আজাদুর রহমান চন্দন
ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের মুখে শেখ হাসিনার কর্তৃত্ববাদী শাসনের অবসান এবং দেশে একটি অন্তর্বর্তী সরকার গঠিত হওয়ার পর থেকেই রাষ্ট্র সংস্কারের আলোচনা চলছে জোরেশোরে। গত ৮ আগস্ট প্রধান উপদেষ্টাসহ অন্তর্বর্তী সরকারের উপদেষ্টাদের শপথ গ্রহণ অনুষ্ঠানের পর বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সমন্বয়ক ও বর্তমান উপদেষ্টা নাহিদ ইসলাম রাষ্ট্র ও সমাজকাঠামোর সংস্কারের কথা তুলে ধরেন। সেদিন রাষ্ট্র সংস্কারের প্রত্যাশা ব্যক্ত করেন আরেক উপদেষ্টা সৈয়দা রিজওয়ানা হাসানও। এই আলোচনার পালে জোর হাওয়া লাগে গত ২৯ আগস্ট রাজধানীতে সেন্টার ফর গভর্ন্যান্স স্টাডিজ (সিজিএস) আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনের পর। ওই সংবাদ সম্মেলনে যুক্তরাষ্ট্রের ইলিনয় স্টেট ইউনিভার্সিটির রাজনীতি ও সরকার বিভাগের ডিস্টিংগুইশড অধ্যাপক আলী রীয়াজ সংবিধান পুনর্লিখনের তাগিদ দেন। তিনি বলেন, ‘আমার ব্যক্তিগত মতামত হচ্ছে, সংবিধানের পুনর্লিখন করতে হবে। এর বাইরে আপনি প্রতিষ্ঠানগুলো তৈরি করতে পারবেন না।’ দেশের রাজনৈতিক দলগুলোও সংস্কারের যেসব প্রস্তাব দিচ্ছে, সংবিধান সংশোধন ছাড়া সেসব প্রস্তাব বাস্তবায়ন সম্ভব নয়। এখন প্রশ্ন হলো, বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকারের পক্ষে কি সংবিধান সংশোধন করা সম্ভব? সংস্কার নিয়ে যত আলোচনা হচ্ছে সে তুলনায় সংস্কার সাধনের উপায় নিয়ে আলোচনাটা অনেক কম।
অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের এখন আশু দায়িত্ব হলো প্রশাসনিক শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনা এবং আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি স্বাভাবিক করা। ক্ষোভের বহিঃপ্রকাশের নামে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর উপস্থিতিতে এমনকি আদালত অঙ্গনেও অভিযুক্ত ব্যক্তিদের ওপর আক্রমণ, মাজার ভাঙচুর, বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের প্রধানদের লাঞ্ছিত করে পদত্যাগপত্রে সই করানোর যে প্রতিযোগিতা চলছে, অবিলম্বে তা বন্ধ করা না গেলে গোটা সমাজে বিশৃঙ্খলা ছড়িয়ে পড়বে। সরকারের নীতিগত দিক, বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান, প্রশাসন, রাজনীতি ও অর্থনীতির নানা ক্ষেত্রে সংস্কারের দাবি আসছে। এককথায় যাকে বলা হচ্ছে রাষ্ট্র সংস্কার বা রাষ্ট্র মেরামত। সংস্কারের এই আকাঙ্ক্ষাটা দেশের আপামর জনগণেরই। রাজনৈতিক দলগুলোও নানা রকম প্রস্তাব হাজির করছে। বর্তমানে ক্রিয়াশীল দলগুলোর মধ্যে সবচেয়ে বড় দলটি অর্থাৎ বিএনপির পক্ষ থেকে বছরখানেক আগেই একগুচ্ছ সংস্কার-প্রস্তাব তুলে ধরা হয়েছে। প্রস্তাবগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো—নির্বাচনকালীন দলনিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা প্রবর্তন; প্রধানমন্ত্রী ও মন্ত্রিসভার নির্বাহী ক্ষমতায় ভারসাম্য আনা, নির্বাহী বিভাগ, আইন বিভাগ ও বিচার বিভাগের ক্ষমতা, দায়িত্ব ও কর্তব্যের সমন্বয়; পরপর দুইবারের বেশি কেউ যেন প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করতে না পারেন তার ব্যবস্থা করা; বিদ্যমান সংসদীয় ব্যবস্থার পাশাপাশি বিশিষ্ট নাগরিক, শিক্ষাবিদ, পেশাজীবীসহ প্রশাসনিক অভিজ্ঞতাসম্পন্ন ব্যক্তিদের সমন্বয়ে সংসদে ‘উচ্চকক্ষবিশিষ্ট আইনসভা’র বিধান চালু এবং সংবিধানের ৭০ অনুচ্ছেদ সংশোধন। হেফাজতে ইসলাম ও ধর্মভিত্তিক ছয়টি দলের নেতারাও অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের কাছে দেশের প্রধানমন্ত্রী পদে এক ব্যক্তির দুই মেয়াদের বেশি না থাকার প্রস্তাব দিয়েছেন। সমমনা ওই ছয়টি ধর্মভিত্তিক দল জাতীয় সংসদ নির্বাচনে আসনভিত্তিক প্রতিনিধিত্বের পরিবর্তে ভোটের হারের ভিত্তিতে আসন বণ্টন তথা সংখ্যানুপাতিক হারে নির্বাচনের প্রস্তাব করেছে। একই প্রস্তাব জাতীয় পার্টি এবং চরমোনাই পীরের ইসলামী আন্দোলনেরও।
অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের উপদেষ্টাদের মধ্যেও কেউ কেউ দ্বিকক্ষবিশিষ্ট সংসদের পাশাপাশি সংসদের অর্ধেক আসনে আনুপাতিক নির্বাচনের পক্ষপাতী। এর বাইরে দেশকে ন্যূনতম পাঁচটি প্রদেশে ভাগ করে একটি ফেডারেল কাঠামোর রাষ্ট্র করার অভিমতও আছে। কিন্তু সংস্কারের এসব প্রস্তাবই সংবিধানের সঙ্গে সম্পর্কিত হওয়ায় তা বাস্তবায়নের উপায় নিয়ে কিছু আলোচনা করাটা জরুরি। আজকাল কারও কারও কথাবার্তা থেকে মনে হতে পারে যে অন্তর্বর্তী সরকার চাইলেই সংবিধান সংশোধন করে ফেলতে পারবে। নির্বাচিত জাতীয় সংসদ বা গণপরিষদ ছাড়া অন্য কারও পক্ষে যে সংবিধান সংশোধন করার সুযোগ নেই, সে কথাটি অনেকেই ভুলে যাচ্ছেন। সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা পদত্যাগপত্র জমা দিয়েই হোক কিংবা না দিয়েই হোক দেশ ছেড়ে যাওয়ার পর সৃষ্ট সাংবিধানিক সংকটের পরিপ্রেক্ষিতে বিদ্যমান সংবিধানের আওতায়ই অন্তর্বর্তী সরকার গঠিত হয়েছে। বিদ্যমান সংবিধানে অন্তর্বর্তী সরকারের কোনো বিধান না থাকলেও বেসিক স্ট্রাকচারাল ডকট্রিন বা মৌলিক কাঠামো মতবাদ এবং ডকট্রিন অব নেসেসিটি বা প্রয়োজনীয়তার নীতি অনুযায়ী এই সরকার বৈধতার দাবিদার। আর সে আলোকেই সংবিধানের ৫৬ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী প্রধান উপদেষ্টা ও অন্য উপদেষ্টাদের নিয়োগ দিয়েছেন বর্তমান রাষ্ট্রপতি। অর্থাৎ বর্তমান সরকার কোনো বিপ্লবী সরকার নয়, তাই ইচ্ছে করলেই তারা কোনো ডিক্রি বা আদেশ জারি করে সংবিধান সংশোধন করতে পারবে না। সংবিধান সংশোধন করতে হলে একটি নির্বাচিত জাতীয় সংসদ লাগবে। তাহলে নতুন জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে সরকারের কিছুই কি করণীয় নেই? অবশ্যই আছে।
বেশ কিছু সংস্কারমূলক কাজ আছে যেগুলো অন্তর্বর্তী সরকার অধ্যাদেশ জারির মাধ্যমে সেরে ফেলতে পারে। নির্বাচন কমিশন এরই মধ্যে পদত্যাগ করেছে। রাজনৈতিক দল ও বিশিষ্টজনদের মতের ভিত্তিতে নিরপেক্ষ ও গ্রহণযোগ্য ব্যক্তিদের সমন্বয়ে একটি কার্যকর নির্বাচন কমিশন গঠন করার লক্ষ্যে বর্তমান ‘প্রধান নির্বাচন কমিশনার ও অন্যান্য নির্বাচন কমিশনার নিয়োগ আইন, ২০২২’ সংশোধন করা এবং রাজনৈতিক দল নিবন্ধন আইন সংস্কার করাটা মোটেই কঠিন কাজ নয়। বেশির ভাগ রাজনৈতিক দল স্থানীয় সরকার নির্বাচনে দলীয় প্রতীক ব্যবহার বাতিল করার পক্ষে থাকায় এ-সংক্রান্ত আইনও সংশোধন করা দরকার। সংকীর্ণ রাজনৈতিক দলীয়করণের ঊর্ধ্বে উঠে সব রাষ্ট্রীয়, সাংবিধানিক ও সংবিধিবদ্ধ প্রতিষ্ঠানে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহির লক্ষ্যে আইন সংস্কারের মাধ্যমে পুনর্গঠন করাও সময়ের দাবি। শুনানির মাধ্যমে সংসদীয় কমিটির ভেটিং সাপেক্ষে প্রতিষ্ঠানের সাংবিধানিক ও গুরুত্বপূর্ণ পদে নিয়োগ দেওয়ার বিধান রেখে অধ্যাদেশ জারি করা হলেও কেউ দ্বিমত করবে বলে মনে হয় না। সুপ্রিম কোর্টের বিচারক নিয়োগের লক্ষ্যে সংবিধানের ৯৫ (গ) ধারা অনুযায়ী সুনির্দিষ্ট যোগ্যতা ও মানদণ্ডসংবলিত বিচারপতি নিয়োগ অধ্যাদেশও জারি করা দরকার। এভাবে অধ্যাদেশগুলো জারি করার পাশাপাশি সংবিধানের যেসব বিধান সংশোধন বা সংযোজন-বিয়োজনের ব্যাপারে রাজনৈতিক দলগুলো একমত হবে, সেসব বিষয়ে একটি সমঝোতা বা সম্মতিপত্রে দলগুলোর সই করা অপরিহার্য। এটা করতে হবে জাতীয় সংসদ নির্বাচনের তফসিল ঘোষণার আগেই।
রাষ্ট্র সংস্কার করতে চাইলে রাজনৈতিক দলগুলোরও নেতৃত্ব-সংগঠনের যুগোপযোগী আদর্শিক ও সাংগঠনিক সংস্কার প্রয়োজন। এই সংস্কারের উদ্যোগ এখনই নিতে হবে। সংবিধানে যেসব সংশোধনী আনার ব্যাপারে সমঝোতা হবে, তার সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে দলগুলোর গঠনতন্ত্র ও ঘোষণা-কর্মসূচিও সংশোধন করা দরকার। পরবর্তী জাতীয় নির্বাচনের তফসিল ঘোষণার আগেই এসব সংশোধনী আনতে পারলে রাষ্ট্র সংস্কারের অঙ্গীকারের প্রতি দলগুলোর আন্তরিকতার প্রতিফলন বোঝা যাবে। কারণ, একক নেতৃত্বনির্ভর দল রাষ্ট্র পরিচালনার দায়িত্ব পেলে সংস্কারের অঙ্গীকার কতটা প্রতিপালিত হবে, তা নিয়ে সন্দেহ থেকে যায়। দেশের রাজনীতির অতীত অভিজ্ঞতা থেকেই এমন সন্দেহ দেখা দেয়। নব্বইয়ে এরশাদবিরোধী আন্দোলনকালে তিন জোটের রূপরেখা এবং ১৯৯১ সালের নির্বাচনের আগে বিচারপতি সাহাবুদ্দীন আহমদের নেতৃত্বাধীন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময় প্রণীত সংস্কার প্রস্তাবগুলোর কী হাল হয়েছিল, তা অনেকেরই জানা।
রাষ্ট্রকাঠামো ও প্রশাসনের কার্যকর বিকেন্দ্রীকরণ এবং রাজনৈতিক দলগুলোর গণতন্ত্রায়ন না হলে অন্যান্য সংস্কার কতটা স্থায়িত্ব পাবে সে নিয়েও যথেষ্ট সংশয় আছে। রাষ্ট্রকাঠামোর বিকেন্দ্রীকরণ সংবিধানের সঙ্গে সম্পর্কিত হওয়ায় এটি সময়সাপেক্ষ। কিন্তু স্থানীয় সরকারের সংশ্লিষ্ট আইনগুলো সংশোধন করে বিদ্যমান সংবিধান অনুযায়ী স্বশাসিত স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে মাঠপর্যায়ের সব সরকারি দপ্তরকে এর আওতাধীন করে প্রশাসনিক বিকেন্দ্রীকরণের একটি বড় ধাপের কাজ এই সরকারই সেরে ফেলতে পারে। এই মুহূর্তে দেশের সবচেয়ে বড় রাজনৈতিক দল বিএনপি। নিকট ভবিষ্যতে নতুন বাংলাদেশ বিনির্মাণে বিএনপিকে মুখ্য ভূমিকা রাখতে হবে বলে অনেকে মনে করেন। বিএনপিসহ রাজনৈতিক দলগুলোর সংস্কার না হলে ভবিষ্যতে হয়তো মনে হতে পারে, রাষ্ট্র সংস্কারের ব্যক্ত করা আকাঙ্ক্ষা ছিল ‘অসম্ভবের প্রতি আমাদের অসম্ভব টান’। যদিও বাস্তব জমিনে পা ফেলে এগোলে কোনো অসম্ভবকে সম্ভব করাই অসাধ্য থাকবে না।
লেখক: সাংবাদিক ও গবেষক
ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের মুখে শেখ হাসিনার কর্তৃত্ববাদী শাসনের অবসান এবং দেশে একটি অন্তর্বর্তী সরকার গঠিত হওয়ার পর থেকেই রাষ্ট্র সংস্কারের আলোচনা চলছে জোরেশোরে। গত ৮ আগস্ট প্রধান উপদেষ্টাসহ অন্তর্বর্তী সরকারের উপদেষ্টাদের শপথ গ্রহণ অনুষ্ঠানের পর বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সমন্বয়ক ও বর্তমান উপদেষ্টা নাহিদ ইসলাম রাষ্ট্র ও সমাজকাঠামোর সংস্কারের কথা তুলে ধরেন। সেদিন রাষ্ট্র সংস্কারের প্রত্যাশা ব্যক্ত করেন আরেক উপদেষ্টা সৈয়দা রিজওয়ানা হাসানও। এই আলোচনার পালে জোর হাওয়া লাগে গত ২৯ আগস্ট রাজধানীতে সেন্টার ফর গভর্ন্যান্স স্টাডিজ (সিজিএস) আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনের পর। ওই সংবাদ সম্মেলনে যুক্তরাষ্ট্রের ইলিনয় স্টেট ইউনিভার্সিটির রাজনীতি ও সরকার বিভাগের ডিস্টিংগুইশড অধ্যাপক আলী রীয়াজ সংবিধান পুনর্লিখনের তাগিদ দেন। তিনি বলেন, ‘আমার ব্যক্তিগত মতামত হচ্ছে, সংবিধানের পুনর্লিখন করতে হবে। এর বাইরে আপনি প্রতিষ্ঠানগুলো তৈরি করতে পারবেন না।’ দেশের রাজনৈতিক দলগুলোও সংস্কারের যেসব প্রস্তাব দিচ্ছে, সংবিধান সংশোধন ছাড়া সেসব প্রস্তাব বাস্তবায়ন সম্ভব নয়। এখন প্রশ্ন হলো, বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকারের পক্ষে কি সংবিধান সংশোধন করা সম্ভব? সংস্কার নিয়ে যত আলোচনা হচ্ছে সে তুলনায় সংস্কার সাধনের উপায় নিয়ে আলোচনাটা অনেক কম।
অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের এখন আশু দায়িত্ব হলো প্রশাসনিক শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনা এবং আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি স্বাভাবিক করা। ক্ষোভের বহিঃপ্রকাশের নামে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর উপস্থিতিতে এমনকি আদালত অঙ্গনেও অভিযুক্ত ব্যক্তিদের ওপর আক্রমণ, মাজার ভাঙচুর, বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের প্রধানদের লাঞ্ছিত করে পদত্যাগপত্রে সই করানোর যে প্রতিযোগিতা চলছে, অবিলম্বে তা বন্ধ করা না গেলে গোটা সমাজে বিশৃঙ্খলা ছড়িয়ে পড়বে। সরকারের নীতিগত দিক, বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান, প্রশাসন, রাজনীতি ও অর্থনীতির নানা ক্ষেত্রে সংস্কারের দাবি আসছে। এককথায় যাকে বলা হচ্ছে রাষ্ট্র সংস্কার বা রাষ্ট্র মেরামত। সংস্কারের এই আকাঙ্ক্ষাটা দেশের আপামর জনগণেরই। রাজনৈতিক দলগুলোও নানা রকম প্রস্তাব হাজির করছে। বর্তমানে ক্রিয়াশীল দলগুলোর মধ্যে সবচেয়ে বড় দলটি অর্থাৎ বিএনপির পক্ষ থেকে বছরখানেক আগেই একগুচ্ছ সংস্কার-প্রস্তাব তুলে ধরা হয়েছে। প্রস্তাবগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো—নির্বাচনকালীন দলনিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা প্রবর্তন; প্রধানমন্ত্রী ও মন্ত্রিসভার নির্বাহী ক্ষমতায় ভারসাম্য আনা, নির্বাহী বিভাগ, আইন বিভাগ ও বিচার বিভাগের ক্ষমতা, দায়িত্ব ও কর্তব্যের সমন্বয়; পরপর দুইবারের বেশি কেউ যেন প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করতে না পারেন তার ব্যবস্থা করা; বিদ্যমান সংসদীয় ব্যবস্থার পাশাপাশি বিশিষ্ট নাগরিক, শিক্ষাবিদ, পেশাজীবীসহ প্রশাসনিক অভিজ্ঞতাসম্পন্ন ব্যক্তিদের সমন্বয়ে সংসদে ‘উচ্চকক্ষবিশিষ্ট আইনসভা’র বিধান চালু এবং সংবিধানের ৭০ অনুচ্ছেদ সংশোধন। হেফাজতে ইসলাম ও ধর্মভিত্তিক ছয়টি দলের নেতারাও অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের কাছে দেশের প্রধানমন্ত্রী পদে এক ব্যক্তির দুই মেয়াদের বেশি না থাকার প্রস্তাব দিয়েছেন। সমমনা ওই ছয়টি ধর্মভিত্তিক দল জাতীয় সংসদ নির্বাচনে আসনভিত্তিক প্রতিনিধিত্বের পরিবর্তে ভোটের হারের ভিত্তিতে আসন বণ্টন তথা সংখ্যানুপাতিক হারে নির্বাচনের প্রস্তাব করেছে। একই প্রস্তাব জাতীয় পার্টি এবং চরমোনাই পীরের ইসলামী আন্দোলনেরও।
অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের উপদেষ্টাদের মধ্যেও কেউ কেউ দ্বিকক্ষবিশিষ্ট সংসদের পাশাপাশি সংসদের অর্ধেক আসনে আনুপাতিক নির্বাচনের পক্ষপাতী। এর বাইরে দেশকে ন্যূনতম পাঁচটি প্রদেশে ভাগ করে একটি ফেডারেল কাঠামোর রাষ্ট্র করার অভিমতও আছে। কিন্তু সংস্কারের এসব প্রস্তাবই সংবিধানের সঙ্গে সম্পর্কিত হওয়ায় তা বাস্তবায়নের উপায় নিয়ে কিছু আলোচনা করাটা জরুরি। আজকাল কারও কারও কথাবার্তা থেকে মনে হতে পারে যে অন্তর্বর্তী সরকার চাইলেই সংবিধান সংশোধন করে ফেলতে পারবে। নির্বাচিত জাতীয় সংসদ বা গণপরিষদ ছাড়া অন্য কারও পক্ষে যে সংবিধান সংশোধন করার সুযোগ নেই, সে কথাটি অনেকেই ভুলে যাচ্ছেন। সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা পদত্যাগপত্র জমা দিয়েই হোক কিংবা না দিয়েই হোক দেশ ছেড়ে যাওয়ার পর সৃষ্ট সাংবিধানিক সংকটের পরিপ্রেক্ষিতে বিদ্যমান সংবিধানের আওতায়ই অন্তর্বর্তী সরকার গঠিত হয়েছে। বিদ্যমান সংবিধানে অন্তর্বর্তী সরকারের কোনো বিধান না থাকলেও বেসিক স্ট্রাকচারাল ডকট্রিন বা মৌলিক কাঠামো মতবাদ এবং ডকট্রিন অব নেসেসিটি বা প্রয়োজনীয়তার নীতি অনুযায়ী এই সরকার বৈধতার দাবিদার। আর সে আলোকেই সংবিধানের ৫৬ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী প্রধান উপদেষ্টা ও অন্য উপদেষ্টাদের নিয়োগ দিয়েছেন বর্তমান রাষ্ট্রপতি। অর্থাৎ বর্তমান সরকার কোনো বিপ্লবী সরকার নয়, তাই ইচ্ছে করলেই তারা কোনো ডিক্রি বা আদেশ জারি করে সংবিধান সংশোধন করতে পারবে না। সংবিধান সংশোধন করতে হলে একটি নির্বাচিত জাতীয় সংসদ লাগবে। তাহলে নতুন জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে সরকারের কিছুই কি করণীয় নেই? অবশ্যই আছে।
বেশ কিছু সংস্কারমূলক কাজ আছে যেগুলো অন্তর্বর্তী সরকার অধ্যাদেশ জারির মাধ্যমে সেরে ফেলতে পারে। নির্বাচন কমিশন এরই মধ্যে পদত্যাগ করেছে। রাজনৈতিক দল ও বিশিষ্টজনদের মতের ভিত্তিতে নিরপেক্ষ ও গ্রহণযোগ্য ব্যক্তিদের সমন্বয়ে একটি কার্যকর নির্বাচন কমিশন গঠন করার লক্ষ্যে বর্তমান ‘প্রধান নির্বাচন কমিশনার ও অন্যান্য নির্বাচন কমিশনার নিয়োগ আইন, ২০২২’ সংশোধন করা এবং রাজনৈতিক দল নিবন্ধন আইন সংস্কার করাটা মোটেই কঠিন কাজ নয়। বেশির ভাগ রাজনৈতিক দল স্থানীয় সরকার নির্বাচনে দলীয় প্রতীক ব্যবহার বাতিল করার পক্ষে থাকায় এ-সংক্রান্ত আইনও সংশোধন করা দরকার। সংকীর্ণ রাজনৈতিক দলীয়করণের ঊর্ধ্বে উঠে সব রাষ্ট্রীয়, সাংবিধানিক ও সংবিধিবদ্ধ প্রতিষ্ঠানে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহির লক্ষ্যে আইন সংস্কারের মাধ্যমে পুনর্গঠন করাও সময়ের দাবি। শুনানির মাধ্যমে সংসদীয় কমিটির ভেটিং সাপেক্ষে প্রতিষ্ঠানের সাংবিধানিক ও গুরুত্বপূর্ণ পদে নিয়োগ দেওয়ার বিধান রেখে অধ্যাদেশ জারি করা হলেও কেউ দ্বিমত করবে বলে মনে হয় না। সুপ্রিম কোর্টের বিচারক নিয়োগের লক্ষ্যে সংবিধানের ৯৫ (গ) ধারা অনুযায়ী সুনির্দিষ্ট যোগ্যতা ও মানদণ্ডসংবলিত বিচারপতি নিয়োগ অধ্যাদেশও জারি করা দরকার। এভাবে অধ্যাদেশগুলো জারি করার পাশাপাশি সংবিধানের যেসব বিধান সংশোধন বা সংযোজন-বিয়োজনের ব্যাপারে রাজনৈতিক দলগুলো একমত হবে, সেসব বিষয়ে একটি সমঝোতা বা সম্মতিপত্রে দলগুলোর সই করা অপরিহার্য। এটা করতে হবে জাতীয় সংসদ নির্বাচনের তফসিল ঘোষণার আগেই।
রাষ্ট্র সংস্কার করতে চাইলে রাজনৈতিক দলগুলোরও নেতৃত্ব-সংগঠনের যুগোপযোগী আদর্শিক ও সাংগঠনিক সংস্কার প্রয়োজন। এই সংস্কারের উদ্যোগ এখনই নিতে হবে। সংবিধানে যেসব সংশোধনী আনার ব্যাপারে সমঝোতা হবে, তার সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে দলগুলোর গঠনতন্ত্র ও ঘোষণা-কর্মসূচিও সংশোধন করা দরকার। পরবর্তী জাতীয় নির্বাচনের তফসিল ঘোষণার আগেই এসব সংশোধনী আনতে পারলে রাষ্ট্র সংস্কারের অঙ্গীকারের প্রতি দলগুলোর আন্তরিকতার প্রতিফলন বোঝা যাবে। কারণ, একক নেতৃত্বনির্ভর দল রাষ্ট্র পরিচালনার দায়িত্ব পেলে সংস্কারের অঙ্গীকার কতটা প্রতিপালিত হবে, তা নিয়ে সন্দেহ থেকে যায়। দেশের রাজনীতির অতীত অভিজ্ঞতা থেকেই এমন সন্দেহ দেখা দেয়। নব্বইয়ে এরশাদবিরোধী আন্দোলনকালে তিন জোটের রূপরেখা এবং ১৯৯১ সালের নির্বাচনের আগে বিচারপতি সাহাবুদ্দীন আহমদের নেতৃত্বাধীন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময় প্রণীত সংস্কার প্রস্তাবগুলোর কী হাল হয়েছিল, তা অনেকেরই জানা।
রাষ্ট্রকাঠামো ও প্রশাসনের কার্যকর বিকেন্দ্রীকরণ এবং রাজনৈতিক দলগুলোর গণতন্ত্রায়ন না হলে অন্যান্য সংস্কার কতটা স্থায়িত্ব পাবে সে নিয়েও যথেষ্ট সংশয় আছে। রাষ্ট্রকাঠামোর বিকেন্দ্রীকরণ সংবিধানের সঙ্গে সম্পর্কিত হওয়ায় এটি সময়সাপেক্ষ। কিন্তু স্থানীয় সরকারের সংশ্লিষ্ট আইনগুলো সংশোধন করে বিদ্যমান সংবিধান অনুযায়ী স্বশাসিত স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে মাঠপর্যায়ের সব সরকারি দপ্তরকে এর আওতাধীন করে প্রশাসনিক বিকেন্দ্রীকরণের একটি বড় ধাপের কাজ এই সরকারই সেরে ফেলতে পারে। এই মুহূর্তে দেশের সবচেয়ে বড় রাজনৈতিক দল বিএনপি। নিকট ভবিষ্যতে নতুন বাংলাদেশ বিনির্মাণে বিএনপিকে মুখ্য ভূমিকা রাখতে হবে বলে অনেকে মনে করেন। বিএনপিসহ রাজনৈতিক দলগুলোর সংস্কার না হলে ভবিষ্যতে হয়তো মনে হতে পারে, রাষ্ট্র সংস্কারের ব্যক্ত করা আকাঙ্ক্ষা ছিল ‘অসম্ভবের প্রতি আমাদের অসম্ভব টান’। যদিও বাস্তব জমিনে পা ফেলে এগোলে কোনো অসম্ভবকে সম্ভব করাই অসাধ্য থাকবে না।
লেখক: সাংবাদিক ও গবেষক
ঝড়-জলোচ্ছ্বাস থেকে রক্ষায় সন্দ্বীপের ব্লক বেড়িবাঁধসহ একাধিক প্রকল্প হাতে নিয়েছে সরকার। এ লক্ষ্যে বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে ৫৬২ কোটি টাকা। এ জন্য টেন্ডারও হয়েছে। প্রায় এক বছর পেরিয়ে গেলেও ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানগুলো কাজ শুরু করছে না। পানি উন্নয়ন বোর্ডের (পাউবো) তাগাদায়ও কোনো কাজ হচ্ছে না বলে জানিয়েছেন...
২ দিন আগেদেশের পরিবহন খাতের অন্যতম নিয়ন্ত্রণকারী ঢাকা সড়ক পরিবহন মালিক সমিতির কমিটির বৈধতা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। সাইফুল আলমের নেতৃত্বাধীন এ কমিটিকে নিবন্ধন দেয়নি শ্রম অধিদপ্তর। তবে এটি কার্যক্রম চালাচ্ছে। কমিটির নেতারা অংশ নিচ্ছেন ঢাকা পরিবহন সমন্বয় কর্তৃপক্ষ (ডিটিসিএ) ও বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষের...
২ দিন আগেআলুর দাম নিয়ন্ত্রণে ব্যর্থ হয়ে এবার নিজেই বিক্রির উদ্যোগ নিয়েছে সরকার। বাজার স্থিতিশীল রাখতে ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশের (টিসিবি) মাধ্যমে রাজধানীতে ভ্রাম্যমাণ ট্রাকের মাধ্যমে ভর্তুকি মূল্যে আলু বিক্রি করা হবে। একজন গ্রাহক ৪০ টাকা দরে সর্বোচ্চ তিন কেজি আলু কিনতে পারবেন...
২ দিন আগেসপ্তাহখানেক আগে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকে অনেকের ওয়াল বিষাদময় হয়ে উঠেছিল ফুলের মতো ছোট্ট শিশু মুনতাহাকে হত্যার ঘটনায়। ৫ বছর বয়সী সিলেটের এই শিশুকে অপহরণের পর হত্যা করে লাশ গুম করতে ডোবায় ফেলে রাখা হয়েছিল। প্রতিবেশী গৃহশিক্ষকের পরিকল্পনায় অপহরণের পর তাকে নির্মমভাবে হত্যা করা হয়...
২ দিন আগে