মামুনুর রশীদ
শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদিনের একটি উক্তি নিয়ে সমকালের পরিপ্রেক্ষিতে ব্যাখ্যা করার ফলে পক্ষে যাঁরা বলেছেন, তাঁরা বিচার-বিশ্লেষণ করে দেখেছেন বিপক্ষের প্রায় সবাই প্রাসঙ্গিকতা ত্যাগ করে ব্যক্তিগত আক্রমণের পথে এগিয়ে গেছেন। সেই ব্যক্তিগত আক্রমণের সঙ্গে আমার বক্তব্যের কোনো ধরনের সম্পর্ক নেই।
অধিকাংশই ভিত্তিহীন এবং প্রমাণের অপেক্ষা রাখে না। দুটি দৈনিক পত্রিকায় উপসম্পাদকীয়তে বিষয়টি নিয়ে গভীরভাবে বিশিষ্ট ব্যক্তিরা বিস্তারিতভাবে লিখেছেন। তাঁদের লেখা ও সমর্থনে অনেকেই নতুন নতুন বিষয় যোগ করেছেন। এর মধ্যে একদল সমর্থক বলতে শুরু করেছেন, বিষয়টিকে এড়িয়ে গেলেই ভালো হতো। কারণ হিসেবে তাঁরা বলছেন, সস্তা বিনোদন এখন সময়ের দাবি। শিল্প-সাহিত্য পড়ে বা কোনো বিষয়ের গভীরে গিয়ে বিনোদন পাওয়া মানুষ দারুণভাবে কম। চিন্তাহীন একেবারে স্থূল বিনোদনে ব্যাপকসংখ্যক দর্শক বিশ্বাস করে। যে কারণে দেখা যায় মননসমৃদ্ধ কাব্য, সাহিত্য, চিত্রকলা, চলচ্চিত্র এসবের আবেদনও কমে যাচ্ছে। আর যাঁরা স্থূল বিনোদন সৃষ্টি করেন, তাঁদের উদ্দেশ্য ভিউ, লাইক, কমেন্টস ইত্যাদি। কাজেই ওই নামগুলো উচ্চারিত হলে তাঁদের ভিউ বেড়ে যাবে এবং টাকা আসতে থাকবে। তাই এসব ব্যাপার বা ব্যক্তিকে এড়িয়ে যাওয়াই বুদ্ধিমানের কাজ।
এই পথ অনুসরণ করে অনেক বুদ্ধিজীবী এবং সুরুচিবান মানুষ মুখ খোলেননি এবং এটিকে তাঁরা কোনো আলোচনার বিষয় বলেও মনে করেন না। বিপরীত দিকে যাঁরা সোচ্চার হয়েছেন, তাঁরা বিষয়টির সত্যতা বিবেচনা করেই যৌক্তিক আলোচনার পথ ত্যাগ করে ব্যক্তিগত আক্রমণের পথ বেছে নিয়েছেন। ফেসবুক এ ধরনের আক্রমণের জন্য অত্যন্ত চমৎকার ব্যবস্থা। যখন খুশি যাকে-তাকে নিয়ে ইচ্ছেমতো মিথ্যাচার করা যায়। তাঁদের মধ্যে অনেক তথাকথিত শিক্ষিত লোকও আছেন। এমনকি বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপকও আছেন। আর আছেন নিরাপদে বসবাসকারী কিছু প্রবাসী। নিজেদের সম্পর্কে অনেক মিথ্যা পরিচয় দিয়ে যাঁরা অ্যাসাইলাম পেয়েছেন। তাঁদের কোনো লোকলজ্জার ভয়ও নেই। একটা মন্তব্য ছুড়ে দেওয়ার পর যখন চারদিক থেকে প্রতিবাদ আসে, তখন তাঁরা নিজেদের ফেসবুক আইডি, পেজ বন্ধ করে দিয়ে চুপচাপ থাকেন। আবার সুযোগ বুঝে দুটো কথা বলে ছিনতাইকারীর মতো পালিয়ে যান।
প্রশ্ন উঠেছে—জনপরিচিতি আর জনপ্রিয়তা কি এক? চুরি করে, ডাকাতি করে বা একটা ঘৃণ্য কাজ করে কেউ কেউ পরিচিতি লাভ করতে পারে। সেই পরিচিতি দেশব্যাপী ছড়িয়ে পড়ে। কিন্তু ভালো কাজ করে জনপ্রিয় হওয়া কঠিন। কারণ, তার সঙ্গে থাকে জনগণের গ্রহণযোগ্যতা, শিল্পের উৎকর্ষ এবং থাকে ঈর্ষা। আমার এক বন্ধু একটি ফারসি বয়েতের কথা প্রায়ই বলে থাকেন—যখন ভালো কাজের জন্য সুখ্যাতি আসে, তখন বন্ধুরা শীতের পাতার মতো ঝরে যায় আর শত্রুরা বসন্তের পাতার মতো গজাতে থাকে।
এ ক্ষেত্রে বিষয়টি ভিন্ন। যাঁরা এই সব কর্মের সমঝদার, তাঁরা নিজেরা এসব দেখেন না, নিজের ছেলেমেয়ে, আত্মীয়স্বজন, বন্ধুবান্ধবকে কখনো দেখার জন্য পাঠানও না। কিন্তু ওই দুষ্কর্মের পক্ষে সাফাই গেয়ে নিজেকে জাহির করতে চান।
আরেক ধরনের মানুষ আছেন—ব্যর্থ বাম। তাঁদের একাংশ কোনো বাম কর্মকাণ্ডে এখন আর নেই। কোনো একটি ক্ষমতাসীন দলে লেজুড় হয়ে বর্তমানে জীবনযাপন করেন। তাঁদের মাথার এক কোণে হয়তো বসবাস করে নিম্নবর্গ-উচ্চবর্গ এই সব। কারণ শ্রেণিসংগ্রাম থেকে তাঁরা বহু আগেই অবসর নিয়েছেন। তাঁরা জানেন না শিল্প-সাহিত্য নিম্নবর্গের মানুষেরই সৃষ্টি। নগরজীবন শুরু হওয়ার আগে থেকেই এই নিম্নবর্গের মানুষেরাই শিল্প সৃষ্টি করত, তাদের শিল্প কালজয়ী হয়ে থাকত। আমাদের দেশের প্রায় কালজয়ী শিল্পই নিরক্ষর শিল্পীদের মুখে মুখে তৈরি। এই শিল্প যুগ যুগ ধরে মানুষকে বিনোদন দিয়েছে, উজ্জীবিত করেছে। এ ক্ষেত্রে আজকের তথাকথিত শিক্ষিত কিছু কিছু ইউটিউবার কতটা সৃষ্টিশীল হতে পেরেছেন? এ বিষয়গুলো উপেক্ষা করে কেউ তর্কের খাতিরে তর্ক এবং ব্যক্তিগত কোনো কারণ ছাড়াই আক্রমণে তাঁরা দিনরাত অস্ত্র শাণ দিয়ে চলেছেন।
অবশ্য সোশ্যাল মিডিয়ার বেশ কিছু মাধ্যম মানুষের কাজেও লাগে। আমাদের সমাজে দুর্বৃত্তায়ন খুবই লক্ষণীয় বিষয়। সেটা রাজনীতিতে হোক, শিক্ষায় হোক, শিল্পে হোক, ব্যবসায় হোক—সর্বত্র এটিকে যদি আমরা স্বচ্ছভাবে না দেখতে পাই তাহলে এক ভয়াবহ পরিণতি আমাদের জন্য অপেক্ষা করবে। খুব সহজে সস্তা বিনোদন পেয়ে মানুষের বিবেক-বুদ্ধি ক্রমেই লোপ পাচ্ছে। তাদের সামনে নদী লুট হয়ে যাচ্ছে, শিক্ষা ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে। এসব দেখার শক্তি ক্রমেই তারা হারিয়ে ফেলছে। স্কুলের শিক্ষক ক্লাসে না পড়িয়ে মাসের পর মাস বেতন নিয়ে যাচ্ছেন, কিন্তু অভিভাবকেরা সংগঠিত হয়ে এর প্রতিবাদ করছেন না। ক্লাসে না পড়িয়ে কিছু শিক্ষক বিকেলবেলা কোচিংয়ে একই বিষয় পড়াচ্ছেন অর্থের বিনিময়ে। সেই শিক্ষক সরকার থেকে এবং ছাত্রদের কাছ থেকেও বেতন পেয়ে যাচ্ছেন।
আমাদের প্রাকৃতিক নদীর বালু উত্তোলন করে নানা উপায়ে কিছু লোক অর্থের পাহাড় গড়ে তুলেছে। একেবারে পরিকল্পনাহীন এই বালু উত্তোলন নদীর গতিপথকে ধ্বংস করে দিচ্ছে। এটিকে রোধ করা কি ইউটিউবারদের বক্তব্য? না, তাঁদের কর্তব্য না; বরং তাঁরা একে আড়াল করেছেন আর সুস্থ সংস্কৃতিমান ব্যক্তি এটার প্রতিবাদ করছেন। পঞ্চাশ, ষাট, সত্তরের দশকে, এমনকি আশির দশকেও মানুষকে শোষণ-নির্যাতন বোঝানো যেত, এখন মানুষের কাছে মিডিয়ার কল্যাণে প্রচুর তথ্য আছে। কিন্তু এর প্রতিরোধ করার নৈতিক শক্তি কি আছে? এই নৈতিক শক্তিটা কোথা থেকে আসে? যথার্থ শিক্ষা ও সংস্কৃতি থেকে আসে।
যখনই কোনো দেশে বিপ্লব হয়েছে, সেখানে বিপ্লবীরা প্রথমেই অনুধাবন করেছেন, মানুষের শিক্ষার পাশাপাশি শিল্প-সাহিত্য প্রয়োজন। তাই তাঁরা প্রচুর বই প্রকাশ করেছেন, চলচ্চিত্র নির্মাণ করেছেন, উচ্চাঙ্গসংগীত পরিবেশনের ব্যবস্থা করেছেন, ভাস্কর্য ও শিল্পকলার জন্য প্রচুর আগ্রহ দেখিয়েছেন। ফ্রান্স, রাশিয়া, চীন, বর্তমানে কিউবা, লাতিন আমেরিকার দেশগুলো এসব আয়োজন করেছে সব সময়। কিন্তু যখনই এসবের ঘাটতি দেখা যায়, ডুবে যায় সস্তা বিনোদনের সামগ্রীতে, তখনই সে দেশের মানুষের মধ্যে বিকৃতি আসে। সুস্থ সংস্কৃতির বদলে উপজীব্য হয়ে উঠতে দেখা যায় বিকৃতি ও অস্থিরতা। বর্তমানে আমাদের দেশকেও তা স্পর্শ করেছে। সর্বত্র টাকা, টাকা এবং টাকা। টাকা এবং অসুস্থ অর্থ, অসুস্থ ভোগেরও জন্ম দিচ্ছে। আমাদের বিজ্ঞজনেরা বলছেন, জ্ঞানের বাজার কমে গেছে। এটা সত্যি কিন্তু কোন বাজারটা বাড়ছে? ভোগের বাজারটা বাড়ছে। সেই ভোগ আসে অসুস্থ বিনোদনের মাধ্যমে।
আজকের দিনে বিনোদনের সবচেয়ে বড় মাধ্যম মিডিয়া। এই মুক্ত মিডিয়ায় যে কেউ একটি বিনোদনের লাড্ডু ফেলে দিতে পারে, সেখানে খাওয়ার লোকের অভাব হচ্ছে না। এই বাস্তবতার বিরুদ্ধেই কিছু কথা চারদিক থেকে হচ্ছে। কিন্তু এত সুবিধাবাদী মহল তৈরি হয়েছে যে তাদের লোভ-লালসার কাছে সত্যকে ধরে রাখা কঠিন হয়ে পড়ছে। যদিও এ কথা অমোঘ সত্য যে পৃথিবীতে খুব অল্পসংখ্যক লোকই সত্যকে ধরে রাখে। ছোট ছোট লোভ তার সঙ্গে খোঁড়া যুক্তিবাদ, ক্ষমতার কাছে যাওয়ার প্রতিযোগিতা—সবটা মিলে একটা জগৎ তৈরি হয়েছে; যা শুধুই রুচির দুর্ভিক্ষ ঘটিয়ে দেয়। রুচির দুর্ভিক্ষের সঙ্গে চিন্তার দুর্ভিক্ষ, শিল্পের দুর্ভিক্ষ দিন দিন বাড়ছেই। এই দুর্ভিক্ষ রোধে দেশের সচেতন মানুষকে রুখে দাঁড়াতে হবে।
কয়েক দিন আগে দেখা গেল বিশ্ববিদ্যালয়ের একদল ছাত্র ক্লাস বর্জন করেছে শিক্ষক পড়াতে পারেন না বলে। ঘটনাটি যদি সত্যি হয়ে থাকে, তবে এটি একটি উজ্জ্বল উদাহরণ হয়ে থাকবে। প্রাথমিক স্কুল থেকে বিশ্ববিদ্যালয় পর্যন্ত শিক্ষাক্ষেত্রে যে নৈরাজ্য চলছে—তার ভূরি ভূরি প্রমাণ আমাদের সামনে আছে। ষষ্ঠ ও সপ্তম শ্রেণির পাঠ্যবইকে বাতিল করা হয়েছে এবং অন্যান্য বিষয়েও শিক্ষকদের ত্রুটি সংশোধন করে পড়ানোর নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। এ ব্যবস্থাও যে কতটা কার্যকর হবে, তা বলা মুশকিল। যাঁরা পাঠ্যপুস্তক রচনা করেন, তাঁরা যথার্থই দায়িত্বহীনতার পরিচয় দিয়েছেন। মানুষ প্রতি মুহূর্তে সমাজের নানাবিধ লোকের কাছে সুবিচার কামনা করে। সেই সুবিচার না পেয়ে তারাও নৈরাজ্যবাদী হয়ে পড়ে। তাই এই নৈরাজ্যেরকালে সাদাকে সাদা বলা এবং কালোকে কালো বলা এক কঠিন সংকটে পরিণত হয়েছে।
এর মধ্য দিয়েই নানান কৌশলে মানুষকে শুধু শোষণ নয়, তার চিন্তার যে মেরুদণ্ড, তাকেও ভেঙে চুরমার করে দিচ্ছে। সংস্কৃতির এই সংকটে এবং রুচির দুর্ভিক্ষে আমরা কি কোনো ভূমিকা পালন করতে পারব?
মামুনুর রশীদ, নাট্যব্যক্তিত্ব
শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদিনের একটি উক্তি নিয়ে সমকালের পরিপ্রেক্ষিতে ব্যাখ্যা করার ফলে পক্ষে যাঁরা বলেছেন, তাঁরা বিচার-বিশ্লেষণ করে দেখেছেন বিপক্ষের প্রায় সবাই প্রাসঙ্গিকতা ত্যাগ করে ব্যক্তিগত আক্রমণের পথে এগিয়ে গেছেন। সেই ব্যক্তিগত আক্রমণের সঙ্গে আমার বক্তব্যের কোনো ধরনের সম্পর্ক নেই।
অধিকাংশই ভিত্তিহীন এবং প্রমাণের অপেক্ষা রাখে না। দুটি দৈনিক পত্রিকায় উপসম্পাদকীয়তে বিষয়টি নিয়ে গভীরভাবে বিশিষ্ট ব্যক্তিরা বিস্তারিতভাবে লিখেছেন। তাঁদের লেখা ও সমর্থনে অনেকেই নতুন নতুন বিষয় যোগ করেছেন। এর মধ্যে একদল সমর্থক বলতে শুরু করেছেন, বিষয়টিকে এড়িয়ে গেলেই ভালো হতো। কারণ হিসেবে তাঁরা বলছেন, সস্তা বিনোদন এখন সময়ের দাবি। শিল্প-সাহিত্য পড়ে বা কোনো বিষয়ের গভীরে গিয়ে বিনোদন পাওয়া মানুষ দারুণভাবে কম। চিন্তাহীন একেবারে স্থূল বিনোদনে ব্যাপকসংখ্যক দর্শক বিশ্বাস করে। যে কারণে দেখা যায় মননসমৃদ্ধ কাব্য, সাহিত্য, চিত্রকলা, চলচ্চিত্র এসবের আবেদনও কমে যাচ্ছে। আর যাঁরা স্থূল বিনোদন সৃষ্টি করেন, তাঁদের উদ্দেশ্য ভিউ, লাইক, কমেন্টস ইত্যাদি। কাজেই ওই নামগুলো উচ্চারিত হলে তাঁদের ভিউ বেড়ে যাবে এবং টাকা আসতে থাকবে। তাই এসব ব্যাপার বা ব্যক্তিকে এড়িয়ে যাওয়াই বুদ্ধিমানের কাজ।
এই পথ অনুসরণ করে অনেক বুদ্ধিজীবী এবং সুরুচিবান মানুষ মুখ খোলেননি এবং এটিকে তাঁরা কোনো আলোচনার বিষয় বলেও মনে করেন না। বিপরীত দিকে যাঁরা সোচ্চার হয়েছেন, তাঁরা বিষয়টির সত্যতা বিবেচনা করেই যৌক্তিক আলোচনার পথ ত্যাগ করে ব্যক্তিগত আক্রমণের পথ বেছে নিয়েছেন। ফেসবুক এ ধরনের আক্রমণের জন্য অত্যন্ত চমৎকার ব্যবস্থা। যখন খুশি যাকে-তাকে নিয়ে ইচ্ছেমতো মিথ্যাচার করা যায়। তাঁদের মধ্যে অনেক তথাকথিত শিক্ষিত লোকও আছেন। এমনকি বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপকও আছেন। আর আছেন নিরাপদে বসবাসকারী কিছু প্রবাসী। নিজেদের সম্পর্কে অনেক মিথ্যা পরিচয় দিয়ে যাঁরা অ্যাসাইলাম পেয়েছেন। তাঁদের কোনো লোকলজ্জার ভয়ও নেই। একটা মন্তব্য ছুড়ে দেওয়ার পর যখন চারদিক থেকে প্রতিবাদ আসে, তখন তাঁরা নিজেদের ফেসবুক আইডি, পেজ বন্ধ করে দিয়ে চুপচাপ থাকেন। আবার সুযোগ বুঝে দুটো কথা বলে ছিনতাইকারীর মতো পালিয়ে যান।
প্রশ্ন উঠেছে—জনপরিচিতি আর জনপ্রিয়তা কি এক? চুরি করে, ডাকাতি করে বা একটা ঘৃণ্য কাজ করে কেউ কেউ পরিচিতি লাভ করতে পারে। সেই পরিচিতি দেশব্যাপী ছড়িয়ে পড়ে। কিন্তু ভালো কাজ করে জনপ্রিয় হওয়া কঠিন। কারণ, তার সঙ্গে থাকে জনগণের গ্রহণযোগ্যতা, শিল্পের উৎকর্ষ এবং থাকে ঈর্ষা। আমার এক বন্ধু একটি ফারসি বয়েতের কথা প্রায়ই বলে থাকেন—যখন ভালো কাজের জন্য সুখ্যাতি আসে, তখন বন্ধুরা শীতের পাতার মতো ঝরে যায় আর শত্রুরা বসন্তের পাতার মতো গজাতে থাকে।
এ ক্ষেত্রে বিষয়টি ভিন্ন। যাঁরা এই সব কর্মের সমঝদার, তাঁরা নিজেরা এসব দেখেন না, নিজের ছেলেমেয়ে, আত্মীয়স্বজন, বন্ধুবান্ধবকে কখনো দেখার জন্য পাঠানও না। কিন্তু ওই দুষ্কর্মের পক্ষে সাফাই গেয়ে নিজেকে জাহির করতে চান।
আরেক ধরনের মানুষ আছেন—ব্যর্থ বাম। তাঁদের একাংশ কোনো বাম কর্মকাণ্ডে এখন আর নেই। কোনো একটি ক্ষমতাসীন দলে লেজুড় হয়ে বর্তমানে জীবনযাপন করেন। তাঁদের মাথার এক কোণে হয়তো বসবাস করে নিম্নবর্গ-উচ্চবর্গ এই সব। কারণ শ্রেণিসংগ্রাম থেকে তাঁরা বহু আগেই অবসর নিয়েছেন। তাঁরা জানেন না শিল্প-সাহিত্য নিম্নবর্গের মানুষেরই সৃষ্টি। নগরজীবন শুরু হওয়ার আগে থেকেই এই নিম্নবর্গের মানুষেরাই শিল্প সৃষ্টি করত, তাদের শিল্প কালজয়ী হয়ে থাকত। আমাদের দেশের প্রায় কালজয়ী শিল্পই নিরক্ষর শিল্পীদের মুখে মুখে তৈরি। এই শিল্প যুগ যুগ ধরে মানুষকে বিনোদন দিয়েছে, উজ্জীবিত করেছে। এ ক্ষেত্রে আজকের তথাকথিত শিক্ষিত কিছু কিছু ইউটিউবার কতটা সৃষ্টিশীল হতে পেরেছেন? এ বিষয়গুলো উপেক্ষা করে কেউ তর্কের খাতিরে তর্ক এবং ব্যক্তিগত কোনো কারণ ছাড়াই আক্রমণে তাঁরা দিনরাত অস্ত্র শাণ দিয়ে চলেছেন।
অবশ্য সোশ্যাল মিডিয়ার বেশ কিছু মাধ্যম মানুষের কাজেও লাগে। আমাদের সমাজে দুর্বৃত্তায়ন খুবই লক্ষণীয় বিষয়। সেটা রাজনীতিতে হোক, শিক্ষায় হোক, শিল্পে হোক, ব্যবসায় হোক—সর্বত্র এটিকে যদি আমরা স্বচ্ছভাবে না দেখতে পাই তাহলে এক ভয়াবহ পরিণতি আমাদের জন্য অপেক্ষা করবে। খুব সহজে সস্তা বিনোদন পেয়ে মানুষের বিবেক-বুদ্ধি ক্রমেই লোপ পাচ্ছে। তাদের সামনে নদী লুট হয়ে যাচ্ছে, শিক্ষা ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে। এসব দেখার শক্তি ক্রমেই তারা হারিয়ে ফেলছে। স্কুলের শিক্ষক ক্লাসে না পড়িয়ে মাসের পর মাস বেতন নিয়ে যাচ্ছেন, কিন্তু অভিভাবকেরা সংগঠিত হয়ে এর প্রতিবাদ করছেন না। ক্লাসে না পড়িয়ে কিছু শিক্ষক বিকেলবেলা কোচিংয়ে একই বিষয় পড়াচ্ছেন অর্থের বিনিময়ে। সেই শিক্ষক সরকার থেকে এবং ছাত্রদের কাছ থেকেও বেতন পেয়ে যাচ্ছেন।
আমাদের প্রাকৃতিক নদীর বালু উত্তোলন করে নানা উপায়ে কিছু লোক অর্থের পাহাড় গড়ে তুলেছে। একেবারে পরিকল্পনাহীন এই বালু উত্তোলন নদীর গতিপথকে ধ্বংস করে দিচ্ছে। এটিকে রোধ করা কি ইউটিউবারদের বক্তব্য? না, তাঁদের কর্তব্য না; বরং তাঁরা একে আড়াল করেছেন আর সুস্থ সংস্কৃতিমান ব্যক্তি এটার প্রতিবাদ করছেন। পঞ্চাশ, ষাট, সত্তরের দশকে, এমনকি আশির দশকেও মানুষকে শোষণ-নির্যাতন বোঝানো যেত, এখন মানুষের কাছে মিডিয়ার কল্যাণে প্রচুর তথ্য আছে। কিন্তু এর প্রতিরোধ করার নৈতিক শক্তি কি আছে? এই নৈতিক শক্তিটা কোথা থেকে আসে? যথার্থ শিক্ষা ও সংস্কৃতি থেকে আসে।
যখনই কোনো দেশে বিপ্লব হয়েছে, সেখানে বিপ্লবীরা প্রথমেই অনুধাবন করেছেন, মানুষের শিক্ষার পাশাপাশি শিল্প-সাহিত্য প্রয়োজন। তাই তাঁরা প্রচুর বই প্রকাশ করেছেন, চলচ্চিত্র নির্মাণ করেছেন, উচ্চাঙ্গসংগীত পরিবেশনের ব্যবস্থা করেছেন, ভাস্কর্য ও শিল্পকলার জন্য প্রচুর আগ্রহ দেখিয়েছেন। ফ্রান্স, রাশিয়া, চীন, বর্তমানে কিউবা, লাতিন আমেরিকার দেশগুলো এসব আয়োজন করেছে সব সময়। কিন্তু যখনই এসবের ঘাটতি দেখা যায়, ডুবে যায় সস্তা বিনোদনের সামগ্রীতে, তখনই সে দেশের মানুষের মধ্যে বিকৃতি আসে। সুস্থ সংস্কৃতির বদলে উপজীব্য হয়ে উঠতে দেখা যায় বিকৃতি ও অস্থিরতা। বর্তমানে আমাদের দেশকেও তা স্পর্শ করেছে। সর্বত্র টাকা, টাকা এবং টাকা। টাকা এবং অসুস্থ অর্থ, অসুস্থ ভোগেরও জন্ম দিচ্ছে। আমাদের বিজ্ঞজনেরা বলছেন, জ্ঞানের বাজার কমে গেছে। এটা সত্যি কিন্তু কোন বাজারটা বাড়ছে? ভোগের বাজারটা বাড়ছে। সেই ভোগ আসে অসুস্থ বিনোদনের মাধ্যমে।
আজকের দিনে বিনোদনের সবচেয়ে বড় মাধ্যম মিডিয়া। এই মুক্ত মিডিয়ায় যে কেউ একটি বিনোদনের লাড্ডু ফেলে দিতে পারে, সেখানে খাওয়ার লোকের অভাব হচ্ছে না। এই বাস্তবতার বিরুদ্ধেই কিছু কথা চারদিক থেকে হচ্ছে। কিন্তু এত সুবিধাবাদী মহল তৈরি হয়েছে যে তাদের লোভ-লালসার কাছে সত্যকে ধরে রাখা কঠিন হয়ে পড়ছে। যদিও এ কথা অমোঘ সত্য যে পৃথিবীতে খুব অল্পসংখ্যক লোকই সত্যকে ধরে রাখে। ছোট ছোট লোভ তার সঙ্গে খোঁড়া যুক্তিবাদ, ক্ষমতার কাছে যাওয়ার প্রতিযোগিতা—সবটা মিলে একটা জগৎ তৈরি হয়েছে; যা শুধুই রুচির দুর্ভিক্ষ ঘটিয়ে দেয়। রুচির দুর্ভিক্ষের সঙ্গে চিন্তার দুর্ভিক্ষ, শিল্পের দুর্ভিক্ষ দিন দিন বাড়ছেই। এই দুর্ভিক্ষ রোধে দেশের সচেতন মানুষকে রুখে দাঁড়াতে হবে।
কয়েক দিন আগে দেখা গেল বিশ্ববিদ্যালয়ের একদল ছাত্র ক্লাস বর্জন করেছে শিক্ষক পড়াতে পারেন না বলে। ঘটনাটি যদি সত্যি হয়ে থাকে, তবে এটি একটি উজ্জ্বল উদাহরণ হয়ে থাকবে। প্রাথমিক স্কুল থেকে বিশ্ববিদ্যালয় পর্যন্ত শিক্ষাক্ষেত্রে যে নৈরাজ্য চলছে—তার ভূরি ভূরি প্রমাণ আমাদের সামনে আছে। ষষ্ঠ ও সপ্তম শ্রেণির পাঠ্যবইকে বাতিল করা হয়েছে এবং অন্যান্য বিষয়েও শিক্ষকদের ত্রুটি সংশোধন করে পড়ানোর নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। এ ব্যবস্থাও যে কতটা কার্যকর হবে, তা বলা মুশকিল। যাঁরা পাঠ্যপুস্তক রচনা করেন, তাঁরা যথার্থই দায়িত্বহীনতার পরিচয় দিয়েছেন। মানুষ প্রতি মুহূর্তে সমাজের নানাবিধ লোকের কাছে সুবিচার কামনা করে। সেই সুবিচার না পেয়ে তারাও নৈরাজ্যবাদী হয়ে পড়ে। তাই এই নৈরাজ্যেরকালে সাদাকে সাদা বলা এবং কালোকে কালো বলা এক কঠিন সংকটে পরিণত হয়েছে।
এর মধ্য দিয়েই নানান কৌশলে মানুষকে শুধু শোষণ নয়, তার চিন্তার যে মেরুদণ্ড, তাকেও ভেঙে চুরমার করে দিচ্ছে। সংস্কৃতির এই সংকটে এবং রুচির দুর্ভিক্ষে আমরা কি কোনো ভূমিকা পালন করতে পারব?
মামুনুর রশীদ, নাট্যব্যক্তিত্ব
ঝড়-জলোচ্ছ্বাস থেকে রক্ষায় সন্দ্বীপের ব্লক বেড়িবাঁধসহ একাধিক প্রকল্প হাতে নিয়েছে সরকার। এ লক্ষ্যে বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে ৫৬২ কোটি টাকা। এ জন্য টেন্ডারও হয়েছে। প্রায় এক বছর পেরিয়ে গেলেও ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানগুলো কাজ শুরু করছে না। পানি উন্নয়ন বোর্ডের (পাউবো) তাগাদায়ও কোনো কাজ হচ্ছে না বলে জানিয়েছেন...
৩ দিন আগেদেশের পরিবহন খাতের অন্যতম নিয়ন্ত্রণকারী ঢাকা সড়ক পরিবহন মালিক সমিতির কমিটির বৈধতা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। সাইফুল আলমের নেতৃত্বাধীন এ কমিটিকে নিবন্ধন দেয়নি শ্রম অধিদপ্তর। তবে এটি কার্যক্রম চালাচ্ছে। কমিটির নেতারা অংশ নিচ্ছেন ঢাকা পরিবহন সমন্বয় কর্তৃপক্ষ (ডিটিসিএ) ও বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষের...
৩ দিন আগেআলুর দাম নিয়ন্ত্রণে ব্যর্থ হয়ে এবার নিজেই বিক্রির উদ্যোগ নিয়েছে সরকার। বাজার স্থিতিশীল রাখতে ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশের (টিসিবি) মাধ্যমে রাজধানীতে ভ্রাম্যমাণ ট্রাকের মাধ্যমে ভর্তুকি মূল্যে আলু বিক্রি করা হবে। একজন গ্রাহক ৪০ টাকা দরে সর্বোচ্চ তিন কেজি আলু কিনতে পারবেন...
৩ দিন আগেসপ্তাহখানেক আগে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকে অনেকের ওয়াল বিষাদময় হয়ে উঠেছিল ফুলের মতো ছোট্ট শিশু মুনতাহাকে হত্যার ঘটনায়। ৫ বছর বয়সী সিলেটের এই শিশুকে অপহরণের পর হত্যা করে লাশ গুম করতে ডোবায় ফেলে রাখা হয়েছিল। প্রতিবেশী গৃহশিক্ষকের পরিকল্পনায় অপহরণের পর তাকে নির্মমভাবে হত্যা করা হয়...
৩ দিন আগে