প্রশান্তির জন্য মেডিটেশন

আবুল বাশার খান
আপডেট : ২১ মে ২০২৪, ১১: ০৯
Thumbnail image

অধ্যাপক, ইকোনমিকস অ্যান্ড সোসিওলজি বিভাগ, পটুয়াখালী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় সারা বিশ্বের মতো বাংলাদেশে ২১ মে বিশ্ব মেডিটেশন দিবস পালন করা হয়। ১৯৯৫ সাল থেকে দিবসটি পালিত হয়ে আসছে। দিবসটি উপলক্ষে স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন কোয়ান্টাম ফাউন্ডেশন প্রতিবছর বিভিন্ন এলাকার উন্মুক্ত স্থানে প্রাণায়াম বা দমচর্চা, প্রত্যয়ন পাঠ ও মেডিটেশন চর্চার আয়োজন করে। দুই বছর ধরে বাংলাদেশ ও বিশ্বের বিভিন্ন দেশে এই ফাউন্ডেশনের উদ্যোগে আনুষ্ঠানিকভাবে পালিত হচ্ছে দিনটি।

বিশ্বের বিভিন্ন দেশের চিকিৎসকেরা এখন মেডিটেশনের দিকে আগ্রহী হয়ে উঠছেন। কারণ এতে করে তাঁরা আগের তুলনায় (মানে মেডিটেশন না করার সময়ের চেয়ে এটা করার পর থেকে) রোগীদের প্রতি মনোযোগ বেশি দিতে পারেন। এটা বিভিন্ন জরিপের ফল থেকে জানা গেছে।

প্রফেসর ডা. স্টিভেন লরিস নিউরোসায়েন্স গবেষণায় বর্তমান বিশ্বে নেতৃস্থানীয় গবেষকদের একজন। ব্যক্তিজীবনে তিনি খুব সংকটময় একটা সময়ে মেডিটেশন ও ইয়োগাচর্চা শুরু করেছিলেন। একসময় সফলভাবে তিনি মানসিক বৈকল্য কাটিয়ে ওঠেন। ২০২১ সালে প্রকাশিত তাঁর লিখিত ‘দ্য নো-ননসেন্স মেডিটেশন বুক: অ্যা সায়েন্টিস্ট’স গাইড টু দ্য পাওয়ার অব মেডিটেশন’ বইয়ে তিনি বলেন, ‘প্রতিদিন ভোর সাড়ে ৫টায় আমি ঘুম থেকে উঠি। এরপর ইয়োগা করি এবং এক ঘণ্টা মেডিটেশন করি। এটি সুনিশ্চিতভাবেই স্ট্রেস কমায়। মেডিটেশন হতে পারে পাশ্চাত্যের আধুনিক চিকিৎসাব্যবস্থার পরিপূরক।’

‘একবার মৃত্যুপথযাত্রী এক শিশুকে দেখতে হাসপাতালে গিয়েছি। বুঝতে পারলাম, বছর পেরোনোর আগেই হয়তো শিশুটির মাকে তাঁর সন্তানের মৃত্যুর সংবাদটা জানাতে হবে। উপলব্ধি করলাম, এই পরিস্থিতি সামাল দেওয়ার জন্য আমি এখনো প্রস্তুত নই। মেডিকেল স্কুলগুলো আমাদের চিকিৎসক হিসেবে দক্ষ করে তুলেছে। কিন্তু শেখায়নি কীভাবে আমরা হারানোর বেদনা, ভুলভ্রান্তি আর পরাজয়ের মুহূর্তগুলোকে মোকাবিলা করব। ফলে শোক আর অনিশ্চয়তা কখনো কখনো সুনামির মতো ভর করে। দিনে ১২-১৪ ঘণ্টা হাসপাতালে কাজের পর স্থির থাকাও কঠিন। তাই মানসিক স্থিরতার জন্য চিকিৎসকদের মেডিটেশনচর্চা প্রয়োজন।’

এ কথাগুলো বলেছেন প্রফেসর ডা. ডেভিড আর স্যান্ডওয়েস। তিনি যুক্তরাষ্ট্রের ইউনিভার্সিটি অব ইউটাহ হেলথের শিশুরোগ বিশেষজ্ঞ। ২০১৮ থেকে তিনি মাইন্ডফুলনেস নিয়ে নানাবিধ কার্যক্রমে জড়িত।

ডিপ্রেশন নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের দ্য ফিজিশিয়ানস ফাউন্ডেশন ২০২৩ সালে একটি জরিপ চালায়। তাদের জরিপের ফল মতে, প্রায় প্রতি ১০ জন চিকিৎসকের মধ্যে ৬ জন বার্ন-আউট বা ক্ষোভে-অবসাদে ফেটে পড়ার মতো অনুভূতিতে ভোগেন। ৭৫ শতাংশ মেডিকেলশিক্ষার্থী ভোগেন তীব্র বিষণ্নতায়। আর ৫৫ শতাংশ শিক্ষার্থী হতাশায় ভোগেন এবং জীবনের কোনো অর্থ খুঁজে পান না।

এ রকম একটি জরিপ বাংলাদেশেও হয়েছে। ২০২০ সালে প্রকাশিত দ্য অফিশিয়াল জার্নাল অব ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব মেন্টাল হেলথ ঢাকার একটি প্রবন্ধে বলা হয়, এ দেশের ৪০ দশমিক ৮ শতাংশ মেডিকেলশিক্ষার্থী ডিপ্রেশনে ভুগছেন।

যুক্তরাষ্ট্রের হার্ভার্ড হেলথ পাবলিশিংয়ের ২০২১ সালের ১২ ফেব্রুয়ারির রিপোর্ট অনুসারে, ডিপ্রেশনের কার্যকরী সমাধান হলো মেডিটেশন। ধ্যানী চিকিৎসকেরা রোগীদের প্রতি বেশি মনোযোগী থাকেন। ২০২০ সালে চীনে চিকিৎসক ও রোগীর সম্পর্ক নিয়ে একটি গবেষণা হয়।

এতে ১০৬ জন চিকিৎসককে দুটি গ্রুপে ভাগ করা হয়। একটি গ্রুপকে আট সপ্তাহ মেডিটেশন প্রোগ্রামে যুক্ত করা হয়। আরেকটি গ্রুপকে তাদের চিরাচরিত রুটিনেই জীবনযাপন করতে বলা হয়। দেখা গেছে, মেডিটেশন করার পর ধ্যানী চিকিৎসকেরা রোগীদের প্রতি সমমর্মী হয়ে উঠেছেন। রোগীর সঙ্গে কথোপকথনে তাঁরা আগের চেয়ে বেশি মনোযোগী মনোভাব দেখিয়েছেন। আর অন্য গ্রুপের চিকিৎসকেরা আগের মতো করেই তাঁদের দায়িত্ব পালন করেছেন। তাঁদের মধ্যে তেমন পরিবর্তন লক্ষ করা যায়নি।

যুক্তরাষ্ট্রের রচেস্টার স্কুল অব মেডিসিন অ্যান্ড ডেন্টিস্ট্রির প্যালিয়েটিভ কেয়ার বিশেষজ্ঞ, লেখক ও কমিউনিকেশন অ্যান্ড মাইন্ডফুল প্র্যাকটিস ইন মেডিসিনের শিক্ষক রোনাল্ড এম এপস্টেইন বলেন, ‘চিকিৎসক এবং চিকিৎসাপেশায় নিয়োজিতদের মধ্যে যাঁরা মেডিটেশন করেন, তাঁরা প্রতিদিনের প্রতিকূলতা সহজে সামাল দিতে পারেন। রোগীদের সঙ্গে কথা বলায় তাঁরা অধিক মনোযোগী। পেশাগত ত্রুটি শুধরে নিতে আন্তরিক এবং সিদ্ধান্ত গ্রহণেও তৎপর। পেশাগত চাপ তাঁদের ওপর কোনো নেতিবাচক প্রভাব ফেলতে পারে না।’
আমাদের দেশের চিকিৎসকদের প্রতি অনুরোধ থাকবে, সময় এসেছে নিজের দিকে তাকানোর—আপনি কি রোগী হওয়ার পর মেডিটেশন শুরু করতে চান? নাকি এখনই? সিদ্ধান্তটি আজই নিন।

পুরো বিশ্বের মতো আমাদের দেশেও দিন দিন মেডিটেশনের জনপ্রিয়তা বাড়ছে। পরিপূর্ণ সুস্থতার জন্য বিদ্যমান চিকিৎসার পাশাপাশি মেডিটেশন যে প্রয়োজন, সেই পরামর্শ এখন চিকিৎসকেরা দিচ্ছেন। স্বাস্থ্য অধিদপ্তর সম্প্রতি যোগ-মেডিটেশনকে স্বাস্থ্যসেবার পরিপূরক হিসেবে অন্তর্ভুক্ত করেছে।

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
খুঁজুন

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত