মোনায়েম সরকার
ক্ষমতা গ্রহণের দুই মাস পূর্ণ হওয়ার আগেই দেশের ভেতর নানা ধরনের বিতর্কে জড়িয়ে পড়ছে ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে গঠিত অন্তর্বর্তী সরকার। তবে ব্যক্তিগতভাবে ড. ইউনূস আমেরিকা জয় করে এসেছেন। জাতিসংঘের ৭৯তম অধিবেশনে যোগ দেওয়ার জন্য আমেরিকা গিয়ে ড. ইউনূস সে দেশের বর্তমান ও সাবেক প্রেসিডেন্টের কাছে যে খাতির-সমাদর পেয়েছেন তার তুলনা হয় না। সাধারণ পরিষদের অধিবেশনে বাংলায় বক্তৃতা দেওয়ার পাশাপাশি আমেরিকার প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন, সাবেক প্রেসিডেন্ট বিল ক্লিনটন, পররাষ্ট্রমন্ত্রী অ্যান্টনি ব্লিঙ্কেন, কানাডার প্রধানমন্ত্রী জাস্টিন ট্রুডোর সঙ্গে বৈঠক করেছেন ইউনূস। পাশাপাশি, ইউরোপীয় কমিশনের প্রেসিডেন্ট, বিশ্বব্যাংকের প্রধান এবং এডিবির শীর্ষকর্তার সঙ্গেও আলাদা করে আলোচনা হয়েছে তাঁর। এইসব দেখা-সাক্ষাৎ ও আলাপ-আলোচনা থেকে এটা স্পষ্ট হয়েছে যে ড. ইউনূসের নেতৃত্বে বাংলাদেশের হাসিনা-পরবর্তী বর্তমান সরকারের প্রতি পশ্চিমি দুনিয়া এবং আমেরিকার পূর্ণ সমর্থন এবং সহযোগিতা অব্যাহত থাকবে ভবিষ্যতে। এটা সুখবর বৈকি!
তবে দেশের ভেতরে শুরুতে ড. মুহাম্মদ ইউনূসকে নিয়ে অনেকের মধ্যে যে আবেগ-উচ্ছ্বাস দেখা গিয়েছিল, দিন দিন তা অনেক কমে আসছে। রাজনীতি যে খুব সহজ বিষয় নয়, রাজনীতিতে প্রশংসা ও নিন্দা যে সবার ক্ষেত্রে সমান স্থায়ী হয় না, তার অনেক প্রমাণ ইতিহাস থেকে দেওয়া যায়। ড. ইউনূসের ক্ষেত্রে কোনটা সত্য হবে, সেটা বলার সময় এখনই নয়।
তবে এটা বলা যায় যে ক্ষুদ্রঋণের প্রবক্তা ড. ইউনূস চার দিনের জন্য নিউইয়র্ক গিয়ে দেশকে এক বৃহৎ উচ্চতায় পৌঁছে দিয়েছেন। আমেরিকার প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন তাঁর সঙ্গে বৈঠক করেছেন, আলিঙ্গনাবদ্ধ হয়েছেন। বিভিন্ন দেশের সরকার ও রাষ্ট্রপ্রধান তাঁর সঙ্গে দেখা করে তাঁর সরকারকে সব ধরনের সহযোগিতার আশ্বাস দিয়েছেন। নিন্দুক ছাড়া তাঁর এতসব অর্জনকে কেউ ‘ক্ষুদ্র’ বলে নিন্দামন্দ করবে না নিশ্চয়ই।
নিউইয়র্কে অবস্থানকালে ড. মুহাম্মদ ইউনূস দেশটির সাবেক প্রেসিডেন্ট বিল ক্লিনটনের প্রতিষ্ঠান ‘ক্লিনটন গ্লোবাল ইনিশিয়েটিভ’-এর একটি অনুষ্ঠানে অংশ নিয়েছিলেন। জ্যাকসন হাইটসে আয়োজিত ওই অনুষ্ঠানের মঞ্চে ড. ইউনূস তাঁর দীর্ঘদিনের বন্ধু সাবেক প্রেসিডেন্ট বিল ক্লিনটনের সঙ্গে নানা বিষয়ে কথা বলার ফাঁকে সফরসঙ্গীদের দুইজনকে পরিচয় করিয়ে দেন। প্রধান উপদেষ্টা তাঁর বিশেষ সহকারী মো. মাহফুজ আলমকে সাম্প্রতিক কোটা সংস্কার আন্দোলন ও পরে সরকার পতনের আন্দোলনের কারিগর বা ‘মাস্টারমাইন্ড’ হিসেবে উল্লেখ করেন। শুধু তা-ই নয়, ড. ইউনূস আরও বলেন, ছাত্র আন্দোলনটি অত্যন্ত পরিকল্পিত, নিখুঁত ও খুব গোছানো ছিল।
ড. ইউনূসের এইসব বক্তব্যের প্রতিক্রিয়া দেশের অভ্যন্তরে খুব ইতিবাচক হয়েছে কি? ছাত্র-জনতার স্বতঃস্ফূর্ত আন্দোলনে কোনো মাস্টারমাইন্ড থাকার কথা নয়। কোনো বিশেষ ব্যক্তি, দল বা সংগঠন এই আন্দোলনের নেতৃত্বে ছিল না। তা ছাড়া, ড. ইউনূস ছাত্রসমাজের এই আন্দোলনকে সরকার পতনের পরিকল্পিত আন্দোলন বলে স্বীকার করায় এখন ওই আন্দোলনকে স্বতঃস্ফূর্ত ও অরাজনৈতিক ভেবে যাঁরা অংশ নিয়েছিলেন, তাঁদের কেউ কেউ নিজেদের ‘আহাম্মক’ মনে করে মাথা কুটছেন।
কোটাবিরোধী আন্দোলনে বিএনপি-জামায়াত ঢুকেছে বলে শেখ হাসিনার সরকারের পক্ষ থেকে অভিযোগ করা হলে তখন বড় গলায় যাঁরা প্রতিবাদ করতেন, তাঁরা এখন ‘খামোশ’ হয়েছেন আন্দোলনে নেতৃত্ব দেওয়া সমন্বয়কদের কারও কারও পরিচয় জেনে। ইসলামী ছাত্রশিবিরের নেতারা পরিচয় গোপন করে, এমনকি ছাত্রলীগে নাম লিখিয়েও যে বৈষম্যবিরোধী সেজেছিল, সেসব তথ্য সামনে আসায় সাধারণ মানুষের মধ্যে কি খুব ভালো প্রতিক্রিয়া হয়েছে?
ভয়েস অব আমেরিকার প্রবীণ সাংবাদিক আনিস আহমদের সঙ্গে এক সাক্ষাৎকারে ৩২ নম্বর, বঙ্গবন্ধু, মুক্তিযুদ্ধ ইত্যাদি বিষয়ে এক প্রশ্নের উত্তরে ড. ইউনূস বলেছেন, ‘আন্দোলনকারীরা রিসেট বাটন টিপেছে—অতীত এখন নিশ্চিহ্ন’। ড. ইউনূসের এই বক্তব্য কি বাংলাদেশের মানুষকে খুব অনুপ্রাণিত করেছে? একাত্তর, মুক্তিযুদ্ধ, বঙ্গবন্ধু যদি অতীত হয়, তাহলে বাংলাদেশের থাকে কী?
দুই.
ছাত্র-জনতার আন্দোলন পরিকল্পিত, নিখুঁত ও গোছানো হলেও ওই আন্দোলনের ফলে যে অন্তর্বর্তী সরকার ক্ষমতাসীন হয়েছে, সেই সরকারের কাজকর্ম খুব পরিকল্পিত ও গোছানো বলে মনে হচ্ছে কি? সরকারের কাজকর্মে সমন্বয়হীনতা ও পরিকল্পনার ঘাটতির প্রকাশ লক্ষ করা যাচ্ছে। সংস্কার কমিটির প্রধানদের নাম ঘোষণা ও পরিবর্তনে হোম ওয়ার্কের অভাব দেখা গেছে।
ড. ইউনূসের সরকার আওয়ামী লীগ সরকারের রেখে যাওয়া ব্যবস্থা বদলাবে, এটাই স্বাভাবিক। ওই সরকারের করা নতুন শিক্ষাক্রম অব্যাহত না রাখার সিদ্ধান্ত নিয়ে নতুন সরকার ২০১২ সালের পুরোনো শিক্ষাক্রম অনুযায়ী আগামী বছর পাঠ্যবই দেওয়ার কথা জানিয়েছে। ২০২৬ সাল থেকে নতুন শিক্ষাক্রম প্রণয়ন করে বই দেওয়ার পরিকল্পনা করা হয়। আগামী বছর চতুর্থ শ্রেণি থেকে দশম শ্রেণি পর্যন্ত নতুন শিক্ষাক্রমের পরিবর্তে ২০১২ সালে প্রণীত শিক্ষাক্রমের আলোকে তৈরি পাঠ্যবই পাবে শিক্ষার্থীরা। তবে বইয়ের বিষয়বস্তুতে কিছু পরিবর্তন হবে।
১৫ সেপ্টেম্বর এনসিটিবি প্রণীত ও মুদ্রিত সব পাঠ্যপুস্তক সংশোধন এবং পরিমার্জন কার্যক্রম সুষ্ঠুভাবে সম্পন্ন ও সমন্বয়ের লক্ষ্যে ১০ সদস্যের একটি সমন্বয় কমিটি গঠন করেছিল শিক্ষা মন্ত্রণালয়। মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব খ ম কবিরুল ইসলামকে আহ্বায়ক করে গঠিত ওই কমিটিতে সদস্য হিসেবে ছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পদার্থবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক কামরুল হাসান, বাংলা বিভাগের অধ্যাপক মোহাম্মদ আজম, সমাজবিজ্ঞান বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক সামিনা লুৎফা, প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব মাসুদ আখতার খান, এনসিটিবির চেয়ারম্যান অধ্যাপক এ কে এম রিয়াজুল হাসান, সদস্য (শিক্ষাক্রম) অধ্যাপক রবিউল কবীর চৌধুরী, সদস্য (প্রাথমিক শিক্ষাক্রম) অধ্যাপক এ এফ এম সারোয়ার জাহান, গবেষক রাখাল রাহা এবং মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা বিভাগের সিনিয়র সহকারী সচিব মো. ইয়ানুর রহমান (সদস্যসচিব)।
এর মধ্যে অধ্যাপক সামিনা লুৎফা ও অধ্যাপক কামরুল হাসানকে নিয়ে আপত্তি তোলে ধর্মভিত্তিক কয়েকটি সংগঠন। তাদের ‘ইসলামবিদ্বেষী’ বলে দাবি করা হয়। অধ্যাপক সামিনা লুৎফা ও অধ্যাপক কামরুল হাসান আওয়ামী লীগ সরকারের বিরুদ্ধে ছাত্র-জনতার আন্দোলনের সময় শিক্ষার্থীদের সঙ্গে সক্রিয় ছিলেন। সাম্প্রদায়িক গোষ্ঠীর বিরোধিতার কারণে এই কমিটি বাতিল করার ঘোষণা দেওয়ার পর শিক্ষা উপদেষ্টা অধ্যাপক ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদ গণমাধ্যমের কাছে বলেন, সময় কম, তাই পুরোনো শিক্ষাক্রমের পাঠ্যপুস্তকে ভাষাগত ও সংবেদনশীল বিষয় থাকলে তা দ্রুত সংশোধনের লক্ষ্যে প্রতিটি বিষয়ের জন্য বিশেষজ্ঞ শিক্ষকেরা কাজ করেছেন। যার মধ্যে মাদ্রাসার শিক্ষক যেমন আছেন, তেমনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকেরাও রয়েছেন।
উল্লেখ করা প্রয়োজন, বিগত আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে ২০১৭ সালে কওমি মাদ্রাসাভিত্তিক সংগঠনের প্রস্তাব অনুযায়ী তখনকার পাঠ্যপুস্তকে বেশ কিছু পরিবর্তন এনেছিল সরকার। বিতর্কের মুখে চলতি বছরের সপ্তম শ্রেণির পাঠ্যবই থেকে ‘শরীফার গল্প’ শীর্ষক বহুল আলোচিত গল্পটি বাদ দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছিল।
ধর্মভিত্তিক কিছু সংগঠনের মতামতকে গুরুত্ব দিয়ে হুট করে সমন্বয় কমিটি বাতিল করার বিষয়টি ভালোভাবে দেখছেন না অনেকেই। অর্থনীতিবিদ অধ্যাপক আনু মুহাম্মদ বলেছেন, গণ-অভ্যুত্থানের মাধ্যমে এই সরকার এসেছে। তাদের প্রতি জনগণের আস্থা ও প্রত্যাশা ব্যাপক। পাঠ্যপুস্তক পরিমার্জনে সমন্বয় কমিটি বাতিলের মাধ্যমে সরকার সেই আস্থা ও প্রত্যাশার ওপর নিজেই আঘাত করল। এই কমিটি নিশ্চয়ই সরকার বুঝেশুনে করেছিল। সেখানে বাইরের নানা কথাবার্তা বা মিথ্যাচার ও হিংসামিশ্রিত প্রচারণার পর কমিটি বাতিলের মাধ্যমে সরকারের দুর্বলতাই প্রকাশিত হলো। এটা গণতান্ত্রিক রূপান্তর ও শিক্ষা সংস্কারের পথে খুবই খারাপ দৃষ্টান্ত হবে।
অন্যদিকে কমিটি বাতিলের ঘটনাকে মৌলবাদের সঙ্গে অন্তর্বর্তী সরকারের আপসকামিতাকে উদ্বেগজনক দৃষ্টান্ত হিসেবে উল্লেখ করেছে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ (টিআইবি)। টিআইবির নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান এক বিবৃতিতে বলেছেন, কর্তৃত্ববাদী সরকারের বহুমাত্রিক ও নজিরবিহীন মানবাধিকার লঙ্ঘন এবং হাজারো শহীদের আত্মত্যাগের বিনিময়ে ছাত্র-জনতা নতুন বাংলাদেশ বিনির্মাণের সুযোগ সৃষ্টি করেছে, যা ধর্মীয়, সামাজিক, সাংস্কৃতিকসহ সব বৈচিত্র্য-মতাদর্শের শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান ও সম-অধিকার নিশ্চিত করবে। পাশাপাশি নতুন বাংলাদেশ বৈষম্যমুক্ত, অসাম্প্রদায়িক, স্বচ্ছ, জবাবদিহিমূলক ও সুশাসিত হবে। যেখানে ধর্মীয় বা অন্য কোনো মতাদর্শ কারও ওপর চাপিয়ে দেওয়া হবে না। কিন্তু তাঁরা আতঙ্কের সঙ্গে লক্ষ করছেন, অসাম্প্রদায়িক চেতনা ও বহুত্বের বিরুদ্ধে কুৎসা, বিদ্বেষ, ঘৃণা ছড়িয়ে শঙ্কা ও হুমকির বাতাবরণ সৃষ্টির প্রচেষ্টা ক্রমেই উৎকট রূপ ধারণ করছে। এ ধরনের স্বার্থান্বেষী মহলের অপপ্রচার, হুমকির প্রতি নতি স্বীকার করে অন্তর্বর্তী সরকার আপস করছে; যার উদ্বেগজনক উদাহরণ হলো পাঠ্যপুস্তক সংশোধন ও পরিমার্জন সমন্বয় কমিটি বাতিলের ঘটনা। বিষয়টি একদিকে যেমন সরকারের মৌলবাদ ও সাম্প্রদায়িকতার সঙ্গে আপসের উদাহরণ, অন্যদিকে তেমনি নতুন বাংলাদেশের বৈষম্যহীন, অসাম্প্রদায়িক ও গণতান্ত্রিক দেশের আকাঙ্ক্ষার প্রতি রীতিমতো প্রহসন।
পরবর্তী সময়ে অন্তর্বর্তী সরকারের কাজকর্ম প্রহসনমুক্ত হলেই দেশের মানুষ স্বস্তি পাবে।
লেখক: রাজনীতিবিদ, লেখক, চেয়ারম্যান, বিএফডিআর
ক্ষমতা গ্রহণের দুই মাস পূর্ণ হওয়ার আগেই দেশের ভেতর নানা ধরনের বিতর্কে জড়িয়ে পড়ছে ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে গঠিত অন্তর্বর্তী সরকার। তবে ব্যক্তিগতভাবে ড. ইউনূস আমেরিকা জয় করে এসেছেন। জাতিসংঘের ৭৯তম অধিবেশনে যোগ দেওয়ার জন্য আমেরিকা গিয়ে ড. ইউনূস সে দেশের বর্তমান ও সাবেক প্রেসিডেন্টের কাছে যে খাতির-সমাদর পেয়েছেন তার তুলনা হয় না। সাধারণ পরিষদের অধিবেশনে বাংলায় বক্তৃতা দেওয়ার পাশাপাশি আমেরিকার প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন, সাবেক প্রেসিডেন্ট বিল ক্লিনটন, পররাষ্ট্রমন্ত্রী অ্যান্টনি ব্লিঙ্কেন, কানাডার প্রধানমন্ত্রী জাস্টিন ট্রুডোর সঙ্গে বৈঠক করেছেন ইউনূস। পাশাপাশি, ইউরোপীয় কমিশনের প্রেসিডেন্ট, বিশ্বব্যাংকের প্রধান এবং এডিবির শীর্ষকর্তার সঙ্গেও আলাদা করে আলোচনা হয়েছে তাঁর। এইসব দেখা-সাক্ষাৎ ও আলাপ-আলোচনা থেকে এটা স্পষ্ট হয়েছে যে ড. ইউনূসের নেতৃত্বে বাংলাদেশের হাসিনা-পরবর্তী বর্তমান সরকারের প্রতি পশ্চিমি দুনিয়া এবং আমেরিকার পূর্ণ সমর্থন এবং সহযোগিতা অব্যাহত থাকবে ভবিষ্যতে। এটা সুখবর বৈকি!
তবে দেশের ভেতরে শুরুতে ড. মুহাম্মদ ইউনূসকে নিয়ে অনেকের মধ্যে যে আবেগ-উচ্ছ্বাস দেখা গিয়েছিল, দিন দিন তা অনেক কমে আসছে। রাজনীতি যে খুব সহজ বিষয় নয়, রাজনীতিতে প্রশংসা ও নিন্দা যে সবার ক্ষেত্রে সমান স্থায়ী হয় না, তার অনেক প্রমাণ ইতিহাস থেকে দেওয়া যায়। ড. ইউনূসের ক্ষেত্রে কোনটা সত্য হবে, সেটা বলার সময় এখনই নয়।
তবে এটা বলা যায় যে ক্ষুদ্রঋণের প্রবক্তা ড. ইউনূস চার দিনের জন্য নিউইয়র্ক গিয়ে দেশকে এক বৃহৎ উচ্চতায় পৌঁছে দিয়েছেন। আমেরিকার প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন তাঁর সঙ্গে বৈঠক করেছেন, আলিঙ্গনাবদ্ধ হয়েছেন। বিভিন্ন দেশের সরকার ও রাষ্ট্রপ্রধান তাঁর সঙ্গে দেখা করে তাঁর সরকারকে সব ধরনের সহযোগিতার আশ্বাস দিয়েছেন। নিন্দুক ছাড়া তাঁর এতসব অর্জনকে কেউ ‘ক্ষুদ্র’ বলে নিন্দামন্দ করবে না নিশ্চয়ই।
নিউইয়র্কে অবস্থানকালে ড. মুহাম্মদ ইউনূস দেশটির সাবেক প্রেসিডেন্ট বিল ক্লিনটনের প্রতিষ্ঠান ‘ক্লিনটন গ্লোবাল ইনিশিয়েটিভ’-এর একটি অনুষ্ঠানে অংশ নিয়েছিলেন। জ্যাকসন হাইটসে আয়োজিত ওই অনুষ্ঠানের মঞ্চে ড. ইউনূস তাঁর দীর্ঘদিনের বন্ধু সাবেক প্রেসিডেন্ট বিল ক্লিনটনের সঙ্গে নানা বিষয়ে কথা বলার ফাঁকে সফরসঙ্গীদের দুইজনকে পরিচয় করিয়ে দেন। প্রধান উপদেষ্টা তাঁর বিশেষ সহকারী মো. মাহফুজ আলমকে সাম্প্রতিক কোটা সংস্কার আন্দোলন ও পরে সরকার পতনের আন্দোলনের কারিগর বা ‘মাস্টারমাইন্ড’ হিসেবে উল্লেখ করেন। শুধু তা-ই নয়, ড. ইউনূস আরও বলেন, ছাত্র আন্দোলনটি অত্যন্ত পরিকল্পিত, নিখুঁত ও খুব গোছানো ছিল।
ড. ইউনূসের এইসব বক্তব্যের প্রতিক্রিয়া দেশের অভ্যন্তরে খুব ইতিবাচক হয়েছে কি? ছাত্র-জনতার স্বতঃস্ফূর্ত আন্দোলনে কোনো মাস্টারমাইন্ড থাকার কথা নয়। কোনো বিশেষ ব্যক্তি, দল বা সংগঠন এই আন্দোলনের নেতৃত্বে ছিল না। তা ছাড়া, ড. ইউনূস ছাত্রসমাজের এই আন্দোলনকে সরকার পতনের পরিকল্পিত আন্দোলন বলে স্বীকার করায় এখন ওই আন্দোলনকে স্বতঃস্ফূর্ত ও অরাজনৈতিক ভেবে যাঁরা অংশ নিয়েছিলেন, তাঁদের কেউ কেউ নিজেদের ‘আহাম্মক’ মনে করে মাথা কুটছেন।
কোটাবিরোধী আন্দোলনে বিএনপি-জামায়াত ঢুকেছে বলে শেখ হাসিনার সরকারের পক্ষ থেকে অভিযোগ করা হলে তখন বড় গলায় যাঁরা প্রতিবাদ করতেন, তাঁরা এখন ‘খামোশ’ হয়েছেন আন্দোলনে নেতৃত্ব দেওয়া সমন্বয়কদের কারও কারও পরিচয় জেনে। ইসলামী ছাত্রশিবিরের নেতারা পরিচয় গোপন করে, এমনকি ছাত্রলীগে নাম লিখিয়েও যে বৈষম্যবিরোধী সেজেছিল, সেসব তথ্য সামনে আসায় সাধারণ মানুষের মধ্যে কি খুব ভালো প্রতিক্রিয়া হয়েছে?
ভয়েস অব আমেরিকার প্রবীণ সাংবাদিক আনিস আহমদের সঙ্গে এক সাক্ষাৎকারে ৩২ নম্বর, বঙ্গবন্ধু, মুক্তিযুদ্ধ ইত্যাদি বিষয়ে এক প্রশ্নের উত্তরে ড. ইউনূস বলেছেন, ‘আন্দোলনকারীরা রিসেট বাটন টিপেছে—অতীত এখন নিশ্চিহ্ন’। ড. ইউনূসের এই বক্তব্য কি বাংলাদেশের মানুষকে খুব অনুপ্রাণিত করেছে? একাত্তর, মুক্তিযুদ্ধ, বঙ্গবন্ধু যদি অতীত হয়, তাহলে বাংলাদেশের থাকে কী?
দুই.
ছাত্র-জনতার আন্দোলন পরিকল্পিত, নিখুঁত ও গোছানো হলেও ওই আন্দোলনের ফলে যে অন্তর্বর্তী সরকার ক্ষমতাসীন হয়েছে, সেই সরকারের কাজকর্ম খুব পরিকল্পিত ও গোছানো বলে মনে হচ্ছে কি? সরকারের কাজকর্মে সমন্বয়হীনতা ও পরিকল্পনার ঘাটতির প্রকাশ লক্ষ করা যাচ্ছে। সংস্কার কমিটির প্রধানদের নাম ঘোষণা ও পরিবর্তনে হোম ওয়ার্কের অভাব দেখা গেছে।
ড. ইউনূসের সরকার আওয়ামী লীগ সরকারের রেখে যাওয়া ব্যবস্থা বদলাবে, এটাই স্বাভাবিক। ওই সরকারের করা নতুন শিক্ষাক্রম অব্যাহত না রাখার সিদ্ধান্ত নিয়ে নতুন সরকার ২০১২ সালের পুরোনো শিক্ষাক্রম অনুযায়ী আগামী বছর পাঠ্যবই দেওয়ার কথা জানিয়েছে। ২০২৬ সাল থেকে নতুন শিক্ষাক্রম প্রণয়ন করে বই দেওয়ার পরিকল্পনা করা হয়। আগামী বছর চতুর্থ শ্রেণি থেকে দশম শ্রেণি পর্যন্ত নতুন শিক্ষাক্রমের পরিবর্তে ২০১২ সালে প্রণীত শিক্ষাক্রমের আলোকে তৈরি পাঠ্যবই পাবে শিক্ষার্থীরা। তবে বইয়ের বিষয়বস্তুতে কিছু পরিবর্তন হবে।
১৫ সেপ্টেম্বর এনসিটিবি প্রণীত ও মুদ্রিত সব পাঠ্যপুস্তক সংশোধন এবং পরিমার্জন কার্যক্রম সুষ্ঠুভাবে সম্পন্ন ও সমন্বয়ের লক্ষ্যে ১০ সদস্যের একটি সমন্বয় কমিটি গঠন করেছিল শিক্ষা মন্ত্রণালয়। মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব খ ম কবিরুল ইসলামকে আহ্বায়ক করে গঠিত ওই কমিটিতে সদস্য হিসেবে ছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পদার্থবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক কামরুল হাসান, বাংলা বিভাগের অধ্যাপক মোহাম্মদ আজম, সমাজবিজ্ঞান বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক সামিনা লুৎফা, প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব মাসুদ আখতার খান, এনসিটিবির চেয়ারম্যান অধ্যাপক এ কে এম রিয়াজুল হাসান, সদস্য (শিক্ষাক্রম) অধ্যাপক রবিউল কবীর চৌধুরী, সদস্য (প্রাথমিক শিক্ষাক্রম) অধ্যাপক এ এফ এম সারোয়ার জাহান, গবেষক রাখাল রাহা এবং মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা বিভাগের সিনিয়র সহকারী সচিব মো. ইয়ানুর রহমান (সদস্যসচিব)।
এর মধ্যে অধ্যাপক সামিনা লুৎফা ও অধ্যাপক কামরুল হাসানকে নিয়ে আপত্তি তোলে ধর্মভিত্তিক কয়েকটি সংগঠন। তাদের ‘ইসলামবিদ্বেষী’ বলে দাবি করা হয়। অধ্যাপক সামিনা লুৎফা ও অধ্যাপক কামরুল হাসান আওয়ামী লীগ সরকারের বিরুদ্ধে ছাত্র-জনতার আন্দোলনের সময় শিক্ষার্থীদের সঙ্গে সক্রিয় ছিলেন। সাম্প্রদায়িক গোষ্ঠীর বিরোধিতার কারণে এই কমিটি বাতিল করার ঘোষণা দেওয়ার পর শিক্ষা উপদেষ্টা অধ্যাপক ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদ গণমাধ্যমের কাছে বলেন, সময় কম, তাই পুরোনো শিক্ষাক্রমের পাঠ্যপুস্তকে ভাষাগত ও সংবেদনশীল বিষয় থাকলে তা দ্রুত সংশোধনের লক্ষ্যে প্রতিটি বিষয়ের জন্য বিশেষজ্ঞ শিক্ষকেরা কাজ করেছেন। যার মধ্যে মাদ্রাসার শিক্ষক যেমন আছেন, তেমনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকেরাও রয়েছেন।
উল্লেখ করা প্রয়োজন, বিগত আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে ২০১৭ সালে কওমি মাদ্রাসাভিত্তিক সংগঠনের প্রস্তাব অনুযায়ী তখনকার পাঠ্যপুস্তকে বেশ কিছু পরিবর্তন এনেছিল সরকার। বিতর্কের মুখে চলতি বছরের সপ্তম শ্রেণির পাঠ্যবই থেকে ‘শরীফার গল্প’ শীর্ষক বহুল আলোচিত গল্পটি বাদ দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছিল।
ধর্মভিত্তিক কিছু সংগঠনের মতামতকে গুরুত্ব দিয়ে হুট করে সমন্বয় কমিটি বাতিল করার বিষয়টি ভালোভাবে দেখছেন না অনেকেই। অর্থনীতিবিদ অধ্যাপক আনু মুহাম্মদ বলেছেন, গণ-অভ্যুত্থানের মাধ্যমে এই সরকার এসেছে। তাদের প্রতি জনগণের আস্থা ও প্রত্যাশা ব্যাপক। পাঠ্যপুস্তক পরিমার্জনে সমন্বয় কমিটি বাতিলের মাধ্যমে সরকার সেই আস্থা ও প্রত্যাশার ওপর নিজেই আঘাত করল। এই কমিটি নিশ্চয়ই সরকার বুঝেশুনে করেছিল। সেখানে বাইরের নানা কথাবার্তা বা মিথ্যাচার ও হিংসামিশ্রিত প্রচারণার পর কমিটি বাতিলের মাধ্যমে সরকারের দুর্বলতাই প্রকাশিত হলো। এটা গণতান্ত্রিক রূপান্তর ও শিক্ষা সংস্কারের পথে খুবই খারাপ দৃষ্টান্ত হবে।
অন্যদিকে কমিটি বাতিলের ঘটনাকে মৌলবাদের সঙ্গে অন্তর্বর্তী সরকারের আপসকামিতাকে উদ্বেগজনক দৃষ্টান্ত হিসেবে উল্লেখ করেছে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ (টিআইবি)। টিআইবির নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান এক বিবৃতিতে বলেছেন, কর্তৃত্ববাদী সরকারের বহুমাত্রিক ও নজিরবিহীন মানবাধিকার লঙ্ঘন এবং হাজারো শহীদের আত্মত্যাগের বিনিময়ে ছাত্র-জনতা নতুন বাংলাদেশ বিনির্মাণের সুযোগ সৃষ্টি করেছে, যা ধর্মীয়, সামাজিক, সাংস্কৃতিকসহ সব বৈচিত্র্য-মতাদর্শের শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান ও সম-অধিকার নিশ্চিত করবে। পাশাপাশি নতুন বাংলাদেশ বৈষম্যমুক্ত, অসাম্প্রদায়িক, স্বচ্ছ, জবাবদিহিমূলক ও সুশাসিত হবে। যেখানে ধর্মীয় বা অন্য কোনো মতাদর্শ কারও ওপর চাপিয়ে দেওয়া হবে না। কিন্তু তাঁরা আতঙ্কের সঙ্গে লক্ষ করছেন, অসাম্প্রদায়িক চেতনা ও বহুত্বের বিরুদ্ধে কুৎসা, বিদ্বেষ, ঘৃণা ছড়িয়ে শঙ্কা ও হুমকির বাতাবরণ সৃষ্টির প্রচেষ্টা ক্রমেই উৎকট রূপ ধারণ করছে। এ ধরনের স্বার্থান্বেষী মহলের অপপ্রচার, হুমকির প্রতি নতি স্বীকার করে অন্তর্বর্তী সরকার আপস করছে; যার উদ্বেগজনক উদাহরণ হলো পাঠ্যপুস্তক সংশোধন ও পরিমার্জন সমন্বয় কমিটি বাতিলের ঘটনা। বিষয়টি একদিকে যেমন সরকারের মৌলবাদ ও সাম্প্রদায়িকতার সঙ্গে আপসের উদাহরণ, অন্যদিকে তেমনি নতুন বাংলাদেশের বৈষম্যহীন, অসাম্প্রদায়িক ও গণতান্ত্রিক দেশের আকাঙ্ক্ষার প্রতি রীতিমতো প্রহসন।
পরবর্তী সময়ে অন্তর্বর্তী সরকারের কাজকর্ম প্রহসনমুক্ত হলেই দেশের মানুষ স্বস্তি পাবে।
লেখক: রাজনীতিবিদ, লেখক, চেয়ারম্যান, বিএফডিআর
গাজীপুর মহানগরের বোর্ডবাজার এলাকার ইসলামিক ইউনিভার্সিটি অব টেকনোলজির (আইইউটি) মেকানিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের শিক্ষার্থীরা পিকনিকে যাচ্ছিলেন শ্রীপুরের মাটির মায়া ইকো রিসোর্টে। ঢাকা-ময়মনসিংহ মহাসড়ক থেকে বাসগুলো গ্রামের সরু সড়কে ঢোকার পর বিদ্যুতের তারে জড়িয়ে যায় বিআরটিসির একটি দোতলা বাস...
৪ দিন আগেঝড়-জলোচ্ছ্বাস থেকে রক্ষায় সন্দ্বীপের ব্লক বেড়িবাঁধসহ একাধিক প্রকল্প হাতে নিয়েছে সরকার। এ লক্ষ্যে বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে ৫৬২ কোটি টাকা। এ জন্য টেন্ডারও হয়েছে। প্রায় এক বছর পেরিয়ে গেলেও ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানগুলো কাজ শুরু করছে না। পানি উন্নয়ন বোর্ডের (পাউবো) তাগাদায়ও কোনো কাজ হচ্ছে না বলে জানিয়েছেন...
৮ দিন আগেদেশের পরিবহন খাতের অন্যতম নিয়ন্ত্রণকারী ঢাকা সড়ক পরিবহন মালিক সমিতির কমিটির বৈধতা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। সাইফুল আলমের নেতৃত্বাধীন এ কমিটিকে নিবন্ধন দেয়নি শ্রম অধিদপ্তর। তবে এটি কার্যক্রম চালাচ্ছে। কমিটির নেতারা অংশ নিচ্ছেন ঢাকা পরিবহন সমন্বয় কর্তৃপক্ষ (ডিটিসিএ) ও বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষের...
৮ দিন আগেআলুর দাম নিয়ন্ত্রণে ব্যর্থ হয়ে এবার নিজেই বিক্রির উদ্যোগ নিয়েছে সরকার। বাজার স্থিতিশীল রাখতে ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশের (টিসিবি) মাধ্যমে রাজধানীতে ভ্রাম্যমাণ ট্রাকের মাধ্যমে ভর্তুকি মূল্যে আলু বিক্রি করা হবে। একজন গ্রাহক ৪০ টাকা দরে সর্বোচ্চ তিন কেজি আলু কিনতে পারবেন...
৮ দিন আগে