জুলফিকার আলি মাণিক, জ্যেষ্ঠ সাংবাদিক
মেয়েটির পুরোনো জামা নরম হতে হতে অনেক জায়গায় ছিঁড়ে গেছে। তারপরও সেই জামা পরা ছাড়া তার গত্যন্তর নেই। কেননা, হতদরিদ্র বাবা অমানুষিক পরিশ্রমের সামান্য আয় দিয়ে কোনোমতে সংসার চালান, পাশাপাশি মেয়েকে পড়াচ্ছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে। ছিঁড়ে গেলেও চট করে মেয়েকে নতুন জামা কিনে দেওয়ার সামর্থ্য নেই বাবার। তাই বলে ছেঁড়া জামা পরে তো ক্লাসে যাওয়া যায় না, চলা যায় না সহপাঠী-বন্ধুদের সঙ্গে। আবার একটি নতুন জামা কেনাও সমাধান নয়। কেননা, দরিদ্র হলেও একজন বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ুয়া মেয়ের একই জামা প্রতিদিন পরে সমাজে চলা সম্ভব নয়। ছাত্রী নিজেই সমাধান খুঁজেছেন। একটি বোরকা কিনে নিয়েছেন। সব সময় ছেঁড়া জামার ওপর একই বোরকা চাপিয়ে চলে। সবাই কেবল তাঁর বোরকাটা দেখে, সে ছেঁড়া জামা আর জীবনের দারিদ্র্য লুকিয়ে রাখে বোরকার আড়ালে।
এই ছাত্রীর জীবনসংগ্রামের সঙ্গে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আরেক ছাত্রের বেঁচে থাকার লড়াইয়ে মিল আছে। ছাত্রের ফুলশার্টের হাতা কনুইয়ের নিচে ছিঁড়ে গেছে। ছেলেটির বোরকা পরার সুযোগ নেই। নিরুপায় হয়ে গায়ে চড়ানো ছেঁড়া শার্ট লুকাবে কী করে? সে-ও বুদ্ধি বের করে। ফুলশার্টের হাতা দুটো গোটাতে গোটাতে কনুইয়ের ওপরের বাহু পর্যন্ত ভাঁজ করে রাখে। গোটানো হাতার ভাঁজের ভেতর আড়াল হয় ছেঁড়া অংশগুলো। সহপাঠী-বন্ধুরা জানে এটা ‘স্টাইল’, কিন্তু ছেলেটি আসলে শার্টের ছিঁড়ে যাওয়া হাতা আর জীবনের দৈন্যদশা গোপন করেন।
দরিদ্র দুই ছাত্র-ছাত্রীর একজনের বাবা একটি গ্রামীণ জনপদে ইটখোলার কর্মী। আরকজনের বাবাও অতি নিম্ন আয়ের কাজ করেন। তাঁদের মতো কত অভিভাবকের সন্তান শতবর্ষী ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে অতীতে পড়েছে, এখন পড়ছে এবং ভবিষ্যতে পড়বে, তার বিস্তৃত হিসাব অতীতে যেমন নেওয়ার চেষ্টা দেখিনি, হয়তো ভবিষ্যতে থাকবে না। শুধু ভালো পড়ালেখা করে নয়, চরম দারিদ্র্য, বিচিত্র বেদনা, বঞ্চনা, অবহেলা, নিগ্রহ, অপমান ও অসহায়ত্বের মতো নিষ্ঠুর বাস্তবতা জয় করে এই মেধাবীরা উঠে আসে দেশসেরা সর্বোচ্চ বিদ্যাপীঠে।
নিম্ন আয় ও দরিদ্র পরিবারের সন্তানদের জীবনসংগ্রাম রাজধানীর বুকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে এসে আরও বিস্তৃত ও কঠিন হয়। কেননা, এখানে চরম বৈচিত্র্যপূর্ণ পরিবারের ছেলেমেয়েরা একসঙ্গে পাঠ নিতে আসে। সমাজের সব ধরনের সুযোগ-সুবিধা, সর্বাধুনিক ও বিলাসী জীবনের স্বাদ অনায়াসে পাওয়ার মতো বিত্তশালীদের ছেলেমেয়েরাও থাকেন। তাঁদের সঙ্গেই পাঠ নেন জীর্ণ জামা পাল্টে একটা নতুন জামা কিনে পরার মতো সামর্থ্যহীন পরিবারের সন্তানেরাও। চরম আর্থসামাজিক-সাংস্কৃতিক বৈপরীত্যের বাস্তবতা থেকে এসেও একই বিশ্ববিদ্যালয়ের, একই বিভাগের, একই শ্রেণিতে, একই বেঞ্চে পাশাপাশি বসে পড়ালেখা করার সুযোগটাই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সবচেয়ে বড় সৌন্দর্য বলে আমার ভাবনায় মনে হয়। তবে এমন পরিবেশে বিদ্যা গ্রহণের সংগ্রাম অসহায় দরিদ্র পরিবারের সন্তানদের জন্য বাস্তবে খুব কঠিন। কারণ, তাঁদের বহু সচ্ছল, বিত্তবান সহপাঠী-বন্ধুর জীবন তুলনামূলকভাবে বিপুল আধুনিক সুখ-সুবিধার স্পর্শে অগ্রসর হয়েছে। সেসব সহপাঠীর সামনে সংকুচিত না হয়ে, সংকীর্ণতাকে তুড়ি মেরে উড়িয়ে দিয়ে নিজের সম্মান ও মর্যাদা রক্ষা করে কমপক্ষে অর্ধদশক ধরে পাঠ নেওয়ার সংগ্রাম করতে হয় দরিদ্র পরিবারের সন্তানদের। সেই লড়াই কত কঠিন, সেটা হাড়ে হাড়ে টের পায় শুধু দারিদ্র্যের ভেতর থেকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে উঠে আসা মেধাবী ছাত্রছাত্রীরা।
সুশৃঙ্খল তথ্য না থাকলেও এমন ধারণা অবাস্তব হবে না যে, স্কুল-কলেজের মতো ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকেও গত ১০০ বছরে দারিদ্র্যের জন্য অনেক মেধাবী ছাত্রছাত্রী পাঠ গ্রহণের মাঝপথে নীরবে ঝরে গেছেন। হয়তো কারও বাড়িয়ে দেওয়া সামান্য সহযোগিতার হাত তাঁদের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অসামান্য কৃতিত্ব অর্জনের পথে এগিয়ে দিতে পারত। হয়তো তাঁদের কেউ দেশের জন্য গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখতেন, নিজের কাজ দিয়ে নিজেকেই দেশের অমূল্য সম্পদে পরিণত করতে পারতেন।
২০২১ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ১০০ বছর পূর্ণ করেছে। করোনার সংক্রমণসহ নানা কারণে সাবেক শিক্ষার্থীদের সংগঠন ‘ঢাকা ইউনিভার্সিটি অ্যালামনাই অ্যাসোসিয়েশন’ প্রতিষ্ঠার শতবর্ষ উদযাপন করছে ২০২২ সালের জানুয়ারিতে। এই প্রাণপ্রিয় বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক ছাত্র ও সাংবাদিক হিসেবে উদযাপন আয়োজনের একটি ঘরোয়া আলোচনায় যুক্ত হওয়ার সুযোগ হয়েছিল। সেখানে অ্যালামনাই অ্যাসোসিয়েশনের নেতাদের কাছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যয়নরত দরিদ্র, নিম্ন আয়ের পরিবারের দুই ছাত্র-ছাত্রীর জীবনসংগ্রামের নির্মম বাস্তবতার খণ্ডচিত্র জেনেছি, যা হৃদয়কে কাঁদায়। সংগঠনটি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এমন অসহায় শিক্ষার্থীদের অনেককে মাসিক ভিত্তিতে ন্যূনতম প্রয়োজনের জন্য অর্থসহায়তা দেওয়ার কর্মসূচি পরিচালনা করছে। বর্তমানে সবাইকে না পারলেও তহবিলের সামর্থ্য অনুসারে দুই হাজারের বেশি অসচ্ছল শিক্ষার্থীকে আর্থিক সহায়তা দিচ্ছে। তহবিল বাড়লে সহায়তার বৃত্ত বড় হবে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রতিবছর বহু শিক্ষার্থী ভর্তি হন, যাঁদের পরিবার ধনাঢ্য কিংবা খুব সচ্ছল। তাঁরাও জনগণের টাকায় পরিচালিত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রতি মাসে ৩০ টাকা, অর্থাৎ বছরে ৩৬০ টাকা বেতন দিয়ে পড়েন। বহু শিক্ষার্থী এক বছরের বেতনের টাকার চেয়ে বহুগুণ বেশি টাকা দৈনিক হাতখরচ হিসেবে ব্যয় করার সামর্থ্য রাখেন। এমন শিক্ষার্থীদের পরিবারগুলোর প্রত্যেকে যদি তাদের সন্তানের পাশাপাশি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অন্তত একজন দরিদ্র শিক্ষার্থীর পড়ালেখার দায়িত্ব নেয়, তাহলে খুব সহজে অ্যালামনাই অ্যাসোসিয়েশনের এই মহতী উদ্যোগের দ্রুত ব্যাপ্তি ঘটবে।
১৯২১ সালে কলা, বিজ্ঞান ও আইন—এ তিনটি অনুষদে ১২টি বিভাগ, ৮৭৭ জন শিক্ষার্থী, ৬০ জন শিক্ষক ও তিনটি আবাসিক হল নিয়ে যাত্রা শুরু করা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শতবর্ষে শিক্ষার্থী ৪০ হাজার হওয়ার পথে। বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের দীর্ঘ ইতিহাসের সঙ্গে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অবিচ্ছেদ্য সম্পর্ক। এই বিদ্যাপীঠ বাঙালি ও বাংলাদেশিদের গৌরবময় অহংকার, যা কেবলই বর্ণাঢ্য দূর অতীতের অবদানগুলোকে ঘিরে। সেই অতীতগুলো যত দূরে গেছে, যত নতুন বর্তমান এসেছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় নিয়ে, ততই বাষ্পরুদ্ধ বেদনার অনুভূতির পাহাড় জমেছে। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার মান হয়েছে প্রশ্নবিদ্ধ; আন্তর্জাতিক আঙিনায় বিদ্যাপীঠটির মর্যাদার অবস্থান নিয়ে আছে হতাশা; গবেষণায় অনীহা, দৈন্য-উদাসীনতা; শিক্ষকদের মর্যাদা ক্ষুণ্নকারী দলবাজি-বিভক্তি-স্বজনপ্রীতি; পেশিশক্তি, সন্ত্রাস ও আর্থিক কেলেঙ্কারিতে ডুবে যাওয়া ছাত্ররাজনীতি; হলগুলোয় সাধারণ ছাত্রছাত্রীদের বঞ্চনা, ভীতি ও জিম্মিদশা; হলের খাবার, শিক্ষার্থীদের শারীরিক ও মানসিক স্বাস্থ্যসহ বহু গুরুত্বপূর্ণ সেবার প্রশ্নবিদ্ধ মান; শৌচাগারগুলোর অস্বাস্থ্যকর পরিবেশ; নানা ক্ষেত্রে বিচিত্র দুর্নীতি-অনিয়ম-অপচয় ও কেলেঙ্কারি; বাস্তবতার নিরিখে অপ্রয়োজনীয় বিভাগগুলো বিলুপ্ত না করে যুগের পর যুগ ধরে অর্থ ব্যয়; কিছু শিক্ষকের অসদাচরণ; পাঠদান, পরীক্ষা ও প্রকাশনা নিয়ে অনিয়ম; ব্যক্তি ও গোষ্ঠীস্বার্থের কর্মকাণ্ডে আগ্রহ; দুর্বল জবাবদিহি ও ব্যবস্থাপনা এবং অনেক বিতর্কিত প্রশাসনিক সিদ্ধান্ত পঞ্চাশের বাংলাদেশের গর্বের ধন শতবর্ষী ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় নিয়ে গত পাঁচ দশকে কেবল আক্ষেপই বাড়িয়েছে।
জীবনে শুধু একটি চাকরি কিংবা ব্যবসা করে সংসার পালতে বা বিত্ত গড়তে উচ্চতর শিক্ষার সনদ দেওয়ার লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য নিয়ে কি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল? নাকি সব অর্থে উচ্চতর জ্ঞানের চর্চা ও বিস্তার ঘটিয়ে সুন্দর সমাজ বিনির্মাণে অবদান রাখতে যোগ্য জ্ঞান-মানের মানুষ তৈরির জন্য প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল? এমন অনেক প্রশ্নগুচ্ছ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শতবর্ষ পূর্ণ হওয়ার আনন্দকে পূর্ণতা দেয় না। তবু সব প্রজন্মের শিক্ষার্থী ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গে আত্মার সম্পর্ক অনুভব করেন। এ প্রসঙ্গে একজনের একটি আবেগপূর্ণ ঘটনা উল্লেখযোগ্য। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এক সাবেক ছাত্র তাঁর নবজাতকের কেটে ফেলা নাড়ি পুঁতেছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকার মাটিতে। তাঁর চিন্তায়, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গে দেশের মানুষের সম্পর্কটা শুধু শ্রেণিকক্ষে পাঠদানকেন্দ্রিক লেনদেন হতে পারে না। সম্পর্কটা হতে হবে সন্তানের সঙ্গে মায়ের নাড়ির বন্ধনের মতো। তিনি নিজে তা অনুভব করেন এবং প্রত্যাশা করেন, তাঁর সন্তান যেন বড় হয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গে তাঁর নাড়ির টান অনুভব করেন। মা যেমন সন্তান মানুষ করেন, তেমনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ও তার শিক্ষার্থীদের সুনাগরিক হওয়ার যোগ্য করে শিক্ষিত করুক, এটা বুকের গভীরের আকাঙ্ক্ষা। সেই শিক্ষার্থীরা সমাজের সর্বত্র ছড়িয়ে যাবে। নিজেরা সৎ থাকবে, দুর্নীতি করবে না, লোভী প্রতারক-প্রবঞ্চক হবে না, অন্যের ও দেশের অনিষ্ট করবে না; বরং যেকোনো অন্যায়, অনৈতিক চর্চার বিরুদ্ধে সোচ্চার হবে, প্রয়োজনে ত্যাগ স্বীকার করবে এবং সমাজ, দেশ ও বৃহৎ জনগোষ্ঠীকে সুন্দর করে তুলবে।
পরীক্ষায় ভালো ফল পেতে যেমন ভালো পড়ালেখা করা দরকার, তেমনি ভালো দেশ ও সমাজ পেতে প্রকৃত সুশিক্ষিত ভালো মানুষ দরকার। সেটা তৈরি করার দায়িত্ব গত পঞ্চাশ বছরে কতটুকু আন্তরিকতার সঙ্গে অনুভব করেছে আজকের শতবর্ষী ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়? চিরকাল যেন উদার মানবিক জ্ঞাননির্ভর শিক্ষিত সমাজ, জাতি, দেশ ও বিশ্বগঠনের অক্ষয় বটবৃক্ষ হয়ে থাকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।
জুলফিকার আলি মাণিক, জ্যেষ্ঠ সাংবাদিক
মেয়েটির পুরোনো জামা নরম হতে হতে অনেক জায়গায় ছিঁড়ে গেছে। তারপরও সেই জামা পরা ছাড়া তার গত্যন্তর নেই। কেননা, হতদরিদ্র বাবা অমানুষিক পরিশ্রমের সামান্য আয় দিয়ে কোনোমতে সংসার চালান, পাশাপাশি মেয়েকে পড়াচ্ছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে। ছিঁড়ে গেলেও চট করে মেয়েকে নতুন জামা কিনে দেওয়ার সামর্থ্য নেই বাবার। তাই বলে ছেঁড়া জামা পরে তো ক্লাসে যাওয়া যায় না, চলা যায় না সহপাঠী-বন্ধুদের সঙ্গে। আবার একটি নতুন জামা কেনাও সমাধান নয়। কেননা, দরিদ্র হলেও একজন বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ুয়া মেয়ের একই জামা প্রতিদিন পরে সমাজে চলা সম্ভব নয়। ছাত্রী নিজেই সমাধান খুঁজেছেন। একটি বোরকা কিনে নিয়েছেন। সব সময় ছেঁড়া জামার ওপর একই বোরকা চাপিয়ে চলে। সবাই কেবল তাঁর বোরকাটা দেখে, সে ছেঁড়া জামা আর জীবনের দারিদ্র্য লুকিয়ে রাখে বোরকার আড়ালে।
এই ছাত্রীর জীবনসংগ্রামের সঙ্গে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আরেক ছাত্রের বেঁচে থাকার লড়াইয়ে মিল আছে। ছাত্রের ফুলশার্টের হাতা কনুইয়ের নিচে ছিঁড়ে গেছে। ছেলেটির বোরকা পরার সুযোগ নেই। নিরুপায় হয়ে গায়ে চড়ানো ছেঁড়া শার্ট লুকাবে কী করে? সে-ও বুদ্ধি বের করে। ফুলশার্টের হাতা দুটো গোটাতে গোটাতে কনুইয়ের ওপরের বাহু পর্যন্ত ভাঁজ করে রাখে। গোটানো হাতার ভাঁজের ভেতর আড়াল হয় ছেঁড়া অংশগুলো। সহপাঠী-বন্ধুরা জানে এটা ‘স্টাইল’, কিন্তু ছেলেটি আসলে শার্টের ছিঁড়ে যাওয়া হাতা আর জীবনের দৈন্যদশা গোপন করেন।
দরিদ্র দুই ছাত্র-ছাত্রীর একজনের বাবা একটি গ্রামীণ জনপদে ইটখোলার কর্মী। আরকজনের বাবাও অতি নিম্ন আয়ের কাজ করেন। তাঁদের মতো কত অভিভাবকের সন্তান শতবর্ষী ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে অতীতে পড়েছে, এখন পড়ছে এবং ভবিষ্যতে পড়বে, তার বিস্তৃত হিসাব অতীতে যেমন নেওয়ার চেষ্টা দেখিনি, হয়তো ভবিষ্যতে থাকবে না। শুধু ভালো পড়ালেখা করে নয়, চরম দারিদ্র্য, বিচিত্র বেদনা, বঞ্চনা, অবহেলা, নিগ্রহ, অপমান ও অসহায়ত্বের মতো নিষ্ঠুর বাস্তবতা জয় করে এই মেধাবীরা উঠে আসে দেশসেরা সর্বোচ্চ বিদ্যাপীঠে।
নিম্ন আয় ও দরিদ্র পরিবারের সন্তানদের জীবনসংগ্রাম রাজধানীর বুকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে এসে আরও বিস্তৃত ও কঠিন হয়। কেননা, এখানে চরম বৈচিত্র্যপূর্ণ পরিবারের ছেলেমেয়েরা একসঙ্গে পাঠ নিতে আসে। সমাজের সব ধরনের সুযোগ-সুবিধা, সর্বাধুনিক ও বিলাসী জীবনের স্বাদ অনায়াসে পাওয়ার মতো বিত্তশালীদের ছেলেমেয়েরাও থাকেন। তাঁদের সঙ্গেই পাঠ নেন জীর্ণ জামা পাল্টে একটা নতুন জামা কিনে পরার মতো সামর্থ্যহীন পরিবারের সন্তানেরাও। চরম আর্থসামাজিক-সাংস্কৃতিক বৈপরীত্যের বাস্তবতা থেকে এসেও একই বিশ্ববিদ্যালয়ের, একই বিভাগের, একই শ্রেণিতে, একই বেঞ্চে পাশাপাশি বসে পড়ালেখা করার সুযোগটাই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সবচেয়ে বড় সৌন্দর্য বলে আমার ভাবনায় মনে হয়। তবে এমন পরিবেশে বিদ্যা গ্রহণের সংগ্রাম অসহায় দরিদ্র পরিবারের সন্তানদের জন্য বাস্তবে খুব কঠিন। কারণ, তাঁদের বহু সচ্ছল, বিত্তবান সহপাঠী-বন্ধুর জীবন তুলনামূলকভাবে বিপুল আধুনিক সুখ-সুবিধার স্পর্শে অগ্রসর হয়েছে। সেসব সহপাঠীর সামনে সংকুচিত না হয়ে, সংকীর্ণতাকে তুড়ি মেরে উড়িয়ে দিয়ে নিজের সম্মান ও মর্যাদা রক্ষা করে কমপক্ষে অর্ধদশক ধরে পাঠ নেওয়ার সংগ্রাম করতে হয় দরিদ্র পরিবারের সন্তানদের। সেই লড়াই কত কঠিন, সেটা হাড়ে হাড়ে টের পায় শুধু দারিদ্র্যের ভেতর থেকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে উঠে আসা মেধাবী ছাত্রছাত্রীরা।
সুশৃঙ্খল তথ্য না থাকলেও এমন ধারণা অবাস্তব হবে না যে, স্কুল-কলেজের মতো ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকেও গত ১০০ বছরে দারিদ্র্যের জন্য অনেক মেধাবী ছাত্রছাত্রী পাঠ গ্রহণের মাঝপথে নীরবে ঝরে গেছেন। হয়তো কারও বাড়িয়ে দেওয়া সামান্য সহযোগিতার হাত তাঁদের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অসামান্য কৃতিত্ব অর্জনের পথে এগিয়ে দিতে পারত। হয়তো তাঁদের কেউ দেশের জন্য গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখতেন, নিজের কাজ দিয়ে নিজেকেই দেশের অমূল্য সম্পদে পরিণত করতে পারতেন।
২০২১ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ১০০ বছর পূর্ণ করেছে। করোনার সংক্রমণসহ নানা কারণে সাবেক শিক্ষার্থীদের সংগঠন ‘ঢাকা ইউনিভার্সিটি অ্যালামনাই অ্যাসোসিয়েশন’ প্রতিষ্ঠার শতবর্ষ উদযাপন করছে ২০২২ সালের জানুয়ারিতে। এই প্রাণপ্রিয় বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক ছাত্র ও সাংবাদিক হিসেবে উদযাপন আয়োজনের একটি ঘরোয়া আলোচনায় যুক্ত হওয়ার সুযোগ হয়েছিল। সেখানে অ্যালামনাই অ্যাসোসিয়েশনের নেতাদের কাছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যয়নরত দরিদ্র, নিম্ন আয়ের পরিবারের দুই ছাত্র-ছাত্রীর জীবনসংগ্রামের নির্মম বাস্তবতার খণ্ডচিত্র জেনেছি, যা হৃদয়কে কাঁদায়। সংগঠনটি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এমন অসহায় শিক্ষার্থীদের অনেককে মাসিক ভিত্তিতে ন্যূনতম প্রয়োজনের জন্য অর্থসহায়তা দেওয়ার কর্মসূচি পরিচালনা করছে। বর্তমানে সবাইকে না পারলেও তহবিলের সামর্থ্য অনুসারে দুই হাজারের বেশি অসচ্ছল শিক্ষার্থীকে আর্থিক সহায়তা দিচ্ছে। তহবিল বাড়লে সহায়তার বৃত্ত বড় হবে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রতিবছর বহু শিক্ষার্থী ভর্তি হন, যাঁদের পরিবার ধনাঢ্য কিংবা খুব সচ্ছল। তাঁরাও জনগণের টাকায় পরিচালিত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রতি মাসে ৩০ টাকা, অর্থাৎ বছরে ৩৬০ টাকা বেতন দিয়ে পড়েন। বহু শিক্ষার্থী এক বছরের বেতনের টাকার চেয়ে বহুগুণ বেশি টাকা দৈনিক হাতখরচ হিসেবে ব্যয় করার সামর্থ্য রাখেন। এমন শিক্ষার্থীদের পরিবারগুলোর প্রত্যেকে যদি তাদের সন্তানের পাশাপাশি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অন্তত একজন দরিদ্র শিক্ষার্থীর পড়ালেখার দায়িত্ব নেয়, তাহলে খুব সহজে অ্যালামনাই অ্যাসোসিয়েশনের এই মহতী উদ্যোগের দ্রুত ব্যাপ্তি ঘটবে।
১৯২১ সালে কলা, বিজ্ঞান ও আইন—এ তিনটি অনুষদে ১২টি বিভাগ, ৮৭৭ জন শিক্ষার্থী, ৬০ জন শিক্ষক ও তিনটি আবাসিক হল নিয়ে যাত্রা শুরু করা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শতবর্ষে শিক্ষার্থী ৪০ হাজার হওয়ার পথে। বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের দীর্ঘ ইতিহাসের সঙ্গে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অবিচ্ছেদ্য সম্পর্ক। এই বিদ্যাপীঠ বাঙালি ও বাংলাদেশিদের গৌরবময় অহংকার, যা কেবলই বর্ণাঢ্য দূর অতীতের অবদানগুলোকে ঘিরে। সেই অতীতগুলো যত দূরে গেছে, যত নতুন বর্তমান এসেছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় নিয়ে, ততই বাষ্পরুদ্ধ বেদনার অনুভূতির পাহাড় জমেছে। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার মান হয়েছে প্রশ্নবিদ্ধ; আন্তর্জাতিক আঙিনায় বিদ্যাপীঠটির মর্যাদার অবস্থান নিয়ে আছে হতাশা; গবেষণায় অনীহা, দৈন্য-উদাসীনতা; শিক্ষকদের মর্যাদা ক্ষুণ্নকারী দলবাজি-বিভক্তি-স্বজনপ্রীতি; পেশিশক্তি, সন্ত্রাস ও আর্থিক কেলেঙ্কারিতে ডুবে যাওয়া ছাত্ররাজনীতি; হলগুলোয় সাধারণ ছাত্রছাত্রীদের বঞ্চনা, ভীতি ও জিম্মিদশা; হলের খাবার, শিক্ষার্থীদের শারীরিক ও মানসিক স্বাস্থ্যসহ বহু গুরুত্বপূর্ণ সেবার প্রশ্নবিদ্ধ মান; শৌচাগারগুলোর অস্বাস্থ্যকর পরিবেশ; নানা ক্ষেত্রে বিচিত্র দুর্নীতি-অনিয়ম-অপচয় ও কেলেঙ্কারি; বাস্তবতার নিরিখে অপ্রয়োজনীয় বিভাগগুলো বিলুপ্ত না করে যুগের পর যুগ ধরে অর্থ ব্যয়; কিছু শিক্ষকের অসদাচরণ; পাঠদান, পরীক্ষা ও প্রকাশনা নিয়ে অনিয়ম; ব্যক্তি ও গোষ্ঠীস্বার্থের কর্মকাণ্ডে আগ্রহ; দুর্বল জবাবদিহি ও ব্যবস্থাপনা এবং অনেক বিতর্কিত প্রশাসনিক সিদ্ধান্ত পঞ্চাশের বাংলাদেশের গর্বের ধন শতবর্ষী ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় নিয়ে গত পাঁচ দশকে কেবল আক্ষেপই বাড়িয়েছে।
জীবনে শুধু একটি চাকরি কিংবা ব্যবসা করে সংসার পালতে বা বিত্ত গড়তে উচ্চতর শিক্ষার সনদ দেওয়ার লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য নিয়ে কি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল? নাকি সব অর্থে উচ্চতর জ্ঞানের চর্চা ও বিস্তার ঘটিয়ে সুন্দর সমাজ বিনির্মাণে অবদান রাখতে যোগ্য জ্ঞান-মানের মানুষ তৈরির জন্য প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল? এমন অনেক প্রশ্নগুচ্ছ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শতবর্ষ পূর্ণ হওয়ার আনন্দকে পূর্ণতা দেয় না। তবু সব প্রজন্মের শিক্ষার্থী ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গে আত্মার সম্পর্ক অনুভব করেন। এ প্রসঙ্গে একজনের একটি আবেগপূর্ণ ঘটনা উল্লেখযোগ্য। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এক সাবেক ছাত্র তাঁর নবজাতকের কেটে ফেলা নাড়ি পুঁতেছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকার মাটিতে। তাঁর চিন্তায়, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গে দেশের মানুষের সম্পর্কটা শুধু শ্রেণিকক্ষে পাঠদানকেন্দ্রিক লেনদেন হতে পারে না। সম্পর্কটা হতে হবে সন্তানের সঙ্গে মায়ের নাড়ির বন্ধনের মতো। তিনি নিজে তা অনুভব করেন এবং প্রত্যাশা করেন, তাঁর সন্তান যেন বড় হয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গে তাঁর নাড়ির টান অনুভব করেন। মা যেমন সন্তান মানুষ করেন, তেমনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ও তার শিক্ষার্থীদের সুনাগরিক হওয়ার যোগ্য করে শিক্ষিত করুক, এটা বুকের গভীরের আকাঙ্ক্ষা। সেই শিক্ষার্থীরা সমাজের সর্বত্র ছড়িয়ে যাবে। নিজেরা সৎ থাকবে, দুর্নীতি করবে না, লোভী প্রতারক-প্রবঞ্চক হবে না, অন্যের ও দেশের অনিষ্ট করবে না; বরং যেকোনো অন্যায়, অনৈতিক চর্চার বিরুদ্ধে সোচ্চার হবে, প্রয়োজনে ত্যাগ স্বীকার করবে এবং সমাজ, দেশ ও বৃহৎ জনগোষ্ঠীকে সুন্দর করে তুলবে।
পরীক্ষায় ভালো ফল পেতে যেমন ভালো পড়ালেখা করা দরকার, তেমনি ভালো দেশ ও সমাজ পেতে প্রকৃত সুশিক্ষিত ভালো মানুষ দরকার। সেটা তৈরি করার দায়িত্ব গত পঞ্চাশ বছরে কতটুকু আন্তরিকতার সঙ্গে অনুভব করেছে আজকের শতবর্ষী ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়? চিরকাল যেন উদার মানবিক জ্ঞাননির্ভর শিক্ষিত সমাজ, জাতি, দেশ ও বিশ্বগঠনের অক্ষয় বটবৃক্ষ হয়ে থাকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।
জুলফিকার আলি মাণিক, জ্যেষ্ঠ সাংবাদিক
ঝড়-জলোচ্ছ্বাস থেকে রক্ষায় সন্দ্বীপের ব্লক বেড়িবাঁধসহ একাধিক প্রকল্প হাতে নিয়েছে সরকার। এ লক্ষ্যে বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে ৫৬২ কোটি টাকা। এ জন্য টেন্ডারও হয়েছে। প্রায় এক বছর পেরিয়ে গেলেও ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানগুলো কাজ শুরু করছে না। পানি উন্নয়ন বোর্ডের (পাউবো) তাগাদায়ও কোনো কাজ হচ্ছে না বলে জানিয়েছেন...
৩ দিন আগেদেশের পরিবহন খাতের অন্যতম নিয়ন্ত্রণকারী ঢাকা সড়ক পরিবহন মালিক সমিতির কমিটির বৈধতা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। সাইফুল আলমের নেতৃত্বাধীন এ কমিটিকে নিবন্ধন দেয়নি শ্রম অধিদপ্তর। তবে এটি কার্যক্রম চালাচ্ছে। কমিটির নেতারা অংশ নিচ্ছেন ঢাকা পরিবহন সমন্বয় কর্তৃপক্ষ (ডিটিসিএ) ও বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষের...
৩ দিন আগেআলুর দাম নিয়ন্ত্রণে ব্যর্থ হয়ে এবার নিজেই বিক্রির উদ্যোগ নিয়েছে সরকার। বাজার স্থিতিশীল রাখতে ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশের (টিসিবি) মাধ্যমে রাজধানীতে ভ্রাম্যমাণ ট্রাকের মাধ্যমে ভর্তুকি মূল্যে আলু বিক্রি করা হবে। একজন গ্রাহক ৪০ টাকা দরে সর্বোচ্চ তিন কেজি আলু কিনতে পারবেন...
৩ দিন আগেসপ্তাহখানেক আগে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকে অনেকের ওয়াল বিষাদময় হয়ে উঠেছিল ফুলের মতো ছোট্ট শিশু মুনতাহাকে হত্যার ঘটনায়। ৫ বছর বয়সী সিলেটের এই শিশুকে অপহরণের পর হত্যা করে লাশ গুম করতে ডোবায় ফেলে রাখা হয়েছিল। প্রতিবেশী গৃহশিক্ষকের পরিকল্পনায় অপহরণের পর তাকে নির্মমভাবে হত্যা করা হয়...
৩ দিন আগে