জাবিতে ছাত্রী নিপীড়ন: শিক্ষক জনির বিরুদ্ধে তদন্ত শেষ হয়নি দেড় বছরেও

সৌগত বসু ও বেলাল হোসেন, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় থেকে
প্রকাশ : ০৯ ফেব্রুয়ারি ২০২৪, ১১: ৩৩

জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে নতুন করে আলোচনায় এসেছে এক শিক্ষকের যৌন নিপীড়নের পুরোনো ঘটনা। একটি আবাসিক হলে স্বামীকে বেঁধে রেখে স্ত্রীকে ধর্ষণ করার অভিযোগ ওঠায় পুরোনো ঘটনাটি আলোচনায় এসেছে। পাবলিক হেলথ ও ইনফরমেটিকস বিভাগের শিক্ষক ও বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগের সাবেক সভাপতি মাহমুদুর রহমান জনির বিরুদ্ধে নিজ বিভাগের ছাত্রীকে যৌন নিপীড়নের অভিযোগের তদন্ত শেষ হয়নি দেড় বছরেও।

গত শনিবার রাতের ধর্ষণ ঘটনার পর থেকেই ক্যাম্পাসে নিপীড়নবিরোধী আন্দোলন শুরু হয়। এসব আন্দোলনে বিগত কয়েক বছরের বিচারাধীন ও বিচার না হওয়া বিষয়গুলো নিয়ে সময়ক্ষেপণের অভিযোগ তোলেন আন্দোলনকারীরা।

জানা যায়, ২০২২ সালের নভেম্বর মাসে শিক্ষক জনির সঙ্গে নিয়োগপ্রার্থী এক ছাত্রীর অন্তরঙ্গ ছবি ফাঁস হয়। পরে সে বছরের ৮ ডিসেম্বর জনি বিশ্ববিদ্যালয়ের সহকারী প্রক্টর পদ ত্যাগ করেন। ওই বছরের ১০ ডিসেম্বর তাঁর বিরুদ্ধে একই বিভাগের ৪৩ ব্যাচের এক ছাত্রীকে যৌন নিপীড়ন ও জোর করে গর্ভপাত করানোর অভিযোগে প্রাথমিক তদন্ত শুরু হয়। সেই তদন্তের ফল স্পষ্ট করতে অধিকতর স্পষ্টিকরণ কমিটি করা হয়। স্পষ্টিকরণ কমিটি অভিযোগের প্রাথমিক সত্যতা সম্পর্কে নিশ্চিত হওয়ায় শুরু হয় স্ট্রাকচার্ড কমিটির তদন্ত। এটি শুরু হয়েছে গত বছরের ১০ আগস্ট। আগামী রোববার বেলা আড়াইটায় এই কমিটির ষষ্ঠ সভা হওয়ার কথা। তবে ছয় মাস পার হলেও স্ট্রাকচার্ড কমিটি ভুক্তভোগীর সঙ্গে যোগাযোগ করেনি। তবে জনিকে ডাকা হয়েছে পরবর্তী সভায়। উপাচার্য নূরুল আলম স্ট্রাকচার্ড কমিটির প্রধান।

আন্দোলনকারীদের অভিযোগ, জনির বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা না নিতেই সময়ক্ষেপণ করা হচ্ছে। উপাচার্যের নিয়োগ নিয়ে জনির বিরুদ্ধে আর্থিক লেনদেনেরও অভিযোগ ওঠে কয়েকবার। এ ছাড়া উপাচার্যের কাছে পাঠানো কিছু অডিওতে তাকে অশ্লীল ভাষায় গালাগাল করতেও শোনা যায়; কিন্তু এ নিয়ে কোনো ব্যবস্থা নেয়নি প্রশাসন। জনি তদন্ত প্রক্রিয়া প্রভাবিত করার চেষ্টা করছেন।

ইতিহাস বিভাগের অধ্যাপক ও সিনেট সদস্য গোলাম রব্বানী বলেন, এই যে গড়িমসি করা হচ্ছে, সেটি মূলত জনিকে বাঁচানোর জন্যই। শুধু আন্দোলন হলেই এই তদন্ত গতি পায়। তিনি বলেন, প্রাথমিক কমিটির পর আবার স্পষ্টিকরণ কমিটির প্রতিবেদনের পরই বিচার হয়। কিন্তু এখানে স্ট্রাকচার্ড কমিটি হলেও বিচার হচ্ছে না। আবার কোনো শিক্ষকের বিরুদ্ধে এমন স্ট্রাকচার্ড কমিটি হলে তাঁকে ক্লাস ও পরীক্ষা থেকে অব্যাহতি দেওয়া হয়, সেটিও হয়নি।

তদন্ত কমিটির নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক কয়েকজন সদস্য বলেন, প্রাথমিক তদন্তে যে বিষয়গুলো আসা দরকার ছিল, সেগুলো নিয়ে কাজ করেননি ওই কমিটির সদস্যরা। এরপর স্পষ্টিকরণ কমিটি বানানো হয়েছিল আরও গভীরে যাওয়ার জন্য। সেখানেও ভুক্তভোগীদের সাক্ষাৎকার নেওয়া হয়েছে। এরপরও সেটি তাঁরা পর্যাপ্ত বলে মনে করছেন না।

যদিও স্পষ্টিকরণ কমিটির আহ্বায়ক অধ্যাপক কৌশিক সাহা আজকের পত্রিকাকে বলেন, তাঁরা পাঁচ মাস ধরে এ বিষয়ে তদন্ত করেছেন। এ সময়ের মধ্যে ঘটনার সঙ্গে সম্পর্কিত প্রত্যেক ব্যক্তি ও দলিল পর্যবেক্ষণ করেই প্রতিবেদন জমা দেওয়া হয়েছে। তাতে কিছুই বাদ যায়নি।

স্ট্রাকচার্ড কমিটির একজন সদস্য জানান, কিছু বিষয়ে আরও বিশ্লেষণের জন্য স্ট্রাকচার্ড কমিটি ঘটনায় জড়িত ব্যক্তিদের সাক্ষাৎকার নেবে, যাচাই-বাছাই করবে, সেটি সিন্ডিকেটে জমা দিলে সিন্ডিকেট সিদ্ধান্ত নেবে।

তবে ভুক্তভোগী বলেন, স্ট্রাকচার্ড কমিটি করার পর তাঁর সঙ্গে কোনো যোগাযোগ করা হয়নি। এতে তিনি হতাশ। ন্যায়বিচার ব্যাহত করতেই সময়ক্ষেপণ করা হচ্ছে বলেও তাঁর দাবি। তিনি জানান, স্পষ্টিকরণ কমিটি চার মাসের মধ্যেই কয়েকবার অনলাইনে তাঁর সঙ্গে যোগাযোগ করে। পাশাপাশি দুবার সরাসরি সাক্ষাৎকার নেয়।

অভিযুক্ত শিক্ষক মাহমুদুর রহমান জনি বলেন, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়ানো অপপ্রচারের জন্যই তাঁর বিরুদ্ধে এমন তদন্ত হচ্ছে। এটা তাঁর জন্য মানহানিকর ও বিব্রতকর। তিনি আরও বলেন, গত বছরের ৯ ডিসেম্বরের মধ্যে তাঁকে লিখিত জবাব দিতে বলা হয়েছিল, যা তিনি ৬ ডিসেম্বর দিয়েছেন। আগামী রোববারের সভায় তাঁকে ডাকা হয়েছে।

স্ট্রাকচার্ড কমিটির প্রধান ও উপাচার্য নূরুল আলম তাঁর বিরুদ্ধে আনা সময়ক্ষেপণ ও জনিকে বাঁচানোর অভিযোগ অস্বীকার করেন। তিনি বলেন, ‘জনি আমাকে নিয়োগ দেওয়ার কেউ নন। তাঁর গালাগালকেও আমি গ্রাহ্য করি না। এসব নিয়ে তাঁর বিরুদ্ধে আমার কোনো অভিযোগ নেই।’ তবে তদন্তে দীর্ঘসূত্রতার বিষয়ে তিনি বলেন, উপাচার্যের জন্য ছয় মাস অত্যন্ত সংক্ষিপ্ত। এ পর্যন্ত পাঁচবার তাঁর কমিটি বৈঠক করেছে। সামনে আরও একটি বৈঠক হবে। 
উপাচার্য বলেন, এই তদন্ত জনি প্রভাবিত করতে পারেন বলে মনে না হওয়ায় তাঁকে অব্যাহতি দেওয়া হয়নি। তিনি বলেন, তদন্তের স্বার্থে তাঁরা সব বিষয় মাথায় রেখে কাজ করছেন, তাই এটাকে সময়ক্ষেপণ বলার সুযোগ নেই।

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
খুঁজুন

সম্পর্কিত