জাহীদ রেজা নূর
নারায়ণগঞ্জের সিটি করপোরেশনের নির্বাচনী প্রচারণা যে জমে উঠেছে, সে কথা বলার অপেক্ষা রাখে না। দৈনিক পত্রিকাগুলো খুবই গুরুত্ব দিয়ে আসন্ন নির্বাচনের খবর ছাপছে। নির্বাচনে আওয়ামী লীগের মনোনয়ন পেয়েছেন সেলিনা হায়াৎ আইভী। ১৮ বছর ধরে এই অফিস সামলাচ্ছেন তিনি। পৌরসভার মেয়র ছিলেন, এরপর তা সিটি করপোরেশন হলো। আইভী হয়ে উঠলেন নগরের ত্রাণকর্তা।এবার নতুন করে আবারও দলের মনোনয়ন পেয়েছেন তিনি।
গোটা দেশে নির্বাচনের হাল-হকিকত ইতিমধ্যেই জানা হয়ে গেছে জনগণের। দীর্ঘদিন ক্ষমতায় থাকা আওয়ামী লীগের বিদ্রোহী প্রার্থীরা যখন আশাতীত ভালো ফল করতে লাগলেন, তখনই বোঝা যাচ্ছিল, ক্ষমতা দলকে গিলে খাচ্ছে। বহু জায়গায় আওয়ামী লীগ প্রার্থীর ভরাডুবি হয়েছে স্বতন্ত্র প্রার্থীর কাছে। সরকারে থাকায় আওয়ামী লীগ সংগঠন হিসেবে শক্তিশালী না হয়ে দুর্বল হয়ে পড়েছে। বহু জায়গা আছে, যেখানে দল যাঁদের ওপর নির্ভর করতে চাইছে, জনগণ তাঁদের ওপর আস্থা রাখছেন না। তাই তাঁদের খারিজ করে বিদ্রোহী প্রার্থীকে দিচ্ছেন ভোট। এটা কোনো ক্ষমতাসীন দলের জন্য সুখবর নয়। বিরোধী দল যেখানে দৌড়ের ওপর আছে, সেখানে নিজের দলের বিদ্রোহী প্রার্থীর জনপ্রিয়তা কিন্তু দলের প্রতি জনগণের অনাস্থার প্রমাণ হতে পারে, সেই সঙ্গে এ প্রশ্নটাও আসতে পারে যে দল কেন ভুল লোককে মনোনয়ন দিচ্ছে?
তার চেয়ে বড় কথা, বহু জায়গায় প্রহসনের নির্বাচন হয়েছে বলে নির্বাচনের ব্যাপারে সাধারণ মানুষের খুব একটা আগ্রহ আছে বলেও মনে হয় না। গণতন্ত্রে ‘এক ব্যক্তি এক ভোট’-এর যে প্রচলিত ধারণা, তার ওপর আস্থা রাখা যাচ্ছে না। কখনো কখনো মনে হচ্ছে, নির্বাচনে জনগণ ভোট না দিলেও চলে, তাতে নির্বাচনের কিছু আসে-যায় না।
দুই. সেলিনা হায়াৎ আইভী নারায়ণগঞ্জে খুবই জনপ্রিয়। তবে একই অফিসে ১৮ বছর কাটানো একজন মানুষের বিরুদ্ধে কারণে-অকারণে অনেক অভিযোগ উঠতে পারে। মানুষ চাইতে পারে পরিবর্তন। ভাবতে পারে, নতুন কেউ মেয়র অফিসে এলে নতুন উৎসাহে অনেক কাজ করতে পারবেন। যে প্রতিশ্রুতি দিয়ে মেয়র হয়েছেন আইভী, সেই প্রতিশ্রুতির কোনো কোনোটি তিনি রক্ষা করতে না পারলে তা থেকে জন্ম নিতে পারে ক্ষোভ আর তাতেই পতন ঘটতে পারে আইভীর।
কিন্তু নারায়ণগঞ্জের হালচাল যাঁরা জানেন, তাঁরা এ কথাও জানেন, দল ও দলের বাইরে বাঘা বাঘা সব নেতার সঙ্গে স্নায়ুযুদ্ধে বারবার অবতীর্ণ হয়েছেন আইভী এবং নির্দ্বিধায় বলা যায়, সেসব যুদ্ধ থেকে তিনি বেরিয়ে এসেছেন বিজয়ীর বেশে। নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশনের সমস্যাগুলোর সমাধানের জন্য আইভী আন্তরিক নন—এ কথা আইভীর সবচেয়ে বড় সমালোচকও বলবেন না।
তিন. একটা অনুমান করা যাক। সেলিনা হায়াৎ আইভী কোন কোন কারণে পরাজিত
হতে পারেন?
ক. জনগণ তাঁকে প্রত্যাখ্যান করলে।
খ. তাঁর দল তাঁর পক্ষে না দাঁড়ালে।
গ. তাঁর দল তাঁকে হারানোর জন্য অন্য কোনো প্রার্থীর সঙ্গে যোগসাজশ করলে।
এর বাইরেও নিশ্চয় আরও কারণ থাকতে পারে, কিন্তু আমরা এ কারণগুলো নিয়েই কথা বলব।জনগণ কোন কারণে আইভীকে প্রত্যাখ্যান করতে পারে? যদি মনে করে, এই ১৮ বছরে আইভী জনগণকে প্রতারণা করে টাকার পাহাড় গড়েছেন। যা প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন, তা পালন করেননি।
কিন্তু নারায়ণগঞ্জের রাজনীতির দিকে তাকালে বোঝা যায়, এ ধরনের অপবাদে আইভীকে জড়ানো যাবে না; বরং শামীম ওসমানের মতো ডাকসাইটে প্রতিদ্বন্দ্বীর সঙ্গে লড়াই করে যিনি টিকে আছেন, তাঁর বিরুদ্ধে প্রতারণার অভিযোগ হাস্যকর শোনাবে। সে রকম কোনো ঘটনা ঘটলে শামীম ওসমান নিশ্চয়ই ছেড়ে কথা বলতেন না। সেলিনা হায়াৎ আইভীর সঙ্গে টক শোগুলোয় শামীম ওসমানের যে শরীরী ভাষার প্রকাশ দেখা গেছে অতীতে, তাতে নিঃসন্দেহে বোঝা যায়, বাগ্যুদ্ধে জয়ের জন্য হলেও তিনি আইভীর বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ তুলতেন। কিন্তু সে অভিযোগ তুলতে হলে বাস্তবে সে রকম কোনো ঘটনা থাকতে হবে। সেটা নেই বলেই প্রতীয়মান হয়েছে।
যে প্রতিশ্রুতিগুলো পালন করা হয়নি বলে আইভীর দিকে আঙুল তোলা যায়, তার একটি হচ্ছে পানি সরবরাহ। একটি বড় পানি শোধনাগার গড়ার জন্য ২ হাজার কোটি টাকা চেয়েছেন তিনি স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ের কাছে। সেটা পাওয়া গেলে বিশুদ্ধ পানির ঘাটতি মিটবে বলে মনে করেন বর্তমান মেয়র। বোঝাই যাচ্ছে, এই বিষয়টি মেয়রের হাতে নেই। মেয়র অফিসের পক্ষ থেকে যা যা করার কথা, সেগুলো করা হয়েছে। অপেক্ষা করতে হচ্ছে মন্ত্রণালয়ের সিদ্ধান্তের ওপর।
রাজপথ হকারমুক্ত না হওয়ার দায়টা কি মেয়রকে দেওয়া যাবে? আইভীর কথা শুনুন। তিনি যে জনগণকে সঙ্গে নিয়ে এই সমস্যার সমাধান চান, সে তো বারবার বলেছেন এবং করেও দেখানোর চেষ্টা করেছেন। কিন্তু এসব ক্ষেত্রে মৌন থাকে কারা? কেন হকারমুক্ত হয়
না ফুটপাত?
চার. এ প্রশ্নের উত্তর অন্যভাবে দেওয়ার চেষ্টা করা যেতে পারে। মেট্রোরেলের কাজ শুরু হওয়ার আগে ঢাকা মহানগরীর ফার্মগেট এলাকার ফুটপাত ও রাস্তার একটা অংশ দখল করে হকাররা বসে যেত। মাঝে মাঝে কোনো জাতীয় বা আন্তর্জাতিক সম্মেলন বা খেলা হলে ফুটপাত ও রাজপথের পাশ থেকে তাদের বিতাড়িত করে রাস্তার শোভাবর্ধন করা হতো। আমজনতা ভাবত, এবার তাহলে নিরাপদে কোনো সংকট ছাড়াই হাঁটাহাঁটি করা যাবে। কিন্তু কদিন পরেই সাড়ম্বরে ফিরে আসত হকাররা।
এই তো গত শুক্রবার সে পথ দিয়ে আসার সময় মনে হলো, আরে! এই রাস্তা এত প্রশস্ত হলো কী করে? খেয়াল করে দেখলাম, মেট্রোর কাজ এখানে শেষ হওয়ায় রাস্তাটা পুরোপুরি খুলে দেওয়া হয়েছে। কোনো দিন এতটা রাস্তা যান চলাচলের জন্য ব্যবহৃত হয়নি।কিছুদিন পর এই রাস্তা আর ফুটপাত দখল করে হকাররা বসে যাবে কি না, সেটা নিতান্তই অনুমানের ব্যাপার। তবে হকাররা কার কাছ থেকে শক্তি পায়, কাদের বশীভূত রাখে, কিসের বিনিময়ে বশীভূত রাখে, কেন স্থানীয় নেতারা এবং পুলিশ প্রশাসন এদিকটায় চোখ বন্ধ করে রাখে, সে প্রশ্নগুলো সহজ এবং উত্তরও তো জানা।নারায়ণগঞ্জে ফুটপাত দখল নিয়ে আইভী নিজেই ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন। কারা ফুটপাত দখলদারদের কাছ থেকে চাঁদা তোলে, পুলিশ কেন নীরব থাকে, তা নিয়েও আক্ষেপ করেছেন আইভী। তাতে বোঝা যায়, মেয়র হলেই ক্ষমতার প্রয়োগ করা যায় না। আরও কিছু ব্যাপার থাকে, যেগুলো নগরকে নিয়ন্ত্রণ করে। এই মাফিয়া চক্রের ব্যাপারে আইভী প্রকাশ্যে অসহায়ত্ব প্রকাশ করেছেন।
পাঁচ. নারায়ণগঞ্জে আওয়ামী লীগ দ্বিধাবিভক্ত নাকি বিভক্তি আরও বেশি, সে প্রসঙ্গে না গিয়েও বলা যায়, দলের মধ্যেই রয়েছে শক্তিশালী প্রতিপক্ষ। আইভী পরাজিত হলে এই প্রতিপক্ষের নেতাদের মুখে হাসি ফুটে উঠতে পারে। নিজের নাক কেটে পরের যাত্রাভঙ্গ করার মতো পরিস্থিতি নারায়ণগঞ্জের আওয়ামী লীগে বিরাজমান। তাই আইভীর মূল লড়াইটা কিন্তু তাঁর বাড়ির ভেতরে। বিএনপি নেতা, নির্বাচনে স্বতন্ত্র প্রার্থী তৈমূর আলম খন্দকার আইভীর জন্য তখনই চ্যালেঞ্জ হয়ে উঠতে পারবেন, যখন আইভীর নিজের দলের মধ্যে দেখা দেবে তাঁর বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র।
বলে রাখা ভালো, আমাদের রাজনীতি যখন টাকার খেলায় পরিণত হতে শুরু করেছিল, সংসদে যখন সত্যিকার রাজনীতিবিদ, সুবক্তা, আইনজীবীর সংখ্যা কমে গিয়ে আদর্শহীন পয়সাওয়ালাদের দাপট দেখা যেতে শুরু করেছিল, মনোনয়ন-বাণিজ্য যখন গ্রাস করছিল রাজনীতিকে, সে সময় থেকেই রাজনীতি নিয়ে জনগণ বা আমজনতার স্বপ্ন ক্রমেই বিলীয়মান। জনগণ এখন বোঝে, দলমত-নির্বিশেষে সবখানেই আদর্শের জায়গা দখল করে নিয়েছে অর্থ। শুধু কি রাজনীতিতে? ব্যবসা-বাণিজ্য, সংস্কৃতি, শিল্প, সাংবাদিকতা, চিকিৎসা—সর্বত্রই টাকা হয়ে উঠেছে ঈশ্বর। এ রকম ভয়াবহ পরিস্থিতিতে স্থানীয় রাজনীতিতে বল প্রয়োগ না করে শুধু কাজের মাধ্যমে টিকে থাকা খুবই কষ্টকর ব্যাপার। ফলে বাংলাদেশের নির্বাচনী প্রতিষ্ঠানটির নড়বড়ে অবস্থায় হতাশ মানুষও কিন্তু চোখ রাখছে নারায়ণগঞ্জের সিটি করপোরেশনের নির্বাচনের দিকে। এখানে যে ‘খেলা’টি হবে, তার চিত্রনাট্য কোথায় লেখা হচ্ছে, কীভাবে লেখা হচ্ছে, তার ওপর নির্ভর করবে খেলাটি কতটা জমবে। এই চিত্রনাট্যে জনগণের ভূমিকা মুখ্য হয়ে উঠতে পারে, অন্য নির্বাচনগুলোয় কখনো কখনো যার ঘাটতি থাকে।
ছয়. বাজার অর্থনীতি আর করপোরেট যুগে জীবনের মূল্যবোধগুলোয় যে যান্ত্রিকতা এসেছে, তাতে ‘মানুষ মানুষের জন্যে’ কথাটির সঙ্গে জীবনের সম্পর্ক আর তেমনভাবে থাকছে না। রাজনীতিতে আদর্শের চেয়ে অর্থকড়ি অনেক বেশি প্রাধান্য পেতে শুরু করায় লোভী মন কি সততার মূল্যায়ন করবে, নাকি স্বার্থের মূল্যায়ন করবে, সেটা এখন কোটি টাকার প্রশ্ন। দেশপ্রেম বা জাতীয়তাবোধের মাধ্যমে আন্তর্জাতিকতাবোধে উত্তীর্ণ হওয়ার জন্য তো মনভূমি কর্ষণের দরকার আছে। সেটা যদি না হয়, তাহলে কি শুধু ফাঁকা বুলি আর লোকদেখানো স্তুতিতে দেশের কোনো ইতিবাচক পরিবর্তন আসে?
তারপরও কেউ কেউ মানুষের কল্যাণের প্রতি একনিষ্ঠ থাকে। সেটাই হয়ে যায় তাদের জীবনের অংশ। তখন ক্ষমতা আর ক্ষমতার বাইরে বলে আলাদা কিছু থাকে না।
দীর্ঘদিন ক্ষমতায় থাকার পরও জনগণের সঙ্গে সম্পর্কটা প্রগাঢ় থাকতে পারে কি না, তার জবাব দিতে পারে নারায়ণগঞ্জ। এটা হয়ে উঠতে পারে সত্যিকারের রাজনীতির এক অ্যাসিড টেস্ট।
জাহীদ রেজা নূর: উপসম্পাদক, আজকের পত্রিকা
আরও পড়ুন:
নারায়ণগঞ্জের সিটি করপোরেশনের নির্বাচনী প্রচারণা যে জমে উঠেছে, সে কথা বলার অপেক্ষা রাখে না। দৈনিক পত্রিকাগুলো খুবই গুরুত্ব দিয়ে আসন্ন নির্বাচনের খবর ছাপছে। নির্বাচনে আওয়ামী লীগের মনোনয়ন পেয়েছেন সেলিনা হায়াৎ আইভী। ১৮ বছর ধরে এই অফিস সামলাচ্ছেন তিনি। পৌরসভার মেয়র ছিলেন, এরপর তা সিটি করপোরেশন হলো। আইভী হয়ে উঠলেন নগরের ত্রাণকর্তা।এবার নতুন করে আবারও দলের মনোনয়ন পেয়েছেন তিনি।
গোটা দেশে নির্বাচনের হাল-হকিকত ইতিমধ্যেই জানা হয়ে গেছে জনগণের। দীর্ঘদিন ক্ষমতায় থাকা আওয়ামী লীগের বিদ্রোহী প্রার্থীরা যখন আশাতীত ভালো ফল করতে লাগলেন, তখনই বোঝা যাচ্ছিল, ক্ষমতা দলকে গিলে খাচ্ছে। বহু জায়গায় আওয়ামী লীগ প্রার্থীর ভরাডুবি হয়েছে স্বতন্ত্র প্রার্থীর কাছে। সরকারে থাকায় আওয়ামী লীগ সংগঠন হিসেবে শক্তিশালী না হয়ে দুর্বল হয়ে পড়েছে। বহু জায়গা আছে, যেখানে দল যাঁদের ওপর নির্ভর করতে চাইছে, জনগণ তাঁদের ওপর আস্থা রাখছেন না। তাই তাঁদের খারিজ করে বিদ্রোহী প্রার্থীকে দিচ্ছেন ভোট। এটা কোনো ক্ষমতাসীন দলের জন্য সুখবর নয়। বিরোধী দল যেখানে দৌড়ের ওপর আছে, সেখানে নিজের দলের বিদ্রোহী প্রার্থীর জনপ্রিয়তা কিন্তু দলের প্রতি জনগণের অনাস্থার প্রমাণ হতে পারে, সেই সঙ্গে এ প্রশ্নটাও আসতে পারে যে দল কেন ভুল লোককে মনোনয়ন দিচ্ছে?
তার চেয়ে বড় কথা, বহু জায়গায় প্রহসনের নির্বাচন হয়েছে বলে নির্বাচনের ব্যাপারে সাধারণ মানুষের খুব একটা আগ্রহ আছে বলেও মনে হয় না। গণতন্ত্রে ‘এক ব্যক্তি এক ভোট’-এর যে প্রচলিত ধারণা, তার ওপর আস্থা রাখা যাচ্ছে না। কখনো কখনো মনে হচ্ছে, নির্বাচনে জনগণ ভোট না দিলেও চলে, তাতে নির্বাচনের কিছু আসে-যায় না।
দুই. সেলিনা হায়াৎ আইভী নারায়ণগঞ্জে খুবই জনপ্রিয়। তবে একই অফিসে ১৮ বছর কাটানো একজন মানুষের বিরুদ্ধে কারণে-অকারণে অনেক অভিযোগ উঠতে পারে। মানুষ চাইতে পারে পরিবর্তন। ভাবতে পারে, নতুন কেউ মেয়র অফিসে এলে নতুন উৎসাহে অনেক কাজ করতে পারবেন। যে প্রতিশ্রুতি দিয়ে মেয়র হয়েছেন আইভী, সেই প্রতিশ্রুতির কোনো কোনোটি তিনি রক্ষা করতে না পারলে তা থেকে জন্ম নিতে পারে ক্ষোভ আর তাতেই পতন ঘটতে পারে আইভীর।
কিন্তু নারায়ণগঞ্জের হালচাল যাঁরা জানেন, তাঁরা এ কথাও জানেন, দল ও দলের বাইরে বাঘা বাঘা সব নেতার সঙ্গে স্নায়ুযুদ্ধে বারবার অবতীর্ণ হয়েছেন আইভী এবং নির্দ্বিধায় বলা যায়, সেসব যুদ্ধ থেকে তিনি বেরিয়ে এসেছেন বিজয়ীর বেশে। নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশনের সমস্যাগুলোর সমাধানের জন্য আইভী আন্তরিক নন—এ কথা আইভীর সবচেয়ে বড় সমালোচকও বলবেন না।
তিন. একটা অনুমান করা যাক। সেলিনা হায়াৎ আইভী কোন কোন কারণে পরাজিত
হতে পারেন?
ক. জনগণ তাঁকে প্রত্যাখ্যান করলে।
খ. তাঁর দল তাঁর পক্ষে না দাঁড়ালে।
গ. তাঁর দল তাঁকে হারানোর জন্য অন্য কোনো প্রার্থীর সঙ্গে যোগসাজশ করলে।
এর বাইরেও নিশ্চয় আরও কারণ থাকতে পারে, কিন্তু আমরা এ কারণগুলো নিয়েই কথা বলব।জনগণ কোন কারণে আইভীকে প্রত্যাখ্যান করতে পারে? যদি মনে করে, এই ১৮ বছরে আইভী জনগণকে প্রতারণা করে টাকার পাহাড় গড়েছেন। যা প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন, তা পালন করেননি।
কিন্তু নারায়ণগঞ্জের রাজনীতির দিকে তাকালে বোঝা যায়, এ ধরনের অপবাদে আইভীকে জড়ানো যাবে না; বরং শামীম ওসমানের মতো ডাকসাইটে প্রতিদ্বন্দ্বীর সঙ্গে লড়াই করে যিনি টিকে আছেন, তাঁর বিরুদ্ধে প্রতারণার অভিযোগ হাস্যকর শোনাবে। সে রকম কোনো ঘটনা ঘটলে শামীম ওসমান নিশ্চয়ই ছেড়ে কথা বলতেন না। সেলিনা হায়াৎ আইভীর সঙ্গে টক শোগুলোয় শামীম ওসমানের যে শরীরী ভাষার প্রকাশ দেখা গেছে অতীতে, তাতে নিঃসন্দেহে বোঝা যায়, বাগ্যুদ্ধে জয়ের জন্য হলেও তিনি আইভীর বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ তুলতেন। কিন্তু সে অভিযোগ তুলতে হলে বাস্তবে সে রকম কোনো ঘটনা থাকতে হবে। সেটা নেই বলেই প্রতীয়মান হয়েছে।
যে প্রতিশ্রুতিগুলো পালন করা হয়নি বলে আইভীর দিকে আঙুল তোলা যায়, তার একটি হচ্ছে পানি সরবরাহ। একটি বড় পানি শোধনাগার গড়ার জন্য ২ হাজার কোটি টাকা চেয়েছেন তিনি স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ের কাছে। সেটা পাওয়া গেলে বিশুদ্ধ পানির ঘাটতি মিটবে বলে মনে করেন বর্তমান মেয়র। বোঝাই যাচ্ছে, এই বিষয়টি মেয়রের হাতে নেই। মেয়র অফিসের পক্ষ থেকে যা যা করার কথা, সেগুলো করা হয়েছে। অপেক্ষা করতে হচ্ছে মন্ত্রণালয়ের সিদ্ধান্তের ওপর।
রাজপথ হকারমুক্ত না হওয়ার দায়টা কি মেয়রকে দেওয়া যাবে? আইভীর কথা শুনুন। তিনি যে জনগণকে সঙ্গে নিয়ে এই সমস্যার সমাধান চান, সে তো বারবার বলেছেন এবং করেও দেখানোর চেষ্টা করেছেন। কিন্তু এসব ক্ষেত্রে মৌন থাকে কারা? কেন হকারমুক্ত হয়
না ফুটপাত?
চার. এ প্রশ্নের উত্তর অন্যভাবে দেওয়ার চেষ্টা করা যেতে পারে। মেট্রোরেলের কাজ শুরু হওয়ার আগে ঢাকা মহানগরীর ফার্মগেট এলাকার ফুটপাত ও রাস্তার একটা অংশ দখল করে হকাররা বসে যেত। মাঝে মাঝে কোনো জাতীয় বা আন্তর্জাতিক সম্মেলন বা খেলা হলে ফুটপাত ও রাজপথের পাশ থেকে তাদের বিতাড়িত করে রাস্তার শোভাবর্ধন করা হতো। আমজনতা ভাবত, এবার তাহলে নিরাপদে কোনো সংকট ছাড়াই হাঁটাহাঁটি করা যাবে। কিন্তু কদিন পরেই সাড়ম্বরে ফিরে আসত হকাররা।
এই তো গত শুক্রবার সে পথ দিয়ে আসার সময় মনে হলো, আরে! এই রাস্তা এত প্রশস্ত হলো কী করে? খেয়াল করে দেখলাম, মেট্রোর কাজ এখানে শেষ হওয়ায় রাস্তাটা পুরোপুরি খুলে দেওয়া হয়েছে। কোনো দিন এতটা রাস্তা যান চলাচলের জন্য ব্যবহৃত হয়নি।কিছুদিন পর এই রাস্তা আর ফুটপাত দখল করে হকাররা বসে যাবে কি না, সেটা নিতান্তই অনুমানের ব্যাপার। তবে হকাররা কার কাছ থেকে শক্তি পায়, কাদের বশীভূত রাখে, কিসের বিনিময়ে বশীভূত রাখে, কেন স্থানীয় নেতারা এবং পুলিশ প্রশাসন এদিকটায় চোখ বন্ধ করে রাখে, সে প্রশ্নগুলো সহজ এবং উত্তরও তো জানা।নারায়ণগঞ্জে ফুটপাত দখল নিয়ে আইভী নিজেই ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন। কারা ফুটপাত দখলদারদের কাছ থেকে চাঁদা তোলে, পুলিশ কেন নীরব থাকে, তা নিয়েও আক্ষেপ করেছেন আইভী। তাতে বোঝা যায়, মেয়র হলেই ক্ষমতার প্রয়োগ করা যায় না। আরও কিছু ব্যাপার থাকে, যেগুলো নগরকে নিয়ন্ত্রণ করে। এই মাফিয়া চক্রের ব্যাপারে আইভী প্রকাশ্যে অসহায়ত্ব প্রকাশ করেছেন।
পাঁচ. নারায়ণগঞ্জে আওয়ামী লীগ দ্বিধাবিভক্ত নাকি বিভক্তি আরও বেশি, সে প্রসঙ্গে না গিয়েও বলা যায়, দলের মধ্যেই রয়েছে শক্তিশালী প্রতিপক্ষ। আইভী পরাজিত হলে এই প্রতিপক্ষের নেতাদের মুখে হাসি ফুটে উঠতে পারে। নিজের নাক কেটে পরের যাত্রাভঙ্গ করার মতো পরিস্থিতি নারায়ণগঞ্জের আওয়ামী লীগে বিরাজমান। তাই আইভীর মূল লড়াইটা কিন্তু তাঁর বাড়ির ভেতরে। বিএনপি নেতা, নির্বাচনে স্বতন্ত্র প্রার্থী তৈমূর আলম খন্দকার আইভীর জন্য তখনই চ্যালেঞ্জ হয়ে উঠতে পারবেন, যখন আইভীর নিজের দলের মধ্যে দেখা দেবে তাঁর বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র।
বলে রাখা ভালো, আমাদের রাজনীতি যখন টাকার খেলায় পরিণত হতে শুরু করেছিল, সংসদে যখন সত্যিকার রাজনীতিবিদ, সুবক্তা, আইনজীবীর সংখ্যা কমে গিয়ে আদর্শহীন পয়সাওয়ালাদের দাপট দেখা যেতে শুরু করেছিল, মনোনয়ন-বাণিজ্য যখন গ্রাস করছিল রাজনীতিকে, সে সময় থেকেই রাজনীতি নিয়ে জনগণ বা আমজনতার স্বপ্ন ক্রমেই বিলীয়মান। জনগণ এখন বোঝে, দলমত-নির্বিশেষে সবখানেই আদর্শের জায়গা দখল করে নিয়েছে অর্থ। শুধু কি রাজনীতিতে? ব্যবসা-বাণিজ্য, সংস্কৃতি, শিল্প, সাংবাদিকতা, চিকিৎসা—সর্বত্রই টাকা হয়ে উঠেছে ঈশ্বর। এ রকম ভয়াবহ পরিস্থিতিতে স্থানীয় রাজনীতিতে বল প্রয়োগ না করে শুধু কাজের মাধ্যমে টিকে থাকা খুবই কষ্টকর ব্যাপার। ফলে বাংলাদেশের নির্বাচনী প্রতিষ্ঠানটির নড়বড়ে অবস্থায় হতাশ মানুষও কিন্তু চোখ রাখছে নারায়ণগঞ্জের সিটি করপোরেশনের নির্বাচনের দিকে। এখানে যে ‘খেলা’টি হবে, তার চিত্রনাট্য কোথায় লেখা হচ্ছে, কীভাবে লেখা হচ্ছে, তার ওপর নির্ভর করবে খেলাটি কতটা জমবে। এই চিত্রনাট্যে জনগণের ভূমিকা মুখ্য হয়ে উঠতে পারে, অন্য নির্বাচনগুলোয় কখনো কখনো যার ঘাটতি থাকে।
ছয়. বাজার অর্থনীতি আর করপোরেট যুগে জীবনের মূল্যবোধগুলোয় যে যান্ত্রিকতা এসেছে, তাতে ‘মানুষ মানুষের জন্যে’ কথাটির সঙ্গে জীবনের সম্পর্ক আর তেমনভাবে থাকছে না। রাজনীতিতে আদর্শের চেয়ে অর্থকড়ি অনেক বেশি প্রাধান্য পেতে শুরু করায় লোভী মন কি সততার মূল্যায়ন করবে, নাকি স্বার্থের মূল্যায়ন করবে, সেটা এখন কোটি টাকার প্রশ্ন। দেশপ্রেম বা জাতীয়তাবোধের মাধ্যমে আন্তর্জাতিকতাবোধে উত্তীর্ণ হওয়ার জন্য তো মনভূমি কর্ষণের দরকার আছে। সেটা যদি না হয়, তাহলে কি শুধু ফাঁকা বুলি আর লোকদেখানো স্তুতিতে দেশের কোনো ইতিবাচক পরিবর্তন আসে?
তারপরও কেউ কেউ মানুষের কল্যাণের প্রতি একনিষ্ঠ থাকে। সেটাই হয়ে যায় তাদের জীবনের অংশ। তখন ক্ষমতা আর ক্ষমতার বাইরে বলে আলাদা কিছু থাকে না।
দীর্ঘদিন ক্ষমতায় থাকার পরও জনগণের সঙ্গে সম্পর্কটা প্রগাঢ় থাকতে পারে কি না, তার জবাব দিতে পারে নারায়ণগঞ্জ। এটা হয়ে উঠতে পারে সত্যিকারের রাজনীতির এক অ্যাসিড টেস্ট।
জাহীদ রেজা নূর: উপসম্পাদক, আজকের পত্রিকা
আরও পড়ুন:
ঝড়-জলোচ্ছ্বাস থেকে রক্ষায় সন্দ্বীপের ব্লক বেড়িবাঁধসহ একাধিক প্রকল্প হাতে নিয়েছে সরকার। এ লক্ষ্যে বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে ৫৬২ কোটি টাকা। এ জন্য টেন্ডারও হয়েছে। প্রায় এক বছর পেরিয়ে গেলেও ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানগুলো কাজ শুরু করছে না। পানি উন্নয়ন বোর্ডের (পাউবো) তাগাদায়ও কোনো কাজ হচ্ছে না বলে জানিয়েছেন...
৪ দিন আগেদেশের পরিবহন খাতের অন্যতম নিয়ন্ত্রণকারী ঢাকা সড়ক পরিবহন মালিক সমিতির কমিটির বৈধতা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। সাইফুল আলমের নেতৃত্বাধীন এ কমিটিকে নিবন্ধন দেয়নি শ্রম অধিদপ্তর। তবে এটি কার্যক্রম চালাচ্ছে। কমিটির নেতারা অংশ নিচ্ছেন ঢাকা পরিবহন সমন্বয় কর্তৃপক্ষ (ডিটিসিএ) ও বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষের...
৪ দিন আগেআলুর দাম নিয়ন্ত্রণে ব্যর্থ হয়ে এবার নিজেই বিক্রির উদ্যোগ নিয়েছে সরকার। বাজার স্থিতিশীল রাখতে ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশের (টিসিবি) মাধ্যমে রাজধানীতে ভ্রাম্যমাণ ট্রাকের মাধ্যমে ভর্তুকি মূল্যে আলু বিক্রি করা হবে। একজন গ্রাহক ৪০ টাকা দরে সর্বোচ্চ তিন কেজি আলু কিনতে পারবেন...
৪ দিন আগেসপ্তাহখানেক আগে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকে অনেকের ওয়াল বিষাদময় হয়ে উঠেছিল ফুলের মতো ছোট্ট শিশু মুনতাহাকে হত্যার ঘটনায়। ৫ বছর বয়সী সিলেটের এই শিশুকে অপহরণের পর হত্যা করে লাশ গুম করতে ডোবায় ফেলে রাখা হয়েছিল। প্রতিবেশী গৃহশিক্ষকের পরিকল্পনায় অপহরণের পর তাকে নির্মমভাবে হত্যা করা হয়...
৪ দিন আগে