সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী
করোনা ভয়ংকর ভাইরাস। কিন্তু তার কোপানলের পড়ে অন্য অসুখগুলোর যে উপশম ঘটেছে তা তো নয়। বিশেষভাবে বেড়েছে মানসিক বিকার। জাতীয় দৈনিকে বিশেষজ্ঞদের পরামর্শের কলাম থাকে। তাতে খুলনার ফুলতলা থেকে একজন লিখেছেন: ‘করোনার পর থেকে আমার ভাবনার জগৎ এলোমেলো। মা-বাবাকে নিয়েও ভেবেছি।
খুবই স্বার্থপর চিন্তাভাবনা মাথায় আসে। মনে হয়, কেন আমি তাঁদের ভালোবাসব। আমি বেঁচে থাকলেই তো হলো। বিদেশে গিয়ে নিজের মতো করে সুন্দর জীবনযাপন করব।
বিয়ের সন্ধানে জড়াতেও ইচ্ছা করে না। আবার মাঝেমধ্যে মনে হয়, শরীরেরও তো চাহিদা থাকে। আসলে আমি হঠাৎ করে নিজেকে গুটিয়ে ফেলেছি। কারও সঙ্গে মিশতে ভালো লাগে না। আগে অনেক আড্ডা দিতাম। এমন নয় যে প্রেমে ব্যর্থ হয়েছি বা বড় দুঃখ পেয়েছি। এমনিতেই মনে হয়, এসব করে কী লাভ। আমার কি চিকিৎসকের কাছে যাওয়া উচিত? নাকি অলস বসে থেকে এসব ভাবছি?’ এ রকম সমস্যা এখন বহু তরুণের। মূল সমস্যাটা হলো, কাজ নেই। সৃষ্টিশীল কাজের অভাব। সে কাজ একক হতে পারে, যৌথ হলেই ভালো। কাজ না থাকলে আলস্য জাপটে ধরে, ঠেলে দেয় হতাশার দিকে, প্রলুব্ধ করে মাদক সেবনে। মাদকের ব্যাপকতার পেছনে কেবল যে মাদকের সহজলভ্যতা কাজ করে তা তো নয়, হতাশাও সক্রিয় থাকে। গত বছরের বিভিন্ন সময় থেকে কয়েকটি চিত্র তুলে ধরব।
আমরা জানি যে পুলিশের হাতে এখন অঢেল ক্ষমতা। পুলিশের হাতে তো অবশ্যই, নকল পুলিশের হাতেও। যে জন্য দেখা গেছে ডাকাতেরাও পুলিশ সেজে, পুলিশের ইউনিফর্ম পরে ডাকাতিতে নেমেছে। কাগজে পড়লাম, ওই কাজ করতে গিয়ে ছয়জন ডাকাত ধরা পড়েছে। পুলিশের হাতে ধরা পড়ার আগে, জনতার হাতেই ধরা পড়ে গেছে। তবে পুলিশ বাহিনীর সদস্যদের মধ্যেও হতাশা দেখা দিয়েছে বলে একটি দৈনিক পত্রিকা খবর দিচ্ছে। আত্মহত্যা পর্যন্ত ঘটছে। আত্মহত্যা অন্য কারণেও ঘটেছে, সেটা আমরা লক্ষ করেছি; কিন্তু দৈনিকটির অনুসন্ধানী প্রতিবেদন যা জানাচ্ছে তা হলো, মানসিক অবসাদের কারণে গত চার মাসে পুলিশ বাহিনীর চারজন সদস্য আত্মহত্যা করেছেন। মানসিক অবসাদের পেছনে কাজ করেছে ঊর্ধ্বতনদের দুর্ব্যবহার, পদায়নে জটিলতা এবং অত্যধিক ডিউটি। (আজকের পত্রিকা, ২৭. ০৯.২১)
ছেলেরা ঘর ছেড়ে চলে যায়, কোথায় যায় জানা যায় না। কিন্তু এখন শুনছি মেয়েরাও যাচ্ছে পালিয়ে। ঢাকার মিরপুর এলাকা থেকে ৪৩৪ জন কিশোরী উধাও হয়ে গিয়েছিল বলে ৭টি থানায় করা জিডির তালিকা থেকে জানা যাচ্ছে। ২৫০ জনকে উদ্ধার করা গেছে, বাকিদের খোঁজ চলছে (কালের কণ্ঠ, ২৭. ১১.২১)। কিন্তু কেন ঘর ছাড়ল? ঘরে শান্তি নেই, সুখ নেই, জীবন একঘেয়ে, বাবা-মা ঝগড়া করে, বাবা-মায়ের সঙ্গে অভিমান–এসব কারণ আছে। কিন্তু আরও একটা কারণ রয়েছে সেটি হলো, মুক্তির হাতছানি।
তিনজন কিশোরী ফেসবুকে নিজেদের মধ্যে যোগাযোগ করেছে, বাড়ি থেকে টাকাপয়সা, অলংকার গুছিয়ে নিয়েছে, যাবে জাপানে, নাকি যাওয়ার জন্য পথ ও লোকের সন্ধান পেয়েছে ফেসবুকেই। জাপানের কথাই শোনা গেছে, সেখানে হয়তো নতুন সম্ভাবনা।
এসব খবর সংবাদপত্রে পাওয়া যায়। সংবাদপত্রে সুসংবাদ কম, দুঃসংবাদই অধিক। যেমন একটি সংবাদপত্রের এক দিনের দশটি খবর: ১. কক্সবাজারে ‘অতিরিক্ত মদ্যপানে’ মারা গেলেন ছাত্রলীগ নেতা, ২. মিরসরাইয়ে কাভার্ড ভ্যানের ধাক্কায় দুই মোটরসাইকেল আরোহী নিহত, ৩. সাতক্ষীরায় বিদ্যুৎস্পৃষ্টে তিন যুবকের মৃত্যু, ৪. বরিশালে মোটরসাইকেলে বেড়াতে এসে তিন বন্ধুর মৃত্যু, ৫. গাজীপুরে অটোরিকশাচালক হত্যা, ৬. কক্সবাজার সৈকতে মিলল অজ্ঞাত ২ যুবকের লাশ, ৭. মিরপুরে ড্রামে যুবকের লাশ, ৮. সেপ্টেম্বরে ডেঙ্গুতে মৃত্যু ১১, ৯. নোয়াখালীতে পল্লী বিদ্যুতের তার ছিঁড়ে পানিতে ৪ জনের মৃত্যু, ১০. কোভিডে মৃত্যু ৩৮ জনের (ইত্তেফাক, ২৮.০৯.২১)।
আরেক দিনের খবর রাজধানীরই একটি এলাকায় স্ত্রীর প্রহারে স্বামীর মৃত্যু। ঘটনাটা এ রকমের। করোনার সময়ে স্বামী বেকার হয়ে গেছে। তিন মাসের বাড়িভাড়া বাকি।
বাড়িওয়ালা তাগাদা দেয়, উঠে যেতে বলে। স্বামী বাইরে থাকে, স্ত্রীকে অপমান সহ্য করতে হয়, তা নিয়ে স্বামী-স্ত্রীতে কলহ। একপর্যায়ে স্বামী প্রহার করেন স্ত্রীকে। জবাবে স্ত্রী ছেলের ব্যাডমিন্টনের ভাঙা র্যাকেট দিয়ে মাথায় মারেন স্বামীর। তাতে স্বামীর মৃত্যু ঘটে।
মৃত্যু এমনভাবে সর্বক্ষেত্রে ঘটে না ঠিকই, কিন্তু কলহ বাড়ছেই। পাশাপাশি বাড়ছে ধর্ষণও। সর্বত্রই দ্বন্দ্ব ক্ষমতা নিয়ে। যার ক্ষমতা বেশি বা হঠাৎ যে ক্ষমতাবান হয়ে ওঠে, জয় তারই। কিন্তু পরাজয় তো ঘটছে মনুষ্যত্বের। অসুখ ব্যাপারটার মানে যে কেবল সুখের অভাব তা তো নয়, অসুখ মানে পীড়াও।
এই পীড়ার খবর শুধু সংবাদপত্রে থাকবে কেন, সাহিত্যেও সরাসরি চলে এসেছে। তবে সাহিত্য এখন আর আগের মতো মূল্যবান নয়; কারণ তার বাজারদর পড়ে গেছে।
দৈনিক পত্রিকার সাহিত্য পাতা একসময়ে সাহিত্যচর্চার জন্য ভালো একটা জায়গা ছিল; ওই পাতা এখন নিজেকে গুটিয়ে এনেছে। বিজ্ঞাপনের চাপে ক্ষীণ হয়ে গেছে তার তনু এবং এটা তো জানি পত্রিকার জন্য বিজ্ঞাপন জিনিসটা যত জরুরি, অন্য কোনো কিছু তত নয়। আর ওই ক্ষীণ তনু সাহিত্যের পাতাতেও অন্য খবর ছাপিয়ে পাওয়া যায় পীড়ার খবরই; যেমন একটি দৈনিকের এক শুক্রবারের সাহিত্য পাতায় তিনটি লেখা। একটি লেখার নামই হচ্ছে ‘পতন’। ভয়ংকর পতনে পতিত তিন যুবক, তাদের কথা আছে; এ ধরনের পতনে নারীসঙ্গী থাকাটা বাধ্যতামূলক, তা-ও আছে বিবরণে। ওই পাতাতেই দুটি কবিতা রয়েছে। পাশাপাশি একটিতে কবি বলছেন, তিনি দেখছেন তাঁর মেরুদণ্ডটি ভেঙে গেছে। সেটা আসলে সমাজেরই মেরুদণ্ড, কবি জানেন। সেটাই তিনি জানাচ্ছেন। অন্য কবিতাটিতে রয়েছে এই দুঃসংবাদ যে মাটি এখন জ্বরে পড়েছে, সে কাঁপছে।
লেখাগুলো সমমাপের নয়, পার্থক্য আছে সাহিত্যগুণে; কিন্তু তাদের খবর ওই একই। পৃথিবী এখন ভীষণ পীড়িত। পীড়া অবশ্য আগেও ছিল। ২০০ বছর হবে, ইংরেজ কবি কিটস মানুষের সর্বজনীন ব্যাধির কথা লিখে রেখে গেছেন। সেই ব্যাধির নাম মৃত্যু। মৃত্যু অনিবার্য, কিন্তু তার আগেই মানুষ অসুখে পড়ে, রোগে ভোগে, কবি নিজেও আক্রান্ত হয়েছিলেন তখনকার দিনের রাজব্যাধি ক্ষয়রোগে, জীবিত ছিলেন মাত্র ২৬ বছর। তিনি লিখেছেন, অসহায় মানুষ কে কাকে অভয় দেবে, প্রত্যেকেই তো কাতর হয়ে রয়েছে যন্ত্রণায় এবং যন্ত্রণার প্রলম্বিত ধ্বনিই শুনছে তারা একে অপরের। তিনি ভাবতেন মুক্তি পাবেন শিল্পের জগতে গিয়ে, অথবা প্রকৃতির সঙ্গে একাত্ম হয়ে। কিন্তু সেটা তো পলায়ন; প্রতিরোধ নয়। আর যে রোগ ব্যক্তিগত নয়, সামাজিক বটে, তার ক্ষেত্রে তো পলায়নের কোনো উপায়ই নেই।
আমাদের পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোয় ছাত্র সংসদ নেই, নির্বাচন হয় না, শিক্ষার্থীরা সুস্থ সাংস্কৃতিক, সামাজিক ও রাজনৈতিক বিকাশের এবং নেতৃত্বদানে প্রস্তুতির সুযোগ থেকে বঞ্চিত থাকে। তাই বলে দলীয় আধিপত্য যে নেই, সেটা মোটেই সত্য নয়। সরকার-সমর্থক ছাত্রসংগঠন সেখানে দুই ধরনের কাজ করে থাকে। একটা হচ্ছে ভিন্নমত দমন; অন্যটা হলো আধিপত্যের সুফল লাভ। প্রথমটির চরম দৃষ্টান্ত বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের আবাসিক হলে আবরার হত্যার ঘটনা। দ্বিতীয়টির, অর্থাৎ আধিপত্যের সুফল লাভের সুন্দর ও পরিচ্ছন্ন একটি খবর পাওয়া গেল (আজকের পত্রিকা, ২৮. ১০.২১), যাতে বলা হচ্ছে, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি ছাত্রাবাসে সিট বিক্রি করেছে ছাত্রলীগের নেতারা। ছাত্রাবাসে সিট খালি হলে নিয়ম অনুযায়ী প্রশাসন সিট বণ্টন করে থাকে; কিন্তু সেই বণ্টন কার্যকর হয় না। কারণ, সিট পেয়েছে যে ছাত্র, সে ঢুকতে পারে না। তার জায়গায় সিট যে কিনেছে তার বসবাসের অধিকার প্রতিষ্ঠা পায়। ব্যবস্থাটা বেশ পুঁজিবাদী এবং সে কারণে অন্যত্র প্রচলিত সামন্তবাদী গণরুমব্যবস্থার তুলনায় উন্নত। গণরুমে গাদাগাদি করে কোনো মতে থাকা যায়, কিন্তু নেতারা এলে লাফিয়ে উঠে সালাম দিতে হয় এবং মিটিং-মিছিলে স্লোগান দিতে দিতে নিয়মিত শামিল হওয়া কর্তব্যের মধ্যে থাকে। গতর খাটা ওই ব্যবস্থা তুলনায় নগদ মূল্যে ক্রয় ব্যবস্থাটা মানবিকও বটে।
তবে সামন্তবাদও কম নাছোড়বান্দা নয়। অর্থনীতি থেকে বিদায় নিলেও সংস্কৃতির আশ্রয় ছাড়তে চায় না। সে জন্য আধিপত্য, ক্ষমতা ও চাঁদা তোলা পরস্পর নির্ভরশীল অবস্থায় রয়ে যায়। এসব নিয়ে নিজেদের মধ্যেও লড়াই চলে। কিছুদিন আগে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজে সরকার-সমর্থক ছাত্রদেরই দুই পক্ষ ভীষণ রকমের মারামারি করেছে, তাতে একজন ছাত্রের মাথার খুলি ফেটে গেছে। চিকিৎসকদের দক্ষ চিকিৎসা ও যত্নে ছেলেটি শেষ পর্যন্ত জীবনীশক্তি ফিরে পেয়েছে, নইলে শেষ হয়ে যাওয়ার কথা ছিল। এ ঘটনার পেছনে যে শুধু মেডিকেল কলেজের ছাত্রলীগের দুই পক্ষ জড়িত তা নয়, জানা যাচ্ছে নগর আওয়ামী লীগের দুই প্রতিদ্বন্দ্বী ধারাও অঙ্গাঙ্গি জড়িয়ে ছিল।
কলেজ যথারীতি বন্ধ হয়ে গিয়েছিল; খোলার জন্য প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ হিসেবে ৩১ জনকে বহিষ্কার করেছে কর্তৃপক্ষ। কিন্তু তা নিয়েও বিরোধ বেধেছে ছাত্রলীগের দুই পক্ষের। একপক্ষ বলছে অপর পক্ষের বেশি দোষ, অথচ তারা শাস্তি পেয়েছে কম। বিপাকে পড়েছে কলেজ কর্তৃপক্ষ। টের পাচ্ছে তারা যে ন্যায়বিচার নিশ্চিত করাটা কত কঠিন।
তবে প্রতিরোধ রয়েছে। সে প্রতিরোধ সামাজিক বিপ্লবের, যে বিপ্লব কোথাও কোথাও হয়েছে, কিন্তু স্থায়ী হতে পারেনি; যে বিপ্লবের জন্য সারা পৃথিবী এখন অপেক্ষা করছে; থরথর করে কাঁপছে প্রতীক্ষায়।
সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী: ইমেরিটাস অধ্যাপক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
করোনা ভয়ংকর ভাইরাস। কিন্তু তার কোপানলের পড়ে অন্য অসুখগুলোর যে উপশম ঘটেছে তা তো নয়। বিশেষভাবে বেড়েছে মানসিক বিকার। জাতীয় দৈনিকে বিশেষজ্ঞদের পরামর্শের কলাম থাকে। তাতে খুলনার ফুলতলা থেকে একজন লিখেছেন: ‘করোনার পর থেকে আমার ভাবনার জগৎ এলোমেলো। মা-বাবাকে নিয়েও ভেবেছি।
খুবই স্বার্থপর চিন্তাভাবনা মাথায় আসে। মনে হয়, কেন আমি তাঁদের ভালোবাসব। আমি বেঁচে থাকলেই তো হলো। বিদেশে গিয়ে নিজের মতো করে সুন্দর জীবনযাপন করব।
বিয়ের সন্ধানে জড়াতেও ইচ্ছা করে না। আবার মাঝেমধ্যে মনে হয়, শরীরেরও তো চাহিদা থাকে। আসলে আমি হঠাৎ করে নিজেকে গুটিয়ে ফেলেছি। কারও সঙ্গে মিশতে ভালো লাগে না। আগে অনেক আড্ডা দিতাম। এমন নয় যে প্রেমে ব্যর্থ হয়েছি বা বড় দুঃখ পেয়েছি। এমনিতেই মনে হয়, এসব করে কী লাভ। আমার কি চিকিৎসকের কাছে যাওয়া উচিত? নাকি অলস বসে থেকে এসব ভাবছি?’ এ রকম সমস্যা এখন বহু তরুণের। মূল সমস্যাটা হলো, কাজ নেই। সৃষ্টিশীল কাজের অভাব। সে কাজ একক হতে পারে, যৌথ হলেই ভালো। কাজ না থাকলে আলস্য জাপটে ধরে, ঠেলে দেয় হতাশার দিকে, প্রলুব্ধ করে মাদক সেবনে। মাদকের ব্যাপকতার পেছনে কেবল যে মাদকের সহজলভ্যতা কাজ করে তা তো নয়, হতাশাও সক্রিয় থাকে। গত বছরের বিভিন্ন সময় থেকে কয়েকটি চিত্র তুলে ধরব।
আমরা জানি যে পুলিশের হাতে এখন অঢেল ক্ষমতা। পুলিশের হাতে তো অবশ্যই, নকল পুলিশের হাতেও। যে জন্য দেখা গেছে ডাকাতেরাও পুলিশ সেজে, পুলিশের ইউনিফর্ম পরে ডাকাতিতে নেমেছে। কাগজে পড়লাম, ওই কাজ করতে গিয়ে ছয়জন ডাকাত ধরা পড়েছে। পুলিশের হাতে ধরা পড়ার আগে, জনতার হাতেই ধরা পড়ে গেছে। তবে পুলিশ বাহিনীর সদস্যদের মধ্যেও হতাশা দেখা দিয়েছে বলে একটি দৈনিক পত্রিকা খবর দিচ্ছে। আত্মহত্যা পর্যন্ত ঘটছে। আত্মহত্যা অন্য কারণেও ঘটেছে, সেটা আমরা লক্ষ করেছি; কিন্তু দৈনিকটির অনুসন্ধানী প্রতিবেদন যা জানাচ্ছে তা হলো, মানসিক অবসাদের কারণে গত চার মাসে পুলিশ বাহিনীর চারজন সদস্য আত্মহত্যা করেছেন। মানসিক অবসাদের পেছনে কাজ করেছে ঊর্ধ্বতনদের দুর্ব্যবহার, পদায়নে জটিলতা এবং অত্যধিক ডিউটি। (আজকের পত্রিকা, ২৭. ০৯.২১)
ছেলেরা ঘর ছেড়ে চলে যায়, কোথায় যায় জানা যায় না। কিন্তু এখন শুনছি মেয়েরাও যাচ্ছে পালিয়ে। ঢাকার মিরপুর এলাকা থেকে ৪৩৪ জন কিশোরী উধাও হয়ে গিয়েছিল বলে ৭টি থানায় করা জিডির তালিকা থেকে জানা যাচ্ছে। ২৫০ জনকে উদ্ধার করা গেছে, বাকিদের খোঁজ চলছে (কালের কণ্ঠ, ২৭. ১১.২১)। কিন্তু কেন ঘর ছাড়ল? ঘরে শান্তি নেই, সুখ নেই, জীবন একঘেয়ে, বাবা-মা ঝগড়া করে, বাবা-মায়ের সঙ্গে অভিমান–এসব কারণ আছে। কিন্তু আরও একটা কারণ রয়েছে সেটি হলো, মুক্তির হাতছানি।
তিনজন কিশোরী ফেসবুকে নিজেদের মধ্যে যোগাযোগ করেছে, বাড়ি থেকে টাকাপয়সা, অলংকার গুছিয়ে নিয়েছে, যাবে জাপানে, নাকি যাওয়ার জন্য পথ ও লোকের সন্ধান পেয়েছে ফেসবুকেই। জাপানের কথাই শোনা গেছে, সেখানে হয়তো নতুন সম্ভাবনা।
এসব খবর সংবাদপত্রে পাওয়া যায়। সংবাদপত্রে সুসংবাদ কম, দুঃসংবাদই অধিক। যেমন একটি সংবাদপত্রের এক দিনের দশটি খবর: ১. কক্সবাজারে ‘অতিরিক্ত মদ্যপানে’ মারা গেলেন ছাত্রলীগ নেতা, ২. মিরসরাইয়ে কাভার্ড ভ্যানের ধাক্কায় দুই মোটরসাইকেল আরোহী নিহত, ৩. সাতক্ষীরায় বিদ্যুৎস্পৃষ্টে তিন যুবকের মৃত্যু, ৪. বরিশালে মোটরসাইকেলে বেড়াতে এসে তিন বন্ধুর মৃত্যু, ৫. গাজীপুরে অটোরিকশাচালক হত্যা, ৬. কক্সবাজার সৈকতে মিলল অজ্ঞাত ২ যুবকের লাশ, ৭. মিরপুরে ড্রামে যুবকের লাশ, ৮. সেপ্টেম্বরে ডেঙ্গুতে মৃত্যু ১১, ৯. নোয়াখালীতে পল্লী বিদ্যুতের তার ছিঁড়ে পানিতে ৪ জনের মৃত্যু, ১০. কোভিডে মৃত্যু ৩৮ জনের (ইত্তেফাক, ২৮.০৯.২১)।
আরেক দিনের খবর রাজধানীরই একটি এলাকায় স্ত্রীর প্রহারে স্বামীর মৃত্যু। ঘটনাটা এ রকমের। করোনার সময়ে স্বামী বেকার হয়ে গেছে। তিন মাসের বাড়িভাড়া বাকি।
বাড়িওয়ালা তাগাদা দেয়, উঠে যেতে বলে। স্বামী বাইরে থাকে, স্ত্রীকে অপমান সহ্য করতে হয়, তা নিয়ে স্বামী-স্ত্রীতে কলহ। একপর্যায়ে স্বামী প্রহার করেন স্ত্রীকে। জবাবে স্ত্রী ছেলের ব্যাডমিন্টনের ভাঙা র্যাকেট দিয়ে মাথায় মারেন স্বামীর। তাতে স্বামীর মৃত্যু ঘটে।
মৃত্যু এমনভাবে সর্বক্ষেত্রে ঘটে না ঠিকই, কিন্তু কলহ বাড়ছেই। পাশাপাশি বাড়ছে ধর্ষণও। সর্বত্রই দ্বন্দ্ব ক্ষমতা নিয়ে। যার ক্ষমতা বেশি বা হঠাৎ যে ক্ষমতাবান হয়ে ওঠে, জয় তারই। কিন্তু পরাজয় তো ঘটছে মনুষ্যত্বের। অসুখ ব্যাপারটার মানে যে কেবল সুখের অভাব তা তো নয়, অসুখ মানে পীড়াও।
এই পীড়ার খবর শুধু সংবাদপত্রে থাকবে কেন, সাহিত্যেও সরাসরি চলে এসেছে। তবে সাহিত্য এখন আর আগের মতো মূল্যবান নয়; কারণ তার বাজারদর পড়ে গেছে।
দৈনিক পত্রিকার সাহিত্য পাতা একসময়ে সাহিত্যচর্চার জন্য ভালো একটা জায়গা ছিল; ওই পাতা এখন নিজেকে গুটিয়ে এনেছে। বিজ্ঞাপনের চাপে ক্ষীণ হয়ে গেছে তার তনু এবং এটা তো জানি পত্রিকার জন্য বিজ্ঞাপন জিনিসটা যত জরুরি, অন্য কোনো কিছু তত নয়। আর ওই ক্ষীণ তনু সাহিত্যের পাতাতেও অন্য খবর ছাপিয়ে পাওয়া যায় পীড়ার খবরই; যেমন একটি দৈনিকের এক শুক্রবারের সাহিত্য পাতায় তিনটি লেখা। একটি লেখার নামই হচ্ছে ‘পতন’। ভয়ংকর পতনে পতিত তিন যুবক, তাদের কথা আছে; এ ধরনের পতনে নারীসঙ্গী থাকাটা বাধ্যতামূলক, তা-ও আছে বিবরণে। ওই পাতাতেই দুটি কবিতা রয়েছে। পাশাপাশি একটিতে কবি বলছেন, তিনি দেখছেন তাঁর মেরুদণ্ডটি ভেঙে গেছে। সেটা আসলে সমাজেরই মেরুদণ্ড, কবি জানেন। সেটাই তিনি জানাচ্ছেন। অন্য কবিতাটিতে রয়েছে এই দুঃসংবাদ যে মাটি এখন জ্বরে পড়েছে, সে কাঁপছে।
লেখাগুলো সমমাপের নয়, পার্থক্য আছে সাহিত্যগুণে; কিন্তু তাদের খবর ওই একই। পৃথিবী এখন ভীষণ পীড়িত। পীড়া অবশ্য আগেও ছিল। ২০০ বছর হবে, ইংরেজ কবি কিটস মানুষের সর্বজনীন ব্যাধির কথা লিখে রেখে গেছেন। সেই ব্যাধির নাম মৃত্যু। মৃত্যু অনিবার্য, কিন্তু তার আগেই মানুষ অসুখে পড়ে, রোগে ভোগে, কবি নিজেও আক্রান্ত হয়েছিলেন তখনকার দিনের রাজব্যাধি ক্ষয়রোগে, জীবিত ছিলেন মাত্র ২৬ বছর। তিনি লিখেছেন, অসহায় মানুষ কে কাকে অভয় দেবে, প্রত্যেকেই তো কাতর হয়ে রয়েছে যন্ত্রণায় এবং যন্ত্রণার প্রলম্বিত ধ্বনিই শুনছে তারা একে অপরের। তিনি ভাবতেন মুক্তি পাবেন শিল্পের জগতে গিয়ে, অথবা প্রকৃতির সঙ্গে একাত্ম হয়ে। কিন্তু সেটা তো পলায়ন; প্রতিরোধ নয়। আর যে রোগ ব্যক্তিগত নয়, সামাজিক বটে, তার ক্ষেত্রে তো পলায়নের কোনো উপায়ই নেই।
আমাদের পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোয় ছাত্র সংসদ নেই, নির্বাচন হয় না, শিক্ষার্থীরা সুস্থ সাংস্কৃতিক, সামাজিক ও রাজনৈতিক বিকাশের এবং নেতৃত্বদানে প্রস্তুতির সুযোগ থেকে বঞ্চিত থাকে। তাই বলে দলীয় আধিপত্য যে নেই, সেটা মোটেই সত্য নয়। সরকার-সমর্থক ছাত্রসংগঠন সেখানে দুই ধরনের কাজ করে থাকে। একটা হচ্ছে ভিন্নমত দমন; অন্যটা হলো আধিপত্যের সুফল লাভ। প্রথমটির চরম দৃষ্টান্ত বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের আবাসিক হলে আবরার হত্যার ঘটনা। দ্বিতীয়টির, অর্থাৎ আধিপত্যের সুফল লাভের সুন্দর ও পরিচ্ছন্ন একটি খবর পাওয়া গেল (আজকের পত্রিকা, ২৮. ১০.২১), যাতে বলা হচ্ছে, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি ছাত্রাবাসে সিট বিক্রি করেছে ছাত্রলীগের নেতারা। ছাত্রাবাসে সিট খালি হলে নিয়ম অনুযায়ী প্রশাসন সিট বণ্টন করে থাকে; কিন্তু সেই বণ্টন কার্যকর হয় না। কারণ, সিট পেয়েছে যে ছাত্র, সে ঢুকতে পারে না। তার জায়গায় সিট যে কিনেছে তার বসবাসের অধিকার প্রতিষ্ঠা পায়। ব্যবস্থাটা বেশ পুঁজিবাদী এবং সে কারণে অন্যত্র প্রচলিত সামন্তবাদী গণরুমব্যবস্থার তুলনায় উন্নত। গণরুমে গাদাগাদি করে কোনো মতে থাকা যায়, কিন্তু নেতারা এলে লাফিয়ে উঠে সালাম দিতে হয় এবং মিটিং-মিছিলে স্লোগান দিতে দিতে নিয়মিত শামিল হওয়া কর্তব্যের মধ্যে থাকে। গতর খাটা ওই ব্যবস্থা তুলনায় নগদ মূল্যে ক্রয় ব্যবস্থাটা মানবিকও বটে।
তবে সামন্তবাদও কম নাছোড়বান্দা নয়। অর্থনীতি থেকে বিদায় নিলেও সংস্কৃতির আশ্রয় ছাড়তে চায় না। সে জন্য আধিপত্য, ক্ষমতা ও চাঁদা তোলা পরস্পর নির্ভরশীল অবস্থায় রয়ে যায়। এসব নিয়ে নিজেদের মধ্যেও লড়াই চলে। কিছুদিন আগে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজে সরকার-সমর্থক ছাত্রদেরই দুই পক্ষ ভীষণ রকমের মারামারি করেছে, তাতে একজন ছাত্রের মাথার খুলি ফেটে গেছে। চিকিৎসকদের দক্ষ চিকিৎসা ও যত্নে ছেলেটি শেষ পর্যন্ত জীবনীশক্তি ফিরে পেয়েছে, নইলে শেষ হয়ে যাওয়ার কথা ছিল। এ ঘটনার পেছনে যে শুধু মেডিকেল কলেজের ছাত্রলীগের দুই পক্ষ জড়িত তা নয়, জানা যাচ্ছে নগর আওয়ামী লীগের দুই প্রতিদ্বন্দ্বী ধারাও অঙ্গাঙ্গি জড়িয়ে ছিল।
কলেজ যথারীতি বন্ধ হয়ে গিয়েছিল; খোলার জন্য প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ হিসেবে ৩১ জনকে বহিষ্কার করেছে কর্তৃপক্ষ। কিন্তু তা নিয়েও বিরোধ বেধেছে ছাত্রলীগের দুই পক্ষের। একপক্ষ বলছে অপর পক্ষের বেশি দোষ, অথচ তারা শাস্তি পেয়েছে কম। বিপাকে পড়েছে কলেজ কর্তৃপক্ষ। টের পাচ্ছে তারা যে ন্যায়বিচার নিশ্চিত করাটা কত কঠিন।
তবে প্রতিরোধ রয়েছে। সে প্রতিরোধ সামাজিক বিপ্লবের, যে বিপ্লব কোথাও কোথাও হয়েছে, কিন্তু স্থায়ী হতে পারেনি; যে বিপ্লবের জন্য সারা পৃথিবী এখন অপেক্ষা করছে; থরথর করে কাঁপছে প্রতীক্ষায়।
সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী: ইমেরিটাস অধ্যাপক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
পর্দার নায়িকারা নিজেদের বয়স আড়ালে রাখা পছন্দ করেন। এ ক্ষেত্রে ব্যতিক্রম আজমেরী হক বাঁধন। প্রতিবছর নিজের জন্মদিনে জানান দেন তাঁর বয়স। গতকাল ছিল বাঁধনের ৪১তম জন্মদিন। সোশ্যাল মিডিয়ায় নিজেই জানালেন এই তথ্য।
২ দিন আগে১০ বছরের বেশি সময় ধরে শোবিজে কাজ করছেন অভিনেত্রী শবনম ফারিয়া। নাটকের পাশাপাশি ওটিটিতে দেখা গেছে তাঁকে। সরকারি অনুদানের ‘দেবী’ নামের একটি সিনেমায়ও অভিনয় করেছেন। প্রশংসিত হলেও সিনেমায় আর দেখা মেলেনি তাঁর। ছোট পর্দাতেও অনেক দিন ধরে অনিয়মিত তিনি। এবার শবনম ফারিয়া হাজির হচ্ছেন নতুন পরিচয়ে। কমেডি রিয়েলিটি
২ দিন আগেআমাদের লোকসংস্কৃতির অন্যতম ঐতিহ্য যাত্রাপালা। গণমানুষের সংস্কৃতি হিসেবে বিবেচিত এই যাত্রাপালা নিয়ে শিল্পকলা একাডেমি আয়োজন করছে ‘যাত্রা উৎসব-২০২৪’। আগামী ১ নভেম্বর সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের মুক্তমঞ্চে শুরু হবে ৭ দিনব্যাপী এই উৎসব।
২ দিন আগে‘বঙ্গবন্ধু’ পদবি বিলীন হবে না। হতে পারে না। যেমনটি ‘দেশবন্ধু’ চিত্তরঞ্জন দাশের পদবি বিলীন হয়নি। ইতিহাসে এসব পদবি অম্লান ও অক্ষয়। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ব্যক্তিত্ব ছিল অনন্যসাধারণ। আপনজনকে তো অবশ্যই, শত্রুপক্ষের লোকেরাও ব্যক্তিগত পর্যায়ে তাঁর প্রতি আকৃষ্ট হতেন। পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর উচ্চপদের
২ দিন আগে