চিররঞ্জন সরকার
দুর্নীতি হয়তো দেশের সব প্রতিষ্ঠানেই আছে। কিন্তু দুর্নামটা পুলিশের ক্ষেত্রে বেশি। পুলিশের নামে কলঙ্ক দিয়ে, তাদের একটা গালি দিয়ে আমাদের দেশের মানুষ কেন জানি বিমলানন্দ লাভ করে। এর জন্য অবশ্য পুলিশও কম দায়ী নয়। পত্রিকার পাতা ওলটালেই পুলিশের অপকর্মের খবর চোখে পড়ে। এ লেখাটি লিখতে বসার আগে খবরের কাগজ পড়তে গিয়ে পুলিশসংক্রান্ত দুটো খবর চোখে পড়ল।
আজকের পত্রিকার খবর হলো: বাথরুমের ওপর দিয়ে নারীর গোসলের দৃশ্য গোপনে মোবাইলে ধারণ করছিলেন এক পুলিশ সদস্য।ভিডিও করার সময় স্থানীয়রা টের পেয়ে চিৎকার করলে আশপাশের লোকজন ছুটে আসে। পরে তাঁরা হাতেনাতে আটক করে অভিযুক্ত পুলিশ সদস্যকে। ঘটনাটি ঘটেছে গাইবান্ধার পৌর শহরের দক্ষিণ ধানগড়ায়। ওদিকে প্রথম আলো লিখেছে: রাজধানীর মিরপুরের একটি আবাসিক হোটেলে মাদক কারবারিকে আটকে রেখে ৭ লাখ ৮০ হাজার টাকা আদায় করে ছেড়ে দিয়েছেন বগুড়া জেলা গোয়েন্দা পুলিশের (ডিবি) কয়েকজন সদস্য। গত ১২ মে ঘটনাটি ঘটেছে মিরপুর ২ নম্বরের বড়বাগ এলাকার একটি আবাসিক হোটেলে।
এমন খবর প্রায় প্রতিদিনই দেখা যায়। ঘুষ-দুর্নীতি-চাঁদাবাজি-হয়রানি তো মামুলি ঘটনা, ছিনতাই, খুন, ধর্ষণের মতো অপরাধের সঙ্গে আমাদের দেশের পুলিশ সদস্যরা নিয়মিত জড়িয়ে পড়ছেন। কেউ কেউ অভিযুক্ত হচ্ছেন, সাজা ভোগ করছেন, চাকরি হারাচ্ছেন। তবে বেশির ভাগই ধরাছোঁয়ার বাইরে থেকে যাচ্ছেন। আর এসব কারণেই গোটা সমাজে পুলিশ সম্পর্কে একটা নেতিবাচক ধারণা তৈরি হয়েছে।
অবশ্য প্রাচীনকাল থেকেই আমাদের দেশে পুলিশ সম্পর্কে একটা নেতিবাচক ধারণা বিদ্যমান। আমাদের সাহিত্যে, স্মৃতিকথায় তো অনাস্থার চিত্রই ছড়িয়ে রয়েছে নানাভাবে। রবীন্দ্রনাথ দিয়েই শুরু করা যাক। কলকাতার এক পুলিশ কর্মকর্তা পঞ্চানন ঘোষাল তাঁর স্মৃতিকথায় লিখেছেন, লেখক হিসেবে তিনি একবার দেখা করতে গিয়েছিলেন রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে।
পঞ্চাননবাবুর পুলিশ পরিচয় শুনে রবীন্দ্রনাথ তাঁকে অপরাধজগৎ নিয়ে লিখতে বলেন এবং সেই সঙ্গে পুলিশ সম্পর্কে মন্তব্য করেন, ‘পুলিশ যদি কারোর পা-ও জড়িয়ে ধরে তো লোকে মনে করে যে পুলিশ তার জুতো জোড়াটা সরাবার মতলব করছে।’ রবীন্দ্রনাথ পঞ্চাননবাবুকে ‘লোকের মনে করার কথা’ বলেছেন। নিজের মনেও কিন্তু পুলিশ সম্পর্কে উচ্চ ধারণা ছিল না। যে কারণে তাঁর লেখা উপন্যাস ‘গোরা’য় গরিব সন্তানের পক্ষে পিতামাতার শ্রাদ্ধ করাটা কতটা কঠিন সে প্রসঙ্গে উপমা দিতে গিয়ে টেনে আনেন পুলিশকে এবং তাদের বিদ্ধও করেন কঠোরভাবে। লেখেন, ‘যেমন ডাকাতির অপেক্ষা পুলিশ-তদন্ত গ্রামের পক্ষে গুরুতর দুর্ঘটনা, তেমনি মা-বাপের মৃত্যুর অপেক্ষা মা-বাপের শ্রাদ্ধ করাটা দুর্ভাগ্যের কারণ হইয়া ওঠে।’
বিখ্যাত লেখক সুকুমার রায় ‘ঘুষ খায় দারোগায়’ লিখে দারোগা এবং ঘুষকে সমার্থক করে দিয়ে গেছেন। রবীন্দ্রনাথের ‘দুর্বুদ্ধি’ গল্পটিও এ প্রসঙ্গে উল্লেখ করা যায়। দারোগা ললিত চক্রবর্তী এ গল্পে পাড়াগেঁয়ে নেটিভ ডাক্তারটিকে ভিটেছাড়া করে। অপরাধ? সে দারোগার মুখের ওপর তার অমানবিক আচরণ দেখে বলেছিল, ‘আপনি মানুষ, না পিশাচ?’ বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘মুক্তি’ গল্পের তুলসী দারোগা আবার আর এককাঠি সরেস। ছয়কে নয় করাতে ওস্তাদ এই দারোগার চরিত্রের দোষও বিলক্ষণ। সুন্দরী গ্রাম্যবধূ নিস্তারিণীর ওপর তার কুনজর পড়ে।
পুলিশ থেকে নায়ক হওয়া ধীরাজ ভট্টাচার্য তাঁর স্মৃতিকথায় লিখেছেন, ‘পুলিশের নাম শুনলেই লোকে ঘৃণায় ভ্রুকুঁচকে প্রকাশ্যে গালাগাল দিতে শুরু করে।’ আর পঞ্চানন ঘোষাল শুনিয়েছেন তাঁর এ রকমই এক অভিজ্ঞতার কথা। একবার ট্রেনে আসার সময় একটি পরিবারের সঙ্গে পঞ্চাননবাবুর ঘনিষ্ঠতা হয়। পরিবারের কর্তাটি তাঁর বালিগঞ্জের বাড়িতে পঞ্চাননবাবুকে একবার পায়ের ধুলো দিতে বলেন। এরপর হাওড়া স্টেশনে নামার পরে ভদ্রলোক বলেন, ‘আপনার সঙ্গে আলাপ করে ভালো লাগল। কিন্তু মশাই কী করেন তা জানা হলো না।’ পঞ্চাননবাবু নিজের পরিচয় দিলে ভদ্রলোক অবাক হয়ে বলেন, ‘সে কী, আপনি পুলিশ অফিসার! আমি তো ভেবেছিলাম ভদ্রলোক।’
বঙ্কিমচন্দ্রের ‘রজনী’ উপন্যাসে মহাদেব দারোগার সঙ্গেও অনেক বাঙালি পাঠকের পরিচয় আছে। রজনীর বাবা হরেকৃষ্ণ দাস বাড়িতে একাকী মারা গেলে মহাদেব দারোগা দলবল নিয়ে এসে হরেকৃষ্ণ দাসের ঘরের সবকিছু হস্তগত করে। হরেকৃষ্ণ মৃত্যুকালে গোবিন্দকান্ত দত্তের কাছে কিছু অলংকার রেখে গিয়েছিলেন। মহাদেব দারোগা সে খবর জানতে পেরে তাকে ডাকিয়ে এনে সেগুলোও করায়ত্ত করেন।
হরেকৃষ্ণ দাসের কন্যা রয়েছে—এ খবরকে মহাদেব পাত্তা না দিয়ে অলংকারগুলো নিজের মেয়ের ব্যবহারের জন্য পাঠিয়ে দেয় বাড়িতে।
সাহিত্যে পুলিশের এমন চরিত্রচিত্রণ নিশ্চয়ই বানানো নয়। হুতোম অনেক আগেই তাঁর নকশায় লিখেছেন, ‘পুলিশের সার্জন-দারোগা-জমাদার প্রভৃতি গরিবের যমেরা থানায় ফিরে যাচ্ছেন; সকলেরই সিকি, আধুলি পয়সা ও টাকায় ট্যাঁক ও পকেট পরিপূর্ণ।’ এ তো ঘুষের গল্প। আর অত্যাচার? একটি প্রাচীন বাংলা পত্রিকা খোলাখুলি লেখে, ‘এই সংসারে যত প্রকার অত্যাচার আছে, তন্মধ্যে বঙ্গীয় পুলিশের অত্যাচারই সর্বাপেক্ষা কঠোর, নিষ্ঠুর ও নৃশংস।’
কম বেতন এবং এ দেশীয়দের জন্য পদোন্নতির কম সুযোগ স্বাধীনতার আগে ভদ্র ও শিক্ষিত যুবকদের পুলিশের চাকরিতে খুব একটা প্রলোভিত করত না। ফলে শিক্ষাদীক্ষাহীন সুযোগসন্ধানী মানুষেরাই এই চাকরিতে ঢুকতেন। কিন্তু এখন অবস্থা পাল্টেছে। অন্য আর পাঁচটা সরকারি চাকরির মতো পুলিশের চাকরিও লোভনীয় ও দুর্লভ। শিক্ষিত ভদ্রজনদের পুলিশের চাকরি নিয়ে নাক সিটকানোর দিন আর নেই। কিন্তু তাদের অবাধ প্রবেশ সত্ত্বেও পুলিশ সম্পর্কে সাধারণ মানুষের ধারণা তেমন উজ্জ্বল হয়নি।
এ প্রসঙ্গে ‘পথের দাবী’র নিমাইবাবুর সেই কথাটা আজও প্রাসঙ্গিক। ‘বাইরে থেকে তোরা পুলিশকে যত মন্দ মনে করিস, সবাই তা নয়, কিন্তু মুখ বুজে যত দুঃখ আমাদের পোহাতে হয় তা যদি জানতে তো তোমার এই দারোগা কাকাবাবুটিকে অত ঘৃণা করতে পারতে না অপূর্ব।’
আসলে রাজা বদল হয়, কিন্তু বদলায় না শাসনের রীতি ও পথ। তাই আজও অনেক ক্ষেত্রেই তাদের মুখ বুজে সব সয়ে যেতে হয় আর রাগে বেদনায় নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায়ের ‘মহানন্দা’ উপন্যাসের দারোগা মফিজুর রহমানের মতো বলতে হয়, ‘পুলিশের চাকরি, এমন পাজি কাজ ভূ-ভারতে আর নেই।’
তবে আমাদের দেশে পুলিশ সম্পর্কে ‘অতিকথন’ বেশি। একদিন এক দারোগা সাহেবের পকেট থেকে তাঁর স্ত্রী ১০০ টাকা ‘চুরি’ করেন। সবাই জানে, স্বামীর পকেট থেকে টাকা সরানোর নাম চুরি নয়। যা-ই হোক, দারোগা সাহেব সঙ্গে সঙ্গে খপ করে স্ত্রীর হাত ধরে বলেন, আজ তোমাকে ছাড়ব না। আমি পুলিশের লোক। তোমাকে লালঘরে ঢোকাবই। স্ত্রী তাঁর শাড়ির খুঁট থেকে ১০ টাকার একটি নোট বের করে স্বামীর হাতে দিয়ে বলেন, এই নাও তোমার দক্ষিণা। হাতটা এবার ছেড়ে দাও। কথা আর বাড়িয়ো না। বাড়ির বাইরে ঘুষ খাওয়া নিয়ে কোনো কোনো পুলিশের বদনাম আছে।
তবে দুই-চারজন দুর্নীতিপরায়ণের জন্য একটা বিভাগের সবাইকে দায়ী করা যায় না। বাংলায় একটা প্রবাদ আছে, ‘হকল মাছে ময়লা খায়, আর লাড়িয়ার উপরে দোষ যায়’। ঘুষ নেওয়ার জন্য শুধু পুলিশকে কেন দোষারোপ করা হবে? অন্যান্য অনেক বিভাগের কর্মচারীও ঘুষ নেন। ওপরতলার অনেক রাঘববোয়ালও ঘুষ খান। কিন্তু দোষ হয় পুলিশের! আসলে বদনাম হজম করাই বুঝি আমাদের দেশের পুলিশের নিয়তি!
পরিশেষে পুলিশ নিয়ে একটি ভিনদেশি গল্প। আইফেল টাওয়ারের অদূরে এক সুন্দরী নারী পর্যটক হেঁটে বেড়াচ্ছেন। তাঁকে অনুসরণ করছেন স্থানীয় এক যুবক। উপায়ান্তর না দেখে মেয়েটি এগিয়ে গেলেন পুলিশের কাছে। বললেন, ‘ওই লম্বামতন লোকটা আমার পিছু ছাড়ছে না। আমি যেখানে যাচ্ছি, সেও যাচ্ছে আমার পিছু পিছু। আমি খুবই বিরক্ত বোধ করছি।’ পুলিশ ভদ্রলোক নির্বিকারভাবে বললেন, ‘ডিউটিতে না থাকলে আমিও একই কাজ করতাম!’
লেখক: গবেষক ও কলামিস্ট
দুর্নীতি হয়তো দেশের সব প্রতিষ্ঠানেই আছে। কিন্তু দুর্নামটা পুলিশের ক্ষেত্রে বেশি। পুলিশের নামে কলঙ্ক দিয়ে, তাদের একটা গালি দিয়ে আমাদের দেশের মানুষ কেন জানি বিমলানন্দ লাভ করে। এর জন্য অবশ্য পুলিশও কম দায়ী নয়। পত্রিকার পাতা ওলটালেই পুলিশের অপকর্মের খবর চোখে পড়ে। এ লেখাটি লিখতে বসার আগে খবরের কাগজ পড়তে গিয়ে পুলিশসংক্রান্ত দুটো খবর চোখে পড়ল।
আজকের পত্রিকার খবর হলো: বাথরুমের ওপর দিয়ে নারীর গোসলের দৃশ্য গোপনে মোবাইলে ধারণ করছিলেন এক পুলিশ সদস্য।ভিডিও করার সময় স্থানীয়রা টের পেয়ে চিৎকার করলে আশপাশের লোকজন ছুটে আসে। পরে তাঁরা হাতেনাতে আটক করে অভিযুক্ত পুলিশ সদস্যকে। ঘটনাটি ঘটেছে গাইবান্ধার পৌর শহরের দক্ষিণ ধানগড়ায়। ওদিকে প্রথম আলো লিখেছে: রাজধানীর মিরপুরের একটি আবাসিক হোটেলে মাদক কারবারিকে আটকে রেখে ৭ লাখ ৮০ হাজার টাকা আদায় করে ছেড়ে দিয়েছেন বগুড়া জেলা গোয়েন্দা পুলিশের (ডিবি) কয়েকজন সদস্য। গত ১২ মে ঘটনাটি ঘটেছে মিরপুর ২ নম্বরের বড়বাগ এলাকার একটি আবাসিক হোটেলে।
এমন খবর প্রায় প্রতিদিনই দেখা যায়। ঘুষ-দুর্নীতি-চাঁদাবাজি-হয়রানি তো মামুলি ঘটনা, ছিনতাই, খুন, ধর্ষণের মতো অপরাধের সঙ্গে আমাদের দেশের পুলিশ সদস্যরা নিয়মিত জড়িয়ে পড়ছেন। কেউ কেউ অভিযুক্ত হচ্ছেন, সাজা ভোগ করছেন, চাকরি হারাচ্ছেন। তবে বেশির ভাগই ধরাছোঁয়ার বাইরে থেকে যাচ্ছেন। আর এসব কারণেই গোটা সমাজে পুলিশ সম্পর্কে একটা নেতিবাচক ধারণা তৈরি হয়েছে।
অবশ্য প্রাচীনকাল থেকেই আমাদের দেশে পুলিশ সম্পর্কে একটা নেতিবাচক ধারণা বিদ্যমান। আমাদের সাহিত্যে, স্মৃতিকথায় তো অনাস্থার চিত্রই ছড়িয়ে রয়েছে নানাভাবে। রবীন্দ্রনাথ দিয়েই শুরু করা যাক। কলকাতার এক পুলিশ কর্মকর্তা পঞ্চানন ঘোষাল তাঁর স্মৃতিকথায় লিখেছেন, লেখক হিসেবে তিনি একবার দেখা করতে গিয়েছিলেন রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে।
পঞ্চাননবাবুর পুলিশ পরিচয় শুনে রবীন্দ্রনাথ তাঁকে অপরাধজগৎ নিয়ে লিখতে বলেন এবং সেই সঙ্গে পুলিশ সম্পর্কে মন্তব্য করেন, ‘পুলিশ যদি কারোর পা-ও জড়িয়ে ধরে তো লোকে মনে করে যে পুলিশ তার জুতো জোড়াটা সরাবার মতলব করছে।’ রবীন্দ্রনাথ পঞ্চাননবাবুকে ‘লোকের মনে করার কথা’ বলেছেন। নিজের মনেও কিন্তু পুলিশ সম্পর্কে উচ্চ ধারণা ছিল না। যে কারণে তাঁর লেখা উপন্যাস ‘গোরা’য় গরিব সন্তানের পক্ষে পিতামাতার শ্রাদ্ধ করাটা কতটা কঠিন সে প্রসঙ্গে উপমা দিতে গিয়ে টেনে আনেন পুলিশকে এবং তাদের বিদ্ধও করেন কঠোরভাবে। লেখেন, ‘যেমন ডাকাতির অপেক্ষা পুলিশ-তদন্ত গ্রামের পক্ষে গুরুতর দুর্ঘটনা, তেমনি মা-বাপের মৃত্যুর অপেক্ষা মা-বাপের শ্রাদ্ধ করাটা দুর্ভাগ্যের কারণ হইয়া ওঠে।’
বিখ্যাত লেখক সুকুমার রায় ‘ঘুষ খায় দারোগায়’ লিখে দারোগা এবং ঘুষকে সমার্থক করে দিয়ে গেছেন। রবীন্দ্রনাথের ‘দুর্বুদ্ধি’ গল্পটিও এ প্রসঙ্গে উল্লেখ করা যায়। দারোগা ললিত চক্রবর্তী এ গল্পে পাড়াগেঁয়ে নেটিভ ডাক্তারটিকে ভিটেছাড়া করে। অপরাধ? সে দারোগার মুখের ওপর তার অমানবিক আচরণ দেখে বলেছিল, ‘আপনি মানুষ, না পিশাচ?’ বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘মুক্তি’ গল্পের তুলসী দারোগা আবার আর এককাঠি সরেস। ছয়কে নয় করাতে ওস্তাদ এই দারোগার চরিত্রের দোষও বিলক্ষণ। সুন্দরী গ্রাম্যবধূ নিস্তারিণীর ওপর তার কুনজর পড়ে।
পুলিশ থেকে নায়ক হওয়া ধীরাজ ভট্টাচার্য তাঁর স্মৃতিকথায় লিখেছেন, ‘পুলিশের নাম শুনলেই লোকে ঘৃণায় ভ্রুকুঁচকে প্রকাশ্যে গালাগাল দিতে শুরু করে।’ আর পঞ্চানন ঘোষাল শুনিয়েছেন তাঁর এ রকমই এক অভিজ্ঞতার কথা। একবার ট্রেনে আসার সময় একটি পরিবারের সঙ্গে পঞ্চাননবাবুর ঘনিষ্ঠতা হয়। পরিবারের কর্তাটি তাঁর বালিগঞ্জের বাড়িতে পঞ্চাননবাবুকে একবার পায়ের ধুলো দিতে বলেন। এরপর হাওড়া স্টেশনে নামার পরে ভদ্রলোক বলেন, ‘আপনার সঙ্গে আলাপ করে ভালো লাগল। কিন্তু মশাই কী করেন তা জানা হলো না।’ পঞ্চাননবাবু নিজের পরিচয় দিলে ভদ্রলোক অবাক হয়ে বলেন, ‘সে কী, আপনি পুলিশ অফিসার! আমি তো ভেবেছিলাম ভদ্রলোক।’
বঙ্কিমচন্দ্রের ‘রজনী’ উপন্যাসে মহাদেব দারোগার সঙ্গেও অনেক বাঙালি পাঠকের পরিচয় আছে। রজনীর বাবা হরেকৃষ্ণ দাস বাড়িতে একাকী মারা গেলে মহাদেব দারোগা দলবল নিয়ে এসে হরেকৃষ্ণ দাসের ঘরের সবকিছু হস্তগত করে। হরেকৃষ্ণ মৃত্যুকালে গোবিন্দকান্ত দত্তের কাছে কিছু অলংকার রেখে গিয়েছিলেন। মহাদেব দারোগা সে খবর জানতে পেরে তাকে ডাকিয়ে এনে সেগুলোও করায়ত্ত করেন।
হরেকৃষ্ণ দাসের কন্যা রয়েছে—এ খবরকে মহাদেব পাত্তা না দিয়ে অলংকারগুলো নিজের মেয়ের ব্যবহারের জন্য পাঠিয়ে দেয় বাড়িতে।
সাহিত্যে পুলিশের এমন চরিত্রচিত্রণ নিশ্চয়ই বানানো নয়। হুতোম অনেক আগেই তাঁর নকশায় লিখেছেন, ‘পুলিশের সার্জন-দারোগা-জমাদার প্রভৃতি গরিবের যমেরা থানায় ফিরে যাচ্ছেন; সকলেরই সিকি, আধুলি পয়সা ও টাকায় ট্যাঁক ও পকেট পরিপূর্ণ।’ এ তো ঘুষের গল্প। আর অত্যাচার? একটি প্রাচীন বাংলা পত্রিকা খোলাখুলি লেখে, ‘এই সংসারে যত প্রকার অত্যাচার আছে, তন্মধ্যে বঙ্গীয় পুলিশের অত্যাচারই সর্বাপেক্ষা কঠোর, নিষ্ঠুর ও নৃশংস।’
কম বেতন এবং এ দেশীয়দের জন্য পদোন্নতির কম সুযোগ স্বাধীনতার আগে ভদ্র ও শিক্ষিত যুবকদের পুলিশের চাকরিতে খুব একটা প্রলোভিত করত না। ফলে শিক্ষাদীক্ষাহীন সুযোগসন্ধানী মানুষেরাই এই চাকরিতে ঢুকতেন। কিন্তু এখন অবস্থা পাল্টেছে। অন্য আর পাঁচটা সরকারি চাকরির মতো পুলিশের চাকরিও লোভনীয় ও দুর্লভ। শিক্ষিত ভদ্রজনদের পুলিশের চাকরি নিয়ে নাক সিটকানোর দিন আর নেই। কিন্তু তাদের অবাধ প্রবেশ সত্ত্বেও পুলিশ সম্পর্কে সাধারণ মানুষের ধারণা তেমন উজ্জ্বল হয়নি।
এ প্রসঙ্গে ‘পথের দাবী’র নিমাইবাবুর সেই কথাটা আজও প্রাসঙ্গিক। ‘বাইরে থেকে তোরা পুলিশকে যত মন্দ মনে করিস, সবাই তা নয়, কিন্তু মুখ বুজে যত দুঃখ আমাদের পোহাতে হয় তা যদি জানতে তো তোমার এই দারোগা কাকাবাবুটিকে অত ঘৃণা করতে পারতে না অপূর্ব।’
আসলে রাজা বদল হয়, কিন্তু বদলায় না শাসনের রীতি ও পথ। তাই আজও অনেক ক্ষেত্রেই তাদের মুখ বুজে সব সয়ে যেতে হয় আর রাগে বেদনায় নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায়ের ‘মহানন্দা’ উপন্যাসের দারোগা মফিজুর রহমানের মতো বলতে হয়, ‘পুলিশের চাকরি, এমন পাজি কাজ ভূ-ভারতে আর নেই।’
তবে আমাদের দেশে পুলিশ সম্পর্কে ‘অতিকথন’ বেশি। একদিন এক দারোগা সাহেবের পকেট থেকে তাঁর স্ত্রী ১০০ টাকা ‘চুরি’ করেন। সবাই জানে, স্বামীর পকেট থেকে টাকা সরানোর নাম চুরি নয়। যা-ই হোক, দারোগা সাহেব সঙ্গে সঙ্গে খপ করে স্ত্রীর হাত ধরে বলেন, আজ তোমাকে ছাড়ব না। আমি পুলিশের লোক। তোমাকে লালঘরে ঢোকাবই। স্ত্রী তাঁর শাড়ির খুঁট থেকে ১০ টাকার একটি নোট বের করে স্বামীর হাতে দিয়ে বলেন, এই নাও তোমার দক্ষিণা। হাতটা এবার ছেড়ে দাও। কথা আর বাড়িয়ো না। বাড়ির বাইরে ঘুষ খাওয়া নিয়ে কোনো কোনো পুলিশের বদনাম আছে।
তবে দুই-চারজন দুর্নীতিপরায়ণের জন্য একটা বিভাগের সবাইকে দায়ী করা যায় না। বাংলায় একটা প্রবাদ আছে, ‘হকল মাছে ময়লা খায়, আর লাড়িয়ার উপরে দোষ যায়’। ঘুষ নেওয়ার জন্য শুধু পুলিশকে কেন দোষারোপ করা হবে? অন্যান্য অনেক বিভাগের কর্মচারীও ঘুষ নেন। ওপরতলার অনেক রাঘববোয়ালও ঘুষ খান। কিন্তু দোষ হয় পুলিশের! আসলে বদনাম হজম করাই বুঝি আমাদের দেশের পুলিশের নিয়তি!
পরিশেষে পুলিশ নিয়ে একটি ভিনদেশি গল্প। আইফেল টাওয়ারের অদূরে এক সুন্দরী নারী পর্যটক হেঁটে বেড়াচ্ছেন। তাঁকে অনুসরণ করছেন স্থানীয় এক যুবক। উপায়ান্তর না দেখে মেয়েটি এগিয়ে গেলেন পুলিশের কাছে। বললেন, ‘ওই লম্বামতন লোকটা আমার পিছু ছাড়ছে না। আমি যেখানে যাচ্ছি, সেও যাচ্ছে আমার পিছু পিছু। আমি খুবই বিরক্ত বোধ করছি।’ পুলিশ ভদ্রলোক নির্বিকারভাবে বললেন, ‘ডিউটিতে না থাকলে আমিও একই কাজ করতাম!’
লেখক: গবেষক ও কলামিস্ট
গাজীপুর মহানগরের বোর্ডবাজার এলাকার ইসলামিক ইউনিভার্সিটি অব টেকনোলজির (আইইউটি) মেকানিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের শিক্ষার্থীরা পিকনিকে যাচ্ছিলেন শ্রীপুরের মাটির মায়া ইকো রিসোর্টে। ঢাকা-ময়মনসিংহ মহাসড়ক থেকে বাসগুলো গ্রামের সরু সড়কে ঢোকার পর বিদ্যুতের তারে জড়িয়ে যায় বিআরটিসির একটি দোতলা বাস...
৪ দিন আগেঝড়-জলোচ্ছ্বাস থেকে রক্ষায় সন্দ্বীপের ব্লক বেড়িবাঁধসহ একাধিক প্রকল্প হাতে নিয়েছে সরকার। এ লক্ষ্যে বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে ৫৬২ কোটি টাকা। এ জন্য টেন্ডারও হয়েছে। প্রায় এক বছর পেরিয়ে গেলেও ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানগুলো কাজ শুরু করছে না। পানি উন্নয়ন বোর্ডের (পাউবো) তাগাদায়ও কোনো কাজ হচ্ছে না বলে জানিয়েছেন...
৮ দিন আগেদেশের পরিবহন খাতের অন্যতম নিয়ন্ত্রণকারী ঢাকা সড়ক পরিবহন মালিক সমিতির কমিটির বৈধতা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। সাইফুল আলমের নেতৃত্বাধীন এ কমিটিকে নিবন্ধন দেয়নি শ্রম অধিদপ্তর। তবে এটি কার্যক্রম চালাচ্ছে। কমিটির নেতারা অংশ নিচ্ছেন ঢাকা পরিবহন সমন্বয় কর্তৃপক্ষ (ডিটিসিএ) ও বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষের...
৮ দিন আগেআলুর দাম নিয়ন্ত্রণে ব্যর্থ হয়ে এবার নিজেই বিক্রির উদ্যোগ নিয়েছে সরকার। বাজার স্থিতিশীল রাখতে ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশের (টিসিবি) মাধ্যমে রাজধানীতে ভ্রাম্যমাণ ট্রাকের মাধ্যমে ভর্তুকি মূল্যে আলু বিক্রি করা হবে। একজন গ্রাহক ৪০ টাকা দরে সর্বোচ্চ তিন কেজি আলু কিনতে পারবেন...
৮ দিন আগে