শাইখ সিরাজ
পাড়া-মহল্লায় জমে উঠছে কোরবানির হাট। আমি যখন এই লেখা লিখছি, তখন রাজধানীর বড় বড় হাট সাজানো শুরু হয়েছে। কোরবানি ঘিরে চাপাউত্তেজনা কাজ করছে সবার ভেতর। যদিও সপ্তাহখানেক আগে বন্যায় উত্তর-পূর্বাঞ্চল ও উত্তরাঞ্চলের কয়েকটি জেলায় বেশ ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। ওই অঞ্চলের কোরবানির পশু নিয়ে বিপাকে পড়েছেন খামারিরা।
ফলে এ বছর কোরবানির বাজার নিয়ে যথেষ্ট শঙ্কাও রয়েছে। তবে প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের তথ্য অনুযায়ী, এ বছর সারা দেশে ১ কোটি ২১ লাখ কোরবানির পশু প্রস্তুত আছে (যদিও পরিসংখ্যানটির নির্ভরযোগ্যতা নিয়ে আমার প্রশ্ন আছে)। গত বছর ঈদুল আজহায় সারা দেশে মোট ৯০ লাখ ৯৩ হাজার গবাদিপশু কোরবানি হয়েছিল। আমি কোরবানির বাজার সম্পর্কে খোঁজখবর নিয়ে জেনেছি ঈদের দিন যত এগিয়ে আসছে বাজার তত সচল হয়ে উঠছে। ঈদুল আজহা মানেই কোরবানির হাট। শৈশব থেকেই কোরবানির হাট নিয়ে আমাদের ছিল অন্য রকম উত্তেজনা। হাট থেকে কোরবানির গরু কেনা নিয়ে আমাদের সবারই নানা রকম অভিজ্ঞতা আছে। আজ আমার কোরবানির গরু কেনার একটি গল্প পাঠকদের বলতে চাই।
আমার চাকরিজীবী বাবা যখন প্রথম এসে বসতি গাড়েন খিলগাঁওয়ে, তখন খিলগাঁও ছিল ঘন অরণ্যে ঢাকা। গাছগাছালির সংখ্যা এত বেশি ছিল যে সূর্য পশ্চিম দিকে হেলে পড়তে না পড়তেই জমিনটা অন্ধকার হয়ে আসত। হরহামেশাই দিনের বেলায় শিয়াল ডাকত। বাবা যাঁর কাছ থেকে জমি কিনে বসতি গড়েছিলেন, তিনি ছিলেন ঢাকার আদি বাসিন্দা মোল্লা সাহেব। বাবা চাকরি করতেন সচিবালয়ে, খিলগাঁওয়ে বাসা করার পর তিনি তাঁর কয়েকজন সহকর্মীকেও খিলগাঁওয়ে বসতি করার জন্য প্রাণিত করেন। বলছি পাকিস্তান আমলের কথা। চাকরিজীবী মানুষ, সীমিত আয় দিয়েই পরিবার চালাতে হতো। তখনকার আর্থসামাজিক অবস্থাও আজকের মতো ছিল না। পরিবারগুলো ছিল আকারে বড়। একেকটি পরিবারে কমপক্ষে আট-দশজন করে সদস্য। একটা গরু কিনে কেউ দুই নাম, কেউবা এক নাম নিয়ে মহল্লার পাঁচ-সাতটি পরিবার এক হয়ে কোরবানি দিত। আমাদের শৈশবে বছরজুড়ে দুই ঈদই ছিল উৎসবের প্রধান উপলক্ষ; বিশেষ করে কোরবানির ঈদের আনন্দটা ছিল বেশি।
এ জন্যই হয়তো আমরা কোরবানির ঈদকে বড় ঈদ বলতাম। আনন্দের আর একটা কারণ ছিল কোরবানির হাট। গরু কেনার সময় বড়দের সঙ্গে গরুর হাটে যাওয়া ছিল দারুণ এক অ্যাডভেঞ্চার। আমরা ছোটরা দল বেঁধে অপেক্ষা করতাম হাটের জন্য। তারপর গরু কিনে নিয়ে আসার সময় পথচারী যখন দাম জানতে চাইত, ‘ভাই, কত নিল?’ তখন সবার আগে দাম বলে দেওয়ার প্রতিযোগিতা চলত। অন্যদের কেনা গরুর সঙ্গে নিজেদেরটারও তুলনা করতাম। যেকোনো মূল্যেই নিজেদেরটা যে সেরা, সেটা প্রমাণ করাই ছিল আনন্দের।
তারপর দেশ স্বাধীন হলো। স্বাধীন দেশের সবকিছুতেই আনন্দ বেশি। আমরাও বড় হতে থাকি। সময়ের সঙ্গে আনন্দের মাত্রাও পরিবর্তন হতে থাকে। আমরা চার ভাই তখন পড়াশোনার পাশাপাশি রোজগারপাতির সঙ্গে কিছুটা যুক্ত হলাম, সে সময় আমরা নিজেরাই সাত নাম নিয়ে কোরবানি দেওয়া শুরু করলাম। সেই সময়টাতেও কোরবানির গরু কিনতে আমরা হাটে যেতাম। বিভিন্ন হাট ঘুরে ঘুরে বাজেটের মাঝে সেরা গরুটা কেনার একটা প্রাণান্ত চেষ্টা ছিল। সে-ও ছিল এক অন্য রকম আনন্দের বিষয়। পড়াশোনা শেষ করে টেলিভিশনের পাশাপাশি আমার প্রথম ভেঞ্চার ছিল সানমুন ভিডিও। মগবাজার পেট্রলপাম্প লাগোয়া ছিল সানমুন ভিডিওর অফিস। বিয়েশাদির পাশাপাশি সে সময় বেসরকারি পর্যায়ে ভিডিও ডকুমেন্টারি নির্মাণে সানমুন, ইমপ্রেস ইত্যাদি খুব সুনাম অর্জন করেছিল। বলা চলে বেসরকারি পর্যায়ে টেলিভিশন পরিচালনার জন্য প্রাথমিক জনশক্তি তৈরি করতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা ছিল এই প্রতিষ্ঠানগুলোর। যা-ই হোক, তখনকার এক কোরবানির ঈদের কথা মনে হচ্ছে। ঈদের আগের দিন গরু কিনে বেঁধে রেখেছিলাম মগবাজারের সানমুন ভিডিওর সামনে তেলের পাম্পটির এক কোনায়।
রাতে বাসায় ফেরার সময় আমি আর আমার ছোট ভাই নজরুল দুজন মিলে গরুটাকে বাসায় নিয়ে যাচ্ছিলাম। খুব শান্তই চলছিল গরুটা। কিন্তু কী জানি কী হলো, মগবাজারের যে জায়গাটাতে বর্তমানে সেঞ্চুরি আর্কেড মার্কেট, তার সামনে এসে ফুটপাত থেকে নেমে মাঝ রাস্তায় গিয়ে গরুটি বসে পড়ল। ঈদের আগের দিন স্বভাবতই রাস্তাঘাটে প্রচুর গাড়ি-ঘোড়া। তারপর মৌচাক মার্কেট ছিল তখন ঢাকার সবচেয়ে জনপ্রিয় মার্কেট। আমরা গরুটাকে বসা থেকে ওঠানোর চেষ্টা করলাম। ওঠা তো দূরে থাক, বসা থেকে এবার সে শুয়ে পড়ল।
পুরোপুরি জ্যাম লেগে গেছে রাস্তায়। টেলিভিশনের ‘মাটি ও মানুষ’ অনুষ্ঠানের সুবাদে তখন আমি মোটামুটি পরিচিত মুখ। জ্যাম লেগে যাওয়ায় লোকজন এমনিই বিরক্ত, তার ওপর আবার কয়েকজন বলাবলি শুরু করল, ‘ওই দেখ, শাইখ সিরাজের গরু শুয়ে পড়ছে!’ আমরা দুই ভাই যারপরনাই লজ্জিত ও বিব্রত। দুয়েকজন রিকশাওয়ালা এসে আমাদের সাহায্য করলেন। গরুটিকে কোনোমতে টেনেটুনে তুলে আবার চলতে শুরু করলাম। কিন্তু কিছুটা এগোতেই বর্তমান উপপুলিশ কমিশনারের কার্যালয়ের সামনে এসে আবার গরুটা আগের মতো মাঝ রাস্তায় শুয়ে পড়ল। আমরা আবার টানাটানি শুরু করলাম। সেখানেও জ্যাম লেগে গেল। বিরক্ত হয়ে একজন বলল, ‘মরা গরু কিইনা আনচেন নিহি? আপনার গরু হুয়া (শুয়ে) পড়ল ক্যালা?’ জবাব দেওয়ার ফুরসত নেই। চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি গরুটাকে রাস্তা থেকে ফুটপাতে নিয়ে আসতে।
আমাদের সঙ্গে যুক্ত হলেন পথচারী ও রিকশাওয়ালা কয়েকজন। কিন্তু গরু তার নিজ মর্জিতে অটল, কিছুতেই পথ থেকে সে ওঠে না। কেউ কেউ বলল, ‘কান ধরে টানেন, উঠবে।’ টানলাম। কিন্তু উঠল না। কেউ বলল, ‘ভাই, লেজ ধরে টান দেন।’ লেজ ধরে টানলাম। কাজ হলো না। একজন বলল, ‘লেজে কামড় দেন।’ মনে মনে ভাবলাম এটা কি সম্ভব! সত্যি সত্যি এক রিকশাওয়ালা নেমে এসে গরুর লেজে কামড় বসিয়ে দিলেন। এতে গরুটি নড়েচড়ে উঠল ঠিকই, কিন্তু শুয়েই রইল। বুঝলাম সুযোগ নিয়ে মানুষ বেশ রসিকতা শুরু করেছে। পেছন থেকে একজন জোরে বললেন, ‘ভাই! ভাই! গরুর নাকে ভেজা কাপড় ধরলে উঠে দাঁড়াবেই।’ কোথায় পাব কাপড়! ছোট ভাইকে বললাম, তুই দড়ি ধরে দাঁড়া। আমি আসছি।
উপপুলিশ কমিশনার, রমনা বিভাগের অফিসের পাশের বাড়িতেই তিনতলায় থাকতেন সরকার ফিরোজ উদ্দীন। তিনি ছিলেন বাংলাদেশ টেলিভিশনের ট্রান্সমিশন কন্ট্রোলার। তাঁর স্ত্রী মাহমুদা ফিরোজ তখন টেলিভিশনের একজন জনপ্রিয় সংবাদ উপস্থাপিকা। এই পরিবারটার সঙ্গে খুব সখ্য ছিলাম। প্রায়ই এই বাসায় বসে আড্ডা দেওয়া হতো। ফিরোজ ভাই-মাহমুদা ভাবির মেয়ে সানজা, ছেলে ইমন আমার খুব আদরের। আফজাল-আমিসহ অনেক বন্ধু মিলে ওই বাসায় বহুবার আড্ডায় বসেছি। আমাদের সানমুন ভিডিওর একটা অংশে ছিল ভিডিও ক্যাসেট। সরকার ফিরোজ ভাইয়ের ভিসিআর ছিল। কাজ শেষে ক্যাসেট নিয়ে আসতাম ফিরোজ ভাইয়ের বাসায়। সবাই এসে জড়ো হলে সিনেমা দেখতে দেখতে আড্ডা জমত বেশ। সে সময়কার আলোচিত হিন্দি সিনেমা ‘মাসুম’, ‘দেহলিজ’, ‘উমরাও জান’, ‘সাদমা’, ‘দিওয়ার’ কত কত সিনেমা নিয়ে যে আড্ডা জমত আমাদের!
যা-ই হোক, গরু নিয়ে বিপদে পড়ে দৌড়ে গেলাম ফিরোজ ভাইয়ের বাসায়। নক করতেই মাহমুদা ভাবি দরজা খুললেন। অসময়ে আমাকে দেখে চমকে উঠলেন। আমি বললাম, ভাবি, একটা গামছা পানিতে ভিজিয়ে দেন। উনি আতঙ্কিত হলেন। ভাবলেন, আমাদের কোনো ইনজুরি হলো কি না! জানতে চাইলেন, ‘ভেজা গামছা দিয়ে কী করবা সিরাজ?’ বললাম, ‘ঘটনা পরে বলব ভাবি; আগে একটা গামছা ভিজিয়ে দেন।’ তিনি একটা ভেজা টাওয়েল দিলেন।
টাওয়েল নিয়ে দৌড়ে নেমে এলাম। ততক্ষণে রাস্তায় ট্রাফিক আরও বেড়ে গেছে। রাস্তার মাঝখানে গরু নিয়ে নজরুলকে দেখতে পাচ্ছি না। আরও বিব্রত হলাম। কয়েকটা রিকশা ডিঙিয়ে দেখি নজরুল রাস্তার মাঝখানে গরু নিয়ে বসে আছে। অনেক চেষ্টা করে ভেজা টাওয়েলটি গরুর নাকে চেপে ধরতেই শুয়ে থাকা গরুটি এক লাফে দাঁড়িয়ে রিকাশা-ভ্যান ঠেলেঠুলে ফেলে মৌচাকের দিকে দিল দৌড়। পথচারীরাও ভয়ে কেউ কেউ দৌড় দিল। পেছনে পেছনে আমরা ছুট দিলাম। গরুর পেছনে আমাদের দৌড়াতে দেখে লোকজন হাসি-তামাশাও করছে। দৌড়াতে দৌড়াতে মৌচাকের উল্টো পাশে ফুজিকালার ল্যাব পর্যন্ত আসলাম। আর দৌড়াতে পারছিলাম না।
আমাদের সঙ্গে আরও কয়েকজন দৌড়াচ্ছে গরু ধরতে। যারা বাজার থেকে গরু বাড়িতে পৌঁছে দেয়—এমন কয়েকজন বলল, ‘ভাই, আমাদের টাকা দিলে গরুটা আমরা ধরে দেব।’ জানতে চাইলাম কত টাকা লাগবে গরু ধরে বাড়ি পৌঁছে দিতে। বলল, দুই হাজার টাকা। তখন দুই হাজার মানে অনেক টাকা। বিস্মিত হয়ে বললাম, এত টাকা! বলল, ‘গরু গেলে তো আপনার ষাট-সত্তর হাজার টাকা যাইব গা।’ দৌড়াতে দৌড়াতে দর-কষাকষি করে শেষে বাধ্য হয়ে এক হাজার টাকায় দুই রাখালকে গরু ধরে বাড়ি পৌঁছে দেওয়ার জন্য ঠিক করলাম। তাঁরা দৌড়ে রাজারবাগের গ্রিনলাইনের যে কাউন্টারটা এখন আছে, তার একটু আগে এসে গরুটি ধরতে পারল। তারপর গরু নিয়ে শাহজাহানপুরের ভেতর দিয়ে বাসায় ফিরলাম। আর ওটাই ছিল আমার জীবনে শেষবার হাটে গিয়ে গরু কেনা।
বলছিলাম কোরবানিকে ঘিরে আমাদের পশুসম্পদের বাজারের কথা। সময়ের সঙ্গে কোরবানির পশুর চাহিদা বাড়ছে, বাজার বড় হচ্ছে। গত দুই কোরবানি ছিল একেবারেই ভিন্ন রকম। করোনার ভেতর ঈদের আনন্দের চেয়ে শঙ্কা ছিল বেশি। দিনে দিনে পাল্টেছে বাজারের ধারণা। সেই সঙ্গে পাল্টেছে গরু বাজারজাতকরণ প্রক্রিয়াও। কোরবানি সামনে রেখে প্রতিবছরই ছোট-বড় অসংখ্য গরুর খামার গড়ে উঠছে। প্রতিবছরই খামারের সংখ্যা বাড়ছে। পরিবর্তন এসেছে ভোক্তা ও খামারিদের ভাবনার মধ্যেও। সেই অনুপাতে বাড়ছে বাজারের সংখ্যা।
এবার ঢাকাসহ সারা দেশে ৪ হাজার ৪০৭টি পশুর হাট বসছে। সবচেয়ে বড় কথা, অনলাইনভিত্তিক গরুর বাজার তৈরি হয়েছে। গত বছর অনলাইনে কোরবানির সাড়ে তিন লাখ পশু বিক্রি হয়। এই সংখ্যাটাও এ বছর হয়তো বাড়বে। এখন অনলাইনে বা মহল্লার খামার থেকে কেনা গরু বাড়ি নিয়ে আসায় ঝক্কি নেই। বিক্রেতাই পিকআপ ভ্যানে করে গরু বাড়িতে পৌঁছে দেন।
সবকিছুই সহজ হয়ে উঠছে। এখনকার শিশু-কিশোরদের মনে কোরবানির বাজার নিয়ে রচিত হচ্ছে অন্য রকমের গল্প। আগামী প্রজন্মও হয়তো আরও বেশি পাল্টে দেবে বাজারব্যবস্থা। তবে কোরবানির যে উদ্দেশ্য, তা যেন অটুট থাকে। অটুট থাকুক মানুষের সঙ্গে মানুষের সম্পর্কের বন্ধন। সবাইকে ঈদের আগাম শুভেচ্ছা।
পাড়া-মহল্লায় জমে উঠছে কোরবানির হাট। আমি যখন এই লেখা লিখছি, তখন রাজধানীর বড় বড় হাট সাজানো শুরু হয়েছে। কোরবানি ঘিরে চাপাউত্তেজনা কাজ করছে সবার ভেতর। যদিও সপ্তাহখানেক আগে বন্যায় উত্তর-পূর্বাঞ্চল ও উত্তরাঞ্চলের কয়েকটি জেলায় বেশ ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। ওই অঞ্চলের কোরবানির পশু নিয়ে বিপাকে পড়েছেন খামারিরা।
ফলে এ বছর কোরবানির বাজার নিয়ে যথেষ্ট শঙ্কাও রয়েছে। তবে প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের তথ্য অনুযায়ী, এ বছর সারা দেশে ১ কোটি ২১ লাখ কোরবানির পশু প্রস্তুত আছে (যদিও পরিসংখ্যানটির নির্ভরযোগ্যতা নিয়ে আমার প্রশ্ন আছে)। গত বছর ঈদুল আজহায় সারা দেশে মোট ৯০ লাখ ৯৩ হাজার গবাদিপশু কোরবানি হয়েছিল। আমি কোরবানির বাজার সম্পর্কে খোঁজখবর নিয়ে জেনেছি ঈদের দিন যত এগিয়ে আসছে বাজার তত সচল হয়ে উঠছে। ঈদুল আজহা মানেই কোরবানির হাট। শৈশব থেকেই কোরবানির হাট নিয়ে আমাদের ছিল অন্য রকম উত্তেজনা। হাট থেকে কোরবানির গরু কেনা নিয়ে আমাদের সবারই নানা রকম অভিজ্ঞতা আছে। আজ আমার কোরবানির গরু কেনার একটি গল্প পাঠকদের বলতে চাই।
আমার চাকরিজীবী বাবা যখন প্রথম এসে বসতি গাড়েন খিলগাঁওয়ে, তখন খিলগাঁও ছিল ঘন অরণ্যে ঢাকা। গাছগাছালির সংখ্যা এত বেশি ছিল যে সূর্য পশ্চিম দিকে হেলে পড়তে না পড়তেই জমিনটা অন্ধকার হয়ে আসত। হরহামেশাই দিনের বেলায় শিয়াল ডাকত। বাবা যাঁর কাছ থেকে জমি কিনে বসতি গড়েছিলেন, তিনি ছিলেন ঢাকার আদি বাসিন্দা মোল্লা সাহেব। বাবা চাকরি করতেন সচিবালয়ে, খিলগাঁওয়ে বাসা করার পর তিনি তাঁর কয়েকজন সহকর্মীকেও খিলগাঁওয়ে বসতি করার জন্য প্রাণিত করেন। বলছি পাকিস্তান আমলের কথা। চাকরিজীবী মানুষ, সীমিত আয় দিয়েই পরিবার চালাতে হতো। তখনকার আর্থসামাজিক অবস্থাও আজকের মতো ছিল না। পরিবারগুলো ছিল আকারে বড়। একেকটি পরিবারে কমপক্ষে আট-দশজন করে সদস্য। একটা গরু কিনে কেউ দুই নাম, কেউবা এক নাম নিয়ে মহল্লার পাঁচ-সাতটি পরিবার এক হয়ে কোরবানি দিত। আমাদের শৈশবে বছরজুড়ে দুই ঈদই ছিল উৎসবের প্রধান উপলক্ষ; বিশেষ করে কোরবানির ঈদের আনন্দটা ছিল বেশি।
এ জন্যই হয়তো আমরা কোরবানির ঈদকে বড় ঈদ বলতাম। আনন্দের আর একটা কারণ ছিল কোরবানির হাট। গরু কেনার সময় বড়দের সঙ্গে গরুর হাটে যাওয়া ছিল দারুণ এক অ্যাডভেঞ্চার। আমরা ছোটরা দল বেঁধে অপেক্ষা করতাম হাটের জন্য। তারপর গরু কিনে নিয়ে আসার সময় পথচারী যখন দাম জানতে চাইত, ‘ভাই, কত নিল?’ তখন সবার আগে দাম বলে দেওয়ার প্রতিযোগিতা চলত। অন্যদের কেনা গরুর সঙ্গে নিজেদেরটারও তুলনা করতাম। যেকোনো মূল্যেই নিজেদেরটা যে সেরা, সেটা প্রমাণ করাই ছিল আনন্দের।
তারপর দেশ স্বাধীন হলো। স্বাধীন দেশের সবকিছুতেই আনন্দ বেশি। আমরাও বড় হতে থাকি। সময়ের সঙ্গে আনন্দের মাত্রাও পরিবর্তন হতে থাকে। আমরা চার ভাই তখন পড়াশোনার পাশাপাশি রোজগারপাতির সঙ্গে কিছুটা যুক্ত হলাম, সে সময় আমরা নিজেরাই সাত নাম নিয়ে কোরবানি দেওয়া শুরু করলাম। সেই সময়টাতেও কোরবানির গরু কিনতে আমরা হাটে যেতাম। বিভিন্ন হাট ঘুরে ঘুরে বাজেটের মাঝে সেরা গরুটা কেনার একটা প্রাণান্ত চেষ্টা ছিল। সে-ও ছিল এক অন্য রকম আনন্দের বিষয়। পড়াশোনা শেষ করে টেলিভিশনের পাশাপাশি আমার প্রথম ভেঞ্চার ছিল সানমুন ভিডিও। মগবাজার পেট্রলপাম্প লাগোয়া ছিল সানমুন ভিডিওর অফিস। বিয়েশাদির পাশাপাশি সে সময় বেসরকারি পর্যায়ে ভিডিও ডকুমেন্টারি নির্মাণে সানমুন, ইমপ্রেস ইত্যাদি খুব সুনাম অর্জন করেছিল। বলা চলে বেসরকারি পর্যায়ে টেলিভিশন পরিচালনার জন্য প্রাথমিক জনশক্তি তৈরি করতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা ছিল এই প্রতিষ্ঠানগুলোর। যা-ই হোক, তখনকার এক কোরবানির ঈদের কথা মনে হচ্ছে। ঈদের আগের দিন গরু কিনে বেঁধে রেখেছিলাম মগবাজারের সানমুন ভিডিওর সামনে তেলের পাম্পটির এক কোনায়।
রাতে বাসায় ফেরার সময় আমি আর আমার ছোট ভাই নজরুল দুজন মিলে গরুটাকে বাসায় নিয়ে যাচ্ছিলাম। খুব শান্তই চলছিল গরুটা। কিন্তু কী জানি কী হলো, মগবাজারের যে জায়গাটাতে বর্তমানে সেঞ্চুরি আর্কেড মার্কেট, তার সামনে এসে ফুটপাত থেকে নেমে মাঝ রাস্তায় গিয়ে গরুটি বসে পড়ল। ঈদের আগের দিন স্বভাবতই রাস্তাঘাটে প্রচুর গাড়ি-ঘোড়া। তারপর মৌচাক মার্কেট ছিল তখন ঢাকার সবচেয়ে জনপ্রিয় মার্কেট। আমরা গরুটাকে বসা থেকে ওঠানোর চেষ্টা করলাম। ওঠা তো দূরে থাক, বসা থেকে এবার সে শুয়ে পড়ল।
পুরোপুরি জ্যাম লেগে গেছে রাস্তায়। টেলিভিশনের ‘মাটি ও মানুষ’ অনুষ্ঠানের সুবাদে তখন আমি মোটামুটি পরিচিত মুখ। জ্যাম লেগে যাওয়ায় লোকজন এমনিই বিরক্ত, তার ওপর আবার কয়েকজন বলাবলি শুরু করল, ‘ওই দেখ, শাইখ সিরাজের গরু শুয়ে পড়ছে!’ আমরা দুই ভাই যারপরনাই লজ্জিত ও বিব্রত। দুয়েকজন রিকশাওয়ালা এসে আমাদের সাহায্য করলেন। গরুটিকে কোনোমতে টেনেটুনে তুলে আবার চলতে শুরু করলাম। কিন্তু কিছুটা এগোতেই বর্তমান উপপুলিশ কমিশনারের কার্যালয়ের সামনে এসে আবার গরুটা আগের মতো মাঝ রাস্তায় শুয়ে পড়ল। আমরা আবার টানাটানি শুরু করলাম। সেখানেও জ্যাম লেগে গেল। বিরক্ত হয়ে একজন বলল, ‘মরা গরু কিইনা আনচেন নিহি? আপনার গরু হুয়া (শুয়ে) পড়ল ক্যালা?’ জবাব দেওয়ার ফুরসত নেই। চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি গরুটাকে রাস্তা থেকে ফুটপাতে নিয়ে আসতে।
আমাদের সঙ্গে যুক্ত হলেন পথচারী ও রিকশাওয়ালা কয়েকজন। কিন্তু গরু তার নিজ মর্জিতে অটল, কিছুতেই পথ থেকে সে ওঠে না। কেউ কেউ বলল, ‘কান ধরে টানেন, উঠবে।’ টানলাম। কিন্তু উঠল না। কেউ বলল, ‘ভাই, লেজ ধরে টান দেন।’ লেজ ধরে টানলাম। কাজ হলো না। একজন বলল, ‘লেজে কামড় দেন।’ মনে মনে ভাবলাম এটা কি সম্ভব! সত্যি সত্যি এক রিকশাওয়ালা নেমে এসে গরুর লেজে কামড় বসিয়ে দিলেন। এতে গরুটি নড়েচড়ে উঠল ঠিকই, কিন্তু শুয়েই রইল। বুঝলাম সুযোগ নিয়ে মানুষ বেশ রসিকতা শুরু করেছে। পেছন থেকে একজন জোরে বললেন, ‘ভাই! ভাই! গরুর নাকে ভেজা কাপড় ধরলে উঠে দাঁড়াবেই।’ কোথায় পাব কাপড়! ছোট ভাইকে বললাম, তুই দড়ি ধরে দাঁড়া। আমি আসছি।
উপপুলিশ কমিশনার, রমনা বিভাগের অফিসের পাশের বাড়িতেই তিনতলায় থাকতেন সরকার ফিরোজ উদ্দীন। তিনি ছিলেন বাংলাদেশ টেলিভিশনের ট্রান্সমিশন কন্ট্রোলার। তাঁর স্ত্রী মাহমুদা ফিরোজ তখন টেলিভিশনের একজন জনপ্রিয় সংবাদ উপস্থাপিকা। এই পরিবারটার সঙ্গে খুব সখ্য ছিলাম। প্রায়ই এই বাসায় বসে আড্ডা দেওয়া হতো। ফিরোজ ভাই-মাহমুদা ভাবির মেয়ে সানজা, ছেলে ইমন আমার খুব আদরের। আফজাল-আমিসহ অনেক বন্ধু মিলে ওই বাসায় বহুবার আড্ডায় বসেছি। আমাদের সানমুন ভিডিওর একটা অংশে ছিল ভিডিও ক্যাসেট। সরকার ফিরোজ ভাইয়ের ভিসিআর ছিল। কাজ শেষে ক্যাসেট নিয়ে আসতাম ফিরোজ ভাইয়ের বাসায়। সবাই এসে জড়ো হলে সিনেমা দেখতে দেখতে আড্ডা জমত বেশ। সে সময়কার আলোচিত হিন্দি সিনেমা ‘মাসুম’, ‘দেহলিজ’, ‘উমরাও জান’, ‘সাদমা’, ‘দিওয়ার’ কত কত সিনেমা নিয়ে যে আড্ডা জমত আমাদের!
যা-ই হোক, গরু নিয়ে বিপদে পড়ে দৌড়ে গেলাম ফিরোজ ভাইয়ের বাসায়। নক করতেই মাহমুদা ভাবি দরজা খুললেন। অসময়ে আমাকে দেখে চমকে উঠলেন। আমি বললাম, ভাবি, একটা গামছা পানিতে ভিজিয়ে দেন। উনি আতঙ্কিত হলেন। ভাবলেন, আমাদের কোনো ইনজুরি হলো কি না! জানতে চাইলেন, ‘ভেজা গামছা দিয়ে কী করবা সিরাজ?’ বললাম, ‘ঘটনা পরে বলব ভাবি; আগে একটা গামছা ভিজিয়ে দেন।’ তিনি একটা ভেজা টাওয়েল দিলেন।
টাওয়েল নিয়ে দৌড়ে নেমে এলাম। ততক্ষণে রাস্তায় ট্রাফিক আরও বেড়ে গেছে। রাস্তার মাঝখানে গরু নিয়ে নজরুলকে দেখতে পাচ্ছি না। আরও বিব্রত হলাম। কয়েকটা রিকশা ডিঙিয়ে দেখি নজরুল রাস্তার মাঝখানে গরু নিয়ে বসে আছে। অনেক চেষ্টা করে ভেজা টাওয়েলটি গরুর নাকে চেপে ধরতেই শুয়ে থাকা গরুটি এক লাফে দাঁড়িয়ে রিকাশা-ভ্যান ঠেলেঠুলে ফেলে মৌচাকের দিকে দিল দৌড়। পথচারীরাও ভয়ে কেউ কেউ দৌড় দিল। পেছনে পেছনে আমরা ছুট দিলাম। গরুর পেছনে আমাদের দৌড়াতে দেখে লোকজন হাসি-তামাশাও করছে। দৌড়াতে দৌড়াতে মৌচাকের উল্টো পাশে ফুজিকালার ল্যাব পর্যন্ত আসলাম। আর দৌড়াতে পারছিলাম না।
আমাদের সঙ্গে আরও কয়েকজন দৌড়াচ্ছে গরু ধরতে। যারা বাজার থেকে গরু বাড়িতে পৌঁছে দেয়—এমন কয়েকজন বলল, ‘ভাই, আমাদের টাকা দিলে গরুটা আমরা ধরে দেব।’ জানতে চাইলাম কত টাকা লাগবে গরু ধরে বাড়ি পৌঁছে দিতে। বলল, দুই হাজার টাকা। তখন দুই হাজার মানে অনেক টাকা। বিস্মিত হয়ে বললাম, এত টাকা! বলল, ‘গরু গেলে তো আপনার ষাট-সত্তর হাজার টাকা যাইব গা।’ দৌড়াতে দৌড়াতে দর-কষাকষি করে শেষে বাধ্য হয়ে এক হাজার টাকায় দুই রাখালকে গরু ধরে বাড়ি পৌঁছে দেওয়ার জন্য ঠিক করলাম। তাঁরা দৌড়ে রাজারবাগের গ্রিনলাইনের যে কাউন্টারটা এখন আছে, তার একটু আগে এসে গরুটি ধরতে পারল। তারপর গরু নিয়ে শাহজাহানপুরের ভেতর দিয়ে বাসায় ফিরলাম। আর ওটাই ছিল আমার জীবনে শেষবার হাটে গিয়ে গরু কেনা।
বলছিলাম কোরবানিকে ঘিরে আমাদের পশুসম্পদের বাজারের কথা। সময়ের সঙ্গে কোরবানির পশুর চাহিদা বাড়ছে, বাজার বড় হচ্ছে। গত দুই কোরবানি ছিল একেবারেই ভিন্ন রকম। করোনার ভেতর ঈদের আনন্দের চেয়ে শঙ্কা ছিল বেশি। দিনে দিনে পাল্টেছে বাজারের ধারণা। সেই সঙ্গে পাল্টেছে গরু বাজারজাতকরণ প্রক্রিয়াও। কোরবানি সামনে রেখে প্রতিবছরই ছোট-বড় অসংখ্য গরুর খামার গড়ে উঠছে। প্রতিবছরই খামারের সংখ্যা বাড়ছে। পরিবর্তন এসেছে ভোক্তা ও খামারিদের ভাবনার মধ্যেও। সেই অনুপাতে বাড়ছে বাজারের সংখ্যা।
এবার ঢাকাসহ সারা দেশে ৪ হাজার ৪০৭টি পশুর হাট বসছে। সবচেয়ে বড় কথা, অনলাইনভিত্তিক গরুর বাজার তৈরি হয়েছে। গত বছর অনলাইনে কোরবানির সাড়ে তিন লাখ পশু বিক্রি হয়। এই সংখ্যাটাও এ বছর হয়তো বাড়বে। এখন অনলাইনে বা মহল্লার খামার থেকে কেনা গরু বাড়ি নিয়ে আসায় ঝক্কি নেই। বিক্রেতাই পিকআপ ভ্যানে করে গরু বাড়িতে পৌঁছে দেন।
সবকিছুই সহজ হয়ে উঠছে। এখনকার শিশু-কিশোরদের মনে কোরবানির বাজার নিয়ে রচিত হচ্ছে অন্য রকমের গল্প। আগামী প্রজন্মও হয়তো আরও বেশি পাল্টে দেবে বাজারব্যবস্থা। তবে কোরবানির যে উদ্দেশ্য, তা যেন অটুট থাকে। অটুট থাকুক মানুষের সঙ্গে মানুষের সম্পর্কের বন্ধন। সবাইকে ঈদের আগাম শুভেচ্ছা।
পর্দার নায়িকারা নিজেদের বয়স আড়ালে রাখা পছন্দ করেন। এ ক্ষেত্রে ব্যতিক্রম আজমেরী হক বাঁধন। প্রতিবছর নিজের জন্মদিনে জানান দেন তাঁর বয়স। গতকাল ছিল বাঁধনের ৪১তম জন্মদিন। সোশ্যাল মিডিয়ায় নিজেই জানালেন এই তথ্য।
২ দিন আগে১০ বছরের বেশি সময় ধরে শোবিজে কাজ করছেন অভিনেত্রী শবনম ফারিয়া। নাটকের পাশাপাশি ওটিটিতে দেখা গেছে তাঁকে। সরকারি অনুদানের ‘দেবী’ নামের একটি সিনেমায়ও অভিনয় করেছেন। প্রশংসিত হলেও সিনেমায় আর দেখা মেলেনি তাঁর। ছোট পর্দাতেও অনেক দিন ধরে অনিয়মিত তিনি। এবার শবনম ফারিয়া হাজির হচ্ছেন নতুন পরিচয়ে। কমেডি রিয়েলিটি
২ দিন আগেআমাদের লোকসংস্কৃতির অন্যতম ঐতিহ্য যাত্রাপালা। গণমানুষের সংস্কৃতি হিসেবে বিবেচিত এই যাত্রাপালা নিয়ে শিল্পকলা একাডেমি আয়োজন করছে ‘যাত্রা উৎসব-২০২৪’। আগামী ১ নভেম্বর সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের মুক্তমঞ্চে শুরু হবে ৭ দিনব্যাপী এই উৎসব।
২ দিন আগে‘বঙ্গবন্ধু’ পদবি বিলীন হবে না। হতে পারে না। যেমনটি ‘দেশবন্ধু’ চিত্তরঞ্জন দাশের পদবি বিলীন হয়নি। ইতিহাসে এসব পদবি অম্লান ও অক্ষয়। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ব্যক্তিত্ব ছিল অনন্যসাধারণ। আপনজনকে তো অবশ্যই, শত্রুপক্ষের লোকেরাও ব্যক্তিগত পর্যায়ে তাঁর প্রতি আকৃষ্ট হতেন। পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর উচ্চপদের
২ দিন আগে