বিভুরঞ্জন সরকার
শেষ পর্যন্ত পদ্মা সেতু উদ্বোধনের দিন ঠিক হয়েছে। আগামী ২৫ জুন সকাল ১০টায় যান চলাচলের জন্য খুলে দেওয়া হবে পদ্মা সেতু। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আমাদের স্বপ্নের এই সেতু উদ্বোধন করবেন। পদ্মা সেতু আদৌ তৈরি হবে কি না, তা নিয়েই একসময় সংশয় দেখা দিয়েছিল। কারণ, বিশ্বব্যাংক মিথ্যা অভিযোগ তুলে এই সেতু নির্মাণে অর্থসহায়তা দিতে অস্বীকার করেছিল। কিন্তু নিজস্ব অর্থায়নে পদ্মা সেতু তৈরির প্রশ্নে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার দৃঢ় অবস্থান ও সাহসী সিদ্ধান্তের কারণেই সম্ভব হয়েছে সব ধরনের বাধাবিপত্তি, অনিশ্চয়তা কাটিয়ে এই প্রকল্পের সফল বাস্তবায়ন।
পদ্মা সেতু অবশ্যই শেখ হাসিনার কৃতিত্ব হিসেবে যুগ যুগ ধরে মানুষের মনে উজ্জ্বল হয়ে থাকবে। শেখ হাসিনা সরকারপ্রধান হিসেবে অনেক কিছুই করেছেন, যার জন্য বাংলাদেশের রাজনীতির ইতিহাসে তাঁর নাম লেখা থাকবে। তবে এটাও ঠিক যে মানুষের চাওয়া-পাওয়ার শেষ নেই। কথায় আছে, বসতে দিলে শুতে চায়। আমাদের দেশে অনেক মানুষ। অনেক মানুষের সমস্যাও অনেক। একজনের যদি বিলাসিতার উপকরণের সমস্যা, অন্য অনেকের বেঁচে থাকার জন্য প্রয়োজনীয় উপকরণেরই ঘাটতি। মানুষের জীবনে সমস্যার শেষ নেই, চাহিদারও শেষ নেই। যখন দুই বেলা পেটপুরে খাওয়া জোটে না, তখন দুমুঠো ডাল-ভাত হলেই বর্তে যায়। কোনোভাবে ডাল-ভাতের ব্যবস্থা হলে মন চায় একটু মাছ কিংবা একটি ডিম। সেটাও যদি জোগাড় হয়, তখন মাংসের জন্য মন আনচান করে। তবে চেষ্টা থাকলে সবার না হলেও কারও কারও ইচ্ছা পূরণ হয়।
শেখ হাসিনার নেতৃত্বে আওয়ামী লীগের সরকার বাংলাদেশকে যে অর্থনৈতিকভাবে একটি শক্ত অবস্থানে নিতে পেরেছে, তা যাঁরা স্বীকার করেন না, তাঁরা রাজনৈতিক ভিন্নমতের জন্যই করেন না। সরকারের অর্থনৈতিক নীতির যাঁরা সমালোচক, তাঁরা নিজেরা ক্ষমতায় থাকতে কী সুফল মানুষের দুয়ারে পৌঁছে দিতে পেরেছিলেন, তা একবারও ভেবে দেখেন না। শেখ হাসিনার শাসনামলে দেশে সুখ ও সমৃদ্ধির বন্যা বয়ে গেছে, তা অবশ্যই নয়। কিন্তু মানুষের অবস্থা খারাপ থেকে আরও খারাপ হয়েছে বললে তা অবশ্যই বাড়িয়ে বলা। সামাজিক সুরক্ষা খাতে বরাদ্দ দিয়ে অনেক অসহায় মানুষের হাহাকার কমানোর ব্যবস্থা হয়েছে। গৃহায়ণ প্রকল্পের মাধ্যমে কয়েক লাখ মানুষের মাথা গোঁজার ঠাঁই হয়েছে।
তার মানে অবশ্যই এটা নয় যে দেশের সব মানুষের সব সমস্যার সমাধান হয়েছে। সমস্যা আছে, থাকবেও। পৃথিবীতে কোনো দেশের কোনো সরকারই সব মানুষের সব সমস্যার সমাধান করতে পারে না, পারেনি। শেখ হাসিনার সরকারও পারেনি, পারবে না। এই যে পারছে না, সেটা যদি কেউ বলেন, তাও কোনো গর্হিত অপরাধ নয়।
দেশে অন্য যারা শাসন করেছে, তাদের তুলনায় শেখ হাসিনার সরকার খারাপ নয়; বরং ভালো। এটা ঠিক, দেশ থেকে দুর্নীতি নির্মূল হয়নি। স্বজনপ্রীতি, অনিয়ম, দলবাজি, লুটপাট কোনোটাই শেষ হয়নি। এখানে প্রশ্ন, আওয়ামী লীগ সরকারের কাছে সব অব্যবস্থার অবসান কামনা করাও কি ঠিক? আওয়ামী লীগের অর্থনৈতিক দর্শন বিএনপি-জাতীয় পার্টি থেকে খুব বেশি আলাদা নয়। আমাদের দেশের বড় সব রাজনৈতিক দল মুক্তবাজার অর্থনীতির সমর্থক। তা ছাড়া, আওয়ামী লীগের নেতৃত্ব এবং অন্য দলগুলোর নেতৃত্বের শ্রেণিগত অবস্থানেও আলাদা বৈশিষ্ট্য খুঁজে পাওয়া কঠিন। আওয়ামী লীগের জন্মলগ্ন থেকেই দলের ভেতরে বাম ও ডান প্রবণতার দ্বন্দ্ব আছে।
বঙ্গবন্ধুর সময় যেমন তাজউদ্দীন আহমদ, সৈয়দ নজরুল, কামারুজ্জামান, মনসুর আলীর মতো অগ্রসরমনা নেতা ছিলেন, তেমনি খন্দকার মোশতাক, শাহ্ মোয়াজ্জেম, ওবায়দুর রহমান, তাহেরউদ্দিন ঠাকুরের মতো রক্ষণশীল-ডান ধারার উপস্থিতিও কম ছিল না। এখনো শেখ হাসিনার পাশে উভয় ধারার মানুষই আছেন; বরং সুবিধাবাদী ধারাই হয়তো জোরদার। শেখ হাসিনার একক চেষ্টায় দলে যে ভারসাম্য দৃশ্যমান, তা খুবই দুর্বল। শেখ হাসিনার পক্ষে দেশের ভেতরে নাগরিক সমাজের বলিষ্ঠ কণ্ঠস্বর শোনা না গেলে আওয়ামী লীগের কাছে শুধু ভালো প্রত্যাশা করা যথাযথ নয়।
মনে রাখতে হবে, ক্ষমতায় যাওয়া ও ক্ষমতায় থাকার জন্য আওয়ামী লীগকে বিএনপি-জামায়াতের মতো রাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বীর সঙ্গে সমানে সমান লড়তে হলে শুধু আদর্শের ওপর নির্ভর করলে চলে না, রাজনৈতিক কৌশলও গুরুত্বপূর্ণ। শেখ হাসিনা কৌশলের খেলায় এগিয়ে আছেন, আদর্শের ক্ষেত্রে ছাড় দিয়ে। প্রশ্ন হতে পারে, এটা কি ঠিক? রাজনীতির সঙ্গে যদি শুধু আদর্শের বিষয়টি যুক্ত থাকত, তাহলে সহজেই বলে দেওয়া যেত—না, এটা ঠিক নয়। কিন্তু রাজনীতির সঙ্গে ক্ষমতার বিষয়টিও যেহেতু কম গুরুত্বপূর্ণ নয়, তাই বলতে হয়, শেখ হাসিনা ঠিক পথেই আছেন। ক্ষমতার বাইরে থেকে কিছুই করা যায় না।
যাঁরা আওয়ামী লীগের পরিবর্তন আশা করেন, তাঁরা কী একইভাবে বিএনপি বা আওয়ামী লীগবিরোধী শক্তির রাজনৈতিক নীতি-কৌশলেরও পরিবর্তন আশা করেন? যদি করেন, তাহলে তো অতীত ভুলত্রুটির জন্য দেশের মানুষের কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করার জন্য বিএনপির ওপর চাপ সৃষ্টি করা উচিত। তা ছাড়া, আওয়ামী লীগের খারাপের বিপরীতে বিএনপি কী কী ভালো করতে চায়, কীভাবে করতে চায়, সেটাও দেশবাসীর সামনে তুলে ধরার জন্য তাদের পরামর্শ দেওয়া দরকার। ক্ষমতায় থাকতে হাওয়া ভবন করবেন, বিদ্যুতের বদলে খাম্বা দেবেন, সার চাইলে বুকে গুলি ছুড়বেন আর আওয়ামী লীগের গিবত গাইবেন, তাহলে মানুষের মনে আস্থা তৈরি হবে কীভাবে?
পদ্মা সেতুতে বিএনপির লোকজন ক্ষমা চেয়ে চলাচল করতে পারবেন—তথ্যমন্ত্রী হাছান মাহমুদের এই বক্তব্যের সমালোচনা করে বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেছেন, ‘ওনারা কি ওইটা (পদ্মা সেতু) ওনাদের পৈতৃক সম্পত্তি থেকে বানিয়েছেন, নাকি আমাদের সবার পকেটের টাকা দিয়ে বানিয়েছেন? আমাদের পকেটের টাকা কেটে নিয়েছেন এবং ১০ হাজার কোটি টাকার প্রকল্প ৩০ হাজার কোটি টাকায় নিয়ে গেছেন চুরি করে। কাজেই এই সমস্ত কথাবার্তা তাঁদের মুখে শোভা পায় না।’
সংগত প্রশ্ন। কোনো সরকারই পৈতৃক সম্পত্তি দিয়ে দেশের কোনো স্থাপনা তৈরি করে না। সব অর্থই জনগণের। বিদেশি ঋণ হলেও তা শোধ করতে হয় জনগণের টাকায়। তবে তারপরও কথা থাকে। বিএনপির আমলে কি পৈতৃক টাকায় কোনো কিছু হয়েছিল? তারেক এবং তাঁর সঙ্গীসাথিরা অর্থ লোপাট করেছিল কোন তহবিল থেকে? পদ্মা সেতুর নাম শেখ হাসিনার নামে করার প্রস্তাবেরও বিএনপি বিরোধিতা করেছে এটা বলে যে সেতু তাঁর বাবার টাকায় তৈরি হয়নি। এখানে প্রশ্ন, কোনো স্থাপনার নামকরণে যদি ‘বাবার টাকা’র প্রশ্ন আসে তাহলে ঢাকা আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের নাম জিয়া আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর করা হয়েছিল কোন যুক্তিতে? তিনি কি এই বিমানবন্দর নির্মাণে তাঁর পৈতৃক সম্পত্তি বিনিয়োগ করেছিলেন?
আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক এবং সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের সম্প্রতি এক অনুষ্ঠানে বলেছেন, আওয়ামী লীগ থেকে দূষিত রক্ত বের করে দিয়ে বিশুদ্ধ রক্ত সঞ্চালন করতে হবে। দলীয় নেতা-কর্মীদের উদ্দেশে তিনি আরও বলেছেন, ভালো আচরণ করে মানুষকে খুশি করতে হবে, তা না হলে শেখ হাসিনার এত সাফল্য, অর্জন ও উন্নয়ন ম্লান হয়ে যাবে।
আওয়ামী লীগে দূষিত রক্ত ঢুকেছে বলে দলের সাধারণ সম্পাদক যে বুঝতে পেরেছেন, এটা একটি ভালো দিক। দলকে দূষিত রক্তমুক্ত করার কাজটি কিন্তু মূলত তাঁরই। তিনি আন্তরিকভাবে চাইলেই শুধু দলে বিশুদ্ধ রক্ত সঞ্চালন সম্ভব। ভালো আচরণ করে মানুষকে খুশি করার যে কথা ওবায়দুল কাদের বলেছেন, তা-ও তাৎপর্যপূর্ণ। আওয়ামী লীগের বিভিন্ন পর্যায়ের কিছু নেতা-কর্মীর আচার-আচরণ এতটাই ঔদ্ধত্যপূর্ণ যে অনেকেই তাদের ওপর ত্যক্তবিরক্ত। মানুষের সঙ্গে অসদাচরণ করা যেকোনো রাজনৈতিক কর্মীর জন্য মারাত্মক অপরাধের মতো। রাজনীতি তো মানুষের জন্য। মানুষকে কাছে না টেনে দূরে ঠেলার মানসিকতা থাকলে ভালো রাজনৈতিক কর্মী হওয়া যায় না।
শেষে আবারও পদ্মা সেতু প্রসঙ্গ। এই সেতু নির্মাণে কারা বাগড়া দিয়েছেন, কারা বিদেশে গিয়ে কার কান ভারী করেছেন, কে এই সেতু জোড়াতালি দিয়ে বানানোয় চলাচলের সময় ভেঙে পড়বে বলে কটূক্তি করেছেন, তা এখন আর মনে করার দরকার নেই। হৃদয় খুঁড়ে বেদনা না জাগানোই ভালো। নিন্দুক বা সমালোচক সব সমাজেই আছে, থাকে। সমালোচকেরা যত কড়া বা তিতা কথাই বলুক না কেন, তাতে মন খারাপের কিছু নেই। কাউকে পদ্মা সেতুতে নিয়ে গিয়ে ওখান থেকে টুস করে নদীতে ফেলে দিয়ে দুটা চুবানি দিয়ে মরার আগে উঠিয়ে এনে কিছু ‘শিক্ষা’ দেওয়ার প্রয়োজন নেই।
আনন্দের দিনে, উদ্যাপনের দিনে কষ্টের কথা মনে না করে বরং সবাইকে আনন্দে শরিক হওয়ার আমন্ত্রণ জানানোই উত্তম। শেখ হাসিনা অতীতে উদারতা ও মানবিকতার একাধিক নজির রেখেছেন। কোকোর মৃত্যুর পর খালেদা জিয়াকে সান্ত্বনা দিতে উপস্থিত হয়ে আমাদের বৈরিতার রাজনীতির গোড়ায় সুবাতাস ছড়িয়ে তিনি প্রশংসিত হয়েছিলেন। পদ্মা সেতু উদ্বোধনের দিনও বিএনপিকে উপস্থিত থাকার জন্য শুধু কাগুজে আমন্ত্রণ না জানিয়ে কয়েকজন শীর্ষ নেতাকে উপস্থিত করার উদ্যোগ নিলে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা কোনোভাবেই ছোট হবেন না; বরং তাঁর উদারতা এক নতুন উচ্চতায় পৌঁছাবে। দেশের রাজনীতিতে পরস্পর দোষারোপ ও বিষোদগারের যে ধারা চলছে তাতে একটি ভিন্ন মাত্রা যোগ হবে। আওয়ামী লীগের ভাবমূর্তিও উজ্জ্বল হবে। মনে রাখতে হবে: উত্তম নিশ্চিন্তে চলে অধমের সঙ্গে, তিনিই মধ্যম যিনি চলেন তফাতে।
বিভুরঞ্জন সরকার, সহকারী সম্পাদক, আজকের পত্রিকা
পদ্মা সেতু সম্পর্কিত আরও পড়ুন:
শেষ পর্যন্ত পদ্মা সেতু উদ্বোধনের দিন ঠিক হয়েছে। আগামী ২৫ জুন সকাল ১০টায় যান চলাচলের জন্য খুলে দেওয়া হবে পদ্মা সেতু। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আমাদের স্বপ্নের এই সেতু উদ্বোধন করবেন। পদ্মা সেতু আদৌ তৈরি হবে কি না, তা নিয়েই একসময় সংশয় দেখা দিয়েছিল। কারণ, বিশ্বব্যাংক মিথ্যা অভিযোগ তুলে এই সেতু নির্মাণে অর্থসহায়তা দিতে অস্বীকার করেছিল। কিন্তু নিজস্ব অর্থায়নে পদ্মা সেতু তৈরির প্রশ্নে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার দৃঢ় অবস্থান ও সাহসী সিদ্ধান্তের কারণেই সম্ভব হয়েছে সব ধরনের বাধাবিপত্তি, অনিশ্চয়তা কাটিয়ে এই প্রকল্পের সফল বাস্তবায়ন।
পদ্মা সেতু অবশ্যই শেখ হাসিনার কৃতিত্ব হিসেবে যুগ যুগ ধরে মানুষের মনে উজ্জ্বল হয়ে থাকবে। শেখ হাসিনা সরকারপ্রধান হিসেবে অনেক কিছুই করেছেন, যার জন্য বাংলাদেশের রাজনীতির ইতিহাসে তাঁর নাম লেখা থাকবে। তবে এটাও ঠিক যে মানুষের চাওয়া-পাওয়ার শেষ নেই। কথায় আছে, বসতে দিলে শুতে চায়। আমাদের দেশে অনেক মানুষ। অনেক মানুষের সমস্যাও অনেক। একজনের যদি বিলাসিতার উপকরণের সমস্যা, অন্য অনেকের বেঁচে থাকার জন্য প্রয়োজনীয় উপকরণেরই ঘাটতি। মানুষের জীবনে সমস্যার শেষ নেই, চাহিদারও শেষ নেই। যখন দুই বেলা পেটপুরে খাওয়া জোটে না, তখন দুমুঠো ডাল-ভাত হলেই বর্তে যায়। কোনোভাবে ডাল-ভাতের ব্যবস্থা হলে মন চায় একটু মাছ কিংবা একটি ডিম। সেটাও যদি জোগাড় হয়, তখন মাংসের জন্য মন আনচান করে। তবে চেষ্টা থাকলে সবার না হলেও কারও কারও ইচ্ছা পূরণ হয়।
শেখ হাসিনার নেতৃত্বে আওয়ামী লীগের সরকার বাংলাদেশকে যে অর্থনৈতিকভাবে একটি শক্ত অবস্থানে নিতে পেরেছে, তা যাঁরা স্বীকার করেন না, তাঁরা রাজনৈতিক ভিন্নমতের জন্যই করেন না। সরকারের অর্থনৈতিক নীতির যাঁরা সমালোচক, তাঁরা নিজেরা ক্ষমতায় থাকতে কী সুফল মানুষের দুয়ারে পৌঁছে দিতে পেরেছিলেন, তা একবারও ভেবে দেখেন না। শেখ হাসিনার শাসনামলে দেশে সুখ ও সমৃদ্ধির বন্যা বয়ে গেছে, তা অবশ্যই নয়। কিন্তু মানুষের অবস্থা খারাপ থেকে আরও খারাপ হয়েছে বললে তা অবশ্যই বাড়িয়ে বলা। সামাজিক সুরক্ষা খাতে বরাদ্দ দিয়ে অনেক অসহায় মানুষের হাহাকার কমানোর ব্যবস্থা হয়েছে। গৃহায়ণ প্রকল্পের মাধ্যমে কয়েক লাখ মানুষের মাথা গোঁজার ঠাঁই হয়েছে।
তার মানে অবশ্যই এটা নয় যে দেশের সব মানুষের সব সমস্যার সমাধান হয়েছে। সমস্যা আছে, থাকবেও। পৃথিবীতে কোনো দেশের কোনো সরকারই সব মানুষের সব সমস্যার সমাধান করতে পারে না, পারেনি। শেখ হাসিনার সরকারও পারেনি, পারবে না। এই যে পারছে না, সেটা যদি কেউ বলেন, তাও কোনো গর্হিত অপরাধ নয়।
দেশে অন্য যারা শাসন করেছে, তাদের তুলনায় শেখ হাসিনার সরকার খারাপ নয়; বরং ভালো। এটা ঠিক, দেশ থেকে দুর্নীতি নির্মূল হয়নি। স্বজনপ্রীতি, অনিয়ম, দলবাজি, লুটপাট কোনোটাই শেষ হয়নি। এখানে প্রশ্ন, আওয়ামী লীগ সরকারের কাছে সব অব্যবস্থার অবসান কামনা করাও কি ঠিক? আওয়ামী লীগের অর্থনৈতিক দর্শন বিএনপি-জাতীয় পার্টি থেকে খুব বেশি আলাদা নয়। আমাদের দেশের বড় সব রাজনৈতিক দল মুক্তবাজার অর্থনীতির সমর্থক। তা ছাড়া, আওয়ামী লীগের নেতৃত্ব এবং অন্য দলগুলোর নেতৃত্বের শ্রেণিগত অবস্থানেও আলাদা বৈশিষ্ট্য খুঁজে পাওয়া কঠিন। আওয়ামী লীগের জন্মলগ্ন থেকেই দলের ভেতরে বাম ও ডান প্রবণতার দ্বন্দ্ব আছে।
বঙ্গবন্ধুর সময় যেমন তাজউদ্দীন আহমদ, সৈয়দ নজরুল, কামারুজ্জামান, মনসুর আলীর মতো অগ্রসরমনা নেতা ছিলেন, তেমনি খন্দকার মোশতাক, শাহ্ মোয়াজ্জেম, ওবায়দুর রহমান, তাহেরউদ্দিন ঠাকুরের মতো রক্ষণশীল-ডান ধারার উপস্থিতিও কম ছিল না। এখনো শেখ হাসিনার পাশে উভয় ধারার মানুষই আছেন; বরং সুবিধাবাদী ধারাই হয়তো জোরদার। শেখ হাসিনার একক চেষ্টায় দলে যে ভারসাম্য দৃশ্যমান, তা খুবই দুর্বল। শেখ হাসিনার পক্ষে দেশের ভেতরে নাগরিক সমাজের বলিষ্ঠ কণ্ঠস্বর শোনা না গেলে আওয়ামী লীগের কাছে শুধু ভালো প্রত্যাশা করা যথাযথ নয়।
মনে রাখতে হবে, ক্ষমতায় যাওয়া ও ক্ষমতায় থাকার জন্য আওয়ামী লীগকে বিএনপি-জামায়াতের মতো রাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বীর সঙ্গে সমানে সমান লড়তে হলে শুধু আদর্শের ওপর নির্ভর করলে চলে না, রাজনৈতিক কৌশলও গুরুত্বপূর্ণ। শেখ হাসিনা কৌশলের খেলায় এগিয়ে আছেন, আদর্শের ক্ষেত্রে ছাড় দিয়ে। প্রশ্ন হতে পারে, এটা কি ঠিক? রাজনীতির সঙ্গে যদি শুধু আদর্শের বিষয়টি যুক্ত থাকত, তাহলে সহজেই বলে দেওয়া যেত—না, এটা ঠিক নয়। কিন্তু রাজনীতির সঙ্গে ক্ষমতার বিষয়টিও যেহেতু কম গুরুত্বপূর্ণ নয়, তাই বলতে হয়, শেখ হাসিনা ঠিক পথেই আছেন। ক্ষমতার বাইরে থেকে কিছুই করা যায় না।
যাঁরা আওয়ামী লীগের পরিবর্তন আশা করেন, তাঁরা কী একইভাবে বিএনপি বা আওয়ামী লীগবিরোধী শক্তির রাজনৈতিক নীতি-কৌশলেরও পরিবর্তন আশা করেন? যদি করেন, তাহলে তো অতীত ভুলত্রুটির জন্য দেশের মানুষের কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করার জন্য বিএনপির ওপর চাপ সৃষ্টি করা উচিত। তা ছাড়া, আওয়ামী লীগের খারাপের বিপরীতে বিএনপি কী কী ভালো করতে চায়, কীভাবে করতে চায়, সেটাও দেশবাসীর সামনে তুলে ধরার জন্য তাদের পরামর্শ দেওয়া দরকার। ক্ষমতায় থাকতে হাওয়া ভবন করবেন, বিদ্যুতের বদলে খাম্বা দেবেন, সার চাইলে বুকে গুলি ছুড়বেন আর আওয়ামী লীগের গিবত গাইবেন, তাহলে মানুষের মনে আস্থা তৈরি হবে কীভাবে?
পদ্মা সেতুতে বিএনপির লোকজন ক্ষমা চেয়ে চলাচল করতে পারবেন—তথ্যমন্ত্রী হাছান মাহমুদের এই বক্তব্যের সমালোচনা করে বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেছেন, ‘ওনারা কি ওইটা (পদ্মা সেতু) ওনাদের পৈতৃক সম্পত্তি থেকে বানিয়েছেন, নাকি আমাদের সবার পকেটের টাকা দিয়ে বানিয়েছেন? আমাদের পকেটের টাকা কেটে নিয়েছেন এবং ১০ হাজার কোটি টাকার প্রকল্প ৩০ হাজার কোটি টাকায় নিয়ে গেছেন চুরি করে। কাজেই এই সমস্ত কথাবার্তা তাঁদের মুখে শোভা পায় না।’
সংগত প্রশ্ন। কোনো সরকারই পৈতৃক সম্পত্তি দিয়ে দেশের কোনো স্থাপনা তৈরি করে না। সব অর্থই জনগণের। বিদেশি ঋণ হলেও তা শোধ করতে হয় জনগণের টাকায়। তবে তারপরও কথা থাকে। বিএনপির আমলে কি পৈতৃক টাকায় কোনো কিছু হয়েছিল? তারেক এবং তাঁর সঙ্গীসাথিরা অর্থ লোপাট করেছিল কোন তহবিল থেকে? পদ্মা সেতুর নাম শেখ হাসিনার নামে করার প্রস্তাবেরও বিএনপি বিরোধিতা করেছে এটা বলে যে সেতু তাঁর বাবার টাকায় তৈরি হয়নি। এখানে প্রশ্ন, কোনো স্থাপনার নামকরণে যদি ‘বাবার টাকা’র প্রশ্ন আসে তাহলে ঢাকা আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের নাম জিয়া আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর করা হয়েছিল কোন যুক্তিতে? তিনি কি এই বিমানবন্দর নির্মাণে তাঁর পৈতৃক সম্পত্তি বিনিয়োগ করেছিলেন?
আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক এবং সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের সম্প্রতি এক অনুষ্ঠানে বলেছেন, আওয়ামী লীগ থেকে দূষিত রক্ত বের করে দিয়ে বিশুদ্ধ রক্ত সঞ্চালন করতে হবে। দলীয় নেতা-কর্মীদের উদ্দেশে তিনি আরও বলেছেন, ভালো আচরণ করে মানুষকে খুশি করতে হবে, তা না হলে শেখ হাসিনার এত সাফল্য, অর্জন ও উন্নয়ন ম্লান হয়ে যাবে।
আওয়ামী লীগে দূষিত রক্ত ঢুকেছে বলে দলের সাধারণ সম্পাদক যে বুঝতে পেরেছেন, এটা একটি ভালো দিক। দলকে দূষিত রক্তমুক্ত করার কাজটি কিন্তু মূলত তাঁরই। তিনি আন্তরিকভাবে চাইলেই শুধু দলে বিশুদ্ধ রক্ত সঞ্চালন সম্ভব। ভালো আচরণ করে মানুষকে খুশি করার যে কথা ওবায়দুল কাদের বলেছেন, তা-ও তাৎপর্যপূর্ণ। আওয়ামী লীগের বিভিন্ন পর্যায়ের কিছু নেতা-কর্মীর আচার-আচরণ এতটাই ঔদ্ধত্যপূর্ণ যে অনেকেই তাদের ওপর ত্যক্তবিরক্ত। মানুষের সঙ্গে অসদাচরণ করা যেকোনো রাজনৈতিক কর্মীর জন্য মারাত্মক অপরাধের মতো। রাজনীতি তো মানুষের জন্য। মানুষকে কাছে না টেনে দূরে ঠেলার মানসিকতা থাকলে ভালো রাজনৈতিক কর্মী হওয়া যায় না।
শেষে আবারও পদ্মা সেতু প্রসঙ্গ। এই সেতু নির্মাণে কারা বাগড়া দিয়েছেন, কারা বিদেশে গিয়ে কার কান ভারী করেছেন, কে এই সেতু জোড়াতালি দিয়ে বানানোয় চলাচলের সময় ভেঙে পড়বে বলে কটূক্তি করেছেন, তা এখন আর মনে করার দরকার নেই। হৃদয় খুঁড়ে বেদনা না জাগানোই ভালো। নিন্দুক বা সমালোচক সব সমাজেই আছে, থাকে। সমালোচকেরা যত কড়া বা তিতা কথাই বলুক না কেন, তাতে মন খারাপের কিছু নেই। কাউকে পদ্মা সেতুতে নিয়ে গিয়ে ওখান থেকে টুস করে নদীতে ফেলে দিয়ে দুটা চুবানি দিয়ে মরার আগে উঠিয়ে এনে কিছু ‘শিক্ষা’ দেওয়ার প্রয়োজন নেই।
আনন্দের দিনে, উদ্যাপনের দিনে কষ্টের কথা মনে না করে বরং সবাইকে আনন্দে শরিক হওয়ার আমন্ত্রণ জানানোই উত্তম। শেখ হাসিনা অতীতে উদারতা ও মানবিকতার একাধিক নজির রেখেছেন। কোকোর মৃত্যুর পর খালেদা জিয়াকে সান্ত্বনা দিতে উপস্থিত হয়ে আমাদের বৈরিতার রাজনীতির গোড়ায় সুবাতাস ছড়িয়ে তিনি প্রশংসিত হয়েছিলেন। পদ্মা সেতু উদ্বোধনের দিনও বিএনপিকে উপস্থিত থাকার জন্য শুধু কাগুজে আমন্ত্রণ না জানিয়ে কয়েকজন শীর্ষ নেতাকে উপস্থিত করার উদ্যোগ নিলে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা কোনোভাবেই ছোট হবেন না; বরং তাঁর উদারতা এক নতুন উচ্চতায় পৌঁছাবে। দেশের রাজনীতিতে পরস্পর দোষারোপ ও বিষোদগারের যে ধারা চলছে তাতে একটি ভিন্ন মাত্রা যোগ হবে। আওয়ামী লীগের ভাবমূর্তিও উজ্জ্বল হবে। মনে রাখতে হবে: উত্তম নিশ্চিন্তে চলে অধমের সঙ্গে, তিনিই মধ্যম যিনি চলেন তফাতে।
বিভুরঞ্জন সরকার, সহকারী সম্পাদক, আজকের পত্রিকা
পদ্মা সেতু সম্পর্কিত আরও পড়ুন:
ঝড়-জলোচ্ছ্বাস থেকে রক্ষায় সন্দ্বীপের ব্লক বেড়িবাঁধসহ একাধিক প্রকল্প হাতে নিয়েছে সরকার। এ লক্ষ্যে বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে ৫৬২ কোটি টাকা। এ জন্য টেন্ডারও হয়েছে। প্রায় এক বছর পেরিয়ে গেলেও ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানগুলো কাজ শুরু করছে না। পানি উন্নয়ন বোর্ডের (পাউবো) তাগাদায়ও কোনো কাজ হচ্ছে না বলে জানিয়েছেন...
৩ দিন আগেদেশের পরিবহন খাতের অন্যতম নিয়ন্ত্রণকারী ঢাকা সড়ক পরিবহন মালিক সমিতির কমিটির বৈধতা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। সাইফুল আলমের নেতৃত্বাধীন এ কমিটিকে নিবন্ধন দেয়নি শ্রম অধিদপ্তর। তবে এটি কার্যক্রম চালাচ্ছে। কমিটির নেতারা অংশ নিচ্ছেন ঢাকা পরিবহন সমন্বয় কর্তৃপক্ষ (ডিটিসিএ) ও বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষের...
৩ দিন আগেআলুর দাম নিয়ন্ত্রণে ব্যর্থ হয়ে এবার নিজেই বিক্রির উদ্যোগ নিয়েছে সরকার। বাজার স্থিতিশীল রাখতে ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশের (টিসিবি) মাধ্যমে রাজধানীতে ভ্রাম্যমাণ ট্রাকের মাধ্যমে ভর্তুকি মূল্যে আলু বিক্রি করা হবে। একজন গ্রাহক ৪০ টাকা দরে সর্বোচ্চ তিন কেজি আলু কিনতে পারবেন...
৩ দিন আগেসপ্তাহখানেক আগে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকে অনেকের ওয়াল বিষাদময় হয়ে উঠেছিল ফুলের মতো ছোট্ট শিশু মুনতাহাকে হত্যার ঘটনায়। ৫ বছর বয়সী সিলেটের এই শিশুকে অপহরণের পর হত্যা করে লাশ গুম করতে ডোবায় ফেলে রাখা হয়েছিল। প্রতিবেশী গৃহশিক্ষকের পরিকল্পনায় অপহরণের পর তাকে নির্মমভাবে হত্যা করা হয়...
৩ দিন আগে