারাজীবন’ ছাড়া এ সময়ের আর কটি নাটকে মধুসূদনের সেই প্রতিবাদী দৃষ্টিভঙ্গি আমাদের এ সময়ের নাট্যকাররা তুলে ধরতে পেরেছেন? স্বাধীনতার ৫২ বছর উদ্‌যাপন উপলক্ষে আমরা কত কিছু করলাম, অথচ বাংলা সাহিত্যের প্রতিবাদী সাহিত্যকর্মগুলো থেকে অনুপ্রেরণা লাভের জন্য হলেও, সেগুলোর কোনোটিকেই আমরা সামনে আনতে পারলাম না, যা আমাদের চিন্তার দৈন্য ও সংকীর্ণতার বহিঃপ্রকাশ। মধুসূদন তাঁর নাটকগুলোর মাধ্যমে সমাজের নানা নীচতা, সংকীর্ণতা ও অন্যায্যতার বিরুদ্ধে শুধু প্রতিবাদই করেননি, নাটকের মধ্য দিয়ে ইউরোপীয় ধাঁচের নতুন মাত্রার শৈল্পিকতাও যুক্ত করেছিলেন। মহাকালের বিবেচনায় তাঁর সেসব শিল্পপ্রয়াস কতটা কালোত্তীর্ণ হয়েছে, সে নিয়ে অবশ্যই আলোচনা হতে পারে। কিন্তু বাংলা সাহিত্যের শূন্যতা পূরণে তিনি তাঁর চিন্তা ও কর্মকে যেভাবে সৃজনশীলতা ও বিশ্বজনীনতার পথে এগিয়ে নিয়ে যেতে সচেষ্ট হয়েছিলেন, বাংলাদেশের আজকের সাহিত্যিকদের মধ্যে সে প্রয়াস কোথায়? আর সমাজ ও রাষ্ট্রের পরিবর্তনে সাহিত্যকে যুক্ত করার চেষ্টাই-বা কতটুকু?

মধুসূদন যে একাধিক বিদেশিনীকে বিয়ে করেছিলেন, এর কারণ ও যুক্তি অনুসন্ধানের আলোচনাও দীর্ঘ হতে বাধ্য। ফলে সেই দীর্ঘ প্রসঙ্গ এখানে না টেনে একটি বিষয়ের প্রতি শুধু দৃষ্টি আকর্ষণ করব, সতীদাহ, বিধবাবিবাহে বারণ কিংবা বর্ণপ্রথার (তাঁর পিতা রাজনারায়ণ দত্ত ব্রাহ্মণ ছিলেন না—ছিলেন কায়স্থ) মতো নিষ্ঠুর ধর্মীয় ও সামাজিক আচরণগুলো দেখে তাঁর মতো একজন শিক্ষিত প্রগতিশীল তরুণ যদি একজন অ-ভারতবর্ষীয় নারীকে বিয়ের সিদ্ধান্ত নিয়ে থাকেন, তাহলে সেটিকে দোষ না দিয়ে বরং নিষ্ঠুর বন্ধন থেকে মুক্তির আকাঙ্ক্ষা হিসেবে গণ্য করাটাই অধিকতর সমীচীন হবে বলে মনে করি।

মধুসূদন শুধু যে প্রতিবাদী বা উচ্চাকাঙ্ক্ষী ছিলেন তা-ই নয়; বাংলা সাহিত্যে মহাকাব্যের (মেঘনাদবধ) প্রথম রচয়িতা, অমিত্রাক্ষর ছন্দের প্রথম কবি কিংবা চতুর্দশপদী কবিতার প্রবর্তক হিসেবে আজও তিনি এক অনতিক্রম্য ব্যক্তিত্ব। তো মাত্র ৪৯ বছরের এই স্বল্পায়ু জীবনে বাংলা সাহিত্যের আঁতুড়ঘরকে তিনি শুধু নিজের অনন্য অবদানে সমৃদ্ধ করেই রেখে যাননি, উত্তরকালের বাংলা সাহিত্যের জন্য সাহস ও অনুপ্রেরণার এক নিরন্তর উৎসস্থল হিসেবেও প্রতিষ্ঠা করে গেছেন। বাংলা সাহিত্যের চলতি সময়ের বন্ধ্যত্ব ঘোচাতে তাই মধুসূদনকে আমাদের বারবারই সামনে আনা উচিত বলে মনে করি। কিন্তু বাংলাদেশের রাষ্ট্রীয় কর্তৃপক্ষ তথা সংস্কৃতি মন্ত্রণালয় ও বাংলা একাডেমির দৃষ্টিতে কি আছে যে ২০২৪ সালের ২৫ জানুয়ারি মাইকেল মধুসূদন দত্তের জন্মের দ্বিশতবার্ষিকী? এ বিষয়ে তাদের নীরবতা দেখে মনে তো হয় না যে বিষয়টি তাদের স্মরণে আছে! কারণ তাদের চিন্তার স্তর ও মান এখন এতটাই অধঃগামী হয়েছে যে ফেসবুক কিংবা পাড়ার ম্যাগাজিনের লেখকও এখন তাঁদের বিবেচনায় বাংলা একাডেমি সাহিত্য পুরস্কার, একুশে পদক কিংবা স্বাধীনতা পুরস্কারের জন্য যোগ্যতম ব্যক্তি। তাদের করুণায় এমন সাংবাদিকও ইদানীং একুশে পদকে ভূষিত হন, যিনি নিজেই নিজের গলায় ঝুলিয়ে রাখেন ‘একুশে পদক বিজয়ী সাংবাদিক’। কারণ এর বাইরে পরিচয় দেওয়ার মতো তাঁর আর অন্য তেমন কোনো উল্লেখযোগ্য যোগ্যতা নেই।

যদিও ২৫ জানুয়ারি পেরিয়ে গেছে, তারপরও বছরজুড়ে দ্বিশতবার্ষিকী পালনের সুযোগ রয়েছে। অতএব আমার প্রস্তাব হলো, সংস্কৃতি মন্ত্রণালয় যেন সংশ্লিষ্ট সব প্রতিষ্ঠানকে যুক্ত করে মধুসূদন দত্তের জন্ম দ্বিশতবার্ষিকী পালনের জন্য বছরব্যাপী কর্মসূচি নেয়, যেখানে তোষামোদী ও চাটুকারিতার পরিবর্তে গুণগত মানসম্পন্ন উদ্যোগই স্থান পাবে সর্বাগ্রে। মধুসূদনের ওপর দেশে-বিদেশে প্রচুর গবেষণা হয়েছে। ওই সব গবেষণার সঙ্গে যুক্ত ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানকে ওই কর্মসূচিতে আমন্ত্রণ জানানো যেতে পারে। তাঁর সাহিত্যকর্ম এ দেশের শিক্ষিত সচেতন মহলের কাছে পৌঁছে দেওয়ার লক্ষ্যে তাঁর পুরো রচনাবলির সুলভ মুদ্রণ ও বিতরণের ব্যবস্থা করা যেতে পারে। তাঁর প্রিয় কবি ছিলেন লর্ড বায়রন, যিনি একসময় কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের ট্রিনিটি কলেজে পড়াশোনা করেছিলেন। ধারণা করা যায়, সে কারণে মাইকেলও হয়তো ব্রিটেনে কখনো ওখানে গিয়ে থাকতে পারেন। তাঁর এ জন্ম দ্বিশতবার্ষিকী উপলক্ষে বিষয়টির খোঁজখবর নেওয়া যেতে পারে। মধুসূদন দত্তের বেঁচে থাকা উত্তরাধিকারীদের মধ্যে অনেক বিখ্যাত মানুষও রয়েছেন, যাঁদের মধ্যে প্রখ্যাত টেনিস খেলোয়াড় লিজেন্ডা পেজ অন্যতম। উল্লিখিত অনুষ্ঠানে তাঁকেও আমন্ত্রণ জানানো যেতে পারে। মোটকথা, মাইকেলের জন্ম দ্বিশতবার্ষিকীর এই অনুষ্ঠানকে এমনভাবে সাজানো যেতে পারে, যাতে এটি একটি বিশ্বজনীন কর্মসূচির মতো হয়ে উঠতে পারে। মধুসূদন তো আসলে বিশ্বমাপের সাহিত্যিকই হয়ে উঠতে চেয়েছিলেন। ফলে এ ধরনের আয়োজনে এ ধরনের বিশ্বজনীনতাই কাম্য। আর সর্বাধিক কাম্য, মাইকেলকে দেখে সর্বাগ্রে আমরা স্বপ্নবান ও সৃজনশীল হওয়ার চেষ্টা করব, বর্তমানে যার ঘাটতিতে আমরা প্রচণ্ডভাবে ভুগছি।

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

আমিনুল ইসলাম নন, শিক্ষা উপদেষ্টা হচ্ছেন অধ্যাপক আবরার

গণপিটুনিতে নিহত জামায়াত কর্মী নেজাম ও তাঁর বাহিনী গুলি ছোঁড়ে, মিলেছে বিদেশি পিস্তল: পুলিশ

উপদেষ্টা হচ্ছেন প্রধান উপদেষ্টার বিশেষ সহকারী আমিনুল ইসলাম

বসুন্ধরায় ছিনতাইকারী সন্দেহে ২ বিদেশি নাগরিককে মারধর

বিএনপির দুই পেশাজীবী সংগঠনের কমিটি বিলুপ্ত

এলাকার খবর
খুঁজুন

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত