চিররঞ্জন সরকার
আধুনিক মানুষের জীবন নানা ব্যস্ততায় মোড়ানো। প্রয়োজন মেটানোর তাগিদে সারাক্ষণ নানা কাজে ছোটাছুটি করতে গিয়ে একঘেয়েমি আর ক্লান্তি আসে খুব সহজেই। আসে অবসাদ। তখন মানুষের শ্রান্ত-ক্লান্ত প্রাণ একটু অবকাশের জন্য উদ্গ্রীব হয়ে ওঠে। কর্মময় জীবনকে ছুটি দিয়ে মন খোঁজে একটু নিভৃত শান্তি। তাই ছুটির জন্য আমাদের মন ব্যাকুল হয়। প্রাত্যহিকতার কারাগার থেকে একটু বাইরে বের হওয়ার ফুসরত মেলে।
ঈদের ছুটি আমাদের জীবনে সেই সুযোগ করে দেয়। ঈদে ঘরে ফেরার ব্যাপারটি সামনে ফটিকের কথা মনে পড়ে। সেই ফটিক, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘ছুটি’ গল্পের ‘বালকদিগের সর্দার’ ফটিক চক্রবর্তী। যে ফটিক বিলাপরত মায়ের কান্নার জবাবে বলেছিল, ‘মা, এখন আমার ছুটি হয়েছে মা, এখন আমি বাড়ি যাচ্ছি।’ ‘ছুটি’ গল্পের ফটিক মায়ের কাছে যেতে চাইলে মামা বিশ্বম্ভরবাবু তাকে বলেছিলেন, পূজায় স্কুল ছুটি হলে বাড়ি যাওয়া যাবে।
আর আমাদের দেশে রাজধানী ঢাকাসহ বিভিন্ন শহরে যাঁরা চাকরি করেন, তাঁরা তীর্থের কাকের মতো অপেক্ষা করেন কখন ঈদের ছুটি শুরু হবে। আমাদের দেশে দুই ঈদের ছুটিতে কোটি কোটি ‘ফটিক’ নাড়ির টানে বাড়ি ফেরেন, তাঁরা তো মায়ের কাছেই ফেরেন। ফেরেন বোনের কাছে, ভাইয়ের কাছে, বন্ধুর কাছে। স্বামী ফিরে যান বউয়ের কাছে। বাবা যান আদরের সন্তানের কাছে। মাটির কাছেও ফেরেন।
এই ফেরাটা আমাদের অভ্যাস। পরিবারের সবার সঙ্গে মিলিত হওয়ার একটা দুর্নিবার আকাঙ্ক্ষা আমাদের মধ্যে কাজ করে। এর জন্য যারপরনাই দুর্ভোগ পোহাতে হয়। পোহাতে হয় বেহাল সড়কে পথে পথে চরম ভোগান্তিও। সৃষ্টি হয় দীর্ঘ যানজট। বাস-ট্রেনের শিডিউলেও বিপর্যয় ঘটে। এতসব দুর্ভোগ উপেক্ষা করে মানুষ ঈদ-উৎসবের জন্য নাড়ির টানে বাড়ি ফেরে।
বসে, দাঁড়িয়ে, প্রয়োজন হলে হেঁটে আপনজনের কাছে পৌঁছাতেই হবে। উৎসবে যাঁরা রাজধানী থেকে গ্রামে ফিরতে চান, তাঁদের সবচেয়ে বেশি দুর্ভোগ পোহাতে হয় আগাম টিকিট সংগ্রহ করতে গিয়ে। দ্বিগুণ ভাড়া দিয়েও কাঙ্ক্ষিত টিকিট মেলে না। ফিরতেও একই বিড়ম্বনা। সঙ্গে যোগ হয় বাস খাদে পড়া, নানা দুর্ঘটনা অথবা ছিনতাইকারী, অজ্ঞান পার্টি-মলম পার্টির খপ্পরে পড়ার আশঙ্কা।
এবার অবশ্য মানুষজনকে তুলনামূলক অনেক কম ভোগান্তি পোহাতে হয়েছে। মানুষজন পর্যায়ক্রমে ঢাকা ছাড়ায় এবারের ঈদযাত্রায় দুর্ভোগ তুলনামূলকভাবে কম পোহাতে হয়েছে। শিক্ষার্থীরা ৩ এপ্রিলের আগে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ‘ছুটির বাঁশি’ বাজামাত্রই ঢাকা ছাড়তে শুরু করেছেন। এবার তুলনামূলকভাবে লম্বা ছুটি কাটানোর সুযোগ এসেছে। ঈদের সরকারি ছুটি ১০, ১১ ও ১২ এপ্রিল। পরদিন, অর্থাৎ ১৩ এপ্রিল শনিবার সাপ্তাহিক ছুটি। তার পরদিন রোববার আবার পয়লা বৈশাখের ছুটি। মানে হলো, সরকারি ছুটি পাঁচ দিন নিশ্চিত। পবিত্র শবে কদরের পর যদি কেউ দুই দিন ছুটি নিতে পারেন, তাহলে তিনি টানা ১০ দিন বাড়িতে কাটাতে পারবেন। কারণ, শবে কদরের আগের দুই দিন শুক্র ও শনিবার সাপ্তাহিক ছুটি।
ঈদের ছুটিতে আমরা অনেক আনন্দ করতে চাই। ভালো খেয়ে-পরে পরিবারের সবাই মিলে একত্রে কাটাতে চাই। তাই তো ঈদ-উৎসব ঘিরে আমাদের কত পরিকল্পনা। কত স্বপ্ন, অপেক্ষা। যদিও অনেকের জীবনে উৎসব-অনুষ্ঠান সীমাহীন বিড়ম্বনা, টাকার শ্রাদ্ধ, অতৃপ্তি আর অবসাদ ছাড়া নগদ তেমন কিছুই দিতে পারে না। কোনো কোনো মধ্যবিত্তের কাছে উৎসব-অনুষ্ঠান এক আপদ ও আতঙ্কের নাম। এর অবশ্য অনেক কারণ আছে।
উৎসবের আনন্দ উপভোগ করতে হলে আরও অনেক কিছু যোগ করতে হয়। সবার আগে আসে টাকার প্রশ্ন। উৎসবে সবাই চায় একটু ভালো পরতে, ভালো খেতে। কিন্তু সীমাবদ্ধ আয়ের মধ্যবিত্তকে বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই আয়ের সঙ্গে ব্যয়ের সামঞ্জস্য বিধান করতে গিয়ে ভীষণ রকম সমস্যায় পড়তে হয়। সন্তানেরা যে যেমনটি চায়, তেমনটি বাজেট স্বল্পতার কারণে দেওয়া সম্ভব হয় না। তারপরও কথা থেকে যায়। নিজের মা-বাবা, ভাইবোনকে সন্তুষ্ট করা গেল তো শ্বশুরবাড়ির লোকজনকে নাখোশ করতে হয়। আবার শ্বশুরপক্ষীয় আত্মীয়দের মন জোগাতে গেলে অন্যরা বেজার হয়।
খাওয়া-পরার ব্যাপারটা কোনো রকমে সামাল দেওয়া গেলেও বেড়ানোর ব্যাপারটা এখন কিছুতেই ম্যানেজ করা যায় না। এখন মধ্যবিত্তরা ভ্রমণপিপাসু হয়ে উঠেছে। উৎসবে-অনুষ্ঠানে শুধু জামা-কাপড়-জুতা আর খাবারদাবারেই সীমাবদ্ধ নেই। এখন ঘুরতে বা বেড়াতে যাওয়াটাও অনিবার্য অনুষঙ্গ হয়ে দাঁড়িয়েছে। অনেকেই এখন ঈদের ছুটিতে দেশের বাইরে বেড়াতে যাওয়ার পরিকল্পনা করেন। এখানেও সমস্যা—কোথায় যাবেন, কীভাবে যাবেন। এ ব্যাপারে মা-বাবার সঙ্গে সন্তানদের মতের মিল হয় খুব সামান্য ক্ষেত্রেই।
অনেক পরিবারে আবার সন্তানেরা মা-বাবার সঙ্গে ঘুরতে যেতে চায় না। বন্ধুবান্ধবরা মিলে নিজেদের মতো করে ঘুরতে চায়। মা-বাবা সায় না দিলে রীতিমতো বাড়ি ছেড়ে চলে যাওয়ার হুমকি আসে। এই বিগড়ানো সন্তানদের বশে রাখাটাই তখন অভিভাবকদের প্রধান দায় হয়ে পড়ে!
দীর্ঘ ছুটি পেয়ে গেলে অনেকে তাই বিপন্ন হয়ে পড়েন। কী করবেন, কোথায় যাবেন, সন্তানদের কীভাবে ম্যানেজ করবেন, আত্মীয়স্বজনদেরই বা কীভাবে বুঝ দেবেন, বাড়তি টাকার জোগাড় কীভাবে হবে—এসব নিয়ে অতিরিক্ত ‘টেনশন’ সৃষ্টি হয়।
এমনিতে উৎসবের মৌসুম মানে শুধু আনন্দ নয়, অবসাদেরও। মনোচিকিৎসকেরাও তা-ই বলেন। উন্নত বিশ্বে টানা ছুটির সময়ে তাঁদের চেম্বারে অবসাদে ভোগা রোগীর সংখ্যা লাফিয়ে বাড়ে। আমাদের দেশেও দিন দিন এই সমস্যায় আক্রান্ত মানুষের সংখ্যা বাড়ছে। এই অবসাদের একটা নামও আছে—‘হলিডে ব্লুজ’। ছুটির মধ্যেই গেঁথে থাকে সেই অবসাদের শিকড়। বিভিন্ন সমীক্ষা অনুযায়ী, ইউরোপ-আমেরিকার বহু দেশে ক্রিসমাস-নিউ ইয়ার বা অন্য ছুটির সময়ে আত্মহত্যার হার বেড়ে যায়।
কেন যায়? কারণ, আমাদের সমাজে এমন অনেক মানুষ আছেন, যাঁরা নিঃসঙ্গ, বন্ধুহীন, যাঁরা হই-হুল্লোড়, ভিড়ভাট্টা একটু এড়িয়ে যেতে চান। তাঁরা প্রাত্যহিক ব্যস্ততার মধ্যে একধরনের খাপ খাইয়ে নেন। কিন্তু সেই মানুষগুলোর কাছে বাড়তি ছুটি মানেই তাঁদের বুক দুরদুর।
টিভির পর্দায়, পাড়ার আলোচনায়, অফিসের গল্পে, খবরের কাগজের পাতায় তখন শুধু কত অসামান্যভাবে ছুটি কাটানো যায় তার হাজারো ফিরিস্তি। কী খাওয়া বা কেনা যায়, কোথায় সবান্ধব যাওয়া যায়, আনন্দে কত পেগ ডুব দেওয়া যায় তার বিশদ বিবরণ। সেই একাকী মানুষগুলো ছুটি কাটানোর কোনো জুতসই পরিকল্পনা করে উঠতে পারেন না, ফলে প্রায় কুঁকড়ে কানচাপা দিয়ে বসে থাকার উপক্রম হয়। ছুটিই তাঁদের ঘাড় ধরে আরও একবার বুঝিয়ে দেয় যে সুস্থ সামাজিক কাঠামোর চলতি সংজ্ঞায় তাঁরা একা, অস্বাভাবিক, বেমানান বা অপাঙ্ক্তেয়। নিজের মনের ওপর যথেষ্ট নিয়ন্ত্রণ না থাকলে ক্রমেই বিষাদের গহনে চলে যেতে থাকেন তাঁরা।
মনোবিদেরা বলেন, ‘হলিডে ব্লুজের’ অন্যতম কারণ হলো, যেভাবে ছুটি কাটাতে চাইছি, যতটা আনন্দ করতে চাইছি, সেটা পারছি না। যদি আনন্দের অস্বাভাবিক লক্ষ্যমাত্রা স্থির করা হয়, তাহলে সেটা পূরণ না হওয়াই স্বাভাবিক। তাতেই সমস্যা বাড়ে। ছুটি এলেই তাকে ‘সর্বকালের সেরা’ বানানোর প্রবণতা থাকে অনেকের। শেষমেশ তা পূরণ হয় না, আশাভঙ্গে অবসাদ আসে। প্রথমত, সব আনন্দের টার্গেট পূর্ণ হলো না বলে অশান্তি। দ্বিতীয়ত, ছুটি শেষ হয়ে আবার গতানুগতিক কাজের রুটিন শুরু হয়ে গেল বলে নিরাশা।
এ ক্ষেত্রে ছুটির ‘প্রায়োরিটি’ ঠিক করাটা সবচেয়ে আগে দরকার। সেই সঙ্গে, এই ছুটিটাকেই আমাকে সর্বোৎকৃষ্ট বলে প্রমাণ করতে হবে এমন চিন্তা ভেঙে বেরোতে হবে। উৎসবের মৌসুম ঘুরে ঘুরে প্রতিবার আসে। যথেষ্ট আনন্দ এবার না হলে অন্যবার হবে। একমাত্র উৎসবের সময়েই যাবতীয় আনন্দ লুটে নিতে হবে—এমন দিব্যিও তো নেই। বছরের অন্য সময়েও তা করা যায়। অন্য সবার মতো ছুটি উদ্যাপন করতে পারছেন না বলে নিজেকে অত্যন্ত বঞ্চিত মনে করার কোনো কারণ নেই। শুধু লোকদেখানো উপায়ে নয়, নিজের মতো করেও ছুটি উদ্যাপন করা যায়, তাতেও আনন্দ হয়, আর সেটা মনকে বোঝানোর দায়িত্ব নিজেরই।
ছুটি তাই সবার জন্য সমান আনন্দ-উৎসবের বার্তা বয়ে আনে না, অনেকের কাছে ছুটি মানে বিভীষিকা, ছুটি এলে তাঁদের মনপ্রাণ ছটফট করতে থাকে, কত তাড়াতাড়ি আবার রুটিনবদ্ধ হওয়া যায়!
শুধু সম্ভাবনা নয়, মানুষের জীবনটা তো একই সঙ্গে অনন্ত সমস্যার সমাহারও বটে। অনেকে কয়েকটা দিন ছুটির জন্য হা-পিত্যেশ করেন। আবার অনেকে লাগাতার কয়েক দিনের ছুটি পেলে বড় ধরনের ফ্যাসাদে পড়ে যান! মানুষের বিচিত্র জীবনের বিচিত্র সব সমস্যা থেকে পরিত্রাণের পথ কীভাবে মিলবে—তা হয়তো কেউই জানেন না!
লেখক: গবেষক, কলামিস্ট
আধুনিক মানুষের জীবন নানা ব্যস্ততায় মোড়ানো। প্রয়োজন মেটানোর তাগিদে সারাক্ষণ নানা কাজে ছোটাছুটি করতে গিয়ে একঘেয়েমি আর ক্লান্তি আসে খুব সহজেই। আসে অবসাদ। তখন মানুষের শ্রান্ত-ক্লান্ত প্রাণ একটু অবকাশের জন্য উদ্গ্রীব হয়ে ওঠে। কর্মময় জীবনকে ছুটি দিয়ে মন খোঁজে একটু নিভৃত শান্তি। তাই ছুটির জন্য আমাদের মন ব্যাকুল হয়। প্রাত্যহিকতার কারাগার থেকে একটু বাইরে বের হওয়ার ফুসরত মেলে।
ঈদের ছুটি আমাদের জীবনে সেই সুযোগ করে দেয়। ঈদে ঘরে ফেরার ব্যাপারটি সামনে ফটিকের কথা মনে পড়ে। সেই ফটিক, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘ছুটি’ গল্পের ‘বালকদিগের সর্দার’ ফটিক চক্রবর্তী। যে ফটিক বিলাপরত মায়ের কান্নার জবাবে বলেছিল, ‘মা, এখন আমার ছুটি হয়েছে মা, এখন আমি বাড়ি যাচ্ছি।’ ‘ছুটি’ গল্পের ফটিক মায়ের কাছে যেতে চাইলে মামা বিশ্বম্ভরবাবু তাকে বলেছিলেন, পূজায় স্কুল ছুটি হলে বাড়ি যাওয়া যাবে।
আর আমাদের দেশে রাজধানী ঢাকাসহ বিভিন্ন শহরে যাঁরা চাকরি করেন, তাঁরা তীর্থের কাকের মতো অপেক্ষা করেন কখন ঈদের ছুটি শুরু হবে। আমাদের দেশে দুই ঈদের ছুটিতে কোটি কোটি ‘ফটিক’ নাড়ির টানে বাড়ি ফেরেন, তাঁরা তো মায়ের কাছেই ফেরেন। ফেরেন বোনের কাছে, ভাইয়ের কাছে, বন্ধুর কাছে। স্বামী ফিরে যান বউয়ের কাছে। বাবা যান আদরের সন্তানের কাছে। মাটির কাছেও ফেরেন।
এই ফেরাটা আমাদের অভ্যাস। পরিবারের সবার সঙ্গে মিলিত হওয়ার একটা দুর্নিবার আকাঙ্ক্ষা আমাদের মধ্যে কাজ করে। এর জন্য যারপরনাই দুর্ভোগ পোহাতে হয়। পোহাতে হয় বেহাল সড়কে পথে পথে চরম ভোগান্তিও। সৃষ্টি হয় দীর্ঘ যানজট। বাস-ট্রেনের শিডিউলেও বিপর্যয় ঘটে। এতসব দুর্ভোগ উপেক্ষা করে মানুষ ঈদ-উৎসবের জন্য নাড়ির টানে বাড়ি ফেরে।
বসে, দাঁড়িয়ে, প্রয়োজন হলে হেঁটে আপনজনের কাছে পৌঁছাতেই হবে। উৎসবে যাঁরা রাজধানী থেকে গ্রামে ফিরতে চান, তাঁদের সবচেয়ে বেশি দুর্ভোগ পোহাতে হয় আগাম টিকিট সংগ্রহ করতে গিয়ে। দ্বিগুণ ভাড়া দিয়েও কাঙ্ক্ষিত টিকিট মেলে না। ফিরতেও একই বিড়ম্বনা। সঙ্গে যোগ হয় বাস খাদে পড়া, নানা দুর্ঘটনা অথবা ছিনতাইকারী, অজ্ঞান পার্টি-মলম পার্টির খপ্পরে পড়ার আশঙ্কা।
এবার অবশ্য মানুষজনকে তুলনামূলক অনেক কম ভোগান্তি পোহাতে হয়েছে। মানুষজন পর্যায়ক্রমে ঢাকা ছাড়ায় এবারের ঈদযাত্রায় দুর্ভোগ তুলনামূলকভাবে কম পোহাতে হয়েছে। শিক্ষার্থীরা ৩ এপ্রিলের আগে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ‘ছুটির বাঁশি’ বাজামাত্রই ঢাকা ছাড়তে শুরু করেছেন। এবার তুলনামূলকভাবে লম্বা ছুটি কাটানোর সুযোগ এসেছে। ঈদের সরকারি ছুটি ১০, ১১ ও ১২ এপ্রিল। পরদিন, অর্থাৎ ১৩ এপ্রিল শনিবার সাপ্তাহিক ছুটি। তার পরদিন রোববার আবার পয়লা বৈশাখের ছুটি। মানে হলো, সরকারি ছুটি পাঁচ দিন নিশ্চিত। পবিত্র শবে কদরের পর যদি কেউ দুই দিন ছুটি নিতে পারেন, তাহলে তিনি টানা ১০ দিন বাড়িতে কাটাতে পারবেন। কারণ, শবে কদরের আগের দুই দিন শুক্র ও শনিবার সাপ্তাহিক ছুটি।
ঈদের ছুটিতে আমরা অনেক আনন্দ করতে চাই। ভালো খেয়ে-পরে পরিবারের সবাই মিলে একত্রে কাটাতে চাই। তাই তো ঈদ-উৎসব ঘিরে আমাদের কত পরিকল্পনা। কত স্বপ্ন, অপেক্ষা। যদিও অনেকের জীবনে উৎসব-অনুষ্ঠান সীমাহীন বিড়ম্বনা, টাকার শ্রাদ্ধ, অতৃপ্তি আর অবসাদ ছাড়া নগদ তেমন কিছুই দিতে পারে না। কোনো কোনো মধ্যবিত্তের কাছে উৎসব-অনুষ্ঠান এক আপদ ও আতঙ্কের নাম। এর অবশ্য অনেক কারণ আছে।
উৎসবের আনন্দ উপভোগ করতে হলে আরও অনেক কিছু যোগ করতে হয়। সবার আগে আসে টাকার প্রশ্ন। উৎসবে সবাই চায় একটু ভালো পরতে, ভালো খেতে। কিন্তু সীমাবদ্ধ আয়ের মধ্যবিত্তকে বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই আয়ের সঙ্গে ব্যয়ের সামঞ্জস্য বিধান করতে গিয়ে ভীষণ রকম সমস্যায় পড়তে হয়। সন্তানেরা যে যেমনটি চায়, তেমনটি বাজেট স্বল্পতার কারণে দেওয়া সম্ভব হয় না। তারপরও কথা থেকে যায়। নিজের মা-বাবা, ভাইবোনকে সন্তুষ্ট করা গেল তো শ্বশুরবাড়ির লোকজনকে নাখোশ করতে হয়। আবার শ্বশুরপক্ষীয় আত্মীয়দের মন জোগাতে গেলে অন্যরা বেজার হয়।
খাওয়া-পরার ব্যাপারটা কোনো রকমে সামাল দেওয়া গেলেও বেড়ানোর ব্যাপারটা এখন কিছুতেই ম্যানেজ করা যায় না। এখন মধ্যবিত্তরা ভ্রমণপিপাসু হয়ে উঠেছে। উৎসবে-অনুষ্ঠানে শুধু জামা-কাপড়-জুতা আর খাবারদাবারেই সীমাবদ্ধ নেই। এখন ঘুরতে বা বেড়াতে যাওয়াটাও অনিবার্য অনুষঙ্গ হয়ে দাঁড়িয়েছে। অনেকেই এখন ঈদের ছুটিতে দেশের বাইরে বেড়াতে যাওয়ার পরিকল্পনা করেন। এখানেও সমস্যা—কোথায় যাবেন, কীভাবে যাবেন। এ ব্যাপারে মা-বাবার সঙ্গে সন্তানদের মতের মিল হয় খুব সামান্য ক্ষেত্রেই।
অনেক পরিবারে আবার সন্তানেরা মা-বাবার সঙ্গে ঘুরতে যেতে চায় না। বন্ধুবান্ধবরা মিলে নিজেদের মতো করে ঘুরতে চায়। মা-বাবা সায় না দিলে রীতিমতো বাড়ি ছেড়ে চলে যাওয়ার হুমকি আসে। এই বিগড়ানো সন্তানদের বশে রাখাটাই তখন অভিভাবকদের প্রধান দায় হয়ে পড়ে!
দীর্ঘ ছুটি পেয়ে গেলে অনেকে তাই বিপন্ন হয়ে পড়েন। কী করবেন, কোথায় যাবেন, সন্তানদের কীভাবে ম্যানেজ করবেন, আত্মীয়স্বজনদেরই বা কীভাবে বুঝ দেবেন, বাড়তি টাকার জোগাড় কীভাবে হবে—এসব নিয়ে অতিরিক্ত ‘টেনশন’ সৃষ্টি হয়।
এমনিতে উৎসবের মৌসুম মানে শুধু আনন্দ নয়, অবসাদেরও। মনোচিকিৎসকেরাও তা-ই বলেন। উন্নত বিশ্বে টানা ছুটির সময়ে তাঁদের চেম্বারে অবসাদে ভোগা রোগীর সংখ্যা লাফিয়ে বাড়ে। আমাদের দেশেও দিন দিন এই সমস্যায় আক্রান্ত মানুষের সংখ্যা বাড়ছে। এই অবসাদের একটা নামও আছে—‘হলিডে ব্লুজ’। ছুটির মধ্যেই গেঁথে থাকে সেই অবসাদের শিকড়। বিভিন্ন সমীক্ষা অনুযায়ী, ইউরোপ-আমেরিকার বহু দেশে ক্রিসমাস-নিউ ইয়ার বা অন্য ছুটির সময়ে আত্মহত্যার হার বেড়ে যায়।
কেন যায়? কারণ, আমাদের সমাজে এমন অনেক মানুষ আছেন, যাঁরা নিঃসঙ্গ, বন্ধুহীন, যাঁরা হই-হুল্লোড়, ভিড়ভাট্টা একটু এড়িয়ে যেতে চান। তাঁরা প্রাত্যহিক ব্যস্ততার মধ্যে একধরনের খাপ খাইয়ে নেন। কিন্তু সেই মানুষগুলোর কাছে বাড়তি ছুটি মানেই তাঁদের বুক দুরদুর।
টিভির পর্দায়, পাড়ার আলোচনায়, অফিসের গল্পে, খবরের কাগজের পাতায় তখন শুধু কত অসামান্যভাবে ছুটি কাটানো যায় তার হাজারো ফিরিস্তি। কী খাওয়া বা কেনা যায়, কোথায় সবান্ধব যাওয়া যায়, আনন্দে কত পেগ ডুব দেওয়া যায় তার বিশদ বিবরণ। সেই একাকী মানুষগুলো ছুটি কাটানোর কোনো জুতসই পরিকল্পনা করে উঠতে পারেন না, ফলে প্রায় কুঁকড়ে কানচাপা দিয়ে বসে থাকার উপক্রম হয়। ছুটিই তাঁদের ঘাড় ধরে আরও একবার বুঝিয়ে দেয় যে সুস্থ সামাজিক কাঠামোর চলতি সংজ্ঞায় তাঁরা একা, অস্বাভাবিক, বেমানান বা অপাঙ্ক্তেয়। নিজের মনের ওপর যথেষ্ট নিয়ন্ত্রণ না থাকলে ক্রমেই বিষাদের গহনে চলে যেতে থাকেন তাঁরা।
মনোবিদেরা বলেন, ‘হলিডে ব্লুজের’ অন্যতম কারণ হলো, যেভাবে ছুটি কাটাতে চাইছি, যতটা আনন্দ করতে চাইছি, সেটা পারছি না। যদি আনন্দের অস্বাভাবিক লক্ষ্যমাত্রা স্থির করা হয়, তাহলে সেটা পূরণ না হওয়াই স্বাভাবিক। তাতেই সমস্যা বাড়ে। ছুটি এলেই তাকে ‘সর্বকালের সেরা’ বানানোর প্রবণতা থাকে অনেকের। শেষমেশ তা পূরণ হয় না, আশাভঙ্গে অবসাদ আসে। প্রথমত, সব আনন্দের টার্গেট পূর্ণ হলো না বলে অশান্তি। দ্বিতীয়ত, ছুটি শেষ হয়ে আবার গতানুগতিক কাজের রুটিন শুরু হয়ে গেল বলে নিরাশা।
এ ক্ষেত্রে ছুটির ‘প্রায়োরিটি’ ঠিক করাটা সবচেয়ে আগে দরকার। সেই সঙ্গে, এই ছুটিটাকেই আমাকে সর্বোৎকৃষ্ট বলে প্রমাণ করতে হবে এমন চিন্তা ভেঙে বেরোতে হবে। উৎসবের মৌসুম ঘুরে ঘুরে প্রতিবার আসে। যথেষ্ট আনন্দ এবার না হলে অন্যবার হবে। একমাত্র উৎসবের সময়েই যাবতীয় আনন্দ লুটে নিতে হবে—এমন দিব্যিও তো নেই। বছরের অন্য সময়েও তা করা যায়। অন্য সবার মতো ছুটি উদ্যাপন করতে পারছেন না বলে নিজেকে অত্যন্ত বঞ্চিত মনে করার কোনো কারণ নেই। শুধু লোকদেখানো উপায়ে নয়, নিজের মতো করেও ছুটি উদ্যাপন করা যায়, তাতেও আনন্দ হয়, আর সেটা মনকে বোঝানোর দায়িত্ব নিজেরই।
ছুটি তাই সবার জন্য সমান আনন্দ-উৎসবের বার্তা বয়ে আনে না, অনেকের কাছে ছুটি মানে বিভীষিকা, ছুটি এলে তাঁদের মনপ্রাণ ছটফট করতে থাকে, কত তাড়াতাড়ি আবার রুটিনবদ্ধ হওয়া যায়!
শুধু সম্ভাবনা নয়, মানুষের জীবনটা তো একই সঙ্গে অনন্ত সমস্যার সমাহারও বটে। অনেকে কয়েকটা দিন ছুটির জন্য হা-পিত্যেশ করেন। আবার অনেকে লাগাতার কয়েক দিনের ছুটি পেলে বড় ধরনের ফ্যাসাদে পড়ে যান! মানুষের বিচিত্র জীবনের বিচিত্র সব সমস্যা থেকে পরিত্রাণের পথ কীভাবে মিলবে—তা হয়তো কেউই জানেন না!
লেখক: গবেষক, কলামিস্ট
ঝড়-জলোচ্ছ্বাস থেকে রক্ষায় সন্দ্বীপের ব্লক বেড়িবাঁধসহ একাধিক প্রকল্প হাতে নিয়েছে সরকার। এ লক্ষ্যে বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে ৫৬২ কোটি টাকা। এ জন্য টেন্ডারও হয়েছে। প্রায় এক বছর পেরিয়ে গেলেও ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানগুলো কাজ শুরু করছে না। পানি উন্নয়ন বোর্ডের (পাউবো) তাগাদায়ও কোনো কাজ হচ্ছে না বলে জানিয়েছেন...
২ দিন আগেদেশের পরিবহন খাতের অন্যতম নিয়ন্ত্রণকারী ঢাকা সড়ক পরিবহন মালিক সমিতির কমিটির বৈধতা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। সাইফুল আলমের নেতৃত্বাধীন এ কমিটিকে নিবন্ধন দেয়নি শ্রম অধিদপ্তর। তবে এটি কার্যক্রম চালাচ্ছে। কমিটির নেতারা অংশ নিচ্ছেন ঢাকা পরিবহন সমন্বয় কর্তৃপক্ষ (ডিটিসিএ) ও বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষের...
৩ দিন আগেআলুর দাম নিয়ন্ত্রণে ব্যর্থ হয়ে এবার নিজেই বিক্রির উদ্যোগ নিয়েছে সরকার। বাজার স্থিতিশীল রাখতে ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশের (টিসিবি) মাধ্যমে রাজধানীতে ভ্রাম্যমাণ ট্রাকের মাধ্যমে ভর্তুকি মূল্যে আলু বিক্রি করা হবে। একজন গ্রাহক ৪০ টাকা দরে সর্বোচ্চ তিন কেজি আলু কিনতে পারবেন...
৩ দিন আগেসপ্তাহখানেক আগে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকে অনেকের ওয়াল বিষাদময় হয়ে উঠেছিল ফুলের মতো ছোট্ট শিশু মুনতাহাকে হত্যার ঘটনায়। ৫ বছর বয়সী সিলেটের এই শিশুকে অপহরণের পর হত্যা করে লাশ গুম করতে ডোবায় ফেলে রাখা হয়েছিল। প্রতিবেশী গৃহশিক্ষকের পরিকল্পনায় অপহরণের পর তাকে নির্মমভাবে হত্যা করা হয়...
৩ দিন আগে