বিভুরঞ্জন সরকার
দেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতি কোন দিকে মোড় নিচ্ছে তা নিয়ে কোনো মন্তব্য করা খুব কঠিন। কেউ মনে করছেন, আওয়ামী লীগ পরেরবারও নির্বাচনে জিতে সরকার গঠন করবে। আবার কারও ধারণা, আওয়ামী লীগ সরকারের পতন হতে আর দেরি নেই। কেউ মনে করছেন, আমেরিকা যে শেখ হাসিনার সরকারকে ক্ষমতায় দেখতে চায় না, সেটা তো শেখ হাসিনা নিজের মুখেই বলেছেন। আবার কেউ উৎফুল্ল শেখ হাসিনার পক্ষ নিয়ে ভারত যুক্তরাষ্ট্রকে বার্তা দেওয়ার খবরে। কেউ আবার খুশিতে বগল বাজাচ্ছেন টেলিগ্রাফের একটি রিপোর্ট দেখে। আনন্দবাজারের রিপোর্ট আওয়ামী লীগের পক্ষে যাওয়ায় ওই রিপোর্টের সত্যতা বা বিশ্বাসযোগ্যতার প্রশ্ন তুলে যাঁরা তুচ্ছতাচ্ছিল্য করেছেন, তাঁরাই আবার টেলিগ্রাফের রিপোর্ট নিয়ে খুশিতে আটখানা! টেলিগ্রাফ লিখেছে, চীন ইস্যুতে আমেরিকা আর ভারত নাকি এক হয়ে গেছে। শেখ হাসিনাকে দিল্লিতে নিয়ে গিয়ে নাকি সাইজ করে দেবে ইত্যাদি!
আওয়ামী লীগের পক্ষে ভারতের অবস্থান কতটা মজবুত, আর কতটা নড়বড়ে, তা পরিমাপ করার মতো কোনো গোপন তথ্য আমার কাছে নেই। কিংবা আওয়ামী লীগকে সরিয়ে আমেরিকা কোন সরকার ক্ষমতায় আনতে চায়, তার কোনো নির্ভরযোগ্য খবরও আমার হাতে নেই। তবে প্রায় ৫০ বছর ধরে দেশের রাজনীতির একজন নিকট-পর্যবেক্ষক হিসেবে এটা বলতে পারি যে আমেরিকা আর যা-ই করুক, বর্তমান ভূ-রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে ভারতের মতামত উপেক্ষা করে বাংলাদেশের আগামী নির্বাচন নিয়ে কোনো সিদ্ধান্ত সম্ভবত নেবে না। আবার ভারতেরও বাংলাদেশে আওয়ামী লীগ সরকারের জন্য বিপজ্জনক কোনো অবস্থান নেওয়ার সম্ভাবনা কম। অবশ্য বাংলাদেশের আগামী নির্বাচন অবাধ ও শান্তিপূর্ণ হোক—সেটা সবারই চাওয়া। এমনকি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাও সেটাই বলছেন।
দেশে এখন রাজনৈতিক পণ্ডিতের ছড়াছড়ি। গণতন্ত্র, মানবাধিকারের জন্য কান্নাকাটি করা লোকেরও অভাব নেই। আহারে, ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট যদি দেশে এত মানবাধিকার দরদি থাকত, তাহলে কি অমন বর্বর হত্যাকাণ্ড ঘটিয়ে ঘাতকেরা ‘ইনডেমনিটি’ পেত? ভোট দিতে না পারার জন্য আকুলিবিকুলি করা এত মানুষ জিয়াউর রহমানের শাসনকালে থাকলে কি জিয়া অমন ‘হ্যাঁ-না’ ভোট করতে পারতেন? কিংবা জিয়ার আমলে অমন সাজানো সংসদ নির্বাচনও কি করা সম্ভব হতো? প্রশ্ন করা যেতে পারে, আমেরিকার গণতন্ত্র ও মানবাধিকারপ্রীতি তখন কোথায় ছিল? আচ্ছা, আমেরিকা পৃথিবীতে কোন দেশে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠায় সহযোগিতা করেছে? দেশে দেশে সামরিক স্বৈরশাসকেরা কোন বিশ্বশক্তির মদদ পেয়েছেন? কিংবা বিএনপি কি একটি গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক দল? বিএনপি তো দেশে একাধিকবার ক্ষমতায় ছিল। কেমন ছিল তখন গণতন্ত্রের অবস্থা? ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলার ঘটনা কোন শাসন আমলে ঘটেছিল?
হ্যাঁ, ২১ আগস্ট সন্ধ্যায় আমরা কয়েকজন একটি আড্ডায় বসেছিলাম। নানা বিষয়ে কথা বলেছি আমরা বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার কয়েকজন। বাঙালির যেকোনো আড্ডায় অবধারিতভাবে রাজনীতি ঢুকে পড়ে। আমাদের আড্ডায়ও তার ব্যতিক্রম হয়নি। একজন বললেন, শেখ হাসিনাসহ দলের প্রথম সারির নেতাদের হত্যার উদ্দেশ্যে ২০০৪ সালের ২১ আগস্ট যে পৈশাচিক গ্রেনেড হামলা হয়েছিল, সেটাই তো বাংলাদেশের রাজনীতিতে বিভাজনের চিরস্থায়ী দেয়াল তুলে দিয়েছে। রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ মোকাবিলার এমন বর্বরতা যে রাজনৈতিক শক্তি করতে পারে, তারা কোন মুখে গণতন্ত্রের কথা বলে?
প্রশ্নের জবাবে আমি কিছু বলব ভাবলেও ফ্লোর নিয়ে আরেকজন বললেন, পৃথিবীর বুকে বিএনপির মতো এত সৌভাগ্যের অধিকারী রাজনৈতিক দল আর দ্বিতীয়টি পাবেন না। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবকে নৃশংসভাবে হত্যার পর সামরিক একনায়ক জিয়াউর রহমান ক্ষমতায় বসে জন্ম দিয়েছেন এই দলের। আবার ২০০৪ সালের ২১ আগস্ট প্রতিপক্ষ রাজনৈতিক দলের ওপর গ্রেনেড হামলার মতো নৃশংস বর্বরতাও চালানো হয়েছে এই দলের পৃষ্ঠপোষকতায়। আবার এই দলটিই বাক্স্বাধীনতা, গণতন্ত্র, নির্বাচনে লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড ইত্যাদি বক্তব্য দিয়ে মিছিল, মিটিং ও সমাবেশ করতে পারছে! আওয়ামী লীগকেই গণতন্ত্রবিরোধী বলে সবক দিচ্ছে।
আলোচনার এই পর্যায়ে একজন হাতের মোবাইল ফোনটা খুলে ফেসবুক থেকে একটি লেখা পড়লেন। একটু দীর্ঘ কিন্তু যুক্তিপূর্ণ বিবেচনা করে তা এখানে তুলে ধরছি।
ফেসবুকে আইনজীবী ইমতিয়াজ মাহমুদ লিখেছেন:
‘২১ আগস্ট আর আমাদের দেশে গণতন্ত্রের উল্টোযাত্রা এই দুইয়ের মধ্যে একটা যোগ আছে। অবাক লাগে যখন কাউকে দেখি এই সংযোগটা হয় দেখতে পান না অথবা পেলেও উপেক্ষা করেন। ২১ আগস্টের গ্রেনেড হামলা আমাদের দেশের রাজনীতিতে আওয়ামী লীগ এবং
আওয়ামী লীগবিরোধী দক্ষিণপন্থী দলগুলোর মধ্যে পারস্পরিক ন্যূনতম বিশ্বাস-আস্থা ও অন্য যেকোনো প্রকারের গণতান্ত্রিক মিথস্ক্রিয়া অসম্ভব করে তুলেছে। ২১ আগস্টের সময় এবং তার পরবর্তী সময়ে সংসদে, আদালতে ও জনসমক্ষে বিএনপি নেতাদের কথাবার্তা ও আচরণ বৈরিতার মাত্রাই বাড়িয়েছে।
পুরো ঘটনা আপনি একটু আওয়ামী লীগের দৃষ্টিতে অথবা একটু নৈর্ব্যক্তিক দৃষ্টিতে দেখুন এবং ভাবুন। শেখ হাসিনা যখন জানলেন যে তাঁদের প্রাণ হরণের
জন্য আক্রমণটা করেছে বিএনপি এবং এই কাজের জন্য নিয়োগ করা হয়েছে ইসলামি জঙ্গিবাদী কিছু ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানকে, তখন তাঁর মানসিক অবস্থা কী হবে? আপনি ভাবুন, রাজনৈতিক বিরোধ বা মতপার্থক্যের কারণে কিছু লোক ও দল তাঁকে ও তাঁর সহযোগীদের হত্যা করতে চায়, পৃথিবী থেকে সরিয়ে দিতে চায় চিরতরে। এরপর কি তিনি আর ওদের সঙ্গে স্বাভাবিক রাজনৈতিক সম্পর্ক রাখতে পারেন?
আপনার নৈর্ব্যক্তিক বিবেচনার সঙ্গে যুক্ত করুন শেখ হাসিনার ব্যক্তিগত স্মৃতি, অভিজ্ঞতা ইত্যাদি। ১৯৭৫ সালের এই আগস্ট মাসেই ঘটেছে এ দেশের রাজনীতির সবচেয়ে বড় ট্র্যাজিক ঘটনা। সেই ঘটনা যারা ঘটিয়েছে ওরা পরে বিএনপির মিত্র হিসেবেই বিবেচিত হয়েছে এবং বিএনপি কখনো ওই ঘটনার নিন্দা করেনি। তাহলে আপনিই বলুন, এরপর বিএনপির প্রতি শেখ হাসিনা বা আওয়ামী লীগ শুধু নয়, কোনো স্বাভাবিক, সুস্থবুদ্ধিসম্পন্ন মানুষের বিএনপির প্রতি দৃষ্টিভঙ্গি কেমন হওয়া উচিত? বিএনপি, বিএনপির সহযোগী ও সমমনা লোকজনের প্রতি কী রকম মনোভাব পোষণ করবে বঙ্গবন্ধু ও আওয়ামী লীগের আদর্শে বিশ্বাসী কোনো মানুষ? ২১ আগস্টের পর আওয়ামী লীগ কীভাবে বিএনপি ও তার সহযোগীদের হাতে ক্ষমতা ছেড়ে দেওয়ায় নিরাপদ বোধ করবে?
২১ আগস্ট হচ্ছে বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসের একটা বড় কালো অধ্যায়। ওই দিন আমাদের রাজনীতিতে পারস্পরিক বিশ্বাস, আস্থা ও গণতান্ত্রিক আচরণের যা যা অনুষঙ্গ সব গ্রেনেড মেরে উড়িয়ে দিয়েছে। কোনো না কোনোভাবে বিএনপি আবার ক্ষমতায় আসতে পারে, মুফতি হান্নান ধরনের ক্যারেক্টারগুলো আবার মাটি ফুঁড়ে গজাবে—বৃষ্টির পর মাটি ফুঁড়ে যেভাবে কীটের দল সারি সারি বেরিয়ে আসতে থাকে—এ রকম আশঙ্কা যদি থাকে তাহলে আওয়ামী লীগ কী করবে? আওয়ামী লীগের পক্ষে জেনেশুনে বিএনপি আবার ক্ষমতায় আসবে—এ রকম পরিস্থিতি মেনে রাজনীতি করা কঠিন। জেনেশুনে আওয়ামী লীগ কোনো দিন বিএনপির হাতে ক্ষমতা হস্তান্তর করবে না।
একটু মোটাদাগে বললাম বলে কারও কাছে এটা সরলীকরণ মনে হতে পারে। কিন্তু কথাটা তো মিথ্যা নয়। বিএনপি ক্ষমতায় আসতে পারে এ রকম পরিস্থিতি ঠেকানোর জন্য আওয়ামী লীগ সাধ্যের মধ্যে সবকিছুই করবে। হয়তো সেটাই করছেও। আওয়ামী লীগের প্রতিপক্ষ যারা, তারাও বিষয়টি নিশ্চয়ই জানে। সুতরাং একটা কঠিন শৃঙ্খলের মধ্যে আমরা আটকে গেছি।
এই কঠিন সমস্যা থেকে আমরা বের হব কী করে? আমি জানি না। আওয়ামী লীগকে বলবেন, কী আছে এবার একটু ছাড় দেন, বিএনপি না হয় জিতলই এক টার্ম, তাতে কী এমন ক্ষতি হবে? আওয়ামী লীগ যখন বলবে, ওরা তো আমাদের সবাইকে প্রাণেই মেরে ফেলবে। কী জবাব দেবেন?’
ইমতিয়াজ মাহমুদের ফেসবুক পোস্ট পড়ার পর আমাদের আড্ডায় কিছুটা নীরবতা নেমে এল। সত্যি তো, আওয়ামী লীগের এই শঙ্কা কি অমূলক? একটু বিরতি দিয়ে আমাদের এক সাংবাদিক বন্ধু আরেক প্রবাসী সাংবাদিক ফজলুল বারীর একটি ফেসবুক পোস্ট বের করলেন। ফজলুল বারী লিখেছেন:
‘আমেরিকার প্রেসিডেন্ট ভারত আসছেন, এটা ভারতের জন্য বিরাট কিছু। আমেরিকা থেকে ব্যবসা-বাণিজ্য, ভিসা থেকে শুরু করে নানান কিছু তারা এই সুযোগে আদায় করে নেবে। বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্ক দুই দেশের সরকার আর জনগণের কাছে ভিন্ন আবেগের বিষয়। সাংস্কৃতিক বন্ধন গুরুত্বপূর্ণ। মুক্তিযুদ্ধে ভূমিকা সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। ব্যবসা-বাণিজ্য, নিরাপত্তা, দুই দেশের আসা-যাওয়া শেখ হাসিনার সময়ে যত বেড়েছে, আগে কোনো আমলেই তা ছিল না। এখানে আমেরিকা, চীন বা অন্য কিছু বেশি গুরুত্বপূর্ণ নয়।
বিএনপি নির্বাচনে আসবে জেনেই আওয়ামী লীগ প্রস্তুতি নিচ্ছে। এক শর বেশি বর্তমান এমপি বাদ পড়বেন। তাঁদের মধ্যে মন্ত্রীও আছেন। সিরিয়াস একটি নির্বাচন হবে। আওয়ামী লীগের কোনো বিদ্রোহী প্রার্থী মাঠে থাকতে পারবেন না। জান থাকবে না।
এখনো নির্বাচনে রাজি না বিএনপি। তারা চায় এক-এগারোর মতো একটি সরকার। কারণ আওয়ামী লীগের এই প্রশাসন ১৫ বছরেও বদলানো যাবে না। নির্বাচন ঠেকাতে বিএনপি পারবে না। কারণ এই আওয়ামী লীগ রাজনৈতিক-প্রশাসনিক সব দিক থেকেই অনেক বেশি সংঘবদ্ধ। এই সামরিক বাহিনী বঙ্গবন্ধু আর মুক্তিযুদ্ধবান্ধব।
আওয়ামী লীগ সরকারের এত উপকারভোগী মানুষ এখন সারা দেশে! সেই করোনা থেকে শুরু করে ঘর-খাদ্যদ্রব্য-ভাতা, এত উপভোগী মানুষ বাংলাদেশের আর কোনো সরকারের আমলে ছিল না। পদ্মা সেতু, মেট্রোরেল, কর্ণফুলী টানেল, কী নেই এখন বাংলাদেশে? এই সরকারের সঙ্গে পারার বিকল্প দল নেই বাংলাদেশে। কারোরই শেখ হাসিনার প্যারালাল নেতৃত্ব নেই।’
পরের আড্ডায় এসব নিয়ে আমি কিছু বলার অঙ্গীকার করে সেদিনের মতো আড্ডার সমাপ্তি টানতে পেরেছি।
লেখক: জ্যেষ্ঠ সহকারী সম্পাদক, আজকের পত্রিকা
দেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতি কোন দিকে মোড় নিচ্ছে তা নিয়ে কোনো মন্তব্য করা খুব কঠিন। কেউ মনে করছেন, আওয়ামী লীগ পরেরবারও নির্বাচনে জিতে সরকার গঠন করবে। আবার কারও ধারণা, আওয়ামী লীগ সরকারের পতন হতে আর দেরি নেই। কেউ মনে করছেন, আমেরিকা যে শেখ হাসিনার সরকারকে ক্ষমতায় দেখতে চায় না, সেটা তো শেখ হাসিনা নিজের মুখেই বলেছেন। আবার কেউ উৎফুল্ল শেখ হাসিনার পক্ষ নিয়ে ভারত যুক্তরাষ্ট্রকে বার্তা দেওয়ার খবরে। কেউ আবার খুশিতে বগল বাজাচ্ছেন টেলিগ্রাফের একটি রিপোর্ট দেখে। আনন্দবাজারের রিপোর্ট আওয়ামী লীগের পক্ষে যাওয়ায় ওই রিপোর্টের সত্যতা বা বিশ্বাসযোগ্যতার প্রশ্ন তুলে যাঁরা তুচ্ছতাচ্ছিল্য করেছেন, তাঁরাই আবার টেলিগ্রাফের রিপোর্ট নিয়ে খুশিতে আটখানা! টেলিগ্রাফ লিখেছে, চীন ইস্যুতে আমেরিকা আর ভারত নাকি এক হয়ে গেছে। শেখ হাসিনাকে দিল্লিতে নিয়ে গিয়ে নাকি সাইজ করে দেবে ইত্যাদি!
আওয়ামী লীগের পক্ষে ভারতের অবস্থান কতটা মজবুত, আর কতটা নড়বড়ে, তা পরিমাপ করার মতো কোনো গোপন তথ্য আমার কাছে নেই। কিংবা আওয়ামী লীগকে সরিয়ে আমেরিকা কোন সরকার ক্ষমতায় আনতে চায়, তার কোনো নির্ভরযোগ্য খবরও আমার হাতে নেই। তবে প্রায় ৫০ বছর ধরে দেশের রাজনীতির একজন নিকট-পর্যবেক্ষক হিসেবে এটা বলতে পারি যে আমেরিকা আর যা-ই করুক, বর্তমান ভূ-রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে ভারতের মতামত উপেক্ষা করে বাংলাদেশের আগামী নির্বাচন নিয়ে কোনো সিদ্ধান্ত সম্ভবত নেবে না। আবার ভারতেরও বাংলাদেশে আওয়ামী লীগ সরকারের জন্য বিপজ্জনক কোনো অবস্থান নেওয়ার সম্ভাবনা কম। অবশ্য বাংলাদেশের আগামী নির্বাচন অবাধ ও শান্তিপূর্ণ হোক—সেটা সবারই চাওয়া। এমনকি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাও সেটাই বলছেন।
দেশে এখন রাজনৈতিক পণ্ডিতের ছড়াছড়ি। গণতন্ত্র, মানবাধিকারের জন্য কান্নাকাটি করা লোকেরও অভাব নেই। আহারে, ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট যদি দেশে এত মানবাধিকার দরদি থাকত, তাহলে কি অমন বর্বর হত্যাকাণ্ড ঘটিয়ে ঘাতকেরা ‘ইনডেমনিটি’ পেত? ভোট দিতে না পারার জন্য আকুলিবিকুলি করা এত মানুষ জিয়াউর রহমানের শাসনকালে থাকলে কি জিয়া অমন ‘হ্যাঁ-না’ ভোট করতে পারতেন? কিংবা জিয়ার আমলে অমন সাজানো সংসদ নির্বাচনও কি করা সম্ভব হতো? প্রশ্ন করা যেতে পারে, আমেরিকার গণতন্ত্র ও মানবাধিকারপ্রীতি তখন কোথায় ছিল? আচ্ছা, আমেরিকা পৃথিবীতে কোন দেশে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠায় সহযোগিতা করেছে? দেশে দেশে সামরিক স্বৈরশাসকেরা কোন বিশ্বশক্তির মদদ পেয়েছেন? কিংবা বিএনপি কি একটি গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক দল? বিএনপি তো দেশে একাধিকবার ক্ষমতায় ছিল। কেমন ছিল তখন গণতন্ত্রের অবস্থা? ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলার ঘটনা কোন শাসন আমলে ঘটেছিল?
হ্যাঁ, ২১ আগস্ট সন্ধ্যায় আমরা কয়েকজন একটি আড্ডায় বসেছিলাম। নানা বিষয়ে কথা বলেছি আমরা বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার কয়েকজন। বাঙালির যেকোনো আড্ডায় অবধারিতভাবে রাজনীতি ঢুকে পড়ে। আমাদের আড্ডায়ও তার ব্যতিক্রম হয়নি। একজন বললেন, শেখ হাসিনাসহ দলের প্রথম সারির নেতাদের হত্যার উদ্দেশ্যে ২০০৪ সালের ২১ আগস্ট যে পৈশাচিক গ্রেনেড হামলা হয়েছিল, সেটাই তো বাংলাদেশের রাজনীতিতে বিভাজনের চিরস্থায়ী দেয়াল তুলে দিয়েছে। রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ মোকাবিলার এমন বর্বরতা যে রাজনৈতিক শক্তি করতে পারে, তারা কোন মুখে গণতন্ত্রের কথা বলে?
প্রশ্নের জবাবে আমি কিছু বলব ভাবলেও ফ্লোর নিয়ে আরেকজন বললেন, পৃথিবীর বুকে বিএনপির মতো এত সৌভাগ্যের অধিকারী রাজনৈতিক দল আর দ্বিতীয়টি পাবেন না। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবকে নৃশংসভাবে হত্যার পর সামরিক একনায়ক জিয়াউর রহমান ক্ষমতায় বসে জন্ম দিয়েছেন এই দলের। আবার ২০০৪ সালের ২১ আগস্ট প্রতিপক্ষ রাজনৈতিক দলের ওপর গ্রেনেড হামলার মতো নৃশংস বর্বরতাও চালানো হয়েছে এই দলের পৃষ্ঠপোষকতায়। আবার এই দলটিই বাক্স্বাধীনতা, গণতন্ত্র, নির্বাচনে লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড ইত্যাদি বক্তব্য দিয়ে মিছিল, মিটিং ও সমাবেশ করতে পারছে! আওয়ামী লীগকেই গণতন্ত্রবিরোধী বলে সবক দিচ্ছে।
আলোচনার এই পর্যায়ে একজন হাতের মোবাইল ফোনটা খুলে ফেসবুক থেকে একটি লেখা পড়লেন। একটু দীর্ঘ কিন্তু যুক্তিপূর্ণ বিবেচনা করে তা এখানে তুলে ধরছি।
ফেসবুকে আইনজীবী ইমতিয়াজ মাহমুদ লিখেছেন:
‘২১ আগস্ট আর আমাদের দেশে গণতন্ত্রের উল্টোযাত্রা এই দুইয়ের মধ্যে একটা যোগ আছে। অবাক লাগে যখন কাউকে দেখি এই সংযোগটা হয় দেখতে পান না অথবা পেলেও উপেক্ষা করেন। ২১ আগস্টের গ্রেনেড হামলা আমাদের দেশের রাজনীতিতে আওয়ামী লীগ এবং
আওয়ামী লীগবিরোধী দক্ষিণপন্থী দলগুলোর মধ্যে পারস্পরিক ন্যূনতম বিশ্বাস-আস্থা ও অন্য যেকোনো প্রকারের গণতান্ত্রিক মিথস্ক্রিয়া অসম্ভব করে তুলেছে। ২১ আগস্টের সময় এবং তার পরবর্তী সময়ে সংসদে, আদালতে ও জনসমক্ষে বিএনপি নেতাদের কথাবার্তা ও আচরণ বৈরিতার মাত্রাই বাড়িয়েছে।
পুরো ঘটনা আপনি একটু আওয়ামী লীগের দৃষ্টিতে অথবা একটু নৈর্ব্যক্তিক দৃষ্টিতে দেখুন এবং ভাবুন। শেখ হাসিনা যখন জানলেন যে তাঁদের প্রাণ হরণের
জন্য আক্রমণটা করেছে বিএনপি এবং এই কাজের জন্য নিয়োগ করা হয়েছে ইসলামি জঙ্গিবাদী কিছু ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানকে, তখন তাঁর মানসিক অবস্থা কী হবে? আপনি ভাবুন, রাজনৈতিক বিরোধ বা মতপার্থক্যের কারণে কিছু লোক ও দল তাঁকে ও তাঁর সহযোগীদের হত্যা করতে চায়, পৃথিবী থেকে সরিয়ে দিতে চায় চিরতরে। এরপর কি তিনি আর ওদের সঙ্গে স্বাভাবিক রাজনৈতিক সম্পর্ক রাখতে পারেন?
আপনার নৈর্ব্যক্তিক বিবেচনার সঙ্গে যুক্ত করুন শেখ হাসিনার ব্যক্তিগত স্মৃতি, অভিজ্ঞতা ইত্যাদি। ১৯৭৫ সালের এই আগস্ট মাসেই ঘটেছে এ দেশের রাজনীতির সবচেয়ে বড় ট্র্যাজিক ঘটনা। সেই ঘটনা যারা ঘটিয়েছে ওরা পরে বিএনপির মিত্র হিসেবেই বিবেচিত হয়েছে এবং বিএনপি কখনো ওই ঘটনার নিন্দা করেনি। তাহলে আপনিই বলুন, এরপর বিএনপির প্রতি শেখ হাসিনা বা আওয়ামী লীগ শুধু নয়, কোনো স্বাভাবিক, সুস্থবুদ্ধিসম্পন্ন মানুষের বিএনপির প্রতি দৃষ্টিভঙ্গি কেমন হওয়া উচিত? বিএনপি, বিএনপির সহযোগী ও সমমনা লোকজনের প্রতি কী রকম মনোভাব পোষণ করবে বঙ্গবন্ধু ও আওয়ামী লীগের আদর্শে বিশ্বাসী কোনো মানুষ? ২১ আগস্টের পর আওয়ামী লীগ কীভাবে বিএনপি ও তার সহযোগীদের হাতে ক্ষমতা ছেড়ে দেওয়ায় নিরাপদ বোধ করবে?
২১ আগস্ট হচ্ছে বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসের একটা বড় কালো অধ্যায়। ওই দিন আমাদের রাজনীতিতে পারস্পরিক বিশ্বাস, আস্থা ও গণতান্ত্রিক আচরণের যা যা অনুষঙ্গ সব গ্রেনেড মেরে উড়িয়ে দিয়েছে। কোনো না কোনোভাবে বিএনপি আবার ক্ষমতায় আসতে পারে, মুফতি হান্নান ধরনের ক্যারেক্টারগুলো আবার মাটি ফুঁড়ে গজাবে—বৃষ্টির পর মাটি ফুঁড়ে যেভাবে কীটের দল সারি সারি বেরিয়ে আসতে থাকে—এ রকম আশঙ্কা যদি থাকে তাহলে আওয়ামী লীগ কী করবে? আওয়ামী লীগের পক্ষে জেনেশুনে বিএনপি আবার ক্ষমতায় আসবে—এ রকম পরিস্থিতি মেনে রাজনীতি করা কঠিন। জেনেশুনে আওয়ামী লীগ কোনো দিন বিএনপির হাতে ক্ষমতা হস্তান্তর করবে না।
একটু মোটাদাগে বললাম বলে কারও কাছে এটা সরলীকরণ মনে হতে পারে। কিন্তু কথাটা তো মিথ্যা নয়। বিএনপি ক্ষমতায় আসতে পারে এ রকম পরিস্থিতি ঠেকানোর জন্য আওয়ামী লীগ সাধ্যের মধ্যে সবকিছুই করবে। হয়তো সেটাই করছেও। আওয়ামী লীগের প্রতিপক্ষ যারা, তারাও বিষয়টি নিশ্চয়ই জানে। সুতরাং একটা কঠিন শৃঙ্খলের মধ্যে আমরা আটকে গেছি।
এই কঠিন সমস্যা থেকে আমরা বের হব কী করে? আমি জানি না। আওয়ামী লীগকে বলবেন, কী আছে এবার একটু ছাড় দেন, বিএনপি না হয় জিতলই এক টার্ম, তাতে কী এমন ক্ষতি হবে? আওয়ামী লীগ যখন বলবে, ওরা তো আমাদের সবাইকে প্রাণেই মেরে ফেলবে। কী জবাব দেবেন?’
ইমতিয়াজ মাহমুদের ফেসবুক পোস্ট পড়ার পর আমাদের আড্ডায় কিছুটা নীরবতা নেমে এল। সত্যি তো, আওয়ামী লীগের এই শঙ্কা কি অমূলক? একটু বিরতি দিয়ে আমাদের এক সাংবাদিক বন্ধু আরেক প্রবাসী সাংবাদিক ফজলুল বারীর একটি ফেসবুক পোস্ট বের করলেন। ফজলুল বারী লিখেছেন:
‘আমেরিকার প্রেসিডেন্ট ভারত আসছেন, এটা ভারতের জন্য বিরাট কিছু। আমেরিকা থেকে ব্যবসা-বাণিজ্য, ভিসা থেকে শুরু করে নানান কিছু তারা এই সুযোগে আদায় করে নেবে। বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্ক দুই দেশের সরকার আর জনগণের কাছে ভিন্ন আবেগের বিষয়। সাংস্কৃতিক বন্ধন গুরুত্বপূর্ণ। মুক্তিযুদ্ধে ভূমিকা সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। ব্যবসা-বাণিজ্য, নিরাপত্তা, দুই দেশের আসা-যাওয়া শেখ হাসিনার সময়ে যত বেড়েছে, আগে কোনো আমলেই তা ছিল না। এখানে আমেরিকা, চীন বা অন্য কিছু বেশি গুরুত্বপূর্ণ নয়।
বিএনপি নির্বাচনে আসবে জেনেই আওয়ামী লীগ প্রস্তুতি নিচ্ছে। এক শর বেশি বর্তমান এমপি বাদ পড়বেন। তাঁদের মধ্যে মন্ত্রীও আছেন। সিরিয়াস একটি নির্বাচন হবে। আওয়ামী লীগের কোনো বিদ্রোহী প্রার্থী মাঠে থাকতে পারবেন না। জান থাকবে না।
এখনো নির্বাচনে রাজি না বিএনপি। তারা চায় এক-এগারোর মতো একটি সরকার। কারণ আওয়ামী লীগের এই প্রশাসন ১৫ বছরেও বদলানো যাবে না। নির্বাচন ঠেকাতে বিএনপি পারবে না। কারণ এই আওয়ামী লীগ রাজনৈতিক-প্রশাসনিক সব দিক থেকেই অনেক বেশি সংঘবদ্ধ। এই সামরিক বাহিনী বঙ্গবন্ধু আর মুক্তিযুদ্ধবান্ধব।
আওয়ামী লীগ সরকারের এত উপকারভোগী মানুষ এখন সারা দেশে! সেই করোনা থেকে শুরু করে ঘর-খাদ্যদ্রব্য-ভাতা, এত উপভোগী মানুষ বাংলাদেশের আর কোনো সরকারের আমলে ছিল না। পদ্মা সেতু, মেট্রোরেল, কর্ণফুলী টানেল, কী নেই এখন বাংলাদেশে? এই সরকারের সঙ্গে পারার বিকল্প দল নেই বাংলাদেশে। কারোরই শেখ হাসিনার প্যারালাল নেতৃত্ব নেই।’
পরের আড্ডায় এসব নিয়ে আমি কিছু বলার অঙ্গীকার করে সেদিনের মতো আড্ডার সমাপ্তি টানতে পেরেছি।
লেখক: জ্যেষ্ঠ সহকারী সম্পাদক, আজকের পত্রিকা
ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের কুমিল্লা এলাকায় যাত্রীবাহী বাসে ডাকাতি বেড়েই চলছে। এ কারণে চালক ও যাত্রীদের কাছে আতঙ্কের নাম হয়ে উঠছে এই সড়ক। ডাকাতির শিকার বেশি হচ্ছেন প্রবাসফেরত লোকজন। ডাকাতেরা অস্ত্র ঠেকিয়ে লুট করে নিচ্ছে সর্বস্ব। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর পরিচয়েও ঘটছে ডাকাতির ঘটনা।
০২ মার্চ ২০২৫বিআরটিসির বাস দিয়ে চালু করা বিশেষায়িত বাস র্যাপিড ট্রানজিট (বিআরটি) লেনে অনুমতি না নিয়েই চলছে বেসরকারি কোম্পানির কিছু বাস। ঢুকে পড়ছে সিএনজিচালিত অটোরিকশা, ব্যাটারিচালিত অটোরিকশা। উল্টো পথে চলছে মোটরসাইকেল। অন্যদিকে বিআরটিসির মাত্র ১০টি বাস চলাচল করায় সোয়া চার হাজার কোটি টাকার এই প্রকল্প থেকে...
১৬ জানুয়ারি ২০২৫গাজীপুর মহানগরের বোর্ডবাজার এলাকার ইসলামিক ইউনিভার্সিটি অব টেকনোলজির (আইইউটি) মেকানিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের শিক্ষার্থীরা পিকনিকে যাচ্ছিলেন শ্রীপুরের মাটির মায়া ইকো রিসোর্টে। ঢাকা-ময়মনসিংহ মহাসড়ক থেকে বাসগুলো গ্রামের সরু সড়কে ঢোকার পর বিদ্যুতের তারে জড়িয়ে যায় বিআরটিসির একটি দোতলা বাস...
২৪ নভেম্বর ২০২৪ঝড়-জলোচ্ছ্বাস থেকে রক্ষায় সন্দ্বীপের ব্লক বেড়িবাঁধসহ একাধিক প্রকল্প হাতে নিয়েছে সরকার। এ লক্ষ্যে বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে ৫৬২ কোটি টাকা। এ জন্য টেন্ডারও হয়েছে। প্রায় এক বছর পেরিয়ে গেলেও ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানগুলো কাজ শুরু করছে না। পানি উন্নয়ন বোর্ডের (পাউবো) তাগাদায়ও কোনো কাজ হচ্ছে না বলে জানিয়েছেন...
২০ নভেম্বর ২০২৪