জাহীদ রেজা নূর
ধর্ষণ বিষয়টি কি খেলো হয়ে গেছে আমাদের সমাজে? আমরা কি ধর্ষণ বিষয়ে নতুন কোনো মূল্যবোধ তৈরি করছি? যে মূল্যবোধের জেরে ধর্ষক সামাজিক মর্যাদা বজায় রাখার পথ খুঁজে পাবে। ‘জোর যার মুল্লুক তার’—এই মতবাদে যারা বিশ্বাসী, তাদের জন্য কিন্তু ধর্ষণের একটা গ্রহণযোগ্য ব্যাখ্যা দাঁড় করিয়ে ফেলা হচ্ছে। এই কুকর্ম সম্পাদন করা মানুষটিকে কী করে সমাজে প্রতিষ্ঠিত করা যায়, তারও বেশ কিছু আলামত দেখতে পাচ্ছি। এ কারণেই এ বিষয়ে লেখা দরকার। লেখার উদ্দেশ্য হলো, বিষয়টিকে চোখে আঙুল দিয়ে দেখানো। যেভাবে ধর্ষণের পর বিয়ের ব্যবস্থা করে খুশি হচ্ছে মানুষ, তাতে যে আশঙ্কার জন্ম হচ্ছে মনে, সে কথাও বলতে হবে।
দুই.
নারী নির্যাতক একধরনের মানুষকে সহজেই শনাক্ত করা যায়।
হঠাৎ নানাভাবে একগাদা টাকা যদি চলে আসে কারও হাতে, তাহলে সে মানুষ ধরাকে সরা জ্ঞান করতে শুরু করে। ব্যাংকঋণ নিয়ে হোক, অন্য কোনো ব্যবসার মাধ্যমে হোক, আঙুল ফুলে কলাগাছ হয়ে উঠলে সেই মানুষের মনে বেশ কিছু ‘খায়েশ’-এর জন্ম হয়। বহুকাল আগে থেকেই এ ধরনের পুরুষের আকাঙ্ক্ষা ছিল মদ, নারী, জুয়া। সেই ঐতিহ্যবাহী পথটিই এখনকার সদ্য ধনী হওয়া মানুষেরাও ব্যবহার করে।
আশঙ্কা বাড়ে তাদের সন্তানদের নিয়ে। কাঁচা টাকার মধ্যে বসবাস করতে করতে তারা মনে করে, সবকিছুই টাকা দিয়ে কেনা সম্ভব। তখন এই টাকার আবর্তে ফেলেই তারা ‘নারী শিকারে’ প্রবৃত্ত হয়।
পাকিস্তান আমলে ২২ পুঁজিপতির কথা শোনা যেত। এখন পুঁজিপতির সংখ্যা অগুনতি। তাঁদের অনেকেই ব্যাংকঋণ নিয়ে পুঁজিপতি হয়েছেন। সেই ঋণ কারও কারও ক্ষেত্রে হাজার কোটি টাকার ওপরে।
সমাজে বা দেশের অর্থনীতিতে পুঁজি যখন যথেচ্ছভাবে ঘুরে বেড়ায়, তখন স্থিতিশীলতা আসার আগপর্যন্ত লুটপাট চলে। এ বহু পুরোনো কথা। বলা হয়ে থাকে, লুণ্ঠনকারী দুর্বৃত্তরা টাকার বিছানায় স্থিত হয়ে বসার পরই কেবল তাঁরা তাঁদের সম্পদের একটি অংশ মানবকল্যাণের জন্য ব্যয় করে থাকেন। তাঁদের পরবর্তী প্রজন্ম সেই লুটপাটের কালিমা থেকে মুক্ত হতে চায় এবং জনকল্যাণকর আরও অনেক কাজ করে।
আমাদের পুঁজিপতিদের সন্তানদের কেউ কেউ সে পথে হাঁটেন বটে, কিন্তু তাঁদের অনেককেই দেখা যায় বিভ্রান্তির পথ বেছে নিয়েছেন। তাঁদের চোখে কোনো মেয়ে পড়লে তাঁরই অনুগত সভাসদদের দ্বারা মেয়েটাকে ছলে-বলে-কৌশলে হুজুরের কাছে হাজির করা হয়।
এটা সমাজের ওপরদিককার ঘটনা। মাঝে মাঝে কোনো মেয়ে কাউকে দোষারোপ করে আত্মহত্যা করলে কিংবা কোনো হোটেলে পার্টি করার ছলে যৌন হয়রানির শিকার হয়েছে বলে অভিযোগ করলেই কেবল এ ধরনের ঘটনা আমজনতার সামনে আসে। নইলে সবার অগোচরে এই যৌনাচার চলতেই থাকে।
তিন.
তার মানে এই নয় যে পয়সাকড়িওয়ালা, সমাজের ওপরমহলেই এই অনাচার চলছে। ধর্ষণ, যৌন হয়রানির ব্যাপারটা যেকোনো সাধারণ অফিসেও ঘটতে পারে। ঘটছেও। যেকোনো বিশ্ববিদ্যালয়ে ঘটতে পারে, ঘটছেও। ঘটতে পারে যেকোনো মাদ্রাসায়, ঘটছেও। সাংবাদিকদের মধ্যে যৌন নির্যাতক নেই? আছে।
বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে ভালো নম্বর পাইয়ে দেওয়ার লোভ দেখিয়ে কিংবা খারাপ নম্বর দেওয়ার ভয় দেখিয়ে শিক্ষকদের কেউ কেউ তাঁদের ছাত্রীদের ধর্ষণ করেছেন বলে অভিযোগ আছে। এ রকম অভিযোগ অনেক।
সম্প্রতি একটি প্রতিষ্ঠিত বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন প্রতিষ্ঠিত শিক্ষকের নামে যৌন হয়রানির অভিযোগ করেন তাঁরই এক ছাত্রী। এই শিক্ষক কিছুকাল আগে ছিলেন একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য। যৌন হয়রানির অভিযোগ এবারই প্রথম ওঠেনি তাঁর নামে। কিন্তু এবার ফেঁসে গেলেন তিনি। পত্রিকায় প্রকাশিত খবর সত্য হলে বিভাগটির একাডেমিক সভায় তাঁর কৃতকর্মের কারণে তাঁকে একাডেমিক কার্যক্রম থেকে অব্যাহতি দেওয়া হয়েছে। অভিযোগটি কতটা গুরুতর, তা বোঝা যাবে এই অধ্যাপকের বিরুদ্ধে একাডেমিক কমিটির আরও কিছু সিদ্ধান্ত থেকে। এই অধ্যাপককে একাডেমিক সভায় ডাকা হবে না, তাঁর নামে বরাদ্দকৃত কক্ষ বাতিল করা হবে। সহজ করে বললে, ক্লাস নেওয়া, পরীক্ষার হলে উপস্থিত থাকা, উত্তরপত্র মূল্যায়ন করা, এমফিল-পিএইচডি গবেষণা তত্ত্বাবধান, পরীক্ষা কমিটির কাজে অংশ নেওয়া থেকে তিনি বিরত থাকবেন।
সেই সভায় উল্লিখিত অধ্যাপক ক্ষমাপ্রার্থনা ও করুণাভিক্ষা করেন। সভার কার্যবিবরণীতে বলা হয়, ‘ক্ষমাপ্রার্থনা ও করুণাভিক্ষার ঘটনায় অপরাধ স্বীকারের মাধ্যমে বিষয়টিও প্রমাণিত হয়।’
কিন্তু প্রকাশ্যে সেই অধ্যাপক বলেছেন, অভিযোগটি সম্পূর্ণ মিথ্যা, বানোয়াট, উদ্দেশ্যপ্রণোদিত ও ষড়যন্ত্রমূলক।
সমুদ্রবন্দরের কাছাকাছি অবস্থিত আরেকটি বিশ্ববিদ্যালয়ের এক শিক্ষককেও অতিসম্প্রতি বরখাস্ত করা হয়েছে যৌন হয়রানির অভিযোগে। বিশ্ববিদ্যালয়ের ২২ জন শিক্ষার্থী তাঁর নামে যৌন হয়রানির অভিযোগ করলে তাঁকে বরখাস্ত করা হয়।
একটি আবাসিক বিশ্ববিদ্যালয়ের এক শিক্ষকের নামে যৌন হয়রানির অভিযোগ করার পর বিভাগীয় কর্তৃপক্ষ থেকে যখন কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছিল না, তখন সেই ছাত্রী আত্মহত্যার চেষ্টা করেছিলেন। এরপর বিষয়টি আলোচনায় আসে। বিভাগের চেয়ারম্যান বিষয়টি ‘যৌন হয়রানি প্রতিরোধ সেল’-এ পাঠালে সেই সেল শিক্ষককে সব ধরনের একাডেমিক ও প্রশাসনিক কার্যক্রম থেকে অপসারণের জন্য সুপারিশ করে। তাঁকে বরখাস্ত করা হয়।
এই হলো শৈলচূড়া। খোঁজ নিলে এ রকম ঘটনা কত যে মিলবে, তা ভাবলে শিউরে উঠতে হয়।
শিক্ষক একজন শিক্ষার্থীর অভিভাবক। তাঁর কাছে নিরাপদ থাকবে শিক্ষার্থী। কিন্তু অবস্থাদৃষ্টে মনে হয়, সে জায়গাটি নষ্ট হয়ে যাচ্ছে।
চার.
মাদ্রাসার শিক্ষার্থীরাও নিরাপদ নয়। একসময় হয়তো মাদ্রাসার শিক্ষকদের বিরুদ্ধে কোনো অভিযোগ এলে তা লুকিয়ে রাখা হতো। কিন্তু সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের কল্যাণে এখন জানা হয়ে গেছে, মাদ্রাসায় যৌন নির্যাতন চলে। কয়েক বছর ধরে মাদ্রাসার শিক্ষকদের কারও কারও আচরণ এতটাই ভয়াবহতা দেখা যাচ্ছে যে তাতে এই শঙ্কা হয়, এসব প্রতিষ্ঠান থেকে ধর্মীয় মূল্যবোধ হারিয়ে গেছে কি না।
ঢাকার খুব কাছের একটি জেলার এক মাদ্রাসার একজন শিক্ষক গত বছরের দ্বিতীয় ভাগে মাদ্রাসার নয় বছর বয়সী এক ছেলেকে নিজ ঘরে ডেকে নিয়ে ধর্ষণ করেন। কাউকে জানালে প্রাণনাশের হুমকি দেন। কিন্তু ঘটনা প্রকাশ হয়ে পড়লে মাদ্রাসা কর্তৃপক্ষ তা ধামাচাপা দেওয়ার চেষ্টা করে। পুলিশ ঘটনাস্থলে গিয়ে ধর্ষণের সত্যতা পায়।
দক্ষিণের একটি জেলায় দশম শ্রেণির এক ছাত্রীকেও একজন মাদ্রাসার শিক্ষক ধর্ষণ করেন। ঢাকার অদূরে গোমতী নদীর তীরে নয় বছর বয়সী এক ছেলেকে ধর্ষণ করেছেন আরেকজন মাদ্রাসাশিক্ষক। গুগলে খুঁজতে গেলে মাদ্রাসাশিক্ষক কর্তৃক শিশু ধর্ষণের এত বেশি খবর পাওয়া যাবে যে মাদ্রাসায় শিশুশিক্ষার পাশাপাশি এসব অরাজকতার কথা ভেবে বিমূঢ় হয়ে যাবে মন।
পাঁচ.
সাংবাদিকদের নিয়েও যৌন নির্যাতনের খবর প্রকাশিত হয়েছে সংবাদপত্রে। প্রচারিত হয়েছে বৈদ্যুতিন মাধ্যমে। টেলিভিশন মাধ্যমের একজন বড় কর্তা এবং বড় সাংবাদিক নেতাকে তো যৌন হয়রানির অভিযোগে একটি টিভি চ্যানেল থেকে বরখাস্তও করা হয়েছে। তাঁর বিচারের দাবিতে প্রেসক্লাবের সামনে মানববন্ধনও হয়েছিল। বিভিন্ন টেলিভিশন চ্যানেলে চাকরি করতে গিয়ে নারীরা যৌন হয়রানির মুখোমুখি হন, সে রকম খবরও প্রকাশিত হয় বিস্তর। সংবাদমাধ্যমে নীতি-নৈতিকতার যে পরিবেশ থাকা দরকার, কিছু মানুষের অনৈতিক আচরণের কারণে তা আর থাকে না। তখন গোটা প্রতিষ্ঠান নিয়েই মানুষের মনে প্রশ্নের জন্ম হয়।
মুশকিল হলো, এসব অভিযোগের পর যে বিচার হওয়া দরকার, সেই বিচারের যে শাস্তি হওয়া দরকার, তা হয় না বলেই পরবর্তীকালে নতুন নতুন নেতারা যৌন হয়রানি করে যেতে পারেন।
ছয়.
নতুন আরেক বাস্তবতা আমাদের শিহরিত করে। দেখা যাচ্ছে, কেউ ধর্ষণ করার পর ধর্ষণের শিকারকে বিয়ে করে তাঁর অপরাধ ঢেকে ফেলছেন। এই প্রক্রিয়ায় অংশ নিচ্ছেন আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী, ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক নেতারাও। তাঁরা হয়তো ভাবছেন, একটা অনাকাঙ্ক্ষিত বিষয়ের মধুর সমাপ্তি ঘটাচ্ছেন তাঁরা।
কিন্তু একটা অপরাধকে ঢেকে দেওয়ার এই প্রবণতা মারাত্মক কোনো ভবিষ্যতের ইঙ্গিত দিচ্ছে কি না, সেটাও ভেবে দেখা দরকার। এমন ঘটনাও রয়েছে, যেখানে চিহ্নিত চার ধর্ষকের মধ্যে একজনকে বিয়ে করতে বলা হয়েছে ধর্ষণের শিকার নারীকে।
ধর্ষণের অপরাধ কি আপসযোগ্য? একেবারেই নয়। এই অপরাধ আপসযোগ্য হলে ভবিষ্যতে যে ঘটনা ঘটবে, তা বলে রাখি।
যদি কোনো পুরুষ কোনো নারীকে দেখে তার প্রতি আকৃষ্ট হন, সেই নারী যদি সেই পুরুষের সঙ্গে সম্পর্ক করতে না চান, তাহলে মেয়েটিকে তুলে নিয়ে গিয়ে ধর্ষণ করা হতে পারে এবং ধর্ষণের পর সেই বদমাশটা মেয়েটিকে বিয়ে করতে চাইতে পারে। সমাজপতিরা উল্লাস করতে করতে দেনমোহর ধার্য করে চার হাতের মিলন ঘটিয়ে দিতে পারেন!
ধর্ষকের সঙ্গে ধর্ষণের শিকারের বিয়ে মেনে নিলে কী রকম অরাজক পরিস্থিতির সৃষ্টি হবে, সেটা কি ভেবে দেখছে কেউ?
সাত.
যা বলা হলো, তা শৈলচূড়ার উপরিভাগমাত্র। সমাজের সর্বক্ষেত্রেই এই ধর্ষণকামী মানসিকতা বেড়ে উঠছে। যৌন হয়রানি ঠেকানোর জন্য যে পারিবারিক, সামাজিক শিক্ষা দরকার, স্কুলে লিঙ্গবৈষম্যের বিরুদ্ধে যে সচেতনতা গড়ে দেওয়া দরকার, তা আমাদের নেই। আমরা একেবারেই সচেতন নেই। বিপদ যতক্ষণ নিজের ঘরে এসে কড়া না নাড়ে, ততক্ষণ আমরা কেউ তা নিয়ে ভাবি না।
এই উদাসীনতা একটি জাতিকে ধ্বংস করে ফেলতে পারে। কবে আর সজাগ হব আমরা?
ধর্ষণ বিষয়টি কি খেলো হয়ে গেছে আমাদের সমাজে? আমরা কি ধর্ষণ বিষয়ে নতুন কোনো মূল্যবোধ তৈরি করছি? যে মূল্যবোধের জেরে ধর্ষক সামাজিক মর্যাদা বজায় রাখার পথ খুঁজে পাবে। ‘জোর যার মুল্লুক তার’—এই মতবাদে যারা বিশ্বাসী, তাদের জন্য কিন্তু ধর্ষণের একটা গ্রহণযোগ্য ব্যাখ্যা দাঁড় করিয়ে ফেলা হচ্ছে। এই কুকর্ম সম্পাদন করা মানুষটিকে কী করে সমাজে প্রতিষ্ঠিত করা যায়, তারও বেশ কিছু আলামত দেখতে পাচ্ছি। এ কারণেই এ বিষয়ে লেখা দরকার। লেখার উদ্দেশ্য হলো, বিষয়টিকে চোখে আঙুল দিয়ে দেখানো। যেভাবে ধর্ষণের পর বিয়ের ব্যবস্থা করে খুশি হচ্ছে মানুষ, তাতে যে আশঙ্কার জন্ম হচ্ছে মনে, সে কথাও বলতে হবে।
দুই.
নারী নির্যাতক একধরনের মানুষকে সহজেই শনাক্ত করা যায়।
হঠাৎ নানাভাবে একগাদা টাকা যদি চলে আসে কারও হাতে, তাহলে সে মানুষ ধরাকে সরা জ্ঞান করতে শুরু করে। ব্যাংকঋণ নিয়ে হোক, অন্য কোনো ব্যবসার মাধ্যমে হোক, আঙুল ফুলে কলাগাছ হয়ে উঠলে সেই মানুষের মনে বেশ কিছু ‘খায়েশ’-এর জন্ম হয়। বহুকাল আগে থেকেই এ ধরনের পুরুষের আকাঙ্ক্ষা ছিল মদ, নারী, জুয়া। সেই ঐতিহ্যবাহী পথটিই এখনকার সদ্য ধনী হওয়া মানুষেরাও ব্যবহার করে।
আশঙ্কা বাড়ে তাদের সন্তানদের নিয়ে। কাঁচা টাকার মধ্যে বসবাস করতে করতে তারা মনে করে, সবকিছুই টাকা দিয়ে কেনা সম্ভব। তখন এই টাকার আবর্তে ফেলেই তারা ‘নারী শিকারে’ প্রবৃত্ত হয়।
পাকিস্তান আমলে ২২ পুঁজিপতির কথা শোনা যেত। এখন পুঁজিপতির সংখ্যা অগুনতি। তাঁদের অনেকেই ব্যাংকঋণ নিয়ে পুঁজিপতি হয়েছেন। সেই ঋণ কারও কারও ক্ষেত্রে হাজার কোটি টাকার ওপরে।
সমাজে বা দেশের অর্থনীতিতে পুঁজি যখন যথেচ্ছভাবে ঘুরে বেড়ায়, তখন স্থিতিশীলতা আসার আগপর্যন্ত লুটপাট চলে। এ বহু পুরোনো কথা। বলা হয়ে থাকে, লুণ্ঠনকারী দুর্বৃত্তরা টাকার বিছানায় স্থিত হয়ে বসার পরই কেবল তাঁরা তাঁদের সম্পদের একটি অংশ মানবকল্যাণের জন্য ব্যয় করে থাকেন। তাঁদের পরবর্তী প্রজন্ম সেই লুটপাটের কালিমা থেকে মুক্ত হতে চায় এবং জনকল্যাণকর আরও অনেক কাজ করে।
আমাদের পুঁজিপতিদের সন্তানদের কেউ কেউ সে পথে হাঁটেন বটে, কিন্তু তাঁদের অনেককেই দেখা যায় বিভ্রান্তির পথ বেছে নিয়েছেন। তাঁদের চোখে কোনো মেয়ে পড়লে তাঁরই অনুগত সভাসদদের দ্বারা মেয়েটাকে ছলে-বলে-কৌশলে হুজুরের কাছে হাজির করা হয়।
এটা সমাজের ওপরদিককার ঘটনা। মাঝে মাঝে কোনো মেয়ে কাউকে দোষারোপ করে আত্মহত্যা করলে কিংবা কোনো হোটেলে পার্টি করার ছলে যৌন হয়রানির শিকার হয়েছে বলে অভিযোগ করলেই কেবল এ ধরনের ঘটনা আমজনতার সামনে আসে। নইলে সবার অগোচরে এই যৌনাচার চলতেই থাকে।
তিন.
তার মানে এই নয় যে পয়সাকড়িওয়ালা, সমাজের ওপরমহলেই এই অনাচার চলছে। ধর্ষণ, যৌন হয়রানির ব্যাপারটা যেকোনো সাধারণ অফিসেও ঘটতে পারে। ঘটছেও। যেকোনো বিশ্ববিদ্যালয়ে ঘটতে পারে, ঘটছেও। ঘটতে পারে যেকোনো মাদ্রাসায়, ঘটছেও। সাংবাদিকদের মধ্যে যৌন নির্যাতক নেই? আছে।
বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে ভালো নম্বর পাইয়ে দেওয়ার লোভ দেখিয়ে কিংবা খারাপ নম্বর দেওয়ার ভয় দেখিয়ে শিক্ষকদের কেউ কেউ তাঁদের ছাত্রীদের ধর্ষণ করেছেন বলে অভিযোগ আছে। এ রকম অভিযোগ অনেক।
সম্প্রতি একটি প্রতিষ্ঠিত বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন প্রতিষ্ঠিত শিক্ষকের নামে যৌন হয়রানির অভিযোগ করেন তাঁরই এক ছাত্রী। এই শিক্ষক কিছুকাল আগে ছিলেন একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য। যৌন হয়রানির অভিযোগ এবারই প্রথম ওঠেনি তাঁর নামে। কিন্তু এবার ফেঁসে গেলেন তিনি। পত্রিকায় প্রকাশিত খবর সত্য হলে বিভাগটির একাডেমিক সভায় তাঁর কৃতকর্মের কারণে তাঁকে একাডেমিক কার্যক্রম থেকে অব্যাহতি দেওয়া হয়েছে। অভিযোগটি কতটা গুরুতর, তা বোঝা যাবে এই অধ্যাপকের বিরুদ্ধে একাডেমিক কমিটির আরও কিছু সিদ্ধান্ত থেকে। এই অধ্যাপককে একাডেমিক সভায় ডাকা হবে না, তাঁর নামে বরাদ্দকৃত কক্ষ বাতিল করা হবে। সহজ করে বললে, ক্লাস নেওয়া, পরীক্ষার হলে উপস্থিত থাকা, উত্তরপত্র মূল্যায়ন করা, এমফিল-পিএইচডি গবেষণা তত্ত্বাবধান, পরীক্ষা কমিটির কাজে অংশ নেওয়া থেকে তিনি বিরত থাকবেন।
সেই সভায় উল্লিখিত অধ্যাপক ক্ষমাপ্রার্থনা ও করুণাভিক্ষা করেন। সভার কার্যবিবরণীতে বলা হয়, ‘ক্ষমাপ্রার্থনা ও করুণাভিক্ষার ঘটনায় অপরাধ স্বীকারের মাধ্যমে বিষয়টিও প্রমাণিত হয়।’
কিন্তু প্রকাশ্যে সেই অধ্যাপক বলেছেন, অভিযোগটি সম্পূর্ণ মিথ্যা, বানোয়াট, উদ্দেশ্যপ্রণোদিত ও ষড়যন্ত্রমূলক।
সমুদ্রবন্দরের কাছাকাছি অবস্থিত আরেকটি বিশ্ববিদ্যালয়ের এক শিক্ষককেও অতিসম্প্রতি বরখাস্ত করা হয়েছে যৌন হয়রানির অভিযোগে। বিশ্ববিদ্যালয়ের ২২ জন শিক্ষার্থী তাঁর নামে যৌন হয়রানির অভিযোগ করলে তাঁকে বরখাস্ত করা হয়।
একটি আবাসিক বিশ্ববিদ্যালয়ের এক শিক্ষকের নামে যৌন হয়রানির অভিযোগ করার পর বিভাগীয় কর্তৃপক্ষ থেকে যখন কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছিল না, তখন সেই ছাত্রী আত্মহত্যার চেষ্টা করেছিলেন। এরপর বিষয়টি আলোচনায় আসে। বিভাগের চেয়ারম্যান বিষয়টি ‘যৌন হয়রানি প্রতিরোধ সেল’-এ পাঠালে সেই সেল শিক্ষককে সব ধরনের একাডেমিক ও প্রশাসনিক কার্যক্রম থেকে অপসারণের জন্য সুপারিশ করে। তাঁকে বরখাস্ত করা হয়।
এই হলো শৈলচূড়া। খোঁজ নিলে এ রকম ঘটনা কত যে মিলবে, তা ভাবলে শিউরে উঠতে হয়।
শিক্ষক একজন শিক্ষার্থীর অভিভাবক। তাঁর কাছে নিরাপদ থাকবে শিক্ষার্থী। কিন্তু অবস্থাদৃষ্টে মনে হয়, সে জায়গাটি নষ্ট হয়ে যাচ্ছে।
চার.
মাদ্রাসার শিক্ষার্থীরাও নিরাপদ নয়। একসময় হয়তো মাদ্রাসার শিক্ষকদের বিরুদ্ধে কোনো অভিযোগ এলে তা লুকিয়ে রাখা হতো। কিন্তু সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের কল্যাণে এখন জানা হয়ে গেছে, মাদ্রাসায় যৌন নির্যাতন চলে। কয়েক বছর ধরে মাদ্রাসার শিক্ষকদের কারও কারও আচরণ এতটাই ভয়াবহতা দেখা যাচ্ছে যে তাতে এই শঙ্কা হয়, এসব প্রতিষ্ঠান থেকে ধর্মীয় মূল্যবোধ হারিয়ে গেছে কি না।
ঢাকার খুব কাছের একটি জেলার এক মাদ্রাসার একজন শিক্ষক গত বছরের দ্বিতীয় ভাগে মাদ্রাসার নয় বছর বয়সী এক ছেলেকে নিজ ঘরে ডেকে নিয়ে ধর্ষণ করেন। কাউকে জানালে প্রাণনাশের হুমকি দেন। কিন্তু ঘটনা প্রকাশ হয়ে পড়লে মাদ্রাসা কর্তৃপক্ষ তা ধামাচাপা দেওয়ার চেষ্টা করে। পুলিশ ঘটনাস্থলে গিয়ে ধর্ষণের সত্যতা পায়।
দক্ষিণের একটি জেলায় দশম শ্রেণির এক ছাত্রীকেও একজন মাদ্রাসার শিক্ষক ধর্ষণ করেন। ঢাকার অদূরে গোমতী নদীর তীরে নয় বছর বয়সী এক ছেলেকে ধর্ষণ করেছেন আরেকজন মাদ্রাসাশিক্ষক। গুগলে খুঁজতে গেলে মাদ্রাসাশিক্ষক কর্তৃক শিশু ধর্ষণের এত বেশি খবর পাওয়া যাবে যে মাদ্রাসায় শিশুশিক্ষার পাশাপাশি এসব অরাজকতার কথা ভেবে বিমূঢ় হয়ে যাবে মন।
পাঁচ.
সাংবাদিকদের নিয়েও যৌন নির্যাতনের খবর প্রকাশিত হয়েছে সংবাদপত্রে। প্রচারিত হয়েছে বৈদ্যুতিন মাধ্যমে। টেলিভিশন মাধ্যমের একজন বড় কর্তা এবং বড় সাংবাদিক নেতাকে তো যৌন হয়রানির অভিযোগে একটি টিভি চ্যানেল থেকে বরখাস্তও করা হয়েছে। তাঁর বিচারের দাবিতে প্রেসক্লাবের সামনে মানববন্ধনও হয়েছিল। বিভিন্ন টেলিভিশন চ্যানেলে চাকরি করতে গিয়ে নারীরা যৌন হয়রানির মুখোমুখি হন, সে রকম খবরও প্রকাশিত হয় বিস্তর। সংবাদমাধ্যমে নীতি-নৈতিকতার যে পরিবেশ থাকা দরকার, কিছু মানুষের অনৈতিক আচরণের কারণে তা আর থাকে না। তখন গোটা প্রতিষ্ঠান নিয়েই মানুষের মনে প্রশ্নের জন্ম হয়।
মুশকিল হলো, এসব অভিযোগের পর যে বিচার হওয়া দরকার, সেই বিচারের যে শাস্তি হওয়া দরকার, তা হয় না বলেই পরবর্তীকালে নতুন নতুন নেতারা যৌন হয়রানি করে যেতে পারেন।
ছয়.
নতুন আরেক বাস্তবতা আমাদের শিহরিত করে। দেখা যাচ্ছে, কেউ ধর্ষণ করার পর ধর্ষণের শিকারকে বিয়ে করে তাঁর অপরাধ ঢেকে ফেলছেন। এই প্রক্রিয়ায় অংশ নিচ্ছেন আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী, ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক নেতারাও। তাঁরা হয়তো ভাবছেন, একটা অনাকাঙ্ক্ষিত বিষয়ের মধুর সমাপ্তি ঘটাচ্ছেন তাঁরা।
কিন্তু একটা অপরাধকে ঢেকে দেওয়ার এই প্রবণতা মারাত্মক কোনো ভবিষ্যতের ইঙ্গিত দিচ্ছে কি না, সেটাও ভেবে দেখা দরকার। এমন ঘটনাও রয়েছে, যেখানে চিহ্নিত চার ধর্ষকের মধ্যে একজনকে বিয়ে করতে বলা হয়েছে ধর্ষণের শিকার নারীকে।
ধর্ষণের অপরাধ কি আপসযোগ্য? একেবারেই নয়। এই অপরাধ আপসযোগ্য হলে ভবিষ্যতে যে ঘটনা ঘটবে, তা বলে রাখি।
যদি কোনো পুরুষ কোনো নারীকে দেখে তার প্রতি আকৃষ্ট হন, সেই নারী যদি সেই পুরুষের সঙ্গে সম্পর্ক করতে না চান, তাহলে মেয়েটিকে তুলে নিয়ে গিয়ে ধর্ষণ করা হতে পারে এবং ধর্ষণের পর সেই বদমাশটা মেয়েটিকে বিয়ে করতে চাইতে পারে। সমাজপতিরা উল্লাস করতে করতে দেনমোহর ধার্য করে চার হাতের মিলন ঘটিয়ে দিতে পারেন!
ধর্ষকের সঙ্গে ধর্ষণের শিকারের বিয়ে মেনে নিলে কী রকম অরাজক পরিস্থিতির সৃষ্টি হবে, সেটা কি ভেবে দেখছে কেউ?
সাত.
যা বলা হলো, তা শৈলচূড়ার উপরিভাগমাত্র। সমাজের সর্বক্ষেত্রেই এই ধর্ষণকামী মানসিকতা বেড়ে উঠছে। যৌন হয়রানি ঠেকানোর জন্য যে পারিবারিক, সামাজিক শিক্ষা দরকার, স্কুলে লিঙ্গবৈষম্যের বিরুদ্ধে যে সচেতনতা গড়ে দেওয়া দরকার, তা আমাদের নেই। আমরা একেবারেই সচেতন নেই। বিপদ যতক্ষণ নিজের ঘরে এসে কড়া না নাড়ে, ততক্ষণ আমরা কেউ তা নিয়ে ভাবি না।
এই উদাসীনতা একটি জাতিকে ধ্বংস করে ফেলতে পারে। কবে আর সজাগ হব আমরা?
গাজীপুর মহানগরের বোর্ডবাজার এলাকার ইসলামিক ইউনিভার্সিটি অব টেকনোলজির (আইইউটি) মেকানিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের শিক্ষার্থীরা পিকনিকে যাচ্ছিলেন শ্রীপুরের মাটির মায়া ইকো রিসোর্টে। ঢাকা-ময়মনসিংহ মহাসড়ক থেকে বাসগুলো গ্রামের সরু সড়কে ঢোকার পর বিদ্যুতের তারে জড়িয়ে যায় বিআরটিসির একটি দোতলা বাস...
২ দিন আগেঝড়-জলোচ্ছ্বাস থেকে রক্ষায় সন্দ্বীপের ব্লক বেড়িবাঁধসহ একাধিক প্রকল্প হাতে নিয়েছে সরকার। এ লক্ষ্যে বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে ৫৬২ কোটি টাকা। এ জন্য টেন্ডারও হয়েছে। প্রায় এক বছর পেরিয়ে গেলেও ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানগুলো কাজ শুরু করছে না। পানি উন্নয়ন বোর্ডের (পাউবো) তাগাদায়ও কোনো কাজ হচ্ছে না বলে জানিয়েছেন...
৫ দিন আগেদেশের পরিবহন খাতের অন্যতম নিয়ন্ত্রণকারী ঢাকা সড়ক পরিবহন মালিক সমিতির কমিটির বৈধতা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। সাইফুল আলমের নেতৃত্বাধীন এ কমিটিকে নিবন্ধন দেয়নি শ্রম অধিদপ্তর। তবে এটি কার্যক্রম চালাচ্ছে। কমিটির নেতারা অংশ নিচ্ছেন ঢাকা পরিবহন সমন্বয় কর্তৃপক্ষ (ডিটিসিএ) ও বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষের...
৫ দিন আগেআলুর দাম নিয়ন্ত্রণে ব্যর্থ হয়ে এবার নিজেই বিক্রির উদ্যোগ নিয়েছে সরকার। বাজার স্থিতিশীল রাখতে ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশের (টিসিবি) মাধ্যমে রাজধানীতে ভ্রাম্যমাণ ট্রাকের মাধ্যমে ভর্তুকি মূল্যে আলু বিক্রি করা হবে। একজন গ্রাহক ৪০ টাকা দরে সর্বোচ্চ তিন কেজি আলু কিনতে পারবেন...
৫ দিন আগে