বাংলা ভাইয়ের গ্রামে নতুন জঙ্গি তৎপরতা

বগুড়া প্রতিনিধি
প্রকাশ : ১০ জানুয়ারি ২০২৩, ১১: ৪৭

নিষিদ্ধঘোষিত জঙ্গি সংগঠন জামাআতুল মুজাহিদীন বাংলাদেশের (জেএমবি) বেশ কিছু সদস্য নতুন নামে সংগঠিত হচ্ছেন। ফাঁসি কার্যকর হওয়া জেএমবির শীর্ষস্থানীয় নেতা সিদ্দিকুল ইসলাম ওরফে বাংলা ভাইয়ের গ্রাম থেকেই তাঁদের তৎপরতা চালানোর তথ্য মিলেছে। জানা গেছে, নতুন তৎপরতায় নেতৃত্ব দিচ্ছেন বাংলা ভাইয়ের চাচাতো ভাই পলাতক জঙ্গিনেতা ওয়ালিউল্লাহ। প্রশিক্ষণ দিচ্ছেন বগুড়ার শেরপুর উপজেলার গাড়িদহ এলাকার আরেক জঙ্গিনেতা। তবে তাঁর নাম জানা যায়নি।

বগুড়ার গাবতলী উপজেলার মহিষাবান ইউনিয়নের কর্ণিপাড়া গ্রামে বাংলা ভাইয়ের বাড়ি। ২০০৭ সালে ফাঁসি কার্যকর হওয়ার পর তাঁকে দাফন করা হয় গ্রামের মসজিদ-সংলগ্ন পারিবারিক কবরস্থানে। মসজিদের পেছনে বাঁশবাগানে ওয়ালিউল্লাহর নেতৃত্বে ১ জানুয়ারি রাত আটটা থেকে গোপনে ঘণ্টাব্যাপী বৈঠক করেন জেএমবির সাত সদস্য। পুলিশ খবর পেয়ে সেখানে পৌঁছার আগেই তাঁরা পালিয়ে যান। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক গ্রাম পুলিশ জানান, থানা থেকে পুলিশ এলেও কাউকে ধরতে পারেনি।

জঙ্গি তৎপরতার তথ্য থাকার কথা জানিয়েছেন গাবতলী মডেল থানার ওসি সনাতন সরকারও। তিনি আজকের পত্রিকাকে বলেন, ‘এক সপ্তাহ আগে জঙ্গিনেতা ওয়ালিউল্লাহ এলাকায় এসেছিলেন। কিন্তু অল্পের জন্য তাঁকে ধরতে পারিনি।’

ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) কাউন্টার টেররিজম অ্যান্ড ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইম (সিটিটিসি) ইউনিটের প্রধান মো. আসাদুজ্জামান আজকের পত্রিকাকে বলেন, ‘বাংলা ভাইয়ের কোনো ভাই জঙ্গিবাদে জড়িত কি না, এই মুহূর্তে আমার জানা নেই। তবে এমন কেউ জড়িত থাকলে তাঁকে নিশ্চয় আইনের আওতায় আনা হবে।’
মহিষাবান ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক আব্দুর রহিম বলেন, ‘এলাকায় নতুন করে জেএমবির সদস্যরা তৎপরতা শুরু করেছে। বাংলা ভাইয়ের পরিবার থেকেই সংগঠিত করা হচ্ছে তাদের।’ তিনি বলেন, ‘যারা দীর্ঘদিন পলাতক ছিল, ইদানীং তাদের আনাগোনা গ্রামের মানুষের মধ্যে সন্দেহ সৃষ্টি করছে। তবে ভয়ে মানুষ মুখ খোলে না।’

কর্ণিপাড়া ছাড়াও গাবতলী উপজেলার সারটিয়া, চক সেকেন্দার, চকসধু, জয়ভোগা, গুড়টুপ নগর, পারকাঁকড়া, গোড়দহ, বাইগুনি, কালুডাঙ্গাপাড়া, রানীরপাড়া, হাসনাপাড়া, নিশিন্দারা, পাঁচমাইল, হামিদপুর, দাড়াইল, তরফসরতাজ গ্রামে অনুসন্ধান চালিয়ে গোপন জঙ্গি তৎপরতার পাশাপাশি সংশ্লিষ্ট অর্ধশতাধিক সদস্যের নাম-পরিচয় পাওয়া গেছে। পুরোনো জেএমবির আদলে নতুন নামে তাঁরা সংগঠিত হচ্ছেন বলে পুলিশও জানতে পেরেছে।

নতুন তৎপরতায় জড়িত বেশির ভাগ সদস্যই তরুণ বা যুবক। তাঁদের কেউ সবজিবিক্রেতা, কেউ ভ্যানচালক, আবার কেউ কাঠমিস্ত্রি। কয়েকজন মাঝেমধ্যেই উধাও হয়ে যান।

পুরোনো জেএমবির ৩০ জন সদস্যের বিষয়ে খোঁজ নিয়ে জানা যায়, তাঁদের মধ্যে ৫ জন পলাতক, ৩ জন জেলহাজতে এবং ২২ জন এলাকায় থাকেন। ২২ জনের মধ্যে ২ জন কলেজে শিক্ষকতা করেন। তাঁদের একজনের নামে সন্ত্রাসবিরোধী আইনে ২০১৭ সালে গাবতলী মডেল থানায় এবং অন্যজনের নামে একই আইনে ২০১৫ সালে বগুড়া সদর থানায় মামলা হয়েছিল। বাংলা ভাইয়ের ঘনিষ্ঠ হিসেবে পরিচিত রাসেল এলাকায় নতুন সদস্য সংগ্রহ করার অভিযোগ আছে।

তাঁর নামে গাবতলী থানায় সন্ত্রাসবিরোধী আইনে দুটি মামলা হয়েছিল। বেশ কিছুদিন হাজতে থাকার পর জামিনে বেরিয়ে রাসেল পাঁচমাইল বাজারে সবজি বিক্রি করেন। স্থানীয় কয়েকজন দোকানি জানান, রাসেল মাঝেমধ্যে দোকান বন্ধ রেখে সাত-আট দিনের জন্য নিরুদ্দেশ হয়ে যান। স্থানীয় একজন গ্রাম পুলিশ জানান, কর্ণিপাড়া গ্রামের আরও কয়েকজন যুবক মাঝেমধ্যে কোথায় যান, তা বলতে পারে না তাঁদের পরিবারও। তিনি বলেন, ‘ওই যুবকদের কারও সঙ্গে তেমন মিশতে দেখা যায় না। মাঝেমধ্যে তাদের মসজিদেও দেখা যায় না। তখন বোঝা যায়, এরা গ্রামে নাই।’

রাসেলের খোঁজ নিতে গিয়ে দেখা যায়, তাঁর দোকান বন্ধ। এলাকাবাসীর মাধ্যমে সংগৃহীত তাঁর ফোন নম্বরটিও বন্ধ পাওয়া যায়।মহিষাবান ইউপি চেয়ারম্যান ও ইউনিয়ন বিএনপির সহসভাপতি আব্দুল মজিদ মণ্ডল অবশ্য বলেন, ‘আমাকে জেএমবির তৎপরতার বিষয়টি কেউ জানায়নি।’ তিনি বলেন, ‘তারা তো প্রকাশ্যে কিছু করছে না। এ কারণে বুঝতে পারি না।’

গাবতলী মডেল থানার ওসি সনাতন সরকার বলেন, ‘গাবতলী সদর ও মহিষাবান ইউনিয়নে জেএমবির গোপন তৎপরতা আছে। এই দুই ইউনিয়নকে অধিক গুরুত্ব দিয়ে নজরদারি করা হয়, বিশেষ করে কয়েকটি মাদ্রাসা আমাদের নজরে আছে। সেগুলোতে গোপনে প্রশিক্ষণ হয় বলে তথ্য রয়েছে। প্রশিক্ষক হিসেবে যারা কাজ করে, তারা স্থানীয় না। শেরপুর উপজেলার গাড়িদহ থেকে এখানে আসে বলে জানতে পেরেছি।’

বগুড়ার অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (অপরাধ) আব্দুর রশিদ আজকের পত্রিকাকে বলেন, ‘পুরোনো জেএমবির সদস্যরা পুলিশের নজরদারিতে আছে। নতুনদের ব্যাপারে আমাদের কাছে তেমন তথ্য নেই। তারপরও এলাকায় গোয়েন্দা তৎপরতা অব্যাহত রয়েছে।’

জঙ্গিবাদ পুরোপুরি নিশ্চিহ্ন হবে না
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অপরাধবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক জিয়াউর রহমান আজকের পত্রিকাকে বলেন, ধর্মকে ব্যবহার করে বাংলা ভাই উত্তরাঞ্চলে রাজনীতি করার চেষ্টা করেছিলেন। তিনি অপর রাজনৈতিক দলের সমর্থনও পেয়েছিলেন। তিনি মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছিলেন। যেহেতু জঙ্গিবাদের একটি সো কলড রাজনৈতিক রং রয়েছে, তাই এর আদর্শের লোকজনও থাকবেন। জঙ্গিবাদ কখনো পুরোপুরি নিশ্চিহ্ন হবে না, তবে নিয়ন্ত্রণে রাখা যেতে পারে। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী হয়তো সেভাবেই কাজ করছে।

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
খুঁজুন

সম্পর্কিত