আর কত হেনারা খুন হবে

স্বপ্না রেজা
প্রকাশ : ০১ সেপ্টেম্বর ২০২৩, ০৮: ৫০

এই সমাজে গৃহকর্ত্রী সাথীদের কাছে গৃহকর্মী হেনারা তুচ্ছ হয়ে থাকে। সাথীদের হাতে নির্মমভাবে খুন হয় হেনারা। পাশবিক ঘটনা ঘটায় সাথীরা। নিকৃষ্ট, বিকৃত মানসিকতার মানুষ এই সাথীরা। দুঃখিত, হেনা ও সাথী—এ দুটি নাম লেখায় ব্যবহার করার জন্য। আমি ক্ষমা চেয়ে নিচ্ছি লেখার শুরুতে। কারণ, পৃথিবীতে ভূমিষ্ঠ হওয়া সাথী নামের সব মানুষ যেমন অমানবিক হয় না, নির্মম ও নিষ্ঠুর হয় না, ঠিক তেমনি হেনা নামের সব মানুষ নির্মল, নিষ্পাপ হয় না। তবে হেনা নামের সব শিশুই নির্মল ও নিষ্পাপ হয়ে থাকে।

শিশুমাত্রই নিষ্পাপ। অপরাধ করার বয়স শিশুদের নয়, ওটা বড়দের, মানসিকভাবে বিকারগ্রস্তদের। পথঘাট চিনে বড়রা অপরাধ করে। কোথাও কোথাও শিশুরা অপরাধের সঙ্গে জড়ায় বড়দের স্বার্থে, বুদ্ধিতে। ওটা প্রকৃতপক্ষে বড়দের অপরাধ। বড়রাই শিশুদের অপরাধে সম্পৃক্ত করে। সমাজে কিশোর অপরাধের আবির্ভাব সে কারণে।

যদিও কিশোর অপরাধ সমাজে প্রচলিত একটা অব্যবস্থা, যার পেছনে অনেক অসংগতি, অনিয়ম ও অধিকার বঞ্চনার গল্প থাকে, কারণ থাকে। কোনো শিশু বা কিশোর অপরাধে জড়ালেও অপরাধী হয়ে কেউ ভূমিষ্ঠ হয় না। এককথায়, সমাজে বিদ্যমান বৈষম্য, অধিকার বঞ্চনা, অসংগতি, দারিদ্র্য, অনিয়ম, যথাযথ আইন প্রয়োগে অবহেলা, শিশুদের অরক্ষিত করে রাখে। সমাজের অস্থিতিশীল পরিস্থিতির প্রভাব পড়ে শিশুদের ওপর। একদিকে যেমন শিশুরা না বুঝে অপরাধে জড়ায়, অন্যদিকে আবার প্রকৃত অপরাধীদের হাতে শিশুরা নির্মমভাবে প্রাণ হারায়।

সম্প্রতি রাজধানীর কলাবাগানের সেন্ট্রাল রোডের বাসার ফ্রিজ থেকে আনুমানিক ১০ বছর বয়সী হেনা নামে এক গৃহকর্মীর লাশ উদ্ধার করেছে পুলিশ। এখানে হেনা অপরাধের সঙ্গে সম্পৃক্ত নয়, বরং অপরাধী দ্বারা নির্যাতিত। জানা গেছে, হেনা ময়মনসিংহের মুক্তাগাছা গ্রামের হক মিয়ার মেয়ে। তার বাবা-মা বেঁচে নেই। বলতে দ্বিধা নেই, শিশু গৃহকর্মীদের নির্যাতন, ধর্ষণ যেন একটা সংস্কৃতিতে পরিণত হয়েছে। সেই সংস্কৃতির বলি হেনা ও তার মতো অসংখ্য শিশু।

হেনার শরীরে নতুন ও পুরোনো অনেক আঘাতের চিহ্ন পাওয়া গেছে বলে প্রাথমিক তদন্তে বলা হয়েছে। এমন প্রাথমিক তদন্তও কম নয়। পত্রপত্রিকার পাতায় প্রায় প্রতিদিনের সংবাদ এসব। সাথী ময়মনসিংহ থেকে হেনাকে নিয়ে আসেন তিন বছর আগে। হিসাব করলে দেখা যায়, তখন হেনার বয়স মাত্র ৭ বছর। এই বয়সে শিশুকে শ্রমে নিয়োগ করা একটি অপরাধ—অনেকের মতোই সাথী হয়তো জেনে কিংবা না জেনে হেনাকে কাজে নিয়োগ দিয়েছেন। এমন অসচেতন সাথীর সংখ্যা কিন্তু এই সমাজে কম নয়।

শিশুর অধিকার ও সুরক্ষায় আইন কী, কতটা তা মানবাধিকারকর্মী, আইন প্রণয়নকারী ও প্রয়োগকারীরাই ভালো বলতে পারেন। কিন্তু তারা কি বলতে পারেন, কেন গৃহকর্ত্রীদের সংখ্যা কমে না, বরং বাড়ে? কেনইবা শিশুরা সুরক্ষিত হতে পারছে না? শিশুকে শ্রমে দেওয়া বা নেওয়া যদি আইনত অপরাধ হয়, তাহলে কেন এই অপরাধ নির্মূল করা সম্ভব হচ্ছে না? এমন প্রশ্নের জবাবে কেউ কেউ বলেন, শিশুশ্রম আইনি অপরাধ হলেও এমন অপরাধ নিয়ে তৎপর হওয়ার কোনো যৌক্তিকতা সম্ভবত কোনো সংগঠন, ব্যক্তি, গোষ্ঠী খুঁজে পায়নি। রাষ্ট্রও সোচ্চার নয়। আইন প্রণয়ন করেই খালাস। আর শুধু সভা-সেমিনারে শিশুশ্রমের বিরুদ্ধে আওয়াজ তোলে। এরা নিজেদের প্রচার বাড়ায়। সম্ভবত সে কারণে শিশুশ্রম কমে না, বরং দেশে আর্থসামাজিক অসংগতির সঙ্গে পাল্লা দিয়ে শিশু শ্রমিকের সংখ্যা বাড়ে।

এই সমাজে বাবা-মা বেঁচে না থাকলে শিশুসন্তানদের অবস্থা অবর্ণনীয় বিপন্ন ও অরক্ষিত হয়। বিশেষ করে দরিদ্র পরিবারের শিশুদের। অধিকাংশ ক্ষেত্রে আত্মীয়স্বজন তাদের শিশুশ্রমে নিয়োজিত করে উপার্জিত অর্থ নিজেরা ভোগ করে। আবার অনেক শিশুকে সুবিধাবাদী স্থানীয়রা মানবতার মুখোশে অসামাজিক কাজে এগিয়ে দেয়, যৌনপল্লিতে বিক্রি করে দেয়।

দুঃখজনক হলেও সত্য, শিশুদের সুরক্ষিত করার জন্য কঠোর কোনো সামাজিক ও রাজনৈতিক আন্দোলন এ দেশে নেই। কারণ, সম্ভবত শিশুদের জন্য আন্দোলনে ব্যক্তি-গোষ্ঠীর স্বার্থ উদ্ধার হয় না। নিশ্চিত করে বলা যায়, অরক্ষিত, অসহায় শিশুদের তথ্য কারও কাছে নেই, যদিও শিশুদের অধিকার নিয়ে মন্ত্রণালয়, অধিদপ্তর ও বিভিন্ন বেসরকারি সংগঠন রয়েছে। তারা শিশুদের সুরক্ষায় বিভিন্ন ধরনের কর্মসূচি বাস্তবায়ন করে, কথা বলে, মাথা ঘামায়—এমনটিই জানান দেয়। অনেকের ধারণা, তারা কপি পেস্ট পরিসংখ্যানে শিশুদের অধিকার সুরক্ষায় বছর-বছর পরিকল্পনা গ্রহণ করে।

শিশু গৃহকর্মী হেনার পরিচয় যদি এই সমাজের উঁচু পর্যায়ের হতো, তাহলে কী হতো? নিশ্চয়ই এমন হত্যার বিচারের দাবিতে অবস্থান ধর্মঘট কিংবা মানববন্ধন হতো। সংশ্লিষ্টদের কাছে বিচারের দাবিতে স্মারক প্রকাশ করা হতো। অনশনও হয়তো হতো, কিন্তু এতিম দরিদ্র গৃহকর্মীর বেলায় এসব অকল্পনীয়। যে জনগোষ্ঠীর সে প্রতিনিধি, সেখানে দারিদ্র্য আছে কেবল, যা ব্যক্তির ক্ষমতাকে দুর্বল করে দেয়। গৃহকর্ত্রী সাথীরা যেন এই হেনাদের নির্মমভাবে হত্যার জন্য আবির্ভূত হয় সমাজে। এদের শিক্ষা নেই, বোধ নেই। নেই ভয়। আইনকে এরা তোয়াক্কা করে না। সাথীরা বিশ্বাস করে, আইন কেবল কাগজে মুদ্রিত কিছু বাক্য। অন্যায় করেও পার পাওয়া যায়।

একটা ছবি দেখেছিলাম—‘হাওয়া’। ছবিতে একটা জায়গায় দেখানো হয়েছিল, খাঁচায় বন্দী একটা শালিককে একপর্যায়ে পুড়িয়ে খাওয়া হয়েছে। ব্যস, বন্য প্রাণী সংরক্ষণ অধিদপ্তর থেকে মামলা করা হলো। কারণ, এই ছবিতে শালিকের অধিকার হরণ করা হয়েছে! শালিককে খাঁচায় বন্দী ও পুড়িয়ে খেতে দেখানো হয়েছে। চলচ্চিত্রে যা দেখানো হয়, তা যে চিত্রনাট্যের প্রয়োজনে এবং কৌশলে, বোকারা তা বোঝে না। অথচ যখন এই লেখাটা লিখছি, তখন পর্যন্ত হেনার জন্য কোনো সংগঠন প্রতিবাদে মূর্ছা যায়নি।

এই দেশে চলচ্চিত্রে একটা শালিককে খাঁচায় বন্দী ও পুড়িয়ে খাওয়ার দৃশ্য দেখে প্রতিবাদ ও মামলা হলেও হেনাদের হত্যাকাণ্ডের বিচারের দাবিতে তেমন কিছু হয় না। সমাজে যেন শালিকের চেয়েও হেনাদের মূল্য কম!

স্বপ্না রেজা, কথাসাহিত্যিক ও কলাম লেখক

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

চট্টগ্রামে নিহত আইনজীবী সাইফুল ইসলামকে নিয়ে ভারতীয় সংবাদমাধ্যমে গুজব

ববির ট্রেজারার সাবেক সেনা কর্মকর্তাকে যোগদানে বাধা

বিগত সরকারে বঞ্চিত কর্মকর্তাদের ক্ষতিপূরণ দিতেই যাবে শতকোটি টাকা

দুই দিনে ৭ ব্যাংককে ২০ হাজার ৫০০ কোটি টাকা দিল বাংলাদেশ ব্যাংক

কোনো পুলিশ কর্মকর্তার সঙ্গে কথা বলেননি রয়টার্সের প্রতিবেদক: সিএমপি

এলাকার খবর
খুঁজুন

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত