চলমান মেগা প্রকল্পের বরাদ্দেও কাটছাঁট

আবু সাইম, ঢাকা
প্রকাশ : ২৭ ফেব্রুয়ারি ২০২৩, ০৮: ৩৮
আপডেট : ২৭ ফেব্রুয়ারি ২০২৩, ০৯: ১৭

ডলার ও অর্থ সংকটে চলমান মেগা প্রকল্পগুলোর বরাদ্দেও কাঁচি চালানো হচ্ছে। এসব প্রকল্পের বরাদ্দ ৫৩ হাজার কোটি টাকা থেকে প্রায় ১১ হাজার কোটি টাকা কাটছাঁট হচ্ছে। এই টাকার সিংহভাগ হচ্ছে প্রকল্পে বৈদেশিক ঋণের অংশ। বরাদ্দ কমিয়ে সংশোধিত বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচির (আরএডিপি) খসড়া তৈরি করা হয়েছে। আগামী ১ মার্চ জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদে (এনইসি) তা চূড়ান্ত করা হবে বলে জানিয়েছে পরিকল্পনা কমিশন।

পরিকল্পনা প্রতিমন্ত্রী বলেছেন, সংশোধিত এডিপিতে বৈদেশিক সাহায্য অংশে বড় কাটছাঁট হচ্ছে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সংকটের এই সময়ে বৈদেশিক অর্থই বেশি খরচ করা দরকার।

এদিকে সরকারের অগ্রাধিকার প্রকল্প তদারকির দায়িত্বে থাকা ফাস্টট্র্যাক প্রজেক্ট মনিটরিং টাস্কফোর্স বড় প্রকল্পগুলোর কাজের গতি বাড়ানোর তাগিদ দিয়েছে।
বরাদ্দ কমছে এমন মেগা প্রকল্পের মধ্যে রয়েছে মেট্রোরেলের তিনটির মধ্যে দুটির, কর্ণফুলী টানেল, ঢাকার হজরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের তৃতীয় টার্মিনাল, পদ্মা সেতু, দোহাজারী-কক্সবাজার রেলপথ, রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র, ঢাকা-আশুলিয়া এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে।

সংশ্লিষ্ট সূত্র বলেছে, চলতি অর্থবছরে ডলারের সংকট, রাজস্ব ঘাটতিসহ প্রধান প্রধান আয়ের খাত দুর্বল হওয়ায় খরচে কৃচ্ছ্রসাধন করছে সরকার। অত্যাবশ্যক প্রকল্প ছাড়া অন্য সব প্রকল্পে অর্থ ছাড় কমানো বা স্থগিত করা হয়েছে।

পর্যাপ্ত ডলার না পাওয়ায় চলমান মেগা প্রকল্পের ঠিকাদারের বিল পরিশোধও চ্যালেঞ্জ হয়ে পড়েছে।

পরিকল্পনা কমিশনের সূত্র জানায়, জাতীয় নির্বাচন সামনে রেখে বড় তিনটি প্রকল্প–হজরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের তৃতীয় টার্মিনাল, মেট্রোরেলের উত্তরা-মতিঝিল পুরো অংশ, কর্ণফুলী টানেল উদ্বোধনের ব্যাপারে জোর দিচ্ছে সরকার। মেট্রোরেলের উত্তরার দিয়াবাড়ি থেকে আগারগাঁও পর্যন্ত অংশ ইতিমধ্যে চালু হয়েছে।

নির্বাচনের আগেই আগারগাঁও-মতিঝিল পর্যন্ত অংশও উদ্বোধন করতে চায় সরকার। এ জন্য প্রায় ৭০ শতাংশ কাজ হওয়া এমআরটি-৬ প্রকল্পে বরাদ্দ ২ হাজার ৮৮২ কোটি টাকা থেকে বাড়িয়ে ৩ হাজার ৪৯ কোটি টাকা করা হচ্ছে।

তবে মেট্রোরেলের অন্য দুটি প্রকল্পে বরাদ্দ অনেক কমছে। এর মধ্যে প্রথম পাতাল মেট্রোরেল ‘ঢাকা ম্যাস র‍্যাপিড ট্রানজিট ডেভেলপমেন্ট–‘এমআরটি-১’ প্রকল্পে অর্থবছরের শুরুতে বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচিতে (এডিপি) বরাদ্দ ছিল ২ হাজার ২৭৬ কোটি টাকা। আরএডিপি বা সংশোধিত এডিপিতে কমে হচ্ছে ৪৮৩ কোটি টাকা। বিমানবন্দর থেকে কুড়িল-রামপুরা-মালিবাগ-কমলাপুর এবং কুড়িল থেকে কাঞ্চন সেতু পর্যন্ত চলবে এ মেট্রো। এ ছাড়া হেমায়েতপুর-গাবতলী-মিরপুর ১-কচুক্ষেত-গুলশান ২ হয়ে ভাটারা পর্যন্ত এমআরটি-৫ প্রকল্পে মূল এডিপিতে বরাদ্দ ছিল ২ হাজার ৮৮০ কোটি টাকা। আরএডিপিতে তা কমে হচ্ছে ৪০৬ কোটি টাকা।

এদিকে পদ্মা সেতু উদ্বোধনের আট মাস পরও এখনো শেষ হয়নি মূল প্রকল্পের কাজ। ৯৪ শতাংশ কাজ হয়েছে। এ প্রকল্পের এ বছরের বরাদ্দ ২ হাজার ২০২ কোটি টাকা থেকে কমিয়ে ১ হাজার ৪০২ কোটি টাকা করা হচ্ছে। আগামী জুনে শেষ হওয়ার কথা থাকলেও বরাদ্দ কমায় প্রকল্পের মেয়াদ এক বছর বাড়ার ঝুঁকি তৈরি হচ্ছে।project_economy_down

দেশের সবচেয়ে বড় প্রকল্প রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের জন্য মূল এডিপিতে রাখা ছিল ১৩ হাজার ৩৯৫ কোটি টাকা। কমে হচ্ছে ১১ হাজার ১৩৯ কোটি টাকা। এতে বিদেশি অংশ কমেছে সাড়ে ৩ হাজার কোটি টাকা, অন্যদিকে বেড়েছে দেশীয় অংশ। রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে নির্মাণাধীন এ প্রকল্পের কাজের গতিও কমেছে। এ পর্যন্ত কাজ হয়েছে ৫৫ শতাংশ।

ঢাকা-আশুলিয়া এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ের বরাদ্দ ৩ হাজার ৭০২ কোটি টাকা থেকে কমে হচ্ছে ৩ হাজার ৩০০ কোটি টাকা। ৯৫ শতাংশ কাজ শেষ হওয়া ‘কর্ণফুলী নদীর তলদেশে বহুমুখী সড়ক টানেল’ প্রকল্পে বরাদ্দ ২ হাজার কোটি টাকা থেকে কমে ১ হাজার ৭২১ কোটি টাকা হচ্ছে। বরাদ্দ কমলে উদ্বোধনের অপেক্ষায় থাকা প্রকল্পটির গতি কমতে পারে।

প্রায় এক দশক ধরে চলমান চট্টগ্রাম-কক্সবাজার রেলসংযোগ প্রকল্পের বরাদ্দ ১ হাজার ৪৫০ কোটি টাকা থেকে কমে ১ হাজার ২০ কোটি টাকা হচ্ছে। এই প্রকল্পের অগ্রগতি ৮০ শতাংশ। হজরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের উন্নয়ন প্রকল্পের জন্য মূল এডিপিতে বরাদ্দ ছিল ৬ হাজার ১৯ কোটি টাকা। আরএডিপিতে তা কমে হচ্ছে ৪ হাজার ৪৬৯ কোটি টাকা। ৬৫ শতাংশ কাজ সম্পন্ন হওয়া তৃতীয় টার্মিনালের একাংশ আগামী অক্টোবরে উদ্বোধনের আশা করছে সরকার।

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব রেলওয়ে সেতুর জন্য মূল এডিপিতে ছিল ৩ হাজার ৮৫০ কোটি টাকা। আরএডিপিতে তা কমে হচ্ছে ২ হাজার ৬৯৯ কোটি টাকা। পায়রা গভীর সমুদ্রবন্দর প্রকল্পের অগ্রগতি ৭৯ শতাংশ। এর দুই প্রকল্পে বরাদ্দ হচ্ছে ১ হাজার ১৭ কোটি টাকা।

তবে বরাদ্দ বাড়ছে পদ্মা সেতুতে রেল সংযোগ প্রকল্পে। ৫ হাজার ৮০৯ কোটি টাকা থেকে বাড়িয়ে ৫ হাজার ৯০৯ কোটি টাকা করা হচ্ছে। প্রকল্পের অগ্রগতি ৭০ দশমিক ৫০ শতাংশ। একইভাবে মাতারবাড়ী আলট্রা সুপার বিদ্যুৎকেন্দ্র প্রকল্পের বরাদ্দ ৬ হাজার ৮১৫ কোটি টাকা থেকে বাড়িয়ে ৭ হাজার ৭৫৫ কোটি টাকা করা হচ্ছে।

পরিকল্পনা প্রতিমন্ত্রী ড. শামসুল আলম আজকের পত্রিকাকে বলেন, এবারের সংশোধিত এডিপিতে বড় কাটছাঁট হচ্ছে। এর পুরোটাই প্রকল্প সাহায্য অংশ থেকে। মন্ত্রণালয়গুলোর চাহিদার পরিপ্রেক্ষিতেই সংশোধিত এডিপির খসড়া চূড়ান্ত করা হয়েছে। ১ মার্চ এনইসি সভায় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এটি অনুমোদন করবেন। কোথায় কত টাকা যাবে তা এনইসিতেই চূড়ান্ত হবে। এর আগে এর বেশি বলা সম্ভব নয়।

জানতে চাইলে অর্থনীতিবিদ ড. আহসান এইচ মনসুর আজকের পত্রিকাকে বলেন, ‘যে বরাদ্দ কমছে, তার বেশির ভাগই প্রকল্পে বৈদেশিক অংশের টাকা। তা কমায় আমাদের লোকসান হচ্ছে। সংকটের এ সময়ে আমাদের উচিত ছিল বেশি করে বিদেশের টাকা আনা। আমাদের দরকার বিদেশি টাকা ব্যবহার করে দেশি টাকা বাঁচানো। অথচ আমরা উল্টো দিকে যাচ্ছি।’

গতি বাড়ানোর তাগিদ
মেগা প্রকল্পের চ্যালেঞ্জ কাটিয়ে গতি বাড়ানোর তাগিদ দিয়েছে ফাস্টট্র্যাক প্রজেক্ট মনিটরিং টাস্কফোর্স। প্রধানমন্ত্রীর মুখ্যসচিব মো. তোফাজ্জল হোসেন মিয়ার সভাপতিত্বে গত জানুয়ারির শেষ সপ্তাহে টাস্কফোর্সের সবশেষ সভায় এই তাগিদ দেওয়া হয়। সভায় বলা হয়, ডলারের সংকটসহ অন্যান্য সমস্যা দ্রুত সমাধান করতে হবে। পদ্মা সেতু রেল সংযোগ প্রকল্পের ভাঙ্গা-যশোর অংশের কাজের গতি বাড়াতে হবে। এমআরটি-১-এর কনস্ট্রাকশন ইয়ার্ড ও অন্যান্য কাজে নির্ধারিত জমি দ্রুত ডিএমটিসিএলকে বুঝিয়ে দিতে হবে। সভায় পায়রা বন্দরের রাবনাবাদ চ্যানেল ড্রেজিং প্রকল্পে জমি অধিগ্রহণ ত্বরান্বিত করা এবং রামপাল প্রকল্পের বিদ্যুৎ সরবরাহ নিশ্চিত করার বিষয়ে আলোচনা হয়। প্রকল্পের কাজ দ্রুত করতে সিনিয়র সচিব ও সচিবদের প্রকল্প সরেজমিনে পরিদর্শনের অনুরোধ করা হয়।এ ছাড়া সভায় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সভাপতিত্বে ফাস্টট্র্যাক প্রজেক্ট মনিটরিং কমিটির সভা আহ্বান করার কথা বলা হয়। যেখানে প্রকল্পগুলোর অগ্রগতি ও চ্যালেঞ্জ তুলে ধরা হবে।

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
খুঁজুন

সম্পর্কিত