চট্টগ্রামে নৈশপ্রহরী হত্যা: স্বীকারোক্তি দিয়েও অভিযোগপত্রে নেই

সোহেল মারমা, চট্টগ্রাম
প্রকাশ : ০৪ ফেব্রুয়ারি ২০২৪, ১০: ০৮

চট্টগ্রামের হালিশহরে নৈশপ্রহরী আজাদুর রহমান আজাদ হত্যা মামলায় শুরুতে প্যানেল মেয়রের ভাই ও স্বেচ্ছাসেবক লীগের নেতা আব্দুল মান্নান খোকনের সম্পৃক্ততার কথা বলেছিল র‍্যাব। তবে পুলিশের দেওয়া অভিযোগপত্রে তাঁকে আসামি করা হয়নি।

এ ছাড়া ওই হত্যাকাণ্ডের পরপরই র‍্যাবের অভিযানে এজাহারনামীয় পলাতক আসামিসহ চারজন গ্রেপ্তার হয়েছিলেন। তাঁরা হত্যায় জড়িত থাকার প্রাথমিক স্বীকারোক্তি দিয়েছেন বলে জানিয়েছিল র‍্যাব। তবে পুলিশের অভিযোগপত্রে তাঁদেরও আসামির নাম থেকে বাদ দেওয়া হয়েছে। গত বছর ২৭ মে রাতে হালিশহরের নয়াবাজার এলাকায় দায়িত্ব পালনকালে স্থানীয় কয়েকজনের সঙ্গে বাগ্‌বিতণ্ডা হয় নৈশপ্রহরী আজাদের। তখন তাঁকে হত্যার হুমকি দেওয়া হয়। পরদিন ২৮ মে ভোরে তাঁকে ছুরিকাঘাত করেন ওই দুর্বৃত্তরা। পরে হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় তিনি মারা যান। মৃত্যুর আগে আজাদ দুই হামলাকারীর নাম বলে যান। এর একটা ভিডিও ফেসবুকে ছড়িয়ে পড়ে।

ওই ঘটনায় নিহত আজাদের স্ত্রী পাহাড়তলী থানায় চারজনের নামে ও অজ্ঞাতনামা কয়েকজনকে আসামি করে একটি হত্যা মামলা করেন। আসামিরা সবাই চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের প্যানেল মেয়র ও রামপুরা ওয়ার্ডের কাউন্সিলর আব্দুস সবুর লিটন এবং তাঁর ছোট ভাই স্বেচ্ছাসেবক লীগের নেতা আব্দুল মান্নান খোকনের অনুসারী হিসেবে পরিচিত।

মামলার তদন্ত কর্মকর্তা নগর গোয়েন্দা পুলিশের পরিদর্শক (ইন্সপেক্টর) রমিজ আহমদ গত বছর ১৯ নভেম্বর আদালতে অভিযোগপত্র জমা দেন। এর একটি অনুলিপি সংগ্রহ করে আসামি নিয়ে ওই অসংগতি পাওয়া গেছে।

অভিযোগপত্রে আসামি করা হয় মো. ওসমান (৩৫), আবুল হাসান রাজু (৩৫), সিরাজুল ইসলাম টনি (৩৮) ও আব্দুল করিম ফাহিম (২২) নামে চারজনকে। তাঁদের মধ্যে আব্দুল করিম পলাতক। বাকি তিনজনের মধ্যে দুজন ভারতে পালানোর সময় গত বছর ৪ জুন গ্রেপ্তার হন গোয়েন্দা পুলিশের হাতে। আরেকজন গত ১৪ জুন গ্রেপ্তার হন।

তবে আগে গ্রেপ্তার হওয়া আবু তাহের রাজীব (২৫), ফয়সাল আহম্মদ চৌধুরী (২৬), আবুল হাসান রানা (৩০), রায়হান সজিব (২৩) ও দেলোয়ার হোসেন (২৪)—এই পাঁচজনকে অব্যাহতি দেওয়ার আবেদন করেন তদন্তকারী কর্মকর্তা। এদের মধ্যে আবু তাহের রাজীব ও ফয়সাল আহম্মদ চৌধুরী মামলার এজাহারনামীয় আসামি। গত বছর ২৯ মে খুনের ঘটনার পর পলাতক থাকা এই দুজনসহ চার আসামিকে রাঙামাটির একটি আবাসিক হোটেল থেকে গ্রেপ্তার করেছিল র‍্যাব-৭। ওই সময় র‍্যাবের বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়েছিল, গ্রেপ্তার করা ব্যক্তিরা সরাসরি ওই খুনে জড়িত ছিলেন বলে র‍্যাবের কাছে প্রাথমিক স্বীকারোক্তি দিয়েছেন।

এ ছাড়া খুনের ঘটনার আগে ও পরে আসামিরা প্যানেল মেয়রের ছোট ভাই স্বেচ্ছাসেবক লীগের নেতা আব্দুল মান্নান খোকনের বাসায় অবস্থান করছিলেন বলে নিশ্চিত করে গোয়েন্দা পুলিশও। আব্দুল মান্নান খোকনকে তখন গ্রেপ্তারের চেষ্টাও চালিয়েছিল তারা।

তবে পুলিশের অভিযোগপত্রে সেই প্যানেল মেয়রের ভাই এবং প্রাথমিক স্বীকারোক্তি দেওয়া চার আসামির বিরুদ্ধে কোনো সাক্ষ্য-প্রমাণ পাওয়া যায়নি বলে উল্লেখ করা হয়। এমনকি অভিযোগপত্রে আব্দুল মান্নান খোকনের বিষয়ে কিছুই বলা হয়নি।

জানতে চাইলে মামলার তদন্ত কর্মকর্তা গোয়েন্দা পুলিশের পরিদর্শক রমিজ আহমদ আদালতে অভিযোগপত্র জমা দেওয়ার বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন। তবে তিনি এই বিষয়ে বিস্তারিত কোনো মন্তব্য করতে রাজি হননি।

মামলাটির তদন্ত সংস্থা নগর গোয়েন্দা পুলিশের উপকমিশনার (বন্দর ও পশ্চিম) মো. আলী হোসেন আজকের পত্রিকাকে বলেন, খুনিরা হত্যাকাণ্ডের আগে ও পরে কাউন্সিলরের ভাই খোকনের বাসায় গিয়েছিলেন। এটা সত্য। মূলত পূর্বপরিচিত হওয়ায় বিভিন্ন সময় তাঁর ওই বাসায় যাওয়া-আসা করতেন। ঘটনাক্রমে খুনের ঘটনার পরও আসামিরা তাঁর বাসায় গিয়েছিলেন। কিন্তু এই খুনের ঘটনার সঙ্গে আব্দুল মান্নান খোকনের কোনো সম্পৃক্ততা পাওয়া যায়নি। তিনি এই বিষয়ে কিছু জানতেন না। এই মামলায় উনার বিরুদ্ধে কোনো সাক্ষ্য-প্রমাণ পাওয়া যায়নি।

উপকমিশনার বলেন, যাঁদের সম্পৃক্ততা পাওয়া গেছে, তাঁদের আসামি করে অভিযোগপত্র জমা দেওয়া হয়েছে।

মামলার পাঁচ নম্বর সাক্ষী, নিহত আজাদের বড় ভাই মো. রহমান আজকের পত্রিকাকে বলেন, ‘চার্জশিট যেটা দেওয়া হয়েছে, সেখানে আমাদের কয়েকজন আসামি বাদ দেওয়া হয়েছে। ঘটনায় সময় কাউন্সিলর লিটনের ভাইসহ অনেকের নাম উঠে এসেছিল। কিন্তু তাঁদের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেয়নি। আমরা এটা আল্লাহর ওপর ছেড়ে দিয়েছি।’

মো. রহমান বলেন, ‘সবচেয়ে বড় কথা, এই ঘটনায় আমাদের পরিবারের ক্ষতি হয়েছে। উল্টো এখন আমাদের বিভিন্নভাবে হয়রানি করা হচ্ছে। আসামিরা সবাই জামিনে বেরিয়েছে। জামিনে বেরিয়ে আমার ছেলে ও ভাইদের বিভিন্ন রকমের হুমকি দেওয়া হচ্ছে। আজাদের স্ত্রীকেও মামলা তুলে নিতে হুমকি দেওয়া হয়েছিল। এটা নিয়ে জিডি করা হয়েছে।’

মো. রহমান জানান, চার্জশিট কবে জমা দিয়েছে, সেটা তাঁরা জানেন না। তবে মামলার তদন্ত কর্মকর্তা এসে একটা নোটিশ দেবেন বলে আজাদের স্ত্রীর কাছ থেকে সই নিয়ে গিয়েছিলেন।

আজাদের স্ত্রী গুরুতর অসুস্থও বলে জানান তিনি। মামলার বাদী, নিহতের স্ত্রী নাজমা আক্তারের কাছে চার্জশিটের বিষয়ে জানতে চাইলে বলেন, ‘আমি এখন অসুস্থ। কথা বলতে পারছি না।’

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
খুঁজুন

সম্পর্কিত