নিহতদের পরিবারে কান্না: হেলিকপ্টার দেখছিলেন মা, আদর হারাল শিশু সুয়াইবা

নারায়ণগঞ্জ প্রতিনিধি
প্রকাশ : ০১ আগস্ট ২০২৪, ১০: ৪৯
আপডেট : ০১ আগস্ট ২০২৪, ১২: ৪৭

মূল সড়ক থেকে আধা কিলোমিটার ভেতরে গৃহবধূ সুমাইয়া আক্তারদের বাসা। ছয়তলা বাড়ির বারান্দায় দাঁড়িয়েও সড়কে কী চলছিল তা দেখার উপায় নেই। মহাসড়কে আন্দোলন দমাতে যখন আকাশে হেলিকপ্টার উড়ছিল, তখন তা দেখতে আশপাশের বাড়ির ছাদ, বারান্দায় ছিল সাধারণ মানুষের উৎসুক দৃষ্টি।

ছয়তলার বারান্দায় দাঁড়িয়ে এসব দেখতে থাকা সুমাইয়া হঠাৎ দেখলেন তিনি নিজেই গুলিবিদ্ধ। আন্দোলনের অংশ না হয়েও প্রাণ হারালেন তিনি। 

গত ২০ জুলাই বিকেলে নারায়ণগঞ্জের সিদ্ধিরগঞ্জ পাইনাদী এলাকায় ভাড়া বাসার বারান্দায় গুলিবিদ্ধ হয়ে মারা যান গৃহবধূ সুমাইয়া আক্তার (২০)। তিনি বরিশালের মেহেন্দীগঞ্জ উপজেলার মৃত সেলিম মাতব্বরের মেয়ে। তাঁর স্বামী কুমিল্লার বাসিন্দা জাহিদ হোসেন সিদ্ধিরগঞ্জের একটি কারখানায় কর্মরত। মাত্র দুই মাস আগে জাহিদ ও সুমাইয়ার ঘরে আগমন ঘটে নতুন অতিথি সুয়াইবার। 

নাতনিকে বুকে আগলে ঘটনার বর্ণনা দিচ্ছিলেন সুমাইয়ার মা আছমা বেগম (৪৪)। বারবার ডুকরে কেঁদে উঠছিলেন কথা বলতে গিয়ে। কোলে শুয়ে থাকা শিশু সুয়াইবা যেন বুঝে গেছে মায়ের কাছে আর আবদার করার সুযোগ নেই। নানিই এখন তার ভরসা। 

আছমা বেগম জানান, করোনায় স্বামীকে হারান। এরপর বরিশাল থেকে নারায়ণগঞ্জে আসেন ছেলেমেয়েদের নিয়ে। একে একে প্রায় সবাই যুক্ত হন বিভিন্ন কর্মস্থলে। দুই মেয়ে ও তিন ছেলের মধ্যে সুমাইয়া ছিলেন তৃতীয়। আড়াই বছর আগে বিয়ে হয় জাহিদ হোসেনের সঙ্গে। গত ১২ মে মাতুয়াইল হাসপাতালে সিজারে জন্ম হয় তাঁদের মেয়ে সুয়াইবা। অসুস্থ মেয়ে ও নাতনির যত্ন নিতে নিজের কাছে রেখে দেন আছমা বেগম। 

ঘটনার দিনের বর্ণনা দিয়ে আছমা আজকের পত্রিকাকে বলেন, ‘কয়েক দিন ধরেই তো ঝামেলা চলছিল। ২০ জুলাই সকাল থেকেই দূর থেকে গোলাগুলির শব্দ আসতাছিল। কিন্তু তাও অত স্পষ্ট না। আমাদের বাসা তো অনেক ভেতরে, বারান্দায় দাঁড়াইলে কিছু শব্দ আসত। এর মধ্যে আবার হেলিকপ্টার উড়তে থাকে। আশপাশের যত মানুষ আছে সবাই বারান্দায়, ছাদে উঠে হেলিকপ্টার দেখতাছিল। আমিও অনেকক্ষণ বারান্দায় দাঁড়িয়ে দেখলাম কী হইতাছে।

আসরের নামাজের পর আমার নাতনিকে ঘুমে রাইখা সুমাইয়া বারান্দায় দাঁড়ায়। আমি রুমে বসে ছিলাম।’ 

আছমার বর্ণনা এগিয়ে যায়—‘হঠাৎ একটা শব্দ হলো, আর দেখি আমার মেয়ে হাত-পা ছাইড়া দিয়া ফ্লোরে বইসা পড়ছে। আমি ভাবছিলাম সিজার রোগী শারীরিক কোনো অসুস্থতায় ফ্লোরে পইড়া গেছে। কিন্তু ওরে ধরতেই দেখি মাথার ওপর দিয়ে রক্ত পড়তাছে। আমি সাথে সাথে চিৎকার করতে লাগলাম। মেয়ের চোখ-মুখ নীল হইয়া গেল। আমার মাইয়া আমারে বিদায় বইলাও যাইতে পারল না। একটা চিৎকারও দিল না। নীরবে আমারে ছাইড়া গেল গা।’ 

সুমাইয়ার ভগ্নিপতি বিল্লাল হোসেন বলেন, ‘এলাকার মানুষের সহযোগিতায় প্রো-অ্যাকটিভ হাসপাতালে নিয়ে গেলাম। তারা মৃত ঘোষণা করল। ভেবেছিলাম গ্রামের দিকে নিয়ে যাব। কিন্তু রাস্তাঘাটে এত ঝামেলা দেখে এলাকার মানুষ বলল এখানেই দাফন করতে। রাতেই সিদ্ধিরগঞ্জ পুল এলাকায় তাকে দাফন করা হয়।’ 

স্বজনেরা জানান, ঘটনার পর মেহেন্দীগঞ্জ থানার একজন উপপরিদর্শক ফোন দিয়ে সুমাইয়ার পরিবারের বিষয়ে খোঁজখবর নিয়েছেন। ঘটনার বিষয়ে শুনতে চেয়েছেন। তবে নারায়ণগঞ্জের কোনো প্রশাসন তাঁদের খোঁজ নেয়নি। 

আছমা বেগম আক্ষেপ করে বলেন, ‘স্বামীরে হারাইয়া শহরে আইসিলাম ভাতের জন্য। সেই শহরে আমার মেয়ে গুলি খাইয়া মরল। ঘরের ভিতরেও আমার মেয়েটা নিরাপদে থাকতে পারল না।’

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
খুঁজুন

সম্পর্কিত