আবু তাহের খান
‘জাতি’ হিসেবে ভারতের টিকে থাকার বিষয়ে উদ্বেগ ও আশঙ্কা ব্যক্ত করেছেন নোবেলজয়ী অর্থনীতিবিদ অধ্যাপক অমর্ত্য সেন। ৩০ জুন কলকাতায় অমর্ত্য সেন গবেষণা কেন্দ্রের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে দেওয়া বক্তব্যে তিনি তাঁর এ আশঙ্কার কথা ব্যক্ত করেন। বহু মত ও বহু ধর্মের সমন্বয়ে গড়ে ওঠা ধর্মনিরপেক্ষ ভারতীয় জাতীয়তা সাম্প্রতিক সময়ে রাষ্ট্রীয় সমর্থন, পৃষ্ঠপোষকতা ও প্রশ্রয়ে ক্রমেই হিন্দুত্ববাদী উগ্রতায় রূপ নিচ্ছে দেখেই বস্তুত তিনি এ মন্তব্য করেছেন। তাঁর এ মন্তব্য শুধু সময়োচিতই নয়, ভারতীয় সমাজ ও রাজনীতির এ সময়কার দুর্ভাগ্যজনক ও হতাশাব্যঞ্জক প্রবণতার বিরুদ্ধে কঠোর প্রতিবাদও বটে। বিশ্বের অগ্রসর চিন্তার সব মানুষ নিঃসন্দেহে তাঁর এ প্রতিবাদকে সাধুবাদ জানাবেন।
এখন প্রশ্ন হচ্ছে, ১৯৪৭ সালে ঔপনিবেশিক শাসন থেকে মুক্তি লাভের পর পরবর্তী প্রায় ছয় দশক ধরে ভারতের সাধারণ মানুষ তাদের অসাম্প্রদায়িক ধর্মনিরপেক্ষ চরিত্র বজায় রাখতে সক্ষম হলেও (নির্বাচনের ফলাফলকে ভিত্তি ধরে বলা) ২০১৪ সালের নির্বাচনে এসে তা এমন ব্যাপক পরিসরে পাল্টে গেল কেমন করে? এটি কি সত্যি কোনো আকস্মিক পরিবর্তন নাকি পূর্ববর্তী বছরগুলোতে ভেতরে-ভেতরে এই পরিবর্তনের ক্ষেত্র ক্রমেই তৈরিই হচ্ছিল, নাকি ভিন্নতর কোনো ব্যাখ্যাও এ ক্ষেত্রে প্রযোজ্য? উল্লেখ্য, ১৯৮৪ সালে ভারতের ৫৪৩ সদস্যবিশিষ্ট লোকসভায় হিন্দুত্ববাদী ভারতীয় জনতা পার্টির (বিজেপি) আসনসংখ্যা ছিল ২টি। আর সেখান থেকে মাত্র ৩০ বছরের ব্যবধানে ২০১৪ সালে এসে তা উন্নীত হয়েছে ২৮২টিতে এবং দেশটির সমাজ ও রাজনীতির সাম্প্রতিক গতিবিধি অনুযায়ী ২০২৩ সালের আসন্ন নির্বাচনে তা যদি ৩০০ ছাড়িয়ে যায়, তাতে মোটেও অবাক হওয়ার কিছু থাকবে না। আর তাতে করে ভারতের ধর্মনিরপেক্ষ জাতীয়তাবাদ যে ক্রমান্বয়ে উগ্র হিন্দু জাতীয়তাবাদে রূপান্তরের পথে হাঁটবে, সে আশঙ্কাই প্রবল এবং সহজেই অনুমেয় যে বস্তুত সেই আশঙ্কার কথা ভেবেই অমর্ত্য সেনের উপরিউক্ত উদ্বেগ।
১৯৪৭-পূর্ব ব্রিটিশবিরোধী সর্বভারতীয় স্বাধীনতা আন্দোলনে নেতৃত্বদানকারী কংগ্রেস ও মুসলিম লীগ উভয়েই ছিল বুর্জোয়া পুঁজিবাদী দল। এর মধ্যে মুসলিম লীগ যেমন ছিল ডানপন্থী, তেমনি কংগ্রেস ছিল কিঞ্চিৎ পরিমাণে হলেও বামপন্থার প্রতি সহানুভূতিশীল, অন্তত জওহরলাল নেহরুর জীবদ্দশা পর্যন্ত। এ অবস্থায় কংগ্রেস যত দিন ভারতের রাষ্ট্রক্ষমতায় (কেন্দ্রে) ছিল, তত দিন পর্যন্ত কাগজে-কলমে হলেও সেখানে ধর্মনিরপেক্ষতার নীতি বহাল ছিল। তদুপরি ১৯৪৭-পূর্ব ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনকালে গড়ে ওঠা কমিউনিস্ট পার্টির আদর্শিক প্রভাব সে সময় যেভাবে সারা ভারতবর্ষে ছড়িয়ে পড়েছিল, সেটিও স্বাধীনতা-পরবর্তী ভারতে দীর্ঘ সময় পর্যন্ত ধর্মনিরপেক্ষ ভাবধারা টিকিয়ে রাখতে সহায়ক ভূমিকা রেখেছিল বলে ধারণা করা চলে।
আর এ সূত্রেই এ ক্ষেত্রে বিশেষভাবে লক্ষণীয় যে কমিউনিস্ট পার্টিসহ বামপন্থী দলগুলো যত দিন পর্যন্ত ভারতীয় লোকসভা ও রাজ্যসভায় গুরুত্বপূর্ণ অবস্থান নিয়ে টিকে ছিল, তত দিন পর্যন্ত ভারতের রাষ্ট্রনীতিতেও যথেষ্ট গুরুত্ব ও প্রভাব নিয়ে বহাল ছিল ধর্মনিরপেক্ষতার আদর্শ। কিন্তু ক্ষমতা (লোকসভা ও রাজ্যসভা) থেকে কংগ্রেস ও কমিউনিস্ট পার্টিসহ বামপন্থী দলগুলোর বিদায়ের পর থেকে দেশটির রাষ্ট্রনীতিতে ধর্মনিরপেক্ষতা শুধু গুরুত্বই হারাতে থাকেনি; বরং এর বিপরীতে উগ্র হিন্দুত্ববাদী সাম্প্রদায়িক বোধের নীতিই ক্রমেই জোরদার হতে থাকে। আর তা হতে হতে এখন সেটি এতটাই মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছে যে অদূর ভবিষ্যতে ভারত যদি নিজেদের আনুষ্ঠানিক হিন্দু রাষ্ট্র হিসেবে ঘোষণা দেয়, তাহলে তাতেও বিস্মিত হওয়ার কিছুই থাকবে না, তা এ ব্যাপারে গভীর মনঃকষ্ট নিয়ে অমর্ত্য সেন যত উদ্বেগই প্রকাশ করুন না কেন।
এখন কথা হচ্ছে, ভারতের রাষ্ট্র ও সমাজ নিয়ে অমর্ত্য সেন যে উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন, বাংলাদেশের ক্ষেত্রেও কি তার কোনো প্রাসঙ্গিকতা রয়েছে? অথবা রাষ্ট্রের প্রশ্রয় ও সমর্থনে ভারতীয় সমাজ থেকে ধর্মনিরপেক্ষতার আদর্শ যেভাবে ক্রমান্বয়ে বিলুপ্ত হতে চলেছে, বাংলাদেশের সমাজেও কি তেমন কোনো লক্ষণ সীমিত পরিসরে হলেও দেখা দিতে শুরু করেছে? সমাজ ও রাষ্ট্রনীতি-সংক্রান্ত গবেষণার সুনির্দিষ্ট তথ্য ব্যতীত এ ক্ষেত্রে মাত্রা ও স্তরসংবলিত জবাব দেওয়া কিছুটা কঠিন। তবে দৃশ্যমান নানা ঘটনা, সমাজের বিভিন্ন স্তরের মানুষের নানাবিধ আচরণ এবং সেসবের সর্বশেষ প্রবণতা দেখে ধারণা করা যায় যে বাংলাদেশেও ধর্মনিরপেক্ষ অসাম্প্রদায়িক চেতনার শক্তি ইতিমধ্যে কিছুটা হলেও হ্রাস পেয়েছে এবং এর বিদ্যমান প্রবণতা অব্যাহত থাকলে নিকট ভবিষ্যতে তা আরও দুর্বল হয়ে পড়বে বলে আশঙ্কা করারও যথেষ্ট কারণ রয়েছে।
কিছু উদাহরণ দিয়ে বিষয়টিকে স্পষ্ট করা যাক। ১৯৭২ সালে বাংলাদেশ থেকে ধর্মভিত্তিক রাজনীতি পরিপূর্ণভাবে নিষিদ্ধ করা হয়েছিল। কিন্তু ১৯৭৫ সালের সামরিক অভ্যুত্থানের পথ ধরে অতি অল্প সময়ের মধ্যেই দেশে আবার ধর্মভিত্তিক রাজনীতি ফিরে আসে। এমনকি সম্মিলিত আন্দোলনের মাধ্যমে ১৯৯০ সালে দেশ থেকে সামরিক শাসনের অবসান ঘটানো সম্ভব হলেও দেশের বৃহত্তম দল দুটির ‘সাময়িক কৌশলের রাজনীতি’র ফাঁক গলিয়ে দেশের বৃহত্তম ধর্মভিত্তিক দলটি কখনো সরাসরি আবার কখনোবা অনানুষ্ঠানিক ছদ্মবেশে রাষ্ট্রক্ষমতার আনুষ্ঠানিক অংশীদার হয়ে বসে। আর তাদের প্রভাব বাড়তে বাড়তে এমন পর্যায়ে পৌঁছেছে যে ধর্মনিরপেক্ষ বলে পরিচিত রাজনৈতিক দলও এখন তাদের মোকাবিলা করতে গিয়ে কট্টরপন্থী ধর্মীয় গোষ্ঠীর সঙ্গে আঁতাত ও চুক্তি করে চলে এবং তাদের পরামর্শ মেনেই প্রণীত হয় দেশের শিক্ষা, সংস্কৃতি, স্বাস্থ্য ইত্যাদি বিষয়ক রাষ্ট্রীয় নীতিমালা।
দেশের শিক্ষাব্যবস্থা ও পাঠ্যপুস্তকের বর্তমান হাল দেখলে কে বলবে যে এটি একটি প্রগতিশীল ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্র? অবশ্য কাগজে-কলমে তা নয়ও। বাংলাদেশের সংশোধিত সংবিধান অনুযায়ী এর একটি রাষ্ট্রধর্ম রয়েছে, অর্থাৎ আনুষ্ঠানিকভাবে বস্তুতই এটি একটি ধর্মভিত্তিক রাষ্ট্র। অথচ পরিপূর্ণ পরিবেশ ও জনসমর্থন থাকা সত্ত্বেও ১৯৭২ সালের সংবিধানে ফিরে গিয়ে একে একটি পূর্ণাঙ্গ ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্র হিসেবে পুনঃপ্রতিষ্ঠার সুযোগটুকু নষ্ট করা হলো। ক্ষমতার রাজনীতিকে পাকাপোক্ত করতে গিয়ে, জন-আকাঙ্ক্ষা ও মুক্তিযুদ্ধের চেতনার বিপরীতে গিয়ে, একে গড়ে তোলা হলো একটি ধর্মীয় রাষ্ট্র হিসেবে। আর এই ধারাবাহিকতায় ভারতের ১৯৮৪ সালের লোকসভা নির্বাচনে ২ আসন পাওয়া বিজেপি যেভাবে ২০১৪ সালে এসে ২৮২ আসন দখল করে বসল, তেমনিভাবে ৪০ বছর পর বাংলাদেশেও যদি কোনো ধর্মভিত্তিক দল সরকার গঠন করে বসে, তাতে মোটেও আশ্চর্য হওয়ার কিছু থাকবে না। কারণ সে পথ ইতিমধ্যে সব দিক থেকেই খুলে দেওয়া হয়েছে।
এরই মধ্যে সংবিধান সংশোধন করে বলা হয়েছে, এটি একটি ধর্মীয় রাষ্ট্র, পাঠ্যক্রম সংশোধন করে বলা হয়েছে, এটি হেফাজতীয় দর্শনের আওতাধীন, একমুখী শিক্ষাব্যবস্থা বিসর্জন দিয়ে একাধিক ধারার মাদ্রাসা শিক্ষাকে উৎসাহিত করার মাধ্যমে নিশ্চিত করা হয়েছে ধর্মভিত্তিক শিক্ষাই রাষ্ট্রের অগ্রাধিকার। আর এসবের ফলে এসব নীতিমালার প্রায়োগিক ফলাফলও ইতিমধ্যে দেখা দিতে শুরু করেছে। গবেষণা প্রতিবেদনের তথ্য জানাচ্ছে, করোনাকালে প্রাথমিক বিদ্যালয়ে শিক্ষার্থী ভর্তির সংখ্যা হ্রাস পেলেও মাদ্রাসায় তা বেড়েছে (ব্র্যাক শিক্ষা উন্নয়ন ইনস্টিটিউট: বাংলাদেশের শিক্ষাব্যবস্থায় কোভিড-১৯-এর প্রভাব, জুন ২০২২)। আর এসব দেখে দেশের শিক্ষিত সচেতন মানুষ এতটাই উদ্বেগ বোধ করতে শুরু করেছে যে এই উদ্বেগ অমর্ত্য সেনের ওই উদ্বেগের সঙ্গে অনেকটাই মিলে যাচ্ছে। আসলে দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ সাধারণ মানুষ রাষ্ট্রপরিচালনায় ক্ষমতা সংহতকরণের আশায় সাময়িক কৌশলের রাজনীতি দেখতে চায় না। তারা চায় দীর্ঘমেয়াদি জাতি গঠনমূলক রাজনীতি, যে রাজনীতির প্রত্যাশার কথা শ্রীলঙ্কা-সংক্রান্ত সাম্প্রতিক আলোচনায়ও উঠে এসেছে।
‘জাতি’ হিসেবে ভারতের টিকে থাকার বিষয়ে উদ্বেগ ও আশঙ্কা ব্যক্ত করেছেন নোবেলজয়ী অর্থনীতিবিদ অধ্যাপক অমর্ত্য সেন। ৩০ জুন কলকাতায় অমর্ত্য সেন গবেষণা কেন্দ্রের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে দেওয়া বক্তব্যে তিনি তাঁর এ আশঙ্কার কথা ব্যক্ত করেন। বহু মত ও বহু ধর্মের সমন্বয়ে গড়ে ওঠা ধর্মনিরপেক্ষ ভারতীয় জাতীয়তা সাম্প্রতিক সময়ে রাষ্ট্রীয় সমর্থন, পৃষ্ঠপোষকতা ও প্রশ্রয়ে ক্রমেই হিন্দুত্ববাদী উগ্রতায় রূপ নিচ্ছে দেখেই বস্তুত তিনি এ মন্তব্য করেছেন। তাঁর এ মন্তব্য শুধু সময়োচিতই নয়, ভারতীয় সমাজ ও রাজনীতির এ সময়কার দুর্ভাগ্যজনক ও হতাশাব্যঞ্জক প্রবণতার বিরুদ্ধে কঠোর প্রতিবাদও বটে। বিশ্বের অগ্রসর চিন্তার সব মানুষ নিঃসন্দেহে তাঁর এ প্রতিবাদকে সাধুবাদ জানাবেন।
এখন প্রশ্ন হচ্ছে, ১৯৪৭ সালে ঔপনিবেশিক শাসন থেকে মুক্তি লাভের পর পরবর্তী প্রায় ছয় দশক ধরে ভারতের সাধারণ মানুষ তাদের অসাম্প্রদায়িক ধর্মনিরপেক্ষ চরিত্র বজায় রাখতে সক্ষম হলেও (নির্বাচনের ফলাফলকে ভিত্তি ধরে বলা) ২০১৪ সালের নির্বাচনে এসে তা এমন ব্যাপক পরিসরে পাল্টে গেল কেমন করে? এটি কি সত্যি কোনো আকস্মিক পরিবর্তন নাকি পূর্ববর্তী বছরগুলোতে ভেতরে-ভেতরে এই পরিবর্তনের ক্ষেত্র ক্রমেই তৈরিই হচ্ছিল, নাকি ভিন্নতর কোনো ব্যাখ্যাও এ ক্ষেত্রে প্রযোজ্য? উল্লেখ্য, ১৯৮৪ সালে ভারতের ৫৪৩ সদস্যবিশিষ্ট লোকসভায় হিন্দুত্ববাদী ভারতীয় জনতা পার্টির (বিজেপি) আসনসংখ্যা ছিল ২টি। আর সেখান থেকে মাত্র ৩০ বছরের ব্যবধানে ২০১৪ সালে এসে তা উন্নীত হয়েছে ২৮২টিতে এবং দেশটির সমাজ ও রাজনীতির সাম্প্রতিক গতিবিধি অনুযায়ী ২০২৩ সালের আসন্ন নির্বাচনে তা যদি ৩০০ ছাড়িয়ে যায়, তাতে মোটেও অবাক হওয়ার কিছু থাকবে না। আর তাতে করে ভারতের ধর্মনিরপেক্ষ জাতীয়তাবাদ যে ক্রমান্বয়ে উগ্র হিন্দু জাতীয়তাবাদে রূপান্তরের পথে হাঁটবে, সে আশঙ্কাই প্রবল এবং সহজেই অনুমেয় যে বস্তুত সেই আশঙ্কার কথা ভেবেই অমর্ত্য সেনের উপরিউক্ত উদ্বেগ।
১৯৪৭-পূর্ব ব্রিটিশবিরোধী সর্বভারতীয় স্বাধীনতা আন্দোলনে নেতৃত্বদানকারী কংগ্রেস ও মুসলিম লীগ উভয়েই ছিল বুর্জোয়া পুঁজিবাদী দল। এর মধ্যে মুসলিম লীগ যেমন ছিল ডানপন্থী, তেমনি কংগ্রেস ছিল কিঞ্চিৎ পরিমাণে হলেও বামপন্থার প্রতি সহানুভূতিশীল, অন্তত জওহরলাল নেহরুর জীবদ্দশা পর্যন্ত। এ অবস্থায় কংগ্রেস যত দিন ভারতের রাষ্ট্রক্ষমতায় (কেন্দ্রে) ছিল, তত দিন পর্যন্ত কাগজে-কলমে হলেও সেখানে ধর্মনিরপেক্ষতার নীতি বহাল ছিল। তদুপরি ১৯৪৭-পূর্ব ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনকালে গড়ে ওঠা কমিউনিস্ট পার্টির আদর্শিক প্রভাব সে সময় যেভাবে সারা ভারতবর্ষে ছড়িয়ে পড়েছিল, সেটিও স্বাধীনতা-পরবর্তী ভারতে দীর্ঘ সময় পর্যন্ত ধর্মনিরপেক্ষ ভাবধারা টিকিয়ে রাখতে সহায়ক ভূমিকা রেখেছিল বলে ধারণা করা চলে।
আর এ সূত্রেই এ ক্ষেত্রে বিশেষভাবে লক্ষণীয় যে কমিউনিস্ট পার্টিসহ বামপন্থী দলগুলো যত দিন পর্যন্ত ভারতীয় লোকসভা ও রাজ্যসভায় গুরুত্বপূর্ণ অবস্থান নিয়ে টিকে ছিল, তত দিন পর্যন্ত ভারতের রাষ্ট্রনীতিতেও যথেষ্ট গুরুত্ব ও প্রভাব নিয়ে বহাল ছিল ধর্মনিরপেক্ষতার আদর্শ। কিন্তু ক্ষমতা (লোকসভা ও রাজ্যসভা) থেকে কংগ্রেস ও কমিউনিস্ট পার্টিসহ বামপন্থী দলগুলোর বিদায়ের পর থেকে দেশটির রাষ্ট্রনীতিতে ধর্মনিরপেক্ষতা শুধু গুরুত্বই হারাতে থাকেনি; বরং এর বিপরীতে উগ্র হিন্দুত্ববাদী সাম্প্রদায়িক বোধের নীতিই ক্রমেই জোরদার হতে থাকে। আর তা হতে হতে এখন সেটি এতটাই মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছে যে অদূর ভবিষ্যতে ভারত যদি নিজেদের আনুষ্ঠানিক হিন্দু রাষ্ট্র হিসেবে ঘোষণা দেয়, তাহলে তাতেও বিস্মিত হওয়ার কিছুই থাকবে না, তা এ ব্যাপারে গভীর মনঃকষ্ট নিয়ে অমর্ত্য সেন যত উদ্বেগই প্রকাশ করুন না কেন।
এখন কথা হচ্ছে, ভারতের রাষ্ট্র ও সমাজ নিয়ে অমর্ত্য সেন যে উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন, বাংলাদেশের ক্ষেত্রেও কি তার কোনো প্রাসঙ্গিকতা রয়েছে? অথবা রাষ্ট্রের প্রশ্রয় ও সমর্থনে ভারতীয় সমাজ থেকে ধর্মনিরপেক্ষতার আদর্শ যেভাবে ক্রমান্বয়ে বিলুপ্ত হতে চলেছে, বাংলাদেশের সমাজেও কি তেমন কোনো লক্ষণ সীমিত পরিসরে হলেও দেখা দিতে শুরু করেছে? সমাজ ও রাষ্ট্রনীতি-সংক্রান্ত গবেষণার সুনির্দিষ্ট তথ্য ব্যতীত এ ক্ষেত্রে মাত্রা ও স্তরসংবলিত জবাব দেওয়া কিছুটা কঠিন। তবে দৃশ্যমান নানা ঘটনা, সমাজের বিভিন্ন স্তরের মানুষের নানাবিধ আচরণ এবং সেসবের সর্বশেষ প্রবণতা দেখে ধারণা করা যায় যে বাংলাদেশেও ধর্মনিরপেক্ষ অসাম্প্রদায়িক চেতনার শক্তি ইতিমধ্যে কিছুটা হলেও হ্রাস পেয়েছে এবং এর বিদ্যমান প্রবণতা অব্যাহত থাকলে নিকট ভবিষ্যতে তা আরও দুর্বল হয়ে পড়বে বলে আশঙ্কা করারও যথেষ্ট কারণ রয়েছে।
কিছু উদাহরণ দিয়ে বিষয়টিকে স্পষ্ট করা যাক। ১৯৭২ সালে বাংলাদেশ থেকে ধর্মভিত্তিক রাজনীতি পরিপূর্ণভাবে নিষিদ্ধ করা হয়েছিল। কিন্তু ১৯৭৫ সালের সামরিক অভ্যুত্থানের পথ ধরে অতি অল্প সময়ের মধ্যেই দেশে আবার ধর্মভিত্তিক রাজনীতি ফিরে আসে। এমনকি সম্মিলিত আন্দোলনের মাধ্যমে ১৯৯০ সালে দেশ থেকে সামরিক শাসনের অবসান ঘটানো সম্ভব হলেও দেশের বৃহত্তম দল দুটির ‘সাময়িক কৌশলের রাজনীতি’র ফাঁক গলিয়ে দেশের বৃহত্তম ধর্মভিত্তিক দলটি কখনো সরাসরি আবার কখনোবা অনানুষ্ঠানিক ছদ্মবেশে রাষ্ট্রক্ষমতার আনুষ্ঠানিক অংশীদার হয়ে বসে। আর তাদের প্রভাব বাড়তে বাড়তে এমন পর্যায়ে পৌঁছেছে যে ধর্মনিরপেক্ষ বলে পরিচিত রাজনৈতিক দলও এখন তাদের মোকাবিলা করতে গিয়ে কট্টরপন্থী ধর্মীয় গোষ্ঠীর সঙ্গে আঁতাত ও চুক্তি করে চলে এবং তাদের পরামর্শ মেনেই প্রণীত হয় দেশের শিক্ষা, সংস্কৃতি, স্বাস্থ্য ইত্যাদি বিষয়ক রাষ্ট্রীয় নীতিমালা।
দেশের শিক্ষাব্যবস্থা ও পাঠ্যপুস্তকের বর্তমান হাল দেখলে কে বলবে যে এটি একটি প্রগতিশীল ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্র? অবশ্য কাগজে-কলমে তা নয়ও। বাংলাদেশের সংশোধিত সংবিধান অনুযায়ী এর একটি রাষ্ট্রধর্ম রয়েছে, অর্থাৎ আনুষ্ঠানিকভাবে বস্তুতই এটি একটি ধর্মভিত্তিক রাষ্ট্র। অথচ পরিপূর্ণ পরিবেশ ও জনসমর্থন থাকা সত্ত্বেও ১৯৭২ সালের সংবিধানে ফিরে গিয়ে একে একটি পূর্ণাঙ্গ ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্র হিসেবে পুনঃপ্রতিষ্ঠার সুযোগটুকু নষ্ট করা হলো। ক্ষমতার রাজনীতিকে পাকাপোক্ত করতে গিয়ে, জন-আকাঙ্ক্ষা ও মুক্তিযুদ্ধের চেতনার বিপরীতে গিয়ে, একে গড়ে তোলা হলো একটি ধর্মীয় রাষ্ট্র হিসেবে। আর এই ধারাবাহিকতায় ভারতের ১৯৮৪ সালের লোকসভা নির্বাচনে ২ আসন পাওয়া বিজেপি যেভাবে ২০১৪ সালে এসে ২৮২ আসন দখল করে বসল, তেমনিভাবে ৪০ বছর পর বাংলাদেশেও যদি কোনো ধর্মভিত্তিক দল সরকার গঠন করে বসে, তাতে মোটেও আশ্চর্য হওয়ার কিছু থাকবে না। কারণ সে পথ ইতিমধ্যে সব দিক থেকেই খুলে দেওয়া হয়েছে।
এরই মধ্যে সংবিধান সংশোধন করে বলা হয়েছে, এটি একটি ধর্মীয় রাষ্ট্র, পাঠ্যক্রম সংশোধন করে বলা হয়েছে, এটি হেফাজতীয় দর্শনের আওতাধীন, একমুখী শিক্ষাব্যবস্থা বিসর্জন দিয়ে একাধিক ধারার মাদ্রাসা শিক্ষাকে উৎসাহিত করার মাধ্যমে নিশ্চিত করা হয়েছে ধর্মভিত্তিক শিক্ষাই রাষ্ট্রের অগ্রাধিকার। আর এসবের ফলে এসব নীতিমালার প্রায়োগিক ফলাফলও ইতিমধ্যে দেখা দিতে শুরু করেছে। গবেষণা প্রতিবেদনের তথ্য জানাচ্ছে, করোনাকালে প্রাথমিক বিদ্যালয়ে শিক্ষার্থী ভর্তির সংখ্যা হ্রাস পেলেও মাদ্রাসায় তা বেড়েছে (ব্র্যাক শিক্ষা উন্নয়ন ইনস্টিটিউট: বাংলাদেশের শিক্ষাব্যবস্থায় কোভিড-১৯-এর প্রভাব, জুন ২০২২)। আর এসব দেখে দেশের শিক্ষিত সচেতন মানুষ এতটাই উদ্বেগ বোধ করতে শুরু করেছে যে এই উদ্বেগ অমর্ত্য সেনের ওই উদ্বেগের সঙ্গে অনেকটাই মিলে যাচ্ছে। আসলে দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ সাধারণ মানুষ রাষ্ট্রপরিচালনায় ক্ষমতা সংহতকরণের আশায় সাময়িক কৌশলের রাজনীতি দেখতে চায় না। তারা চায় দীর্ঘমেয়াদি জাতি গঠনমূলক রাজনীতি, যে রাজনীতির প্রত্যাশার কথা শ্রীলঙ্কা-সংক্রান্ত সাম্প্রতিক আলোচনায়ও উঠে এসেছে।
ঝড়-জলোচ্ছ্বাস থেকে রক্ষায় সন্দ্বীপের ব্লক বেড়িবাঁধসহ একাধিক প্রকল্প হাতে নিয়েছে সরকার। এ লক্ষ্যে বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে ৫৬২ কোটি টাকা। এ জন্য টেন্ডারও হয়েছে। প্রায় এক বছর পেরিয়ে গেলেও ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানগুলো কাজ শুরু করছে না। পানি উন্নয়ন বোর্ডের (পাউবো) তাগাদায়ও কোনো কাজ হচ্ছে না বলে জানিয়েছেন...
৩ দিন আগেদেশের পরিবহন খাতের অন্যতম নিয়ন্ত্রণকারী ঢাকা সড়ক পরিবহন মালিক সমিতির কমিটির বৈধতা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। সাইফুল আলমের নেতৃত্বাধীন এ কমিটিকে নিবন্ধন দেয়নি শ্রম অধিদপ্তর। তবে এটি কার্যক্রম চালাচ্ছে। কমিটির নেতারা অংশ নিচ্ছেন ঢাকা পরিবহন সমন্বয় কর্তৃপক্ষ (ডিটিসিএ) ও বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষের...
৩ দিন আগেআলুর দাম নিয়ন্ত্রণে ব্যর্থ হয়ে এবার নিজেই বিক্রির উদ্যোগ নিয়েছে সরকার। বাজার স্থিতিশীল রাখতে ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশের (টিসিবি) মাধ্যমে রাজধানীতে ভ্রাম্যমাণ ট্রাকের মাধ্যমে ভর্তুকি মূল্যে আলু বিক্রি করা হবে। একজন গ্রাহক ৪০ টাকা দরে সর্বোচ্চ তিন কেজি আলু কিনতে পারবেন...
৩ দিন আগেসপ্তাহখানেক আগে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকে অনেকের ওয়াল বিষাদময় হয়ে উঠেছিল ফুলের মতো ছোট্ট শিশু মুনতাহাকে হত্যার ঘটনায়। ৫ বছর বয়সী সিলেটের এই শিশুকে অপহরণের পর হত্যা করে লাশ গুম করতে ডোবায় ফেলে রাখা হয়েছিল। প্রতিবেশী গৃহশিক্ষকের পরিকল্পনায় অপহরণের পর তাকে নির্মমভাবে হত্যা করা হয়...
৩ দিন আগে