রঙিন হরফে উদ্বাস্তু জীবনের ফরিয়াদ

ইজাজুল হক
প্রকাশ : ৩০ ডিসেম্বর ২০২২, ০৮: ৫১

ভাসানচর রোহিঙ্গা ক্যাম্পের ২৭ নম্বর শেল্টারের দেয়ালে শোভা পাচ্ছে নান্দনিক এক ক্যালিগ্রাফি। দুই তলাজুড়ে করা বড় আরবি অক্ষরে লেখা ক্যালিগ্রাফিটির সঙ্গে রয়েছে শরণার্থীজীবনের বিভিন্ন অনুষঙ্গ নিয়ে আঁকা রঙিন আলপনা। শিল্পের ভাষায় গুরুত্ব পেয়েছে ধর্মীয় আবহও। তরুণ ক্যালিগ্রাফার ত্বোয়াসীন আরাফাত ত্বোয়াহার আঁকা এই শিল্পকর্মে ফুটে উঠেছে উদ্বাস্তুজীবনের কথা। লিখেছেন ইজাজুল হক

পৃথিবীর নানা প্রান্তের সংকটাপন্ন উদ্বাস্তুদের শিল্পের ভাষায় মানসিক শক্তি জোগাতে সাহায্য করে আন্তর্জাতিক কমিউনিটি আর্ট সংস্থা ‘আর্টোলুশন’। বাংলাদেশে বসবাসরত রোহিঙ্গা শরণার্থীদের জন্য কাজ করতে সংস্থাটি প্রথমবারের মতো ভাসানচরে একটি আর্ট প্রজেক্ট শুরু করে। সেই প্রজেক্টে তিনজন আর্টিস্টকে নির্বাচিত করে আর্টোলুশন, যাঁদের একজন তরুণ ক্যালিগ্রাফার ত্বোয়াসীন আরাফাত ত্বোয়াহা।

রোহিঙ্গাদের ধর্মীয় মূল্যবোধের প্রতি লক্ষ রেখে ত্বোয়াহাকে ২৭ নম্বর শেল্টারে আরবি ক্যালিগ্রাফি করার প্রস্তাব করা হয়। শেল্টারের নিচতলায় মসজিদ এবং দ্বিতীয় তলায় ব্র্যাকের কমিউনিটি সেন্টার। এ দুই ফ্লোরের বাইরের বিশাল দেয়ালজুড়ে বড় আরবি অক্ষরে ত্বোয়াহা আঁকেন ‘আল-হায়াত ওয়ার-রজা’ ক্যালিগ্রাফি, যার অর্থ ‘জীবন ও আশা’। এর মাধ্যমে রং-তুলির আঁচড়ে জীবন-মৃত্যুর দোলাচল পেরিয়ে রোহিঙ্গাদের বেঁচে থাকার আশায় বুক বাঁধার কথা তুলে ধরতে চেয়েছেন তিনি।

এ প্রসঙ্গে ক্যালিগ্রাফার ত্বোয়াহা বলেন, ‘ক্যালিগ্রাফির প্রতিপাদ্য নির্বাচনে আমার জীবনের কিছু বাস্তব অভিজ্ঞতা সহায়তা করেছে। ২০১৭ সালে যখন বিপুলসংখ্যক রোহিঙ্গা জীবন বাঁচাতে বাংলাদেশে শরণার্থী হচ্ছিল, তখন আমি স্বেচ্ছাসেবী হিসেবে রোহিঙ্গা ক্যাম্পে কাজ করি। তখন দেখেছি, শরণার্থীদের অনেকের বেঁচে থাকার মতো প্রাণটা (আল-হায়াত) ছাড়া কিছুই বাকি নেই। পরিবার-পরিজনকে তারা নৃশংসভাবে খুন হতে দেখেছে, ধর্ষিত-নির্যাতিত হতে দেখেছে, মানুষ যা যা নিয়ে বেঁচে থাকার স্বপ্ন দেখে, সবই তাদের থেকে ছিনিয়ে নেওয়া হয়েছে। এত বিশাল শূন্যতা নিয়েও তারা বেঁচে থাকার আশায় (আর-রজা) বুক বাঁধছে প্রতিদিন। সেদিকে লক্ষ রেখেই এ দুই শব্দের মাধ্যমে তাঁদের পুরো জীবনের কথা তুলে আনতে চেয়েছি।’

আর্টোলুশনের সহপ্রতিষ্ঠাতা ও চিফ ক্রিয়েটিভ অফিসার ড. ম্যাক্স ফ্রাইডার প্রজেক্টের লক্ষ্য-উদ্দেশ্য সম্পর্কে বলেন, ‘রোহিঙ্গা সম্প্রদায়ের চারুশৈলীর সঙ্গে ক্যালিগ্রাফির ঐতিহ্য মিশিয়ে দিয়ে আলাদা আবেদন তৈরি করার জন্যই আমরা এই উদ্যোগ হাতে নিই এবং অন্য কয়েকজন শিল্পীর সঙ্গে ক্যালিগ্রাফার ত্বোয়াহাকে আমন্ত্রণ জানাই। আমাদের শিল্পীরা একদল রোহিঙ্গা শরণার্থীকে প্রশিক্ষণ দেয় এবং তাদের সহায়তায় আমাদের প্রজেক্টের কয়েকটি শিল্পকর্ম বাস্তবায়ন করি।’

 ২৭ নম্বর শেল্টারের মসজিদের দেয়ালে আঁকা ত্বোয়াহার গ্রাফিতি সম্পর্কে ড. ম্যাক্স বলেন, ‘মসজিদের ইমাম সাহেব আমাদের অনুরোধ করেছিলেন, গ্রাফিতির মধ্যে যেন কোনো মানুষ ও প্রাণীর ছবি না রাখি। তাঁর কথার প্রতি সম্মান রেখেই আমরা ‘জীবন ও আশা’ ক্যালিগ্রাফির কাজ শুরু করি। এটি ভবনের দুই তলার দেয়ালজুড়ে ১৩৫ ফুটের বিশাল জায়গা দখল করে নেয়। আমার জানামতে, এই অসাধারণ কাজ বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় একক ক্যালিগ্রাফি। এ ছাড়া রোহিঙ্গা চারুশৈলীর সঙ্গে ক্যালিগ্রাফির সম্মিলনও ইতিহাসে প্রথম।’

আর্টোলুশনের পাবলিক আর্ট পদ্ধতির সঙ্গে দারুণভাবে ক্যালিগ্রাফিকে একীভূত করতে সক্ষম হয়েছেন ক্যালিগ্রাফার ত্বোয়াহা। তাই তাঁর এই শিল্পকর্মকে ড. ম্যাক্স ‘আরবি ক্যালিগ্রাফির ঐতিহাসিক মুহূর্ত’ বলে অভিহিত করেছেন। বাংলাদেশের কোনো রোহিঙ্গা ক্যাম্পে এটিই প্রথম মসজিদ, যেখানে সব বয়সী শরণার্থীর সম্মিলিত অংশগ্রহণে এত বড় ক্যালিগ্রাফি ও সমাজঘনিষ্ঠ পাবলিক পেইন্টিং আঁকা হয়েছে। এই প্রজেক্টের ফলাফল নিয়ে মন্তব্য করে ড. ম্যাক্স ফ্রাইডার বলেন, ‘এটি একটি আন্দোলন, যা বৈশ্বিক শিল্প, শিক্ষা ও সংকটের ভবিষ্যৎ ইতিহাসের ধারণার সঙ্গে ক্যালিগ্রাফিকে এক কাতারে নিয়ে আসবে।’

ভাসানচরে আর্টোলুশনের এই প্রজেক্ট বাস্তবায়নে সহযোগিতা করেছে জাতিসংঘ শরণার্থীবিষয়ক হাইকমিশনার ইউএনএইচসিআর এবং বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা ব্র্যাক। 

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
খুঁজুন

সম্পর্কিত