সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী
মানুষের পরাধীনতার কুফল কেবল অর্থনৈতিক তা নয়, মনস্তাত্ত্বিকও। পরাধীন থাকতে থাকতে বাঙালি নিজেকে খুবই ছোট ভেবেছে; তাদের মধ্যে যারা উচ্চমনে ছিল, অর্থাৎ কিনা কাছে ছিল শাসকদের, তারাও হীনম্মন্যতায় ভুগেছে। হীনতার বোধটা মস্তিষ্কে চলে গেছে এবং সেখানে আটকা থাকেনি, থাকার কথাও নয়; পৌঁছে গেছে মেরুদণ্ডেও। এটা যে কেবল বাংলাদেশের ব্যাপারে সত্য, তা নয়। একই ঘটনা উপনিবেশ-শাসিত অন্যান্য দেশেও ঘটেছে।
ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনে একদিন বাংলাই ছিল সামনে। ১৯০৫ সালের বঙ্গভঙ্গবিরোধী আন্দোলন কেবল বাংলায় সীমাবদ্ধ থাকেনি, ভারতজুড়ে ব্রিটিশের বিরুদ্ধে বিক্ষোভের প্রকাশমুখ হয়ে দাঁড়িয়েছিল। কিন্তু এই আন্দোলনের অর্জনের মধ্যে বাংলার দিক থেকে প্রান্তের দিকে পেছানোর ঘটনাও জড়িত হয়ে গেল। চতুর ইংরেজ বঙ্গভঙ্গ রোধে বাধ্য হলো ঠিকই, কিন্তু ব্রিটিশ ভারতের রাজধানী আর কলকাতায় রাখল না, সরিয়ে নিয়ে গেল দিল্লিতে। তাদের দিক থেকে কৌশলটা ছিল কলকাতা তথা বাংলার গুরুত্ব কমানোর। কলকাতা থেকে রাজধানী দিল্লিতে চলে যাওয়ায় বাংলার রাজনৈতিক, প্রশাসনিক ও অর্থনৈতিক গুরুত্ব কিছু কমল বৈকি। সে আর ভারতে ব্রিটিশ শাসনের কেন্দ্রে রইল না।
এরপর ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনের নেতৃত্বও চলে গেল অবাঙালিদের হাতে। সর্বভারতীয় রাজনীতির নেতা হিসেবে একদিকে গান্ধী, অপর দিকে জিন্নাহ প্রধান হয়ে দাঁড়ালেন। সাতচল্লিশে যখন দেশভাগ হয়, তখন বাংলার ভাগ্য নির্ধারণের ক্ষমতা বাঙালির হাতে ছিল না, চলে গিয়েছিল সর্বভারতীয় নেতাদের হাতে। দেশভাগের ফলে এক বাংলা দুই বাংলায় পরিণত হয়ে উভয়েই প্রান্তবর্তী হয়ে গেল। পশ্চিমবঙ্গ হারিয়ে গেল ভারতীয় ইউনিয়নে; পূর্ববঙ্গ পূর্ব পাকিস্তানে পরিণত হয়ে পাকিস্তানিদের স্বৈরাচারের অধীনে চলে যেতে বাধ্য হলো।
বাইরের শক্তিগুলো সঙ্গে করে নিজ নিজ ধর্মকেও নিয়ে এসেছিল। এভাবে বাংলায় বৈদিক ধর্ম, বৌদ্ধ ধর্ম ও ইসলাম ধর্ম এসেছে; ইংরেজরাও তাদের খ্রিষ্টধর্ম নিয়ে এসেছে, কিন্তু তা গ্রহণযোগ্যতা পায়নি। তবে ইংরেজ তার শাসনের সুবিধার জন্য ধর্মভিত্তিক সাম্প্রদায়িকতাকে উসকানি দিয়েছে। ইংরেজ আসার আগে বাংলায় বিভিন্ন ধর্মের মানুষ পারস্পরিক সম্প্রীতির ভেতর বসবাস করেছে; তাদের ধর্ম আলাদা ছিল, কিন্তু তাদের মধ্যে সাম্প্রদায়িক বিরোধ ছিল না। সাম্প্রদায়িকতা সাম্রাজ্যবাদবিরোধী ঐক্যকে ভেঙে দিয়েছে এবং স্বাধীনতার জন্য সংগ্রাম শেষ পর্যন্ত পরিণত হয়েছে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গায়। এগোতে গিয়ে আমরা পিছিয়ে গেছি।
শাসকেরা তাদের ভাষাও নিয়ে এসেছে এবং সেটা চাপিয়ে দিতে চেষ্টা করেছে জনগণের ওপর। এভাবে সংস্কৃত, ফারসি, ইংরেজি রাজদরবারের ভাষা হয়েছে; জনগণের ভাষা বাংলাকে উপেক্ষাই সহ্য করতে হয়েছে। ইংরেজ চলে গেছে, পাকিস্তানিদেরও বিদায় করে দেওয়া গেছে।
কিন্তু তারপরও তো বাংলা ভাষা এখনো প্রান্তেই রয়ে গেছে, কেন্দ্রে উঠে আসতে পারেনি। আদালত, শিক্ষা ও প্রশাসনের উচ্চস্তরে বাংলা চলে না; সমাজের উঁচু উঁচু জায়গায় সে স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করে না; তাকে জায়গা ছেড়ে দিতে হয় ইংরেজি শব্দ, বাক্যাংশ, এমনকি অস্তি আস্ত বাক্যের অশ্লীল অনুপ্রবেশের জন্য।
ওদিকে আবার উৎপাত আছে আকাশ সংস্কৃতির। টেলিভিশনে আমাদের বিনোদনমূলক অনুষ্ঠানগুলো যে নিম্নমানের তা মোটেই নয়; কিন্তু এসব অনুষ্ঠান অন্য দেশের মানুষ দেখে না, আমরা অন্য দেশের অনুষ্ঠানের জন্য দরজা-জানালা একেবারে উন্মুক্ত করে দিয়েছি। ইংরেজি ও হিন্দি এসে দাপট দেখাচ্ছে। নিজের ঘরে বসেই লোকে পরিণত হচ্ছে পরদেশিতে।
এই যে প্রান্তিকীকরণ, এটা শুধু জাতির ব্যাপার নয়, জাতির ভেতরে যে শ্রেণি রয়েছে, সে ক্ষেত্রেও এটা বিলক্ষণ ঘটেছে। প্রান্তে নয়, আমেরিকা তো কেন্দ্রেরও কেন্দ্রে স্থাপিত। মূলধারা তারাই। কিন্তু সেখানেও দরিদ্র মানুষেরা প্রান্তেই থাকে, তা তারা যতই ভোটাভুটিতে অংশ নেওয়ার সুযোগ পাক না কেন। বর্ণবাদও আছে, কৃষ্ণবর্ণের মানুষেরা এখনো মূলধারায় নিজেদের স্থাপন করতে পারেনি, তাদের মধ্য থেকে দু-একজনকে ধরে এনে উচ্চপদে বসিয়ে বর্ণবাদের সত্যকে অস্পষ্ট করার যে চেষ্টা করা হয় তাতেই বরং ধরা পড়ে যায় বাদবাকিরা কতটা নিচুতে রয়েছে।
আমাদের দেশ দরিদ্র, কিন্তু এ দেশও পুঁজিবাদী। এখানেও বৈষম্য হচ্ছে সবচেয়ে বড় সত্য। বিশ্বমানে আমরা সবাই প্রান্তবর্তী, কিন্তু আমাদের মধ্যেও গরিব মানুষ দ্বিতীয় মাত্রায় প্রান্তে থাকে। ধর্মীয় সংখ্যালঘুরাও দ্বিতীয় মাত্রার প্রান্তিকতার শিকার। আর ক্ষুদ্র জাতিসত্তা? তাদের তো আমরা সাংবিধানিকভাবে স্বীকৃতিই দিইনি; দেশের মূল প্রবাহের বাইরে রাখতে চাইছি। ওদিকে কৃষকের দেশপ্রেমের যতই আমরা প্রশংসা করি, কৃষক যাতে প্রান্তেই থাকেন তার ব্যবস্থা বেশ পাকাপোক্তভাবেই করে রাখা হয়েছে।
২. কিন্তু কীভাবে ঘোচাব আমাদের প্রান্তিকতা, কী করে আধুনিক হব, চলে আসব আন্তর্জাতিক বিশ্বে? পথনির্দেশটা প্রান্তিকতার কারণে ভেতরেই রয়ে গেছে। প্রান্তিকতার কারণ হলো অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক। এদের বিন্যাসের দরুনই আমরা প্রান্তবর্তী। আর ওই বিন্যাসটি হলো পুঁজিবাদী ও সাম্রাজ্যবাদী। মূল ঘটনাটি হচ্ছে পুঁজিবাদ। যাকে সাম্রাজ্যবাদ বলি, সেটা পুঁজিবাদেরই রাজনৈতিক রূপ। পুঁজিবাদ থেকে সে বের হয়ে এসেছে, রূপ নিয়েছে রাষ্ট্রের ওপরে কর্তৃত্বের এবং দায়িত্ব পেয়েছে পুঁজিবাদকে রক্ষা করার।
রাজনীতি থাকে অর্থনীতির শাসনে; যেমনটা অত্যন্ত পরিষ্কারভাবে ঘটছে এখন বাংলাদেশে, দেখা যাচ্ছে শিক্ষা ও চিকিৎসা তো বটেই, রাজনীতি নিজেই কেনাবেচার পণ্যে পরিণত হয়ে গেছে। প্রতিকারের অন্য কোনো পথ নেই, রাষ্ট্র ও সমাজকে পুঁজিবাদের কবল থেকে মুক্ত করা ভিন্ন। উন্নতি ঘটছে রূপকথার মতো, কিন্তু রূপকথায় যেমন দৈত্য থাকে, এখানেও সে আছে। ওই দৈত্যটা হচ্ছে বৈষম্য। যত উন্নতি ঘটছে, ততই বাড়ছে বৈষম্য। একই মাত্রায়। বৈষম্যের এই দৈত্যটাকে পরাভূত করা চাই।
পুঁজিবাদ বিকাশ যে অন্যায়টা বিশেষভাবে করছে সেটা হলো, সমাজের সৃষ্টিশীলতাকে আটকে ফেলা। বিপুলসংখ্যক মানুষ তাদের উৎপাদন ক্ষমতাকে যথোপযুক্ত রূপে ব্যবহার করতে পারছে না; তাদের বেকার, অর্ধবেকার এবং সর্বোপরি যান্ত্রিকভাবে ব্যবহার করা হচ্ছে। পুঁজিবাদী ব্যক্তিমালিকানার শৃঙ্খল থেকে মুক্ত হয়ে এরা যদি তাদের কর্মশক্তিকে সৃজনশীল উপায়ে প্রয়োগ করতে পারত তাহলে মানুষের জীবনে যে সুখ ও আনন্দ আসত, তা অকল্পনীয়। উৎপাদিত পণ্যে মালিকানাটা ব্যক্তিগত থাকত না, হতো সামাজিক। ফলে সমাজের অধিকার ও সুযোগ সৃষ্টি হতো। কেবল অধিকার নয়, সুযোগও। দুটোই দরকার এবং দুটোই পাওয়া যাবে। মানুষের ওই সৃজনশীলতা হাঁসফাঁস করছে, মুক্তির জন্য। পুঁজিবাদ তাকে আটক করে রেখেছে মুনাফার স্বার্থে।
ব্যক্তিমালিকনার পৃথিবীটাকে বদলে ফেলে সামাজিক মালিকানার বিশ্ব গড়ে তোলার জন্য খুব বেশি করে দরকার জ্ঞানচর্চার। জ্ঞানের জন্য জ্ঞান নয়, পৃথিবীকে বদলানোর জন্য জ্ঞান। প্রকৃত জ্ঞানের চর্চাকে পুঁজিবাদী বিশ্ব ভীষণভাবে ভয় করে। অত ভয় আসলে সে কোনো কিছুকেই করে না। যে জ্ঞান ভালো-মন্দ শেখায় এবং যে জ্ঞান প্রায়োগিক পৃথিবীকে বদলানোর, সেটাই হচ্ছে সবচেয়ে শক্তিশালী হাতিয়ার। বিশ্বে এখন তথ্যের প্রবাহ চলছে; ওই প্রবাহ কিন্তু জ্ঞানকে উৎসাহিত করছে না; বরং অভিভূতকরণের মধ্য দিয়ে জ্ঞানকে সংকুচিত করে ফেলছে। গাছে ও অগাছায় আচ্ছাদিত হয়ে যাচ্ছে ভূমি।
জ্ঞানের চর্চা বাংলাদেশে আগেও যে উচ্চমানের ছিল তা মোটেই নয়, এখন তা আরও নিচে নেমে গেছে। বলাই বাহুল্য যে এই জ্ঞানের চর্চা হওয়ার কথা মাতৃভাষার মাধ্যমেই। মাতৃভাষার জ্ঞানের চর্চা আমাদের সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে দাঁড়াতে এবং পুঁজিবাদের দানবিক শাসন থেকে মুক্ত হতে শেখাবে। জ্ঞান দেবে ক্ষমতা, দেবে সচেতনতা। ছোট্ট করে বলি দেশের শাসকশ্রেণি জ্ঞানের অনুশীলনকে কত যে ভয় পায় তার চমৎকার প্রমাণ আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে ছাত্র সংসদ কার্যক্রমের নিষিদ্ধকরণ।
মানুষের পরাধীনতার কুফল কেবল অর্থনৈতিক তা নয়, মনস্তাত্ত্বিকও। পরাধীন থাকতে থাকতে বাঙালি নিজেকে খুবই ছোট ভেবেছে; তাদের মধ্যে যারা উচ্চমনে ছিল, অর্থাৎ কিনা কাছে ছিল শাসকদের, তারাও হীনম্মন্যতায় ভুগেছে। হীনতার বোধটা মস্তিষ্কে চলে গেছে এবং সেখানে আটকা থাকেনি, থাকার কথাও নয়; পৌঁছে গেছে মেরুদণ্ডেও। এটা যে কেবল বাংলাদেশের ব্যাপারে সত্য, তা নয়। একই ঘটনা উপনিবেশ-শাসিত অন্যান্য দেশেও ঘটেছে।
ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনে একদিন বাংলাই ছিল সামনে। ১৯০৫ সালের বঙ্গভঙ্গবিরোধী আন্দোলন কেবল বাংলায় সীমাবদ্ধ থাকেনি, ভারতজুড়ে ব্রিটিশের বিরুদ্ধে বিক্ষোভের প্রকাশমুখ হয়ে দাঁড়িয়েছিল। কিন্তু এই আন্দোলনের অর্জনের মধ্যে বাংলার দিক থেকে প্রান্তের দিকে পেছানোর ঘটনাও জড়িত হয়ে গেল। চতুর ইংরেজ বঙ্গভঙ্গ রোধে বাধ্য হলো ঠিকই, কিন্তু ব্রিটিশ ভারতের রাজধানী আর কলকাতায় রাখল না, সরিয়ে নিয়ে গেল দিল্লিতে। তাদের দিক থেকে কৌশলটা ছিল কলকাতা তথা বাংলার গুরুত্ব কমানোর। কলকাতা থেকে রাজধানী দিল্লিতে চলে যাওয়ায় বাংলার রাজনৈতিক, প্রশাসনিক ও অর্থনৈতিক গুরুত্ব কিছু কমল বৈকি। সে আর ভারতে ব্রিটিশ শাসনের কেন্দ্রে রইল না।
এরপর ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনের নেতৃত্বও চলে গেল অবাঙালিদের হাতে। সর্বভারতীয় রাজনীতির নেতা হিসেবে একদিকে গান্ধী, অপর দিকে জিন্নাহ প্রধান হয়ে দাঁড়ালেন। সাতচল্লিশে যখন দেশভাগ হয়, তখন বাংলার ভাগ্য নির্ধারণের ক্ষমতা বাঙালির হাতে ছিল না, চলে গিয়েছিল সর্বভারতীয় নেতাদের হাতে। দেশভাগের ফলে এক বাংলা দুই বাংলায় পরিণত হয়ে উভয়েই প্রান্তবর্তী হয়ে গেল। পশ্চিমবঙ্গ হারিয়ে গেল ভারতীয় ইউনিয়নে; পূর্ববঙ্গ পূর্ব পাকিস্তানে পরিণত হয়ে পাকিস্তানিদের স্বৈরাচারের অধীনে চলে যেতে বাধ্য হলো।
বাইরের শক্তিগুলো সঙ্গে করে নিজ নিজ ধর্মকেও নিয়ে এসেছিল। এভাবে বাংলায় বৈদিক ধর্ম, বৌদ্ধ ধর্ম ও ইসলাম ধর্ম এসেছে; ইংরেজরাও তাদের খ্রিষ্টধর্ম নিয়ে এসেছে, কিন্তু তা গ্রহণযোগ্যতা পায়নি। তবে ইংরেজ তার শাসনের সুবিধার জন্য ধর্মভিত্তিক সাম্প্রদায়িকতাকে উসকানি দিয়েছে। ইংরেজ আসার আগে বাংলায় বিভিন্ন ধর্মের মানুষ পারস্পরিক সম্প্রীতির ভেতর বসবাস করেছে; তাদের ধর্ম আলাদা ছিল, কিন্তু তাদের মধ্যে সাম্প্রদায়িক বিরোধ ছিল না। সাম্প্রদায়িকতা সাম্রাজ্যবাদবিরোধী ঐক্যকে ভেঙে দিয়েছে এবং স্বাধীনতার জন্য সংগ্রাম শেষ পর্যন্ত পরিণত হয়েছে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গায়। এগোতে গিয়ে আমরা পিছিয়ে গেছি।
শাসকেরা তাদের ভাষাও নিয়ে এসেছে এবং সেটা চাপিয়ে দিতে চেষ্টা করেছে জনগণের ওপর। এভাবে সংস্কৃত, ফারসি, ইংরেজি রাজদরবারের ভাষা হয়েছে; জনগণের ভাষা বাংলাকে উপেক্ষাই সহ্য করতে হয়েছে। ইংরেজ চলে গেছে, পাকিস্তানিদেরও বিদায় করে দেওয়া গেছে।
কিন্তু তারপরও তো বাংলা ভাষা এখনো প্রান্তেই রয়ে গেছে, কেন্দ্রে উঠে আসতে পারেনি। আদালত, শিক্ষা ও প্রশাসনের উচ্চস্তরে বাংলা চলে না; সমাজের উঁচু উঁচু জায়গায় সে স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করে না; তাকে জায়গা ছেড়ে দিতে হয় ইংরেজি শব্দ, বাক্যাংশ, এমনকি অস্তি আস্ত বাক্যের অশ্লীল অনুপ্রবেশের জন্য।
ওদিকে আবার উৎপাত আছে আকাশ সংস্কৃতির। টেলিভিশনে আমাদের বিনোদনমূলক অনুষ্ঠানগুলো যে নিম্নমানের তা মোটেই নয়; কিন্তু এসব অনুষ্ঠান অন্য দেশের মানুষ দেখে না, আমরা অন্য দেশের অনুষ্ঠানের জন্য দরজা-জানালা একেবারে উন্মুক্ত করে দিয়েছি। ইংরেজি ও হিন্দি এসে দাপট দেখাচ্ছে। নিজের ঘরে বসেই লোকে পরিণত হচ্ছে পরদেশিতে।
এই যে প্রান্তিকীকরণ, এটা শুধু জাতির ব্যাপার নয়, জাতির ভেতরে যে শ্রেণি রয়েছে, সে ক্ষেত্রেও এটা বিলক্ষণ ঘটেছে। প্রান্তে নয়, আমেরিকা তো কেন্দ্রেরও কেন্দ্রে স্থাপিত। মূলধারা তারাই। কিন্তু সেখানেও দরিদ্র মানুষেরা প্রান্তেই থাকে, তা তারা যতই ভোটাভুটিতে অংশ নেওয়ার সুযোগ পাক না কেন। বর্ণবাদও আছে, কৃষ্ণবর্ণের মানুষেরা এখনো মূলধারায় নিজেদের স্থাপন করতে পারেনি, তাদের মধ্য থেকে দু-একজনকে ধরে এনে উচ্চপদে বসিয়ে বর্ণবাদের সত্যকে অস্পষ্ট করার যে চেষ্টা করা হয় তাতেই বরং ধরা পড়ে যায় বাদবাকিরা কতটা নিচুতে রয়েছে।
আমাদের দেশ দরিদ্র, কিন্তু এ দেশও পুঁজিবাদী। এখানেও বৈষম্য হচ্ছে সবচেয়ে বড় সত্য। বিশ্বমানে আমরা সবাই প্রান্তবর্তী, কিন্তু আমাদের মধ্যেও গরিব মানুষ দ্বিতীয় মাত্রায় প্রান্তে থাকে। ধর্মীয় সংখ্যালঘুরাও দ্বিতীয় মাত্রার প্রান্তিকতার শিকার। আর ক্ষুদ্র জাতিসত্তা? তাদের তো আমরা সাংবিধানিকভাবে স্বীকৃতিই দিইনি; দেশের মূল প্রবাহের বাইরে রাখতে চাইছি। ওদিকে কৃষকের দেশপ্রেমের যতই আমরা প্রশংসা করি, কৃষক যাতে প্রান্তেই থাকেন তার ব্যবস্থা বেশ পাকাপোক্তভাবেই করে রাখা হয়েছে।
২. কিন্তু কীভাবে ঘোচাব আমাদের প্রান্তিকতা, কী করে আধুনিক হব, চলে আসব আন্তর্জাতিক বিশ্বে? পথনির্দেশটা প্রান্তিকতার কারণে ভেতরেই রয়ে গেছে। প্রান্তিকতার কারণ হলো অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক। এদের বিন্যাসের দরুনই আমরা প্রান্তবর্তী। আর ওই বিন্যাসটি হলো পুঁজিবাদী ও সাম্রাজ্যবাদী। মূল ঘটনাটি হচ্ছে পুঁজিবাদ। যাকে সাম্রাজ্যবাদ বলি, সেটা পুঁজিবাদেরই রাজনৈতিক রূপ। পুঁজিবাদ থেকে সে বের হয়ে এসেছে, রূপ নিয়েছে রাষ্ট্রের ওপরে কর্তৃত্বের এবং দায়িত্ব পেয়েছে পুঁজিবাদকে রক্ষা করার।
রাজনীতি থাকে অর্থনীতির শাসনে; যেমনটা অত্যন্ত পরিষ্কারভাবে ঘটছে এখন বাংলাদেশে, দেখা যাচ্ছে শিক্ষা ও চিকিৎসা তো বটেই, রাজনীতি নিজেই কেনাবেচার পণ্যে পরিণত হয়ে গেছে। প্রতিকারের অন্য কোনো পথ নেই, রাষ্ট্র ও সমাজকে পুঁজিবাদের কবল থেকে মুক্ত করা ভিন্ন। উন্নতি ঘটছে রূপকথার মতো, কিন্তু রূপকথায় যেমন দৈত্য থাকে, এখানেও সে আছে। ওই দৈত্যটা হচ্ছে বৈষম্য। যত উন্নতি ঘটছে, ততই বাড়ছে বৈষম্য। একই মাত্রায়। বৈষম্যের এই দৈত্যটাকে পরাভূত করা চাই।
পুঁজিবাদ বিকাশ যে অন্যায়টা বিশেষভাবে করছে সেটা হলো, সমাজের সৃষ্টিশীলতাকে আটকে ফেলা। বিপুলসংখ্যক মানুষ তাদের উৎপাদন ক্ষমতাকে যথোপযুক্ত রূপে ব্যবহার করতে পারছে না; তাদের বেকার, অর্ধবেকার এবং সর্বোপরি যান্ত্রিকভাবে ব্যবহার করা হচ্ছে। পুঁজিবাদী ব্যক্তিমালিকানার শৃঙ্খল থেকে মুক্ত হয়ে এরা যদি তাদের কর্মশক্তিকে সৃজনশীল উপায়ে প্রয়োগ করতে পারত তাহলে মানুষের জীবনে যে সুখ ও আনন্দ আসত, তা অকল্পনীয়। উৎপাদিত পণ্যে মালিকানাটা ব্যক্তিগত থাকত না, হতো সামাজিক। ফলে সমাজের অধিকার ও সুযোগ সৃষ্টি হতো। কেবল অধিকার নয়, সুযোগও। দুটোই দরকার এবং দুটোই পাওয়া যাবে। মানুষের ওই সৃজনশীলতা হাঁসফাঁস করছে, মুক্তির জন্য। পুঁজিবাদ তাকে আটক করে রেখেছে মুনাফার স্বার্থে।
ব্যক্তিমালিকনার পৃথিবীটাকে বদলে ফেলে সামাজিক মালিকানার বিশ্ব গড়ে তোলার জন্য খুব বেশি করে দরকার জ্ঞানচর্চার। জ্ঞানের জন্য জ্ঞান নয়, পৃথিবীকে বদলানোর জন্য জ্ঞান। প্রকৃত জ্ঞানের চর্চাকে পুঁজিবাদী বিশ্ব ভীষণভাবে ভয় করে। অত ভয় আসলে সে কোনো কিছুকেই করে না। যে জ্ঞান ভালো-মন্দ শেখায় এবং যে জ্ঞান প্রায়োগিক পৃথিবীকে বদলানোর, সেটাই হচ্ছে সবচেয়ে শক্তিশালী হাতিয়ার। বিশ্বে এখন তথ্যের প্রবাহ চলছে; ওই প্রবাহ কিন্তু জ্ঞানকে উৎসাহিত করছে না; বরং অভিভূতকরণের মধ্য দিয়ে জ্ঞানকে সংকুচিত করে ফেলছে। গাছে ও অগাছায় আচ্ছাদিত হয়ে যাচ্ছে ভূমি।
জ্ঞানের চর্চা বাংলাদেশে আগেও যে উচ্চমানের ছিল তা মোটেই নয়, এখন তা আরও নিচে নেমে গেছে। বলাই বাহুল্য যে এই জ্ঞানের চর্চা হওয়ার কথা মাতৃভাষার মাধ্যমেই। মাতৃভাষার জ্ঞানের চর্চা আমাদের সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে দাঁড়াতে এবং পুঁজিবাদের দানবিক শাসন থেকে মুক্ত হতে শেখাবে। জ্ঞান দেবে ক্ষমতা, দেবে সচেতনতা। ছোট্ট করে বলি দেশের শাসকশ্রেণি জ্ঞানের অনুশীলনকে কত যে ভয় পায় তার চমৎকার প্রমাণ আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে ছাত্র সংসদ কার্যক্রমের নিষিদ্ধকরণ।
ঝড়-জলোচ্ছ্বাস থেকে রক্ষায় সন্দ্বীপের ব্লক বেড়িবাঁধসহ একাধিক প্রকল্প হাতে নিয়েছে সরকার। এ লক্ষ্যে বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে ৫৬২ কোটি টাকা। এ জন্য টেন্ডারও হয়েছে। প্রায় এক বছর পেরিয়ে গেলেও ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানগুলো কাজ শুরু করছে না। পানি উন্নয়ন বোর্ডের (পাউবো) তাগাদায়ও কোনো কাজ হচ্ছে না বলে জানিয়েছেন...
২ দিন আগেদেশের পরিবহন খাতের অন্যতম নিয়ন্ত্রণকারী ঢাকা সড়ক পরিবহন মালিক সমিতির কমিটির বৈধতা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। সাইফুল আলমের নেতৃত্বাধীন এ কমিটিকে নিবন্ধন দেয়নি শ্রম অধিদপ্তর। তবে এটি কার্যক্রম চালাচ্ছে। কমিটির নেতারা অংশ নিচ্ছেন ঢাকা পরিবহন সমন্বয় কর্তৃপক্ষ (ডিটিসিএ) ও বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষের...
২ দিন আগেআলুর দাম নিয়ন্ত্রণে ব্যর্থ হয়ে এবার নিজেই বিক্রির উদ্যোগ নিয়েছে সরকার। বাজার স্থিতিশীল রাখতে ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশের (টিসিবি) মাধ্যমে রাজধানীতে ভ্রাম্যমাণ ট্রাকের মাধ্যমে ভর্তুকি মূল্যে আলু বিক্রি করা হবে। একজন গ্রাহক ৪০ টাকা দরে সর্বোচ্চ তিন কেজি আলু কিনতে পারবেন...
৩ দিন আগেসপ্তাহখানেক আগে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকে অনেকের ওয়াল বিষাদময় হয়ে উঠেছিল ফুলের মতো ছোট্ট শিশু মুনতাহাকে হত্যার ঘটনায়। ৫ বছর বয়সী সিলেটের এই শিশুকে অপহরণের পর হত্যা করে লাশ গুম করতে ডোবায় ফেলে রাখা হয়েছিল। প্রতিবেশী গৃহশিক্ষকের পরিকল্পনায় অপহরণের পর তাকে নির্মমভাবে হত্যা করা হয়...
৩ দিন আগে