বিশ্বব্যাংক থেকে করোনা, কত কিছুর মোকাবিলা করেছি

মো. তৌফিকুল ইসলাম
প্রকাশ : ২৫ জুন ২০২২, ০৬: ৩৩
আপডেট : ২৫ জুন ২০২২, ০৯: ১৬

মো. শফিকুল ইসলাম, পদ্মা সেতু প্রকল্পের পরিচালক। সেতু উদ্বোধনের আগে তিনি নির্মাণের গল্প বলেছেন আজকের পত্রিকার মো. তৌফিকুল ইসলামের কাছে।

প্রশ্ন: সেতুর কাজে ব্যবস্থাপনা বা সমন্বয়ের ক্ষেত্রে চ্যালেঞ্জটা কী ছিল?
মো. শফিকুল ইসলাম: প্রকল্পের শুরুর দিকে অর্থায়ন নিয়ে জটিলতা তৈরি হয়েছিল। বিশ্বব্যাংক সরে যাওয়ার পরে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা নিজস্ব অর্থায়নে সেতু নির্মাণের ঘোষণা দিলেন। তারপরও কিছু চ্যালেঞ্জ এসেছিল আমাদের। নিজস্ব অর্থায়নে করার কারণে বড় বড় পরামর্শক প্রতিষ্ঠান, ঠিকাদারেরা আমাদের প্রতি আস্থা রাখতে চাচ্ছিলেন না। এত টাকা আমরা ঠিকমতো দিতে পারব কি না। এটা মোকাবিলা ছিল আমাদের জন্য প্রাথমিক ও প্রথম চ্যালেঞ্জ। তারপর ঠিকাদার পাওয়ার পরে শুরু হলো সেতু নির্মাণের টেকনিক্যাল চ্যালেঞ্জ। ২০১৫ সালের বন্যায় কনস্ট্রাকশন এলাকায় কাজের একটি অংশ ধসে চলে গেল। তারপর পিলারের পাইলের ডিজাইন পরিবর্তন করতে হয়েছে, এটাও আমাদের জন্য একটা চ্যালেঞ্জ ছিল। পাইল না হওয়ার কারণে পিলার হচ্ছে না। আর পিলার না উঠলে স্প্যান বসানো যাচ্ছিল না। এদিকে একের পর এক স্প্যান তৈরি হয়ে যাচ্ছে; সেগুলো রাখব কোথায়, সেটাও একটা চ্যালেঞ্জ ছিল। তারপর হোলি আর্টিজানে হামলার ঘটনায় যখন দেশ থেকে বিদেশিরা চলে যাচ্ছিলেন, তখন বিদেশি শ্রমিকদের নিরাপত্তা দিয়ে প্রকল্পে রাখাও ছিল চ্যালেঞ্জ। তারপর এল করোনা, সেটাও আমরা মোকাবিলা করেছি।

প্রশ্ন: কীভাবে করলেন?
মো. শফিকুল ইসলাম: বাংলাদেশে এত বড় প্রজেক্ট আগে কখনো হয়নি, ফলে সমস্যাগুলো ছিল নতুন। তবে আমরা টিম হয়ে কাজটা শেষ করেছি। আমাদের বিশেষজ্ঞ প্যানেল ছিল। যখন যা প্রয়োজন হয়েছে সরকার সাপোর্ট করেছে। ফলে সব চ্যালেঞ্জ আমরা মোকাবিলা করতে পেরেছি। কাজের গুণমান ধরে রেখে কাজ করতে বলা হয়েছিল। কখনো সরকার থেকে দ্রুত কাজ শেষ করার তাড়া দেয়নি।

প্রশ্ন: দেশি-বিদেশি কতগুলো প্রতিষ্ঠান নির্মাণকাজে যুক্ত ছিল?
মো. শফিকুল ইসলাম: দুটি প্রতিষ্ঠান সরাসরি আমাদের সঙ্গে যুক্ত ছিল। এর বাইরে বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন দেশ থেকে খণ্ডকালীন কাজ করার জন্য লোক এনেছিলাম।

প্রশ্ন: সেতুতে কতজন জনবল কাজ করেছে। কোন দেশের কতজন ছিলেন?
মো. শফিকুল ইসলাম: পিক সময়ে ১০ থেকে ১২ হাজার লোক কাজ করেছেন প্রকল্পের কাজে। এর মধ্যে চাইনিজ ছিলেন ১ হাজার থেকে ১ হাজার ২০০ জন।

প্রশ্ন: মূল সেতু নির্মাণে কত ধরনের উপকরণ ব্যবহার হয়েছে?
মো. শফিকুল ইসলাম: এটা এমন একধরনের বিশেষ ব্রিজ, যেটাতে কংক্রিট ও স্টিল দুটিই আছে। ফলে অনেক ধরনের উপকরণ ব্যবহার হয়েছে সেতুর নির্মাণকাজে। এর মধ্যে ঢালাইয়ের যত রড, সিমেন্ট, বালু—তার সবই বাংলাদেশেরটা ব্যবহার হয়েছে। তবে পাথর এসেছে ভারত ও দুবাই থেকে। স্টিলের প্লেটগুলো চীন থেকে এসেছে। এ ছাড়া ছোট ছোট আরও অনেক উপকরণ ব্যবহার হয়েছে; যেগুলো কানাডা, আমেরিকা, অস্ট্রেলিয়া, ইতালিসহ বিভিন্ন দেশ থেকে এসেছে। তবে তুলনা করলে দেখা যাবে, বেশির ভাগ জিনিসই বাইরের দেশের ব্যবহৃত হয়েছে।

প্রশ্ন: ৪০০ কেভির বিদ্যুৎ লাইন কেন সেতু দিয়ে নেওয়া হলো না?
মো. শফিকুল ইসলাম: বঙ্গবন্ধু ব্রিজ দিয়ে বিদ্যুৎ লাইন নিয়ে যাওয়া গেছে; কারণ, ব্রিজটি সম্পূর্ণ কংক্রিটের ছিল। কিন্তু পদ্মা সেতুতে স্টিলের কাঠামো আছে। তাই ৪০০ কেভির মতো হাইভোল্টেজ লাইন পদ্মা সেতুর ওপর দিয়ে নেওয়া যাবে না। টেকনিক্যাল কারণে পদ্মা সেতুর ওপর দিয়ে বিদ্যুৎ লাইন নেওয়া যায়নি। ফলে সেতুর দুই কিলোমিটার ডাউনে সাতটি প্ল্যাটফর্ম করে তার ওপর দিয়ে আলাদাভাবে ৪০০ কেভির বিদ্যুৎ লাইন নিয়ে যাওয়া হচ্ছে মাওয়া থেকে জাজিরা।

প্রশ্ন: সেতু উদ্বোধন হয়ে গেলে নিয়মিত নদীশাসন কীভাবে হবে?
মো. শফিকুল ইসলাম: নদীশাসনের কাজ ৯৪ ভাগ শেষ হয়েছে। বাকিটা আগামী বছরের জুনে শেষ হবে। জাজিরা প্রান্তে নদীশাসনের কাজ সবটাই শেষ। কিছুটা বাকি আছে মাওয়াতে। নদীশাসনের কাজটি খুবই জটিল।

প্রশ্ন: দেশের যেসব প্রকৌশলী এই প্রকল্পে কাজ করেছেন, তাঁদের নিয়ে কোনো পরিকল্পনা আছে?
মো. শফিকুল ইসলাম: আমাদের দেশের প্রকৌশলীরা এত বড় প্রকল্পে আগে কখনো কাজ করেননি। এটা একটা অভিজ্ঞতা হয়েছে তাঁদের জন্য। পরে দেশের অন্যান্য বড় প্রকল্পে কাজে লাগানো যাবে তাঁদের।

প্রশ্ন: সড়কের সঙ্গে সেতুর রেলের কাজ শেষ হলো না। দুই পক্ষের সমন্বয়ের কী অভাব ছিল?
মো. শফিকুল ইসলাম: টেকনিক্যাল কারণে সেতুতে রেললাইনের কাজ আগে করার কোনো সুযোগ ছিল না। সেখানে সমন্বয়ের কোনো ঘাটতি ছিল না। আগামী মাসের মাঝামাঝিতে কাজ করার জন্য রেল কর্তৃপক্ষকে দেওয়া হবে।

প্রশ্ন: সেতুর ওপরে ট্রেন বিকল হলে কীভাবে সরানো হবে?
মো. শফিকুল ইসলাম: অন্যান্য ব্রিজে যেভাবে কাজ করা হয়, এই ব্রিজেও ট্রেন একইভাবে সরানো যাবে। ব্রিজের ওপর যাত্রীবাহী ট্রেন ১৬০ কিলোমিটার গতিতে চলবে। আর পণ্যবাহী ট্রেন চলবে ১২০ কিলোমিটার বেগে।

প্রশ্ন: কাজ থেকে অবসরে গেলে ভবিষ্যতে কী করতে চান?
মো. শফিকুল ইসলাম: এই প্রকল্প থেকে আমার অনেক অভিজ্ঞতা হয়েছে। ভবিষ্যতে সুযোগ থাকলে আমার এই অভিজ্ঞতা কাজে লাগাব।

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
খুঁজুন

সম্পর্কিত