Ajker Patrika

‘মানুষ’ হওয়ার মন্ত্র

রুশা চৌধুরী
‘মানুষ’ হওয়ার মন্ত্র

তারপর সে জলের কাছে গেল। যত গভীরে যায়, কে যেন টানে তাকে। নরম জমিনে অতল এক টান। সে আর যেতে চায় না। থাক বাবা, কাজ নেই এমন গভীরের সঙ্গে থাকার।দূরে নিশাচর প্যাঁচা তখন পাখার নিচে ছানাদের ঘুম পাড়িয়েছে। বেঁচেবর্তে থাকা দু-একটা শেয়াল মন খারাপ করে তাদের হারিয়ে যাওয়া স্বজনদের স্মৃতিতে মগ্ন।

এবার মহুয়াগাছের ফুল সবার আগে যে দেখবে তার জীবনে বসন্ত চিরস্থায়ী হবে—এমন স্বপ্নও দেখছিল কোনো এক পাগল। আহা! সবাই যদি একটুখানি পাগল হতে পারত, প্রতিদিন না হলেও এক একটা দিন। সেই সব দিনে চাঁদ উঠত, হাওয়া দিত, ফুল ফুটত, নবীন মাঝি মাঝদরিয়ায় হাঁক ছাড়ত, ‘কে যায় গো?’

মন্টু নামের ছোট ছেলেটা তার গ্যাস বেলুন উড়িয়ে দিয়ে কান্না চেপে সাহসী হতে চাইছে তখন। কান্না করলে যে বড় খারাপ দেখাবে! এই বয়সেই তাকে বুঝিয়ে দেওয়া হয়েছে কান্না শুধু ‘মেয়ে’দের, ‘পুরুষ’দের নয়। ওর বোন পিয়ালী তেমন কাঁদে না, বেশ সাহস তার। এতে ওদের বাবা-মায়ের মনে যতটা দুঃখ, তার থেকে ঢের বেশি দুঃখ ওদের প্রতিবেশীদের মনেও। দীর্ঘশ্বাস ফেলে আঁধার বলে, ‘ইহাই সমাজ, এরাই সব ঠিকঠাক চালিয়ে নিতে চাচ্ছে।’

পাড়াগাঁয়ে সন্ধ্যা আর রাতের পার্থক্য একটা সুতার মতো। নরম কালো সুতা...সুতার গায়ে জুঁই ফুলের নকশা আঁকা। কেউ জানে না এই নকশার গোপন রহস্য। যে জানতে পারবে তার জীবনে শুরু হবে ঝোড়ো হাওয়া আর অশান্তি। সে বরং চাঁদের বুকের বুড়িটাকে বন্ধু ভাবে, লাল গ্রহটাকে কালো আকাশের বুকে কৃষ্ণচূড়া ভাবে, ছাদের থেকে দেখতে পাওয়া নিকশ রাস্তাটাকে বিশাল কোনো সরীসৃপ কল্পনা করে। এই সব ভাবতে ভাবতে সে জলের বুকে আরেক পা বাড়ায়। কী শীতল...!

তার আত্মার কাছে হাহাকার ওঠে, সেই কোনকালে সে একটা কিছু চেয়েছিল, বদলে অনেক কিছু হারিয়েও ফেলল। শৈশব, কৈশোর, যৌবন পেছনে থেকে গেল, থেকে গেল সেই মায়া, ছায়া কায়া...আর?

আর যা, তার কথা জমা ছিল ওই ভেঙে ফেলা দেয়ালের গায়ে। এককালে সাদা ছিল দেয়ালটা। বেণি করা মেয়েটা আয়না দেখে দেখে চুল বেঁধে দেয়ালের বুকে কাজল দিয়ে একটু দাগ দিত।

কী লিখত তা সে-ই জানে। জানা হয়নি আর কারও, সে যে বলতেই ভুলে গিয়েছিল। ভুলতে ভুলতে একসময় দেখে শূন্য খাতায় কিচ্ছু লেখা হয়নি, সামনে শুধু হলদে হয়ে যাওয়া সাদা দেয়াল। একসময় সেই দেয়ালটাও ভেঙে ফেলা হলো। জগতের এটাই নিয়ম।

খুব বুদ্ধিমান এক মানুষ বিশ্বাস করে যে সব ভালোবাসার সম্পর্কই একসময় ফিকে হয়ে যায়। তাই সে নতুন নতুন জামা পরাতে চেষ্টা করে ভালোবাসার গায়ে। দিনের আলোয় সুখী হলেও প্রতি রাতে সে অসুখী হয়ে আশ্রয় খোঁজে সেই জলে নামা মানুষটার কাছেই। সেই বুদ্ধিমান মানুষটাও জন্মের সঙ্গে সঙ্গেই জেনেছিল যে সে ‘পুরুষ’।

জলে নামা সেই মানুষটা কিন্তু বিশ্বাস করে সব সম্পর্ক এক রকমই থাকে, থাকতেই হবে একই রকম। শুধু তার যত্ন করা লাগবে, মাঝে মাঝে ছুঁয়ে দেখা লাগবে, আর কিচ্ছু না। অতল জলের নিতল টান অগ্রাহ্য করে ঘুরে দাঁড়ায় সে। আধো আঁধারে মৃদু বাতাসে তার দীর্ঘ চুলগুলো উড়তে থাকে। ও মা! সে একজন নারী তাহলে! বোঝা যায়নি এতক্ষণ।

এ কারণেই এতক্ষণ নৈঃশব্দ্য ছিল চারদিকে, অন্ধকারে বোঝা যায়নি একা, সাগরের জলের কাছে একজন ‘নারী’ দাঁড়িয়ে ছিল। এই সব কথা তোলা থাকুক আরেক বসন্তদিনের জন্য। সাদামাটা জীবনটাকে সহজ করে রাখতে শিখেছিল জলে নামা সেই নারী। আমি তাকে চিনি।

সে আমাকে বলে গিয়েছিল, ‘সোনার শিকল নয়, একটা দুটো ফুল খুঁজে নাও, তাতেও না হলে গাছের পাতার কাছে যাও, একটা দুটো গান মনে রাখো...জীবনে শুধু “মানুষ” হয়ে বাঁচতে শেখার মন্ত্র ওইখানেই পাবে।’

লেখক: আবৃত্তিশিল্পী

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

ভারতের বিপক্ষে সেমির আগেই ধাক্কা খেল অস্ট্রেলিয়া

পরমাণু শক্তিধর হতে চেয়েছিল তাইওয়ান, সিআইএ এজেন্টের বিশ্বাসঘাতকতায় স্বপ্নভঙ্গ

এলপি গ্যাস, তেল, আটাসহ বেশ কিছু পণ্যে ভ্যাট তুলে দিল এনবিআর

চ্যাম্পিয়নস ট্রফি: রিজার্ভ-ডেতেও সেমিফাইনাল না হলে হৃদয়বিদারক সমীকরণ

অমর্ত্য সেনের বক্তব্যের প্রতিক্রিয়ায় যা বললেন জামায়াতের আমির

এলাকার খবর
খুঁজুন

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত