নারায়ণগঞ্জের পরীক্ষা

বিভুরঞ্জন সরকার
প্রকাশ : ১৬ জানুয়ারি ২০২২, ০৪: ২০
আপডেট : ১৬ জানুয়ারি ২০২২, ১১: ০৮

নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশন নির্বাচনের প্রচারণা শেষ হয়েছে। এই লেখা ছাপা হওয়ার দিন অর্থাৎ রোববার, ১৬ জানুয়ারি তৃতীয়বারের মতো অনুষ্ঠিত হচ্ছে নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশন নির্বাচন। এই নির্বাচন সুষ্ঠু ও শান্তিপূর্ণ পরিবেশে অনুষ্ঠিত হোক, প্রত্যেক ভোটার নিজের পছন্দের প্রার্থীকে ভোট দিয়ে নিরাপদে যাঁর যাঁর ঘরে ফিরুন–এই প্রত্যাশা আমাদের সবারই।

বলা হয়ে থাকে, বাঙালি উৎসবপ্রিয় জাতি। উপলক্ষ পেলে উৎসবে মেতে উঠতে বাঙালি দ্বিধা করে না। ভোটও বাঙালির কাছে একটি উৎসব। নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশন নির্বাচন উপলক্ষে নগরজুড়ে সৃষ্টি হয়েছে উৎসবমুখর পরিবেশ। প্রধান সড়ক থেকে শুরু করে অলিগলি প্রার্থীদের ছবি ও প্রতীকসংবলিত পোস্টারে ছেয়ে গেছে। নগরজুড়ে মিছিল আর মিছিল। ভোট চেয়ে চলছে মাইকিং। প্রার্থীরা গিয়েছেন ভোটারদের দ্বারে দ্বারে। শিশু-কিশোরেরাও এই উৎসব থেকে বাইরে নেই। নৌকা ও হাতি প্রতীক নিয়ে উচ্ছ্বাস-উল্লাসে কয়দিন ধরেই মেতে আছেন অসংখ্য মানুষ। দেয়ালঘড়ি, হাতপাখাসহ 
অন্য প্রতীকও চোখে পড়ছে। কেউ কারও পোস্টার ছিঁড়ে ফেলেছেন বা কারও প্রচারণায় কেউ বাধা দিয়েছেন, তেমন অভিযোগ শোনা যায়নি।  

সম্প্রতি ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে ব্যাপক সহিংসতা ও প্রাণহানির ঘটনা ঘটায় নারায়ণগঞ্জের নির্বাচনী পরিবেশ শান্তিপূর্ণ থাকবে কি না, সে সংশয় অনেকের মনে থাকলেও নির্বাচনী প্রচারণা শেষ হয়েছে উৎসবের আমেজেই। ভোটের দিনটিও এমন শান্তিপূর্ণ থাকলেই ভালো।

প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থী এবং তাঁদের সমর্থকেরা যেকোনো উপায়ে ভোটে জেতার জন্য মরিয়া হয়ে না উঠলে মারামারি, হানাহানির ঘটনা সাধারণত ঘটে না। নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশন নির্বাচনে মেয়র পদে যাঁরা প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন, তাঁদের কারও বিরুদ্ধেই আচরণবিধি লঙ্ঘনের বড় কোনো অভিযোগ ওঠেনি। আওয়ামী লীগের প্রার্থী সেলিনা হায়াৎ আইভী এবং স্বতন্ত্র প্রার্থী তৈমুর আলম খন্দকারের মধ্যে হাড্ডাহাড্ডি লড়াই হবে বলে ধারণা করা হচ্ছে। দুজনই জয়ের ব্যাপারে আশাবাদী। কে জয়ী হবেন, সেটা ভোটের শেষেই জানা যাবে।  

সেলিনা হায়াৎ আইভী এর আগেও মেয়র পদে নির্বাচন করে জয়লাভ করেছেন। তৈমুর আলম খন্দকার একবার প্রার্থী হয়ে ভোটের আগে আগে সরে গিয়ে সমালোচিত হয়েছেন। এবার অবশ্য বিএনপি আনুষ্ঠানিকভাবে নির্বাচন না করায় তৈমুর স্বতন্ত্র প্রার্থী হয়ে নির্বাচন করছেন। তাঁর সঙ্গে স্থানীয় বিএনপি যেমন আছে, তেমনি আইভী ও আওয়ামী লীগবিরোধী আরও কেউ কেউ আছেন বলে প্রচার আছে। আইভী নিজেই বলেছেন, ‘এখানে আইভী ভার্সেস অনেক কিছু।’

অবশ্য নিজের বিজয় সম্পর্কে আইভী মোটামুটি নিশ্চিত। বলেছেন, ‘আমি লক্ষাধিক ভোটের ব্যবধানে পাস করব।’ অন্যদিকে নির্বাচন সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ হবে না বলে সংশয় প্রকাশ করে তৈমুর আলম খন্দকার অভিযোগ করেছেন, তাঁর কর্মীদের হয়রানি করা হচ্ছে এবং তাঁকেও নানাভাবে হুমকি দেওয়া হচ্ছে। তবে যেকোনো পরিস্থিতি মোকাবিলা করে তিনি ভোটের মাঠে থাকবেন। ভোটাররাও নিশ্চয়ই সেটাই আশা করবেন। নির্বাচনী প্রচারণায় যেমন কাউকে বাধা দেওয়া হয়নি, ভোটের দিনও ভোটাররা নিজেদের পছন্দের প্রার্থীকে অবাধে ভোট দিতে পারবেন বলে আমরা আশা করছি।  

আওয়ামী লীগের মনোনয়ন নিয়ে নৌকা প্রতীকে মেয়র পদের প্রার্থী সেলিনা হায়াৎ আইভী বলেছেন, ‘আমি সহিংসতার বিপক্ষে। প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থী (তৈমুর আলম খন্দকার) সম্পর্কে আমার চাচা। আমাদের বাসায় তাঁর অনেক আগে থেকে যাতায়াত। খুব ভালো সম্পর্ক তাঁর সঙ্গে আমার। ভোটযুদ্ধে আমরা প্রতিপক্ষ।’ ভোটের মাঠে সাধারণত প্রার্থীদের মধ্যে এমন সৌজন্য রক্ষা করে চলতে দেখা যায় না। এদিক দিয়েও নারায়ণগঞ্জ ব্যতিক্রম বলেই মনে হচ্ছে। আগের দুই নির্বাচনও নারায়ণগঞ্জে সুষ্ঠুভাবেই সম্পন্ন হয়েছিল।

সাধারণত সরকারদলীয় প্রার্থীর পক্ষ থেকেই ভয়ভীতি প্রদর্শন করা হয়। নারায়ণগঞ্জের পরিস্থিতি এ ক্ষেত্রেও ভিন্ন। আইভী বলেছেন, ‘আমি চাই, আমার ভোটাররা যাতে ভোটকেন্দ্রে শান্তিপূর্ণ পরিবেশে ভোট দিতে যেতে পারেন, কোনো সন্ত্রাসী যেন ঝামেলা পাকাতে না পারে, প্রশাসনকে সেই পরিবেশ নিশ্চিত করতে হবে।’  

নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশনে ভোটার সংখ্যা প্রায় পৌনে ৫ লাখ। নারীর চেয়ে পুরুষ ভোটার সামান্য বেশি। সব ভোটার কখনোই ভোটকেন্দ্রে যান না। তবে অবস্থা উত্তেজনাকর না হলে বেশিসংখ্যক ভোটারই ভোটাধিকার প্রয়োগ করেন। নারায়ণগঞ্জে ভোট উৎসবে বেশির ভাগ ভোটার শামিল হবেন বলে আশা করা যায়।

অতীতে নানা সময়ে, নানাভাবে আমাদের দেশে মানুষের ভোটের অধিকার নিয়ে ছিনিমিনি খেলা হয়েছে। সামরিক স্বৈরশাসকেরা যেমন এই খেলা খেলেছেন, তেমনি নির্বাচিত সরকারের আমলেও সেটা হয়েছে। হোন্ডা, গুন্ডা দিয়ে ভোটকেন্দ্র দখল, ব্যালট ছিনতাই, ফলাফল উল্টে দেওয়া, মিডিয়া ক্যু ইত্যাদি কতভাবে যে জনগণের রায় বদলে দেওয়া হয়েছে, তা অনেকেরই জানা। আবার আমাদের দেশে জনগণের ভোটের অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য আন্দোলনও হয়েছে। বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ‘আমার ভোট আমি দেব, যাকে খুশি তাকে দেব’ স্লোগান দিয়ে ভোটাধিকার প্রতিষ্ঠার আন্দোলনে নেতৃত্ব দিয়েছেন। বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টি (সিপিবি) একই দাবিতে দেশজুড়ে পদযাত্রা করেছে।

নির্বাচন বর্জন, নির্বাচন অনুষ্ঠানে বাধা দেওয়া, ভোটারদের হুমকি দিয়ে ভোটকেন্দ্রে যাওয়া থেকে বিরত রাখার জন্য আগুন-সন্ত্রাসসহ সহিংস ঘটনাও দেশে ঘটেছে। কিন্তু ভোট নিয়ে কোনো ধরনের তামাশা কারও কাম্য হতে পারে না। গত কয়েক বছরে ‘ভোট ছাড়া’ নির্বাচনের ঘটনাও ঘটেছে। এখন সময় এসেছে অতীতের খারাপ প্রবণতা থেকে বেরিয়ে এসে মানুষকে নিজ নিজ পছন্দের প্রার্থীকে ভোট দেওয়ার অধিকার ফিরিয়ে দিয়ে গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা শক্তিশালী করার। নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশন নির্বাচন থেকে ঘুরে দাঁড়ানোর অবস্থাটা তৈরি হোক–সেই আশা করা যেতেই পারে।  

বিভুরঞ্জন সরকার, সহকারী সম্পাদক, আজকের পত্রিকা নির্বাচনে হার-জিত আছে। প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেন অনেকে, জয়লাভ করেন একজন। নারায়ণগঞ্জে একজন প্রার্থীর সঙ্গে নির্বাচনী ব্যবস্থাটাও যাতে বিজয়ী হয়, তা নিশ্চিত করতে সংশ্লিষ্ট কোনো পক্ষেরই যেন দ্বিধা না থাকে।

নারায়ণগঞ্জে আওয়ামী লীগের প্রার্থী আইভী পরাজিত হলে সরকারের পতন হবে না। আবার তৈমুর আলম খন্দকার জয়ী হলেও বিএনপির দলীয় রাজনীতিতে নাটকীয় কোনো পরিবর্তন আসবে না। তৈমুর বিএনপির মার্কা নিয়ে বিএনপির হয়েও ভোট করছেন না। বিএনপি তাঁকে ‘না’ বলেছে। আবার যেহেতু তিনি বিএনপির নন, তাই সবাই তাঁকেই ভোট দেবেন, এমন অবস্থাও তৈরি হয়েছে বলে খবর নেই। আওয়ামী লীগবিরোধী সব ভোট তৈমুর পাবেন, তারও বাস্তব অবস্থা তৈরি হয়নি। আওয়ামীবিরোধী ভোট খেলাফত মজলিস, ইসলামী আন্দোলন, খেলাফত আন্দোলনের প্রার্থীদের মধ্যে ভাগ হওয়ার সম্ভাবনা আছে। তাই তৈমুর আলম খন্দকারের পক্ষে কেউ জনজোয়ার দেখলে সেটা কষ্টকল্পনা ছাড়া কিছু নয়। সব মিলিয়ে এটা বলা যায় না যে ১৬ জানুয়ারি নারায়ণগঞ্জে ভোটের ফলাফল দেশের রাজনীতিতে বড় ধরনের প্রভাব ফেলবে।

আমাদের দেশে কিছু কিছু মানুষের মধ্যে একটি কথা বলার প্রবণতা তৈরি হয়েছে যে, ‘সুষ্ঠু নির্বাচন হলে আওয়ামী লীগ হারবে’। এটা আসলে আওয়ামী লীগবিরোধী মহলের একটি কৌশলী প্রচারণা। আওয়ামী লীগ জিতলে বলা হবে, ‘নির্বাচন সুষ্ঠু হয়নি’। নারায়ণগঞ্জের ব্যাপারেও কেউ কেউ বলেছেন যে ‘সুষ্ঠু ভোট হলে আইভীর জেতা কঠিন’। তৈমুরের জেতা কেন সহজ—এই প্রশ্ন করলে তাঁরা অবশ্য পরিষ্কার জবাব দিতে পারেন না।

সেলিনা হায়াৎ আইভী একদিকে আওয়ামী লীগের, আবার তিনি তাঁর নিজের যোগ্যতায় আওয়ামী লীগের ঊর্ধ্বেও। তিনি নৌকা ছাড়া জিতেছেন, আবার নৌকা নিয়েও জিতেছেন। স্থানীয় সাংসদ শামীম ওসমান এবার আন্তরিকভাবে তাঁর পক্ষে নেই, আগেও তা-ই ছিলেন। নারায়ণগঞ্জের ভোটারদের একাংশের ওপর শামীম ওসমানের কিছু প্রভাব অবশ্যই আছে। কিন্তু সেটা কি আইভীর চেয়ে বেশি? আওয়ামী লীগের একটি ভোটব্যাংক যেমন আছে, তেমনি আইভী নিজেও ১৮ বছরে নিজস্ব একটি ভোটব্যাংক গড়ে তুলেছেন। ১৮ বছর দায়িত্ব পালন করে তিনি একদিকে প্রশাসনিক অভিজ্ঞতা অর্জন করেছেন, অন্যদিকে দলের ঊর্ধ্বে উঠে ‘সবার মেয়র’ হওয়ার স্বাক্ষরও রেখেছেন। নারায়ণগঞ্জে উন্নয়নের ক্ষেত্রে তিনি যে পরিবর্তন এনেছেন, তা অস্বীকার করার মতো মানুষও সম্ভবত কম। ক্ষমতায় বেশি সময় থাকলে অনেকে যেভাবে সমালোচিত হন, আইভীর বেলায় সেটাও প্রযোজ্য নয়। তিনি বিনয়ী, ভদ্র, মার্জিত। তাঁর বিরুদ্ধে অনিয়ম-দুর্নীতির অভিযোগও তেমন আছে বলে 
শোনা যায় না।  

নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশন নির্বাচন শান্তিপূর্ণ পরিবেশে সুষ্ঠুভাবে সম্পন্ন হলে ফলাফল মেনে নিতে সব পক্ষকেই উদারতা দেখাতে হবে। পরাজিত হলেই ভোটের ফল না মানার যে সংস্কৃতি গড়ে উঠেছে, তা থেকে বেরিয়ে আসতে হবে। পরাজিত প্রার্থী বিজয়ী প্রার্থীকে অভিনন্দন জানাতে হবে, আবার বিজয়ী প্রার্থীকেও পরাজিতদের তাচ্ছিল্য না করে তাঁদের প্রতি সৌহার্দ্য দেখাতে হবে। নির্বাচনী প্রচারের সময় যদি কেউ কারও উদ্দেশ্যে কটু কথাও বলে থাকেন, তা ভুলে গিয়ে নারায়ণগঞ্জবাসীর বৃহত্তর কল্যাণে একসঙ্গে কাজ করার মনোভাব দেখাতে হবে। সংকীর্ণতা নয়, উদার মানসিকতাই দেশের রাজনীতি থেকে মন্দ উদাহরণ দূর করতে সহায়ক হতে পারে। একজন সেনাশাসক দেশের রাজনীতিকে রাজনীতিবিদদের জন্য ‘ডিফিকাল্ট’ করতে চেয়েছিলেন, রাজনীতিবিদেরাও একই পথে হাঁটলে সেটা হবে দুর্ভাগ্যজনক।

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
খুঁজুন

সম্পর্কিত