পাভেল পার্থ
প্রতিদিন দুড়মুড় করে বদলে যাচ্ছে দৃশ্যপট। বিশ্বব্যাপী খাদ্য ও নিত্যপ্রয়োজনীয় সামগ্রীর দাম বাড়ছে। কিন্তু মানুষ হিসেবে আমরা কিছুই মনে রাখছি না। এত কঠোর এক মহামারিকাল পাড়ি দিয়েও আমাদের কোনো শিক্ষা হয়নি। নির্দয়ভাবে আমরা রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ বাধিয়ে রেখেছি। যুদ্ধকে জায়েজ করে উৎপাদন ও সমাজকাঠামোর আর সব বিবাদ আড়াল করে সব দায় চাপিয়ে দেওয়া হচ্ছে এই যুদ্ধের ওপর। বাজারে ডিম বা রুটির দাম বাড়ছে। কী কারণ? রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ। গাড়িভাড়া বাড়ছে, বিদ্যুৎ-বিভ্রাটে নাকাল দেশ। কারণ কী? ওই সেই যুদ্ধ। এমনকি নিদারুণ খাদ্যসংকট ও আকালের আওয়াজও ভাসছে চারধারে।
করোনা মহামারিকালে অনেকে বলেছিল, বাংলাদেশ এক চরম খাদ্যহীনতায় পড়বে। কিন্তু পড়েনি। কারা বাঁচিয়েছে বাংলাদেশ? গ্রামীণ নারীরা। মূলত সব ঝঞ্ঝা কি সংকটে গ্রামীণ নারীই বারবার মজবুত রেখেছে দেশের খাদ্যভিত। যদিও গ্রামীণ নারীর রক্ত-ঘামের কোনো স্বীকৃতি বা মর্যাদা পরিবার, সমাজ, বর্গ, শ্রেণি ও রাষ্ট্রে নেই। করোনা মহামারি ও যুদ্ধের মধ্যে এখনো দুনিয়াজুড়ে গ্রামীণ নারীই সর্বস্ব নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে ক্ষুধার বিরুদ্ধে। তবে কৃষি ও খাদ্য উৎপাদনে গ্রামীণ নারীর এই ঐতিহাসিক অবদান এখনো অস্বীকৃত। এমনকি গ্রামীণ নারী নিজের মতো করে কৃষিকে এগিয়ে নেবে, খাদ্যব্যবস্থা রূপান্তরে তার সক্রিয় অংশগ্রহণে গড়ে ওঠেনি কোনো প্রকল্প। নিশ্চিত হয়নি বিশেষ অর্থায়ন কিংবা নীতিমালা। জাতিসংঘ (২০২২) বলছে, নারীকে পুরুষের মতো সুযোগ দিলে কৃষি উৎপাদন ২ দশমিক ৫ থেকে ৪ শতাংশ বাড়তে পারে এবং অপুষ্টির হার কমতে পারে ১২ থেকে ১৭ শতাংশ। পরিবার, সমাজ, রাষ্ট্র কিংবা বৈশ্বিক ময়দানে সর্বত্র গ্রামীণ নারী এই সুযোগ থেকে বঞ্চিত। তাই দেখা যায় আজ বাংলাদেশসহ দক্ষিণ এশিয়া ও আফ্রিকার দেশগুলোতে কৃষিকাজ থেকে গ্রামীণ নারীর নিদারুণ উচ্ছেদ ঘটছে। জীবিকার প্রয়োজনে নারী আজ শিল্পকারখানার দাস-মজুরে পরিণত হতে বাধ্য হচ্ছে।
করোনা মহামারিকালের ছবি ও ঘটনা আমাদের শরীর ও মনে দাগ রেখে গেছে। মনে আছে, যখন পোশাক কারখানা খোলার কথা বলে গ্রাম থেকে শ্রমিকদের টেনে আনা হলো, আবার ঠেলেঠুলে বাড়িতে পাঠানো হলো। তারপর থেকে সংক্রমণ ছড়িয়ে পড়ল দেশময়। মনে আছে, সেই পরিশ্রান্ত, আশাহীন, নিরানন্দ শ্রমিকের দলে কারা ছিল? পুরুষও ছিল, তবে বেশির ভাগ ছিল নারী, যারা প্রত্যেকেই দারুণ সব সাজানো সংসার আর স্মৃতিময় গ্রাম পেছনে ফেলে গত তিরিশ বছর ধরে এমন একটা টালমাটাল লাইনে দাঁড়িয়েছে। এই কিশোরী, যুব বা মধ্যবয়সী নারীদের মা-নানি-দাদিরা কিন্তু বহুকাল এমন কোনো দমবন্ধ লাইনে দাঁড়াননি। তাঁদেরও অভাব ছিল, হাহাকার ছিল। কিন্তু তাঁরা সামলেছেন, সিনা টান করে বাঁচার একটা লড়াই করেছেন। নিদেনপক্ষে হাঁস-মুরগির ডিম বেচে মেয়ের সেন্ডেল, মাচার কুমড়া বা পাগাড়ের কচু বেঁচে সংসারের নানা খরচ মিটিয়েছেন এই অসাধারণ নারীরাই। অভাব, বন্যা, খরা, ঘূর্ণিঝড় কি সামাজিক বঞ্চনা সয়ে এই গ্রামীণ নারীরাই গড়ে তুলেছেন বাংলার মায়াময় ভূগোল।
অতিসাধারণভাবে অনেকেই নারীর কাজ বলতে কৃষিকাজ, গৃহস্থালির কাজ আর কিছু হস্তশিল্প বোঝায়। কিন্তু চিকিৎসা, স্থাপত্য, প্রকৌশল, উদ্ভাবন, সৃজনশীল নির্মাণ, সংরক্ষণ, যোগাযোগ—সব ক্ষেত্রেই আছে গ্রামীণ নারীর অবিস্মরণীয় ছাপ ও ছন্দ। আমাদের সামনে সব সময় একটা দগদগে পুরুষালি বর্ণবাদী আয়না থাকে বলে আমরা ভুলে যাই গ্রামীণ নারীর কর্মপরিসর, অবদান এবং মহিমা। আমরা তাই স্বীকৃতি কিংবা সম্মানের ময়দান উন্মুক্ত করিনি, বরং জাঁদরেল কায়দায় রুদ্ধ করেছি।
আজ পরিস্থিতি বদলেছে, গ্রামীণ নারী আর আগের সেই পরিধি ও পরিস্থিতিতে নেই। নয়া উদারবাদী করপোরেট দুনিয়ার বিশ্বায়িত বাজারে দাঁড়াতে হয়েছে গ্রামীণ নারীকে। গ্রামীণ কৃষি উৎপাদন থেকে সম্পূর্ণ উদ্বাস্তু ও বিচ্ছিন্ন হয়ে আজকের গ্রামীণ নারীদের পোশাক কারখানা কিংবা করপোরেট কারখানার নানা ঝুঁকিপূর্ণ কাজ বেছে নিতে হচ্ছে কিংবা শহরে এসে নাম-পরিচয় হারিয়ে হতে হচ্ছে ‘কাজের বুয়া’। বুঝলাম এতে উন্নয়ন ঘটছে, জিডিপি বাড়ছে, দেশ এগিয়ে যাচ্ছে।
এই যে গ্রামীণ নারী গ্রাম ছাড়ছে প্রতিদিন, তাতে আমরা কী হারাচ্ছি তার কি কোনো খতিয়ান আছে? নারী সর্বোপরি বিচ্ছিন্ন হয়ে যাচ্ছে খাদ্যব্যবস্থা থেকে। স্মরণ রাখা জরুরি, নিয়ানডার্থালদের যুগ থেকে আজকের হোমো স্যাপিয়েন্স সব মানুষই যুদ্ধ করে খাদ্যের জন্য। খাদ্যের জন্যই লড়াই, দরবার, যুদ্ধ, সংঘাত, সংহতি। আর আজ গ্রামীণ নারীকে কী নিদারুণ প্রক্রিয়ায় প্রতিদিন বিচ্ছিন্ন করা হচ্ছে তার নিজের আবিষ্কার ও উদ্ভাবন থেকে। কৃষি ও খাদ্যব্যবস্থা ঐতিহাসিকভাবে গ্রামীণ নারীর মাধ্যমেই বিকশিত ও রূপান্তরিত হয়েছে।
‘বস্ত্রবালিকা’ নামে পোশাকশ্রমিকদের নিয়ে তানভীর মোকাম্মেলের একটি প্রামাণ্যচিত্র আছে। ছবিটির মূল চরিত্র নূরজাহান নামে গ্রামের এক কিশোরী, যার নিদারুণ গন্তব্য হয়েছিল পোশাক কারখানা। ছবিটিতে নূরজাহানের বাবা ও তানভীর মোকাম্মেলের কিছু আলাপ আছে। সেখানে তানভীর মোকাম্মেল নূরজাহানের বাবাকে জিজ্ঞেস করেন, গ্রামে একটা মেয়ে কি কোনো আয় করতে পারে? এর উত্তরে নূরজাহানের বাবা জবাব দেন, গ্রামে মেয়েরা কী আয় করব? ছবিতে এর পরের ধারাভাষ্যটি খুবই গুরুত্ববহ ও রাজনৈতিক। ধারাভাষ্যে বলা হয়, ‘...যেসব নারীর অবধারিত পরিণতি ছিল স্বল্প বেতনে গৃহপরিচারিকা হওয়া, আজ তারা গার্মেন্টসে কাজ করে স্বাবলম্বী হতে পারছে। বাংলাদেশের গার্মেন্টস শিল্প দরিদ্র মেয়েদের জন্য নিয়ে এসেছে এক বিরাট সুযোগ। এ ছিল এক অনাবিষ্কৃত শ্রমশক্তি। অথচ আগে এই শ্রমের কোনো আর্থিক মূল্য ছিল না।’ আদতেই কি গ্রামে একটি মেয়ের আয়রোজগারের কোনো ব্যবস্থা নেই? নাকি পোশাক কারখানার মতো নয়া করপোরেট খাতে সস্তা শ্রমে গ্রামীণ নারীর অংশগ্রহণকে পোক্ত করতে এই ধারাভাষ্য তৈরি হয়েছে? এর মাধ্যমে গ্রামীণ উৎপাদনব্যবস্থা এবং গ্রামীণ রূপান্তরে নারীর ভূমিকা ও অবদানকে কৌশলে আড়াল করে ফেলা হয়েছে। নারীর ওপর নিপীড়ন আর আড়ালীকরণের এমনতর বৈধতাই গ্রামীণ নারীর অবদানকে ‘অনৈতিহাসিক’ করে রাখছে।
বলা হয়ে থাকে, বাংলাদেশের গ্রামীণ গরিব কৃষক পরিবারের ১৫ থেকে ৪৫ বছরের বাঙালি মুসলিম নারীদের সর্বাধিক অভিবাসন ঘটেছে পোশাক কারখানাগুলোতে। এই উপার্জনকারী নারীরা আজ মিনিপ্যাক শ্যাম্পু ব্যবহার করে, নিজে ঘর ভাড়া নিয়ে থাকে, বন্ধুরা মিলে সিনেমা দেখতে যায়, মোবাইল ফোনে বাড়িতে টাকা পাঠায়। পাশাপাশি এই নারীরা তাজরীন কি রানা প্লাজায় অঙ্গার বা থেঁতলে একটি ‘মৃত সংখ্যা’ হয়ে যায়।
গ্রামীণ নারীর কী আছে? আছে পরিচয়, অস্তিত্ব, ইতিহাস, লড়াই, মেধা আর সৃজনশীলতা। বাংলাদেশের ২৩০টি নদী অববাহিকায় যত ধরনের মাটির চুলা আছে, তার হিসাব কি করেছে রাষ্ট্র? এসব মাটির চুলার নির্মাণ ও কারিগরি নিয়ে কি বিস্তর কোনো গবেষণা ও জাতীয় বাজেট বরাদ্দ হয়েছে? গ্রামে গ্রামে নারীর গড়ে তোলা বসতবাড়ি, বাগানগুলোর বিন্যাস ও সজ্জা নিয়ে আমরা কতটুকু ভেবেছি? কিংবা প্রতিনিয়ত কৃষি ও গৃহস্থালি কাজে গ্রামীণ নানা উপকরণ আবিষ্কার ও ব্যবহারকে আমরা কতটা গুরুত্ব দিয়েছি? গ্রামীণ নারীর এই মেধা, কারিগরি ও উৎপাদনশীলতাকে মূলধারার উৎপাদন প্রক্রিয়ায় যুক্ত করা সম্ভব ছিল। তাতে গ্রামীণ নারীর আয়ক্ষেত্র বাড়ত, উপার্জন বাড়ত, স্থানীয় সম্পদের সৃজনশীল ব্যবহার হতো, ভোক্তা হিসেবে আমরা পরিবেশবান্ধব সাংস্কৃতিক উপকরণ ও উপাদান পেতাম। এই গ্রামীণ উন্নয়নের সঙ্গে আমাদের জল-মাটির গন্ধ থাকত।
উন্নয়নশীল দেশগুলোতে গরিব মানুষের জীবন-জীবিকার ক্ষেত্রে প্রাকৃতিক সম্পদই হচ্ছে কেন্দ্রীয় ভিত্তি, যার প্রাথমিক সংগ্রহকারী থেকে শুরু করে গৃহস্থালি পরিবেশে এর ব্যবহার পর্যন্ত সব কাজই করতে হয় নারীদের। নারীরাই প্রাকৃতিক বায়োমাসের সংরক্ষক এবং ব্যবস্থাপক। গ্রামীণ নারীরা প্রাকৃতিক সম্পদের বৈশিষ্ট্যময় রক্ষক এবং ব্যবস্থাপক। প্রাণসম্পদের এক্স-সিট্যু জিনব্যাংকের ব্যবস্থাপকও নারীরা। কিন্তু প্রাকৃতিক সম্পদের পুরুষতান্ত্রিক নিয়ন্ত্রণ নারীকে বারবার তার আপন সম্পর্ক থেকে উচ্ছেদে তৎপর, দখলে মাতোয়ারা।
পাহাড় থেকে সমতল, দেশ থেকে দুনিয়া—কোথাও গ্রামীণ নারীর স্বীকৃতি ও মর্যাদা নেই। তার পরও গ্রামীণ নারীর জন্য একটি আন্তর্জাতিক দিবস আছে। ১৯৯৫ সালের ১৫ অক্টোবরকে আন্তর্জাতিক গ্রামীণ নারী দিবস হিসেবে ঘোষণা করা হয়। এ বছরের প্রতিপাদ্য হলো ‘গ্রামীণ নারীই ক্ষুধা ও দারিদ্র্য দূরীকরণে আলোকবর্তিকা’। কিন্তু আমরা কী দেখি? আজ গ্রামীণ নারীর চারধারে আমরা বহাল রেখেছি সিনথেটিক সার, বিষ ও বিনাশী বীজের এক বিপজ্জনক কৃষি উৎপাদনব্যবস্থা। আমাদের শরীর-মজ্জায় মিশছে বিষ। মায়ের দুধেও মিলছে প্লাস্টিক। অথচ এই জাঁদরেল করপোরেট কৃষি উৎপাদনের বিপরীতে নির্ঘুম আছে দেশ-দুনিয়ার গ্রামীণ নারী। ক্ষুধার বিরুদ্ধে দাঁড়ানো গ্রামীণ নারীর কৃষি ও প্রাকৃতিক খাদ্যব্যবস্থাকে নিরাপদ ও মজুবত করতে আসুন আমরাও দাঁড়াবার সাহস করি।
প্রতিদিন দুড়মুড় করে বদলে যাচ্ছে দৃশ্যপট। বিশ্বব্যাপী খাদ্য ও নিত্যপ্রয়োজনীয় সামগ্রীর দাম বাড়ছে। কিন্তু মানুষ হিসেবে আমরা কিছুই মনে রাখছি না। এত কঠোর এক মহামারিকাল পাড়ি দিয়েও আমাদের কোনো শিক্ষা হয়নি। নির্দয়ভাবে আমরা রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ বাধিয়ে রেখেছি। যুদ্ধকে জায়েজ করে উৎপাদন ও সমাজকাঠামোর আর সব বিবাদ আড়াল করে সব দায় চাপিয়ে দেওয়া হচ্ছে এই যুদ্ধের ওপর। বাজারে ডিম বা রুটির দাম বাড়ছে। কী কারণ? রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ। গাড়িভাড়া বাড়ছে, বিদ্যুৎ-বিভ্রাটে নাকাল দেশ। কারণ কী? ওই সেই যুদ্ধ। এমনকি নিদারুণ খাদ্যসংকট ও আকালের আওয়াজও ভাসছে চারধারে।
করোনা মহামারিকালে অনেকে বলেছিল, বাংলাদেশ এক চরম খাদ্যহীনতায় পড়বে। কিন্তু পড়েনি। কারা বাঁচিয়েছে বাংলাদেশ? গ্রামীণ নারীরা। মূলত সব ঝঞ্ঝা কি সংকটে গ্রামীণ নারীই বারবার মজবুত রেখেছে দেশের খাদ্যভিত। যদিও গ্রামীণ নারীর রক্ত-ঘামের কোনো স্বীকৃতি বা মর্যাদা পরিবার, সমাজ, বর্গ, শ্রেণি ও রাষ্ট্রে নেই। করোনা মহামারি ও যুদ্ধের মধ্যে এখনো দুনিয়াজুড়ে গ্রামীণ নারীই সর্বস্ব নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে ক্ষুধার বিরুদ্ধে। তবে কৃষি ও খাদ্য উৎপাদনে গ্রামীণ নারীর এই ঐতিহাসিক অবদান এখনো অস্বীকৃত। এমনকি গ্রামীণ নারী নিজের মতো করে কৃষিকে এগিয়ে নেবে, খাদ্যব্যবস্থা রূপান্তরে তার সক্রিয় অংশগ্রহণে গড়ে ওঠেনি কোনো প্রকল্প। নিশ্চিত হয়নি বিশেষ অর্থায়ন কিংবা নীতিমালা। জাতিসংঘ (২০২২) বলছে, নারীকে পুরুষের মতো সুযোগ দিলে কৃষি উৎপাদন ২ দশমিক ৫ থেকে ৪ শতাংশ বাড়তে পারে এবং অপুষ্টির হার কমতে পারে ১২ থেকে ১৭ শতাংশ। পরিবার, সমাজ, রাষ্ট্র কিংবা বৈশ্বিক ময়দানে সর্বত্র গ্রামীণ নারী এই সুযোগ থেকে বঞ্চিত। তাই দেখা যায় আজ বাংলাদেশসহ দক্ষিণ এশিয়া ও আফ্রিকার দেশগুলোতে কৃষিকাজ থেকে গ্রামীণ নারীর নিদারুণ উচ্ছেদ ঘটছে। জীবিকার প্রয়োজনে নারী আজ শিল্পকারখানার দাস-মজুরে পরিণত হতে বাধ্য হচ্ছে।
করোনা মহামারিকালের ছবি ও ঘটনা আমাদের শরীর ও মনে দাগ রেখে গেছে। মনে আছে, যখন পোশাক কারখানা খোলার কথা বলে গ্রাম থেকে শ্রমিকদের টেনে আনা হলো, আবার ঠেলেঠুলে বাড়িতে পাঠানো হলো। তারপর থেকে সংক্রমণ ছড়িয়ে পড়ল দেশময়। মনে আছে, সেই পরিশ্রান্ত, আশাহীন, নিরানন্দ শ্রমিকের দলে কারা ছিল? পুরুষও ছিল, তবে বেশির ভাগ ছিল নারী, যারা প্রত্যেকেই দারুণ সব সাজানো সংসার আর স্মৃতিময় গ্রাম পেছনে ফেলে গত তিরিশ বছর ধরে এমন একটা টালমাটাল লাইনে দাঁড়িয়েছে। এই কিশোরী, যুব বা মধ্যবয়সী নারীদের মা-নানি-দাদিরা কিন্তু বহুকাল এমন কোনো দমবন্ধ লাইনে দাঁড়াননি। তাঁদেরও অভাব ছিল, হাহাকার ছিল। কিন্তু তাঁরা সামলেছেন, সিনা টান করে বাঁচার একটা লড়াই করেছেন। নিদেনপক্ষে হাঁস-মুরগির ডিম বেচে মেয়ের সেন্ডেল, মাচার কুমড়া বা পাগাড়ের কচু বেঁচে সংসারের নানা খরচ মিটিয়েছেন এই অসাধারণ নারীরাই। অভাব, বন্যা, খরা, ঘূর্ণিঝড় কি সামাজিক বঞ্চনা সয়ে এই গ্রামীণ নারীরাই গড়ে তুলেছেন বাংলার মায়াময় ভূগোল।
অতিসাধারণভাবে অনেকেই নারীর কাজ বলতে কৃষিকাজ, গৃহস্থালির কাজ আর কিছু হস্তশিল্প বোঝায়। কিন্তু চিকিৎসা, স্থাপত্য, প্রকৌশল, উদ্ভাবন, সৃজনশীল নির্মাণ, সংরক্ষণ, যোগাযোগ—সব ক্ষেত্রেই আছে গ্রামীণ নারীর অবিস্মরণীয় ছাপ ও ছন্দ। আমাদের সামনে সব সময় একটা দগদগে পুরুষালি বর্ণবাদী আয়না থাকে বলে আমরা ভুলে যাই গ্রামীণ নারীর কর্মপরিসর, অবদান এবং মহিমা। আমরা তাই স্বীকৃতি কিংবা সম্মানের ময়দান উন্মুক্ত করিনি, বরং জাঁদরেল কায়দায় রুদ্ধ করেছি।
আজ পরিস্থিতি বদলেছে, গ্রামীণ নারী আর আগের সেই পরিধি ও পরিস্থিতিতে নেই। নয়া উদারবাদী করপোরেট দুনিয়ার বিশ্বায়িত বাজারে দাঁড়াতে হয়েছে গ্রামীণ নারীকে। গ্রামীণ কৃষি উৎপাদন থেকে সম্পূর্ণ উদ্বাস্তু ও বিচ্ছিন্ন হয়ে আজকের গ্রামীণ নারীদের পোশাক কারখানা কিংবা করপোরেট কারখানার নানা ঝুঁকিপূর্ণ কাজ বেছে নিতে হচ্ছে কিংবা শহরে এসে নাম-পরিচয় হারিয়ে হতে হচ্ছে ‘কাজের বুয়া’। বুঝলাম এতে উন্নয়ন ঘটছে, জিডিপি বাড়ছে, দেশ এগিয়ে যাচ্ছে।
এই যে গ্রামীণ নারী গ্রাম ছাড়ছে প্রতিদিন, তাতে আমরা কী হারাচ্ছি তার কি কোনো খতিয়ান আছে? নারী সর্বোপরি বিচ্ছিন্ন হয়ে যাচ্ছে খাদ্যব্যবস্থা থেকে। স্মরণ রাখা জরুরি, নিয়ানডার্থালদের যুগ থেকে আজকের হোমো স্যাপিয়েন্স সব মানুষই যুদ্ধ করে খাদ্যের জন্য। খাদ্যের জন্যই লড়াই, দরবার, যুদ্ধ, সংঘাত, সংহতি। আর আজ গ্রামীণ নারীকে কী নিদারুণ প্রক্রিয়ায় প্রতিদিন বিচ্ছিন্ন করা হচ্ছে তার নিজের আবিষ্কার ও উদ্ভাবন থেকে। কৃষি ও খাদ্যব্যবস্থা ঐতিহাসিকভাবে গ্রামীণ নারীর মাধ্যমেই বিকশিত ও রূপান্তরিত হয়েছে।
‘বস্ত্রবালিকা’ নামে পোশাকশ্রমিকদের নিয়ে তানভীর মোকাম্মেলের একটি প্রামাণ্যচিত্র আছে। ছবিটির মূল চরিত্র নূরজাহান নামে গ্রামের এক কিশোরী, যার নিদারুণ গন্তব্য হয়েছিল পোশাক কারখানা। ছবিটিতে নূরজাহানের বাবা ও তানভীর মোকাম্মেলের কিছু আলাপ আছে। সেখানে তানভীর মোকাম্মেল নূরজাহানের বাবাকে জিজ্ঞেস করেন, গ্রামে একটা মেয়ে কি কোনো আয় করতে পারে? এর উত্তরে নূরজাহানের বাবা জবাব দেন, গ্রামে মেয়েরা কী আয় করব? ছবিতে এর পরের ধারাভাষ্যটি খুবই গুরুত্ববহ ও রাজনৈতিক। ধারাভাষ্যে বলা হয়, ‘...যেসব নারীর অবধারিত পরিণতি ছিল স্বল্প বেতনে গৃহপরিচারিকা হওয়া, আজ তারা গার্মেন্টসে কাজ করে স্বাবলম্বী হতে পারছে। বাংলাদেশের গার্মেন্টস শিল্প দরিদ্র মেয়েদের জন্য নিয়ে এসেছে এক বিরাট সুযোগ। এ ছিল এক অনাবিষ্কৃত শ্রমশক্তি। অথচ আগে এই শ্রমের কোনো আর্থিক মূল্য ছিল না।’ আদতেই কি গ্রামে একটি মেয়ের আয়রোজগারের কোনো ব্যবস্থা নেই? নাকি পোশাক কারখানার মতো নয়া করপোরেট খাতে সস্তা শ্রমে গ্রামীণ নারীর অংশগ্রহণকে পোক্ত করতে এই ধারাভাষ্য তৈরি হয়েছে? এর মাধ্যমে গ্রামীণ উৎপাদনব্যবস্থা এবং গ্রামীণ রূপান্তরে নারীর ভূমিকা ও অবদানকে কৌশলে আড়াল করে ফেলা হয়েছে। নারীর ওপর নিপীড়ন আর আড়ালীকরণের এমনতর বৈধতাই গ্রামীণ নারীর অবদানকে ‘অনৈতিহাসিক’ করে রাখছে।
বলা হয়ে থাকে, বাংলাদেশের গ্রামীণ গরিব কৃষক পরিবারের ১৫ থেকে ৪৫ বছরের বাঙালি মুসলিম নারীদের সর্বাধিক অভিবাসন ঘটেছে পোশাক কারখানাগুলোতে। এই উপার্জনকারী নারীরা আজ মিনিপ্যাক শ্যাম্পু ব্যবহার করে, নিজে ঘর ভাড়া নিয়ে থাকে, বন্ধুরা মিলে সিনেমা দেখতে যায়, মোবাইল ফোনে বাড়িতে টাকা পাঠায়। পাশাপাশি এই নারীরা তাজরীন কি রানা প্লাজায় অঙ্গার বা থেঁতলে একটি ‘মৃত সংখ্যা’ হয়ে যায়।
গ্রামীণ নারীর কী আছে? আছে পরিচয়, অস্তিত্ব, ইতিহাস, লড়াই, মেধা আর সৃজনশীলতা। বাংলাদেশের ২৩০টি নদী অববাহিকায় যত ধরনের মাটির চুলা আছে, তার হিসাব কি করেছে রাষ্ট্র? এসব মাটির চুলার নির্মাণ ও কারিগরি নিয়ে কি বিস্তর কোনো গবেষণা ও জাতীয় বাজেট বরাদ্দ হয়েছে? গ্রামে গ্রামে নারীর গড়ে তোলা বসতবাড়ি, বাগানগুলোর বিন্যাস ও সজ্জা নিয়ে আমরা কতটুকু ভেবেছি? কিংবা প্রতিনিয়ত কৃষি ও গৃহস্থালি কাজে গ্রামীণ নানা উপকরণ আবিষ্কার ও ব্যবহারকে আমরা কতটা গুরুত্ব দিয়েছি? গ্রামীণ নারীর এই মেধা, কারিগরি ও উৎপাদনশীলতাকে মূলধারার উৎপাদন প্রক্রিয়ায় যুক্ত করা সম্ভব ছিল। তাতে গ্রামীণ নারীর আয়ক্ষেত্র বাড়ত, উপার্জন বাড়ত, স্থানীয় সম্পদের সৃজনশীল ব্যবহার হতো, ভোক্তা হিসেবে আমরা পরিবেশবান্ধব সাংস্কৃতিক উপকরণ ও উপাদান পেতাম। এই গ্রামীণ উন্নয়নের সঙ্গে আমাদের জল-মাটির গন্ধ থাকত।
উন্নয়নশীল দেশগুলোতে গরিব মানুষের জীবন-জীবিকার ক্ষেত্রে প্রাকৃতিক সম্পদই হচ্ছে কেন্দ্রীয় ভিত্তি, যার প্রাথমিক সংগ্রহকারী থেকে শুরু করে গৃহস্থালি পরিবেশে এর ব্যবহার পর্যন্ত সব কাজই করতে হয় নারীদের। নারীরাই প্রাকৃতিক বায়োমাসের সংরক্ষক এবং ব্যবস্থাপক। গ্রামীণ নারীরা প্রাকৃতিক সম্পদের বৈশিষ্ট্যময় রক্ষক এবং ব্যবস্থাপক। প্রাণসম্পদের এক্স-সিট্যু জিনব্যাংকের ব্যবস্থাপকও নারীরা। কিন্তু প্রাকৃতিক সম্পদের পুরুষতান্ত্রিক নিয়ন্ত্রণ নারীকে বারবার তার আপন সম্পর্ক থেকে উচ্ছেদে তৎপর, দখলে মাতোয়ারা।
পাহাড় থেকে সমতল, দেশ থেকে দুনিয়া—কোথাও গ্রামীণ নারীর স্বীকৃতি ও মর্যাদা নেই। তার পরও গ্রামীণ নারীর জন্য একটি আন্তর্জাতিক দিবস আছে। ১৯৯৫ সালের ১৫ অক্টোবরকে আন্তর্জাতিক গ্রামীণ নারী দিবস হিসেবে ঘোষণা করা হয়। এ বছরের প্রতিপাদ্য হলো ‘গ্রামীণ নারীই ক্ষুধা ও দারিদ্র্য দূরীকরণে আলোকবর্তিকা’। কিন্তু আমরা কী দেখি? আজ গ্রামীণ নারীর চারধারে আমরা বহাল রেখেছি সিনথেটিক সার, বিষ ও বিনাশী বীজের এক বিপজ্জনক কৃষি উৎপাদনব্যবস্থা। আমাদের শরীর-মজ্জায় মিশছে বিষ। মায়ের দুধেও মিলছে প্লাস্টিক। অথচ এই জাঁদরেল করপোরেট কৃষি উৎপাদনের বিপরীতে নির্ঘুম আছে দেশ-দুনিয়ার গ্রামীণ নারী। ক্ষুধার বিরুদ্ধে দাঁড়ানো গ্রামীণ নারীর কৃষি ও প্রাকৃতিক খাদ্যব্যবস্থাকে নিরাপদ ও মজুবত করতে আসুন আমরাও দাঁড়াবার সাহস করি।
গাজীপুর মহানগরের বোর্ডবাজার এলাকার ইসলামিক ইউনিভার্সিটি অব টেকনোলজির (আইইউটি) মেকানিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের শিক্ষার্থীরা পিকনিকে যাচ্ছিলেন শ্রীপুরের মাটির মায়া ইকো রিসোর্টে। ঢাকা-ময়মনসিংহ মহাসড়ক থেকে বাসগুলো গ্রামের সরু সড়কে ঢোকার পর বিদ্যুতের তারে জড়িয়ে যায় বিআরটিসির একটি দোতলা বাস...
১৫ ঘণ্টা আগেঝড়-জলোচ্ছ্বাস থেকে রক্ষায় সন্দ্বীপের ব্লক বেড়িবাঁধসহ একাধিক প্রকল্প হাতে নিয়েছে সরকার। এ লক্ষ্যে বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে ৫৬২ কোটি টাকা। এ জন্য টেন্ডারও হয়েছে। প্রায় এক বছর পেরিয়ে গেলেও ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানগুলো কাজ শুরু করছে না। পানি উন্নয়ন বোর্ডের (পাউবো) তাগাদায়ও কোনো কাজ হচ্ছে না বলে জানিয়েছেন...
৫ দিন আগেদেশের পরিবহন খাতের অন্যতম নিয়ন্ত্রণকারী ঢাকা সড়ক পরিবহন মালিক সমিতির কমিটির বৈধতা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। সাইফুল আলমের নেতৃত্বাধীন এ কমিটিকে নিবন্ধন দেয়নি শ্রম অধিদপ্তর। তবে এটি কার্যক্রম চালাচ্ছে। কমিটির নেতারা অংশ নিচ্ছেন ঢাকা পরিবহন সমন্বয় কর্তৃপক্ষ (ডিটিসিএ) ও বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষের...
৫ দিন আগেআলুর দাম নিয়ন্ত্রণে ব্যর্থ হয়ে এবার নিজেই বিক্রির উদ্যোগ নিয়েছে সরকার। বাজার স্থিতিশীল রাখতে ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশের (টিসিবি) মাধ্যমে রাজধানীতে ভ্রাম্যমাণ ট্রাকের মাধ্যমে ভর্তুকি মূল্যে আলু বিক্রি করা হবে। একজন গ্রাহক ৪০ টাকা দরে সর্বোচ্চ তিন কেজি আলু কিনতে পারবেন...
৫ দিন আগে