আবু তাহের খান
সন্দেহ নেই যে খেলাপি ঋণের শর্ত শিথিল-সংক্রান্ত বাংলাদেশ ব্যাংকের ১৮ ডিসেম্বরের প্রজ্ঞাপন দেশের খেলাপি ঋণ পরিস্থিতিকে নতুন করে আরও খানিকটা নাজুক করে তুলবে। কিন্তু কথা হচ্ছে, এরপরও কি ঋণখেলাপিদের ছাড়দানের ধারা ও প্রবণতা এতটুকু বন্ধ হবে?
১২ ডিসেম্বর খেলাপি ঋণ পরিশোধে নতুন করে বর্ধিত ছাড়ের আবেদন জানিয়েছিল ব্যবসায়ী ও শিল্পোদ্যোক্তাদের শীর্ষ সংগঠন বাংলাদেশ শিল্প ও বণিক সমিতি ফেডারেশন (এফবিসিসিআই)। ওই দিন বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নরের সঙ্গে অনুষ্ঠিত এক সভায় তাঁরা এ আহ্বান জানান। যেই কথা সেই কাজ। আহ্বান জানানোর পর মাত্র তিন কার্যদিবসের মাথায় ১৮ ডিসেম্বর এক প্রজ্ঞাপন জারি করে বাংলাদেশ ব্যাংক জানিয়েছে, ঋণখেলাপিদের তাঁদের খেলাপি তকমা পরিবর্তনের জন্য এখন থেকে আর কিস্তির ৭৫ শতাংশ জমা দিতে হবে না—৫০ শতাংশ দিলেই চলবে। এতে ঘটনার পক্ষ-সংশ্লিষ্টদের সুবিধা অন্তত চারটি: এক. ঋণখেলাপিরা বাড়তি ছাড় ভোগ করার সুযোগ পাবেন; দুই. সংশ্লিষ্ট ব্যাংকগুলো খেলাপি ঋণের পরিমাণ কমিয়ে দেখাতে পারবে; তিন. উল্লিখিত দুই পক্ষের মধ্যকার দহরমটি আরও মজবুত হবে এবং চার. ক্ষমতাসীন রাজনীতিকেরা ঋণখেলাপিদের সহযোগী হিসেবে পাশে পাবেন।
গণমাধ্যম সূত্রে জানা যায়, ১২ ডিসেম্বরের সভাতেই গভর্নর ঋণখেলাপিদের পক্ষের দাবিগুলো বিবেচনার আশ্বাস দিয়েছিলেন এবং বৈঠক শেষে গণমাধ্যমকে দেওয়া এফবিসিসিআইয়ের সভাপতির বক্তব্য থেকেও ধারণা পাওয়া গিয়েছিল যে তাঁদের এ দাবি শিগগিরই পূরণ হতে যাচ্ছে। কিন্তু এত দ্রুত যে পূরণ হবে, তা বোধকরি ঋণখেলাপিরা নিজেরাও ভাবেননি। আসলে এখানেই নিহিত রয়েছে খেলাপি ঋণের পরিমাণ ক্রমাগত বৃদ্ধির অপার রহস্য। এই রাষ্ট্রে এখন বিশেষ শ্রেণি ও গোষ্ঠীর মানুষ সবকিছু ‘চাহিবামাত্র’ পেয়ে যায় কিংবা কখনো কখনো তা না চাইতেও মেলে এবং তা সবচেয়ে সহজে পান ঋণখেলাপিরা। কিন্তু পায় না কেবল সাধারণ জনগণ। তারা দ্রব্যমূল্যের পীড়ন থেকে বাঁচতে চায়, দুর্নীতি ও স্বেচ্ছাচারিতা থেকে বাঁচতে চায়, একচেটিয়া দলীয়করণ থেকে বাঁচতে চায় এবং বাঁচতে চায় মানহীন শিক্ষার অকার্যকারিতা থেকেও। কিন্তু সেসবের কিছুই পূরণ হয় না—সপ্তাহ থেকে মাস আর মাস থেকে বছর পেরিয়ে গেলেও। যদিও মাত্র তিন দিনের ব্যবধানেই নতুন করে ছাড় পেয়ে যান ঋণখেলাপিরা।
বাংলাদেশ ব্যাংকের কাছে ১২ ডিসেম্বর এফবিসিসিআই যা যা চেয়েছিল, তার সবটা এখনো পূরণ হয়নি। ফলে ধারণা করা চলে যে আরও বর্ধিত ছাড় সামনে অপেক্ষা করছে এবং সামনে যেহেতু নির্বাচন, অতএব তা না চাইলেও পাওয়া যাবে বলেই অনুমান করা চলে। কিন্তু ঋণখেলাপিদের এভাবে ছাড় দিতে দিতে দেশের ব্যাংকিং খাত ইতিমধ্যে কোথায় গিয়ে পৌঁছেছে, তা কি রাষ্ট্রের সিদ্ধান্তপ্রণেতারা একবারের জন্য হলেও ভেবে দেখেছেন? তাঁরা কি ভাবছেন যে বাংলাদেশের ব্যাংকিং খাতের এখানেই সমাপ্তি এবং এরপর বাংলাদেশে আর কোনো ব্যাংকিং কার্যক্রমের প্রয়োজন হবে না?
দেশে ব্যাংকগুলোর সম্মিলিত খেলাপি ঋণের পরিমাণ বর্তমানে প্রায় ১ লাখ ১৬৮ কোটি টাকা, যা ২০০৯ সালে ছিল ২২ হাজার ৪৮১ কোটি টাকা; অর্থাৎ ১৪ বছরে তা প্রায় সাড়ে চার গুণ বৃদ্ধি পেয়েছে। আর এই বৃদ্ধির পেছনে এফবিসিসিআই ও অনুরূপ সংগঠনগুলো এবং তাদের সদস্যদের ভূমিকা খুবই অসামান্য। এ অবস্থায় খেলাপি ঋণের বিষয়ে এফবিসিসিআই কর্তৃক এভাবে ক্রমাগত ছাড় চেয়ে যাওয়ার বিষয়টি বলতে গেলে একধরনের ফৌজদারি অপরাধের পর্যায়ে পড়ে বৈকি! আর এরূপ অপরাধ সংঘটনের আবেদনে সাড়া দেওয়াটা অপরাধকে প্রত্যক্ষ প্ররোচনা, পৃষ্ঠপোষকতা বা সহযোগিতাদানেরই শামিল এবং সেই অর্থে বাংলাদেশ ব্যাংকও এ ক্ষেত্রে ফৌজদারি অপরাধ সংঘটিত করল বৈকি! কিন্তু কথা হচ্ছে, কেন্দ্রীয় ব্যাংক নিজেই যদি এ ধরনের অপরাধে যুক্ত থাকে, তাহলে ঋণখেলাপিদের কীভাবে নিয়ন্ত্রণ করা যাবে আর তাঁদের শাস্তির আওতায়ই-বা আনা যাবে কীভাবে?
ব্যবসায়ী ও শিল্পোদ্যোক্তাদের প্রতিনিধি হিসেবে এফবিসিসিআই তার সদস্যদের ন্যায়সংগত দাবিদাওয়া বাংলাদেশ ব্যাংকের বিবেচনার জন্য পেশ করতেই পারে। কিন্তু সাম্প্রতিক বছরগুলোতে এমন সব দাবিই তারা পেশ করেছে এবং করে সেসব আদায়ও করে নিয়েছে। ফলে ১৪ বছরে খেলাপি ঋণের পরিমাণ সাড়ে চার গুণ বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১ লাখ কোটি টাকার ওপরে, যার মধ্যে গত এক বছরেই বেড়েছে ৩৩ হাজার কোটি টাকা, যা ক্রমপুঞ্জিত খেলাপি ঋণের প্রায় এক-তৃতীয়াংশ। এরপরও যে তারা ঋণখেলাপিদের আরও অধিক হারে ছাড় দেওয়ার জন্য ক্রমাগতভাবে তদবির করে যাচ্ছে, তাতে বুঝতে হবে যে তারা আর যা-ই চায় দেশ ও ব্যাংকিং খাতের মঙ্গল চায় না।
আর সেই সূত্রে অর্থ পাচারের চলমান ধারা যে আরও বহুগুণে বেগবান হয়ে উঠবে, সেটিও প্রায় নিশ্চিত করেই বলা যায়। আর এটি বিরাজমান সম্পদ বৈষম্যের প্রকটতাকে অধিকতর অমানবিক পর্যায়ে নিয়ে যাওয়ার ক্ষেত্রেও যে বড় ধরনের ভূমিকা রাখবে—তাতে কোনোই সন্দেহ নেই।
অবশ্য এফবিসিসিআই যে কেবল বর্তমানেই এরূপ আচরণ করছে, তা নয়; বরং সব সময়, সব সরকারের আমলেই তারা এমনটি করে এসেছে এবং এটি তাদের ঐতিহ্যেরই অংশ। এই সংগঠনের সাবেক এক সভাপতি তাঁদের প্রস্তাবে সম্মত না হওয়ার কারণে বাংলাদেশ ব্যাংকের তৎকালীন গভর্নরের ওপর চড়াও হয়েছিলেন, যা অনেকের স্মৃতি থেকে এখনো মুছে যায়নি। সেরূপ পরিস্থিতি অবশ্য এখন তৈরি হওয়ার কোনো আশঙ্কা নেই। কারণ, এখনকার গভর্নররা আর তেমন কোনো শক্ত নীতিগত অবস্থান গ্রহণের যোগ্যতা বা সাহস রাখেন না, যার পরিপ্রেক্ষিতে ঋণখেলাপিরা তাঁর ওপর চড়াও হতে পারেন; বরং ঋণখেলাপিদের প্রায় সব আবদারই বিনা বাক্য ব্যয়ে তাঁরা মেনে নিয়ে থাকেন, যা বাংলাদেশ ব্যাংকের স্বায়ত্তশাসন-অধিকারের সঙ্গে একেবারেই অসংগতিপূর্ণ।
এখন কথা হচ্ছে, এফবিসিসিআই তো এ দেশের ব্যবসায়ীদেরই সংগঠন। বাংলাদেশের অর্থনীতিতে এর সদস্যদের খুবই গুরুত্বপূর্ণ অবদান রয়েছে। বিভিন্ন জাতীয় ইস্যুতেও তারা নানা সময়ে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রেখেছে। ফলে এটি খুবই কাম্য যে দেশের চলমান অর্থনৈতিক সংকটেও তারা সাধারণ মানুষের স্বার্থের পক্ষে দাঁড়াবে। সে ক্ষেত্রে তারা যদি ঋণখেলাপিদের পক্ষে দাঁড়িয়ে তাঁদের জন্য আরও ছাড়ের সুপারিশ করেন, তাহলে সেটি কিন্তু জাতীয় স্বার্থের অনুকূলে যায় না। তারা তো এটি ভালো করেই বোঝেন যে বাংলাদেশের ব্যাংকিং খাত এখন এক চরম খারাপ সময় অতিক্রম করছে। ঋণ খেলাপের ভারে এ খাতের অবস্থা এতটাই শোচনীয় পর্যায়ে পৌঁছেছে যে প্রচণ্ড সাহসী ও অসাধারণ দেশপ্রেমিক না হলে এ মুহূর্তে প্রয়োজন হলেও কেউ কেন্দ্রীয় ব্যাংকের গভর্নরের দায়িত্ব নিতে চাইবেন না এবং নতুন করে বাণিজ্যিক ব্যাংকের শীর্ষ নির্বাহী হতেও অনেকেই অনাগ্রহ প্রকাশ করবেন বলে মনে হয়।
এ রকম একটি শোচনীয় পরিস্থিতিতে দেশের এ ক্রান্তিলগ্নে এফবিসিসিআইয়ের সদস্যদের উদ্দেশে বলার কথা এটাই, আপনারা তো বিত্তবান মানুষ। বিভিন্ন সময়ে মুনাফাও কমবেশি ভালোই করেছেন। জনগণের কষ্টার্জিত করের পয়সা দিয়ে রাষ্ট্র আপনাদের অনেকের জন্যই ভর্তুকি, অনুদান ও রেয়াত সুবিধার ব্যবস্থা করেছে। রাষ্ট্রমালিকানাধীন ব্যাংকগুলোর বড় অংশ নিজেরা লোকসান দিয়ে আপনাদের জন্য হ্রাসকৃত সুদে ও নানা শিথিল শর্তে পুঁজির ব্যবস্থা করেছে। ঋণ পরিশোধের ক্ষেত্রে বারবার পুনঃ তফসিল সুবিধা দিয়েছে এবং অধিকাংশ ক্ষেত্রে তা করা হয়েছে নিয়ম ভঙ্গ করে। তো, এত বছর ধরে নানা উপায়ে এত সুযোগ-সুবিধা ভোগের কথা ভেবে হলেও এই মুহূর্তে বাংলাদেশ ব্যাংককে আরও ছাড় দিতে না বলে আপনারাই নাহয় আপনাদের একচেটিয়া মুনাফা থেকে জনগণকে একটু ছাড় দিলেন!
সন্দেহ নেই যে খেলাপি ঋণের শর্ত শিথিল-সংক্রান্ত বাংলাদেশ ব্যাংকের ১৮ ডিসেম্বরের প্রজ্ঞাপন দেশের খেলাপি ঋণ পরিস্থিতিকে নতুন করে আরও খানিকটা নাজুক করে তুলবে। কিন্তু কথা হচ্ছে, এরপরও কি ঋণখেলাপিদের ছাড়দানের ধারা ও প্রবণতা এতটুকু বন্ধ হবে? মনে তো হয় না। আর সে আশঙ্কা থেকেই বলা: দেশের খেলাপি ঋণ পরিস্থিতি বর্তমানে যে পর্যায়ে পৌঁছেছে, তাকে যদি নীতিগত সহায়তা দিয়ে আর তিল পরিমাণও বাড়তে দেওয়া হয়, তাহলে দেশের ব্যাংকিং খাতকে অদূর ভবিষ্যতে বস্তুতই অনেক কঠিন মূল্য দিতে হবে। বাংলাদেশ ব্যাংক, দেশের রাজনৈতিক কর্তৃপক্ষ ও এফবিসিসিআইয়ের কাছে বিষয়টি কি বোধগম্য?
সাবেক পরিচালক, বিসিক, শিল্প মন্ত্রণালয়
সন্দেহ নেই যে খেলাপি ঋণের শর্ত শিথিল-সংক্রান্ত বাংলাদেশ ব্যাংকের ১৮ ডিসেম্বরের প্রজ্ঞাপন দেশের খেলাপি ঋণ পরিস্থিতিকে নতুন করে আরও খানিকটা নাজুক করে তুলবে। কিন্তু কথা হচ্ছে, এরপরও কি ঋণখেলাপিদের ছাড়দানের ধারা ও প্রবণতা এতটুকু বন্ধ হবে?
১২ ডিসেম্বর খেলাপি ঋণ পরিশোধে নতুন করে বর্ধিত ছাড়ের আবেদন জানিয়েছিল ব্যবসায়ী ও শিল্পোদ্যোক্তাদের শীর্ষ সংগঠন বাংলাদেশ শিল্প ও বণিক সমিতি ফেডারেশন (এফবিসিসিআই)। ওই দিন বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নরের সঙ্গে অনুষ্ঠিত এক সভায় তাঁরা এ আহ্বান জানান। যেই কথা সেই কাজ। আহ্বান জানানোর পর মাত্র তিন কার্যদিবসের মাথায় ১৮ ডিসেম্বর এক প্রজ্ঞাপন জারি করে বাংলাদেশ ব্যাংক জানিয়েছে, ঋণখেলাপিদের তাঁদের খেলাপি তকমা পরিবর্তনের জন্য এখন থেকে আর কিস্তির ৭৫ শতাংশ জমা দিতে হবে না—৫০ শতাংশ দিলেই চলবে। এতে ঘটনার পক্ষ-সংশ্লিষ্টদের সুবিধা অন্তত চারটি: এক. ঋণখেলাপিরা বাড়তি ছাড় ভোগ করার সুযোগ পাবেন; দুই. সংশ্লিষ্ট ব্যাংকগুলো খেলাপি ঋণের পরিমাণ কমিয়ে দেখাতে পারবে; তিন. উল্লিখিত দুই পক্ষের মধ্যকার দহরমটি আরও মজবুত হবে এবং চার. ক্ষমতাসীন রাজনীতিকেরা ঋণখেলাপিদের সহযোগী হিসেবে পাশে পাবেন।
গণমাধ্যম সূত্রে জানা যায়, ১২ ডিসেম্বরের সভাতেই গভর্নর ঋণখেলাপিদের পক্ষের দাবিগুলো বিবেচনার আশ্বাস দিয়েছিলেন এবং বৈঠক শেষে গণমাধ্যমকে দেওয়া এফবিসিসিআইয়ের সভাপতির বক্তব্য থেকেও ধারণা পাওয়া গিয়েছিল যে তাঁদের এ দাবি শিগগিরই পূরণ হতে যাচ্ছে। কিন্তু এত দ্রুত যে পূরণ হবে, তা বোধকরি ঋণখেলাপিরা নিজেরাও ভাবেননি। আসলে এখানেই নিহিত রয়েছে খেলাপি ঋণের পরিমাণ ক্রমাগত বৃদ্ধির অপার রহস্য। এই রাষ্ট্রে এখন বিশেষ শ্রেণি ও গোষ্ঠীর মানুষ সবকিছু ‘চাহিবামাত্র’ পেয়ে যায় কিংবা কখনো কখনো তা না চাইতেও মেলে এবং তা সবচেয়ে সহজে পান ঋণখেলাপিরা। কিন্তু পায় না কেবল সাধারণ জনগণ। তারা দ্রব্যমূল্যের পীড়ন থেকে বাঁচতে চায়, দুর্নীতি ও স্বেচ্ছাচারিতা থেকে বাঁচতে চায়, একচেটিয়া দলীয়করণ থেকে বাঁচতে চায় এবং বাঁচতে চায় মানহীন শিক্ষার অকার্যকারিতা থেকেও। কিন্তু সেসবের কিছুই পূরণ হয় না—সপ্তাহ থেকে মাস আর মাস থেকে বছর পেরিয়ে গেলেও। যদিও মাত্র তিন দিনের ব্যবধানেই নতুন করে ছাড় পেয়ে যান ঋণখেলাপিরা।
বাংলাদেশ ব্যাংকের কাছে ১২ ডিসেম্বর এফবিসিসিআই যা যা চেয়েছিল, তার সবটা এখনো পূরণ হয়নি। ফলে ধারণা করা চলে যে আরও বর্ধিত ছাড় সামনে অপেক্ষা করছে এবং সামনে যেহেতু নির্বাচন, অতএব তা না চাইলেও পাওয়া যাবে বলেই অনুমান করা চলে। কিন্তু ঋণখেলাপিদের এভাবে ছাড় দিতে দিতে দেশের ব্যাংকিং খাত ইতিমধ্যে কোথায় গিয়ে পৌঁছেছে, তা কি রাষ্ট্রের সিদ্ধান্তপ্রণেতারা একবারের জন্য হলেও ভেবে দেখেছেন? তাঁরা কি ভাবছেন যে বাংলাদেশের ব্যাংকিং খাতের এখানেই সমাপ্তি এবং এরপর বাংলাদেশে আর কোনো ব্যাংকিং কার্যক্রমের প্রয়োজন হবে না?
দেশে ব্যাংকগুলোর সম্মিলিত খেলাপি ঋণের পরিমাণ বর্তমানে প্রায় ১ লাখ ১৬৮ কোটি টাকা, যা ২০০৯ সালে ছিল ২২ হাজার ৪৮১ কোটি টাকা; অর্থাৎ ১৪ বছরে তা প্রায় সাড়ে চার গুণ বৃদ্ধি পেয়েছে। আর এই বৃদ্ধির পেছনে এফবিসিসিআই ও অনুরূপ সংগঠনগুলো এবং তাদের সদস্যদের ভূমিকা খুবই অসামান্য। এ অবস্থায় খেলাপি ঋণের বিষয়ে এফবিসিসিআই কর্তৃক এভাবে ক্রমাগত ছাড় চেয়ে যাওয়ার বিষয়টি বলতে গেলে একধরনের ফৌজদারি অপরাধের পর্যায়ে পড়ে বৈকি! আর এরূপ অপরাধ সংঘটনের আবেদনে সাড়া দেওয়াটা অপরাধকে প্রত্যক্ষ প্ররোচনা, পৃষ্ঠপোষকতা বা সহযোগিতাদানেরই শামিল এবং সেই অর্থে বাংলাদেশ ব্যাংকও এ ক্ষেত্রে ফৌজদারি অপরাধ সংঘটিত করল বৈকি! কিন্তু কথা হচ্ছে, কেন্দ্রীয় ব্যাংক নিজেই যদি এ ধরনের অপরাধে যুক্ত থাকে, তাহলে ঋণখেলাপিদের কীভাবে নিয়ন্ত্রণ করা যাবে আর তাঁদের শাস্তির আওতায়ই-বা আনা যাবে কীভাবে?
ব্যবসায়ী ও শিল্পোদ্যোক্তাদের প্রতিনিধি হিসেবে এফবিসিসিআই তার সদস্যদের ন্যায়সংগত দাবিদাওয়া বাংলাদেশ ব্যাংকের বিবেচনার জন্য পেশ করতেই পারে। কিন্তু সাম্প্রতিক বছরগুলোতে এমন সব দাবিই তারা পেশ করেছে এবং করে সেসব আদায়ও করে নিয়েছে। ফলে ১৪ বছরে খেলাপি ঋণের পরিমাণ সাড়ে চার গুণ বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১ লাখ কোটি টাকার ওপরে, যার মধ্যে গত এক বছরেই বেড়েছে ৩৩ হাজার কোটি টাকা, যা ক্রমপুঞ্জিত খেলাপি ঋণের প্রায় এক-তৃতীয়াংশ। এরপরও যে তারা ঋণখেলাপিদের আরও অধিক হারে ছাড় দেওয়ার জন্য ক্রমাগতভাবে তদবির করে যাচ্ছে, তাতে বুঝতে হবে যে তারা আর যা-ই চায় দেশ ও ব্যাংকিং খাতের মঙ্গল চায় না।
আর সেই সূত্রে অর্থ পাচারের চলমান ধারা যে আরও বহুগুণে বেগবান হয়ে উঠবে, সেটিও প্রায় নিশ্চিত করেই বলা যায়। আর এটি বিরাজমান সম্পদ বৈষম্যের প্রকটতাকে অধিকতর অমানবিক পর্যায়ে নিয়ে যাওয়ার ক্ষেত্রেও যে বড় ধরনের ভূমিকা রাখবে—তাতে কোনোই সন্দেহ নেই।
অবশ্য এফবিসিসিআই যে কেবল বর্তমানেই এরূপ আচরণ করছে, তা নয়; বরং সব সময়, সব সরকারের আমলেই তারা এমনটি করে এসেছে এবং এটি তাদের ঐতিহ্যেরই অংশ। এই সংগঠনের সাবেক এক সভাপতি তাঁদের প্রস্তাবে সম্মত না হওয়ার কারণে বাংলাদেশ ব্যাংকের তৎকালীন গভর্নরের ওপর চড়াও হয়েছিলেন, যা অনেকের স্মৃতি থেকে এখনো মুছে যায়নি। সেরূপ পরিস্থিতি অবশ্য এখন তৈরি হওয়ার কোনো আশঙ্কা নেই। কারণ, এখনকার গভর্নররা আর তেমন কোনো শক্ত নীতিগত অবস্থান গ্রহণের যোগ্যতা বা সাহস রাখেন না, যার পরিপ্রেক্ষিতে ঋণখেলাপিরা তাঁর ওপর চড়াও হতে পারেন; বরং ঋণখেলাপিদের প্রায় সব আবদারই বিনা বাক্য ব্যয়ে তাঁরা মেনে নিয়ে থাকেন, যা বাংলাদেশ ব্যাংকের স্বায়ত্তশাসন-অধিকারের সঙ্গে একেবারেই অসংগতিপূর্ণ।
এখন কথা হচ্ছে, এফবিসিসিআই তো এ দেশের ব্যবসায়ীদেরই সংগঠন। বাংলাদেশের অর্থনীতিতে এর সদস্যদের খুবই গুরুত্বপূর্ণ অবদান রয়েছে। বিভিন্ন জাতীয় ইস্যুতেও তারা নানা সময়ে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রেখেছে। ফলে এটি খুবই কাম্য যে দেশের চলমান অর্থনৈতিক সংকটেও তারা সাধারণ মানুষের স্বার্থের পক্ষে দাঁড়াবে। সে ক্ষেত্রে তারা যদি ঋণখেলাপিদের পক্ষে দাঁড়িয়ে তাঁদের জন্য আরও ছাড়ের সুপারিশ করেন, তাহলে সেটি কিন্তু জাতীয় স্বার্থের অনুকূলে যায় না। তারা তো এটি ভালো করেই বোঝেন যে বাংলাদেশের ব্যাংকিং খাত এখন এক চরম খারাপ সময় অতিক্রম করছে। ঋণ খেলাপের ভারে এ খাতের অবস্থা এতটাই শোচনীয় পর্যায়ে পৌঁছেছে যে প্রচণ্ড সাহসী ও অসাধারণ দেশপ্রেমিক না হলে এ মুহূর্তে প্রয়োজন হলেও কেউ কেন্দ্রীয় ব্যাংকের গভর্নরের দায়িত্ব নিতে চাইবেন না এবং নতুন করে বাণিজ্যিক ব্যাংকের শীর্ষ নির্বাহী হতেও অনেকেই অনাগ্রহ প্রকাশ করবেন বলে মনে হয়।
এ রকম একটি শোচনীয় পরিস্থিতিতে দেশের এ ক্রান্তিলগ্নে এফবিসিসিআইয়ের সদস্যদের উদ্দেশে বলার কথা এটাই, আপনারা তো বিত্তবান মানুষ। বিভিন্ন সময়ে মুনাফাও কমবেশি ভালোই করেছেন। জনগণের কষ্টার্জিত করের পয়সা দিয়ে রাষ্ট্র আপনাদের অনেকের জন্যই ভর্তুকি, অনুদান ও রেয়াত সুবিধার ব্যবস্থা করেছে। রাষ্ট্রমালিকানাধীন ব্যাংকগুলোর বড় অংশ নিজেরা লোকসান দিয়ে আপনাদের জন্য হ্রাসকৃত সুদে ও নানা শিথিল শর্তে পুঁজির ব্যবস্থা করেছে। ঋণ পরিশোধের ক্ষেত্রে বারবার পুনঃ তফসিল সুবিধা দিয়েছে এবং অধিকাংশ ক্ষেত্রে তা করা হয়েছে নিয়ম ভঙ্গ করে। তো, এত বছর ধরে নানা উপায়ে এত সুযোগ-সুবিধা ভোগের কথা ভেবে হলেও এই মুহূর্তে বাংলাদেশ ব্যাংককে আরও ছাড় দিতে না বলে আপনারাই নাহয় আপনাদের একচেটিয়া মুনাফা থেকে জনগণকে একটু ছাড় দিলেন!
সন্দেহ নেই যে খেলাপি ঋণের শর্ত শিথিল-সংক্রান্ত বাংলাদেশ ব্যাংকের ১৮ ডিসেম্বরের প্রজ্ঞাপন দেশের খেলাপি ঋণ পরিস্থিতিকে নতুন করে আরও খানিকটা নাজুক করে তুলবে। কিন্তু কথা হচ্ছে, এরপরও কি ঋণখেলাপিদের ছাড়দানের ধারা ও প্রবণতা এতটুকু বন্ধ হবে? মনে তো হয় না। আর সে আশঙ্কা থেকেই বলা: দেশের খেলাপি ঋণ পরিস্থিতি বর্তমানে যে পর্যায়ে পৌঁছেছে, তাকে যদি নীতিগত সহায়তা দিয়ে আর তিল পরিমাণও বাড়তে দেওয়া হয়, তাহলে দেশের ব্যাংকিং খাতকে অদূর ভবিষ্যতে বস্তুতই অনেক কঠিন মূল্য দিতে হবে। বাংলাদেশ ব্যাংক, দেশের রাজনৈতিক কর্তৃপক্ষ ও এফবিসিসিআইয়ের কাছে বিষয়টি কি বোধগম্য?
সাবেক পরিচালক, বিসিক, শিল্প মন্ত্রণালয়
ঝড়-জলোচ্ছ্বাস থেকে রক্ষায় সন্দ্বীপের ব্লক বেড়িবাঁধসহ একাধিক প্রকল্প হাতে নিয়েছে সরকার। এ লক্ষ্যে বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে ৫৬২ কোটি টাকা। এ জন্য টেন্ডারও হয়েছে। প্রায় এক বছর পেরিয়ে গেলেও ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানগুলো কাজ শুরু করছে না। পানি উন্নয়ন বোর্ডের (পাউবো) তাগাদায়ও কোনো কাজ হচ্ছে না বলে জানিয়েছেন...
৩ দিন আগেদেশের পরিবহন খাতের অন্যতম নিয়ন্ত্রণকারী ঢাকা সড়ক পরিবহন মালিক সমিতির কমিটির বৈধতা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। সাইফুল আলমের নেতৃত্বাধীন এ কমিটিকে নিবন্ধন দেয়নি শ্রম অধিদপ্তর। তবে এটি কার্যক্রম চালাচ্ছে। কমিটির নেতারা অংশ নিচ্ছেন ঢাকা পরিবহন সমন্বয় কর্তৃপক্ষ (ডিটিসিএ) ও বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষের...
৩ দিন আগেআলুর দাম নিয়ন্ত্রণে ব্যর্থ হয়ে এবার নিজেই বিক্রির উদ্যোগ নিয়েছে সরকার। বাজার স্থিতিশীল রাখতে ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশের (টিসিবি) মাধ্যমে রাজধানীতে ভ্রাম্যমাণ ট্রাকের মাধ্যমে ভর্তুকি মূল্যে আলু বিক্রি করা হবে। একজন গ্রাহক ৪০ টাকা দরে সর্বোচ্চ তিন কেজি আলু কিনতে পারবেন...
৩ দিন আগেসপ্তাহখানেক আগে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকে অনেকের ওয়াল বিষাদময় হয়ে উঠেছিল ফুলের মতো ছোট্ট শিশু মুনতাহাকে হত্যার ঘটনায়। ৫ বছর বয়সী সিলেটের এই শিশুকে অপহরণের পর হত্যা করে লাশ গুম করতে ডোবায় ফেলে রাখা হয়েছিল। প্রতিবেশী গৃহশিক্ষকের পরিকল্পনায় অপহরণের পর তাকে নির্মমভাবে হত্যা করা হয়...
৩ দিন আগে