Ajker Patrika

প্রবীণের মৃত্যুচিন্তা

হাসান আলী
প্রবীণের মৃত্যুচিন্তা

প্রবীণেরা বুঝতে পারেন, পৃথিবী ছেড়ে যাওয়ার সময় ঘনিয়ে আসছে। সমবয়সী বন্ধুবান্ধব, আত্মীয়স্বজনের মৃত্যুর খবর মনকে নাড়া দেয়।

মনে মনে অনেকেই মৃত্যুর জন্য প্রস্তুতি নিতে থাকেন। এ সময় জীবনের হিসাব-নিকাশ মেলানোর চেষ্টা করেন। প্রাপ্তি-অপ্রাপ্তির বিষয়গুলো চোখের সামনে চলে আসে। মান-অভিমান, ক্ষোভ-বিক্ষোভ চিন্তার আকাশকে মেঘাচ্ছন্ন করে দেয়। ব্যক্তিবিশেষের প্রতি ভালো লাগা, মন্দ লাগাকে কেন্দ্র করে পারিবারিক মতভিন্নতা চলে আসে। কেউ কেউ মৃত্যুর আগেই জমিজমা, সহায়সম্পদ সন্তানদের মধ্যে বণ্টন করে দেন। সামাজিক কাজকর্মের ওপর অনেক বেশি গুরুত্ব দেন। কোনো স্থাপনা নির্মাণে আগ্রহী হয়ে ওঠেন। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, দাতব্য প্রতিষ্ঠান, হাসপাতাল গড়ে তোলার কাজে নিজেকে যুক্ত করেন কিংবা আর্থিক সহায়তা দেন। যাঁদের সহায়সম্পদ নেই, সমাজ এবং পরিবারকে দেওয়ার মতো কিছু নেই, তাঁরা মৃত্যুর বিষয়কে সাধারণ আসা-যাওয়ার মধ্যেই ফেলেন। কেউ কেউ ঠাট্টার ছলে বলেন, গরিবের মৃত্যু কিছুক্ষণ চোখ বন্ধ করে থাকা। গরিব মানুষ আমৃত্যু বেঁচে থাকার জন্য লড়াই-সংগ্রাম করেছেন। জীবনে স্বস্তি-শান্তি জোটেনি, প্রবীণ বয়সে অশান্তি, অস্বস্তিতে মৃত্যু হবে—এটা মেনে নিয়েছেন।

পৃথিবীতে আসা যেমন সম্মান ও মর্যাদার, তেমনি পৃথিবী থেকে বিদায় নেওয়াও সম্মান-মর্যাদার হওয়া উচিত। প্রবীণ বয়সে মৃত্যু শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নয়, 
জীবনের শেষ অধ্যায়ের পরিসমাপ্তি খুবই স্বাভাবিক একটা বিষয়।

৩০-৩৫ বছর চাকরি শেষে যেমন কর্মস্থল থেকে বিদায় নেওয়া হয়, তেমনি ৭৫-৮০ বছর বয়সে পৃথিবী থেকে বিদায় নেন। কেউ আরও কম বয়সে কিংবা আরও বেশি বয়সে মৃত্যুবরণ করেন। প্রবীণ বয়সে মৃত্যুবরণ করা মানে পৃথিবী থেকে আনন্দের সঙ্গে প্রস্থান। বরণ শব্দটি সম্মানার্থে ব্যবহৃত হচ্ছে। ফলে মৃত্যুবরণ সম্মানজনক শব্দ। সম্মানজনক বিদায়ের জন্য কিছু আনুষ্ঠানিকতা থাকে।

মৃত্যুর আগে ব্যক্তির অসিয়ত, নির্দেশ, পরামর্শ, অনুরোধকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিয়ে পালন করা পরিবার-পরিজনের অবশ্যকরণীয় একটি বিষয়।

মৃত্যুর আগে একজন প্রবীণের তিন ধরনের শারীরিক (মেডিকেল কন্ডিশন) পরিস্থিতি হতে পারে। ১. সিপিআরের প্রয়োজন দেখা দিতে পারে। ২. লাইফ সাপোর্টে নিতে হতে পারে। ৩. জটিল রোগের চিকিৎসা গ্রহণ কিংবা বর্জনের সিদ্ধান্ত গ্রহণ।

একজন প্রবীণের হৃদ্‌যন্ত্রের ক্রিয়া বন্ধ হয়ে গেলে পুনরায় চালু করার জন্য সিপিআর (কার্ডিও পালমোনারি রিসাসিটেশন) করতে হয়। সিপিআর করার সময় বুকের মাঝে জোরে চাপ দিতে হয়। এতে করে পাঁজরের হাড় ভেঙে যাওয়ার আশঙ্কা থাকতে পারে। সিপিআর করার পর কখনো কখনো হৃদ্‌যন্ত্র চালু হলো কিন্তু পাঁজরের হাড় ভেঙে গেল, তখন প্রচণ্ড ব্যথা তৈরি হয়ে ভয়ানক কষ্টের জীবন শুরু হতে পারে। এমন পরিস্থিতির আশঙ্কা করলে হৃদ্‌রোগে আক্রান্ত হওয়ার আগে স্বেচ্ছায়-সজ্ঞানে চিকিৎসক বা পরিবার-পরিজনকে অনুরোধ করতে পারেন তাঁকে যেন সিপিআর দেওয়া না হয়।

জীবনের যেকোনো পরিস্থিতিতে একজন প্রবীণকে লাইফ সাপোর্টে দিতে হতে পারে। প্রবীণ ব্যক্তি স্বেচ্ছায়, সজ্ঞানে এই পরিস্থিতির আগেই লাইফ সাপোর্টে যেতে অস্বীকৃতি জানাতে পারেন। চিকিৎসক ও পরিবারের সদস্যদের উচিত হবে রোগীর ইচ্ছার প্রতি সম্মান জানানো।

একজন প্রবীণ দুরারোগ্য ব্যাধিতে আক্রান্ত হয়ে যদি মনে করেন তাঁর বাঁচার সম্ভাবনা ক্ষীণ, অথবা চিকিৎসা ব্যয় অনেক, যা তাঁর পক্ষে বহন করা সম্ভব হবে না। প্রবীণের এমন একটি অপারেশন, যা শরীরকে বিকৃত করে ফেলবে এবং বেঁচে থাকলে নিম্নমানের অসম্মানজনক জীবন হতে পারে। এমতাবস্থায় রোগী চিকিৎসা গ্রহণ করতে অস্বীকৃতি জানাতে পারেন।

আবার কেউ ক্যানসারের চিকিৎসায় কেমোথেরাপি, রেডিওথেরাপির মতো কষ্টদায়ক চিকিৎসা নিতে রাজি হতে চান না, কিংবা তিনি বুঝতে পারছেন এই কষ্টদায়ক চিকিৎসায় ব্যথা, বেদনা, বমিসহ নানা রকমের উপসর্গ, জটিলতা, বিড়ম্বনা বহন করা অসার। এ অবস্থায় প্রবীণ ব্যক্তির ইচ্ছাকে চিকিৎসক এবং রোগীর আত্মীয়স্বজনের সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিয়ে বিবেচনা করতে হবে। আবার অনেক সময় এমন রোগে আক্রান্ত হয়, যার আরোগ্য লাভের সম্ভাবনা নেই, একই সঙ্গে চিকিৎসার ব্যয় মেটাতে গেলে পরিবারের সদস্যরা ভবিষ্যতে আর্থিক সংকটে পড়বে, এমতাবস্থায় রোগী পরিবারকে নিঃস্ব করে চিকিৎসা নিতে রাজি না-ও হতে পারেন।

মৃত্যুর পর কবর কোথায় হবে, জানাজা কোথায় হবে, কত টাকা গরিব-মিসকিনকে দিতে হবে, কুলখানিতে কত লোক খাওয়াতে হবে ইত্যাদি বিষয় বিবেচনায় নিতে হবে।

হিন্দু, বৌদ্ধ ও খ্রিষ্টধর্মাবলম্বীদের ধর্ম অনুযায়ী মৃত ব্যক্তির ইচ্ছাপূরণের ব্যবস্থা নিতে হবে। প্রবীণ ব্যক্তির ইচ্ছানুসারে মৃত্যুর আগে আত্মীয়স্বজন, বন্ধুবান্ধবের সঙ্গে দেখা-সাক্ষাৎ করার ব্যবস্থা করে দিতে হবে। সবাইকে একসঙ্গে পেয়ে আনন্দ লাভের সুযোগ পাবেন।

প্রবীণের মৃত্যু অনেক ক্ষেত্রে কাঙ্ক্ষিত হয়ে থাকে। পরিবারের সদস্যদের প্রস্তুতিও থাকে। প্রবীণের মৃত্যুর সংবাদে শোকে কাতর হতে দেখা যায় না।

প্রবীণের দায়দেনা থেকে মুক্ত করার জন্য মৃত্যুর আগে তা পরিশোধ করে তাঁকে চিন্তামুক্ত করতে হবে। প্রবীণের দাফন-কাফন, অন্ত্যেষ্টিক্রিয়া ইচ্ছানুসারে পরিবারের সহযোগিতা ও সমর্থন নিয়ে সম্পন্ন করতে হবে।

প্রবীণের বিদায়বেলায় শোকে কাতর হওয়া স্বাভাবিক একটা বিষয়। কিন্তু মৃত্যুকে সম্মান ও মর্যাদার সঙ্গে গ্রহণ করা গৌরবের। পৃথিবীতে খালি হাতে আগমন এবং খালি হাতে প্রস্থান চিরন্তন।

প্রবীণ অন্যায়, জুলুম, নির্যাতন, ঘুষ, দুর্নীতি, লুটপাটে আকণ্ঠ নিমজ্জিত থেকে মৃত্যুবরণ করলে সম্মানজনক মৃত্যু দুরাশা।

হাসান আলী, সভাপতি, এজিং সাপোর্ট ফোরাম 

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

প্রধান উপদেষ্টার বিশেষ সহকারী হলেন ক্যালিফোর্নিয়ার পরিবহন বিশেষজ্ঞ

‘তল্লাশির’ জন্য উসকানি দিয়েছে গুলশানের ওই বাসার সাবেক কেয়ারটেকার: প্রেস উইং

প্রধান উপদেষ্টার আরও দুই বিশেষ সহকারী নিয়োগ

খালেদা জিয়ার উপদেষ্টা মাসুদ আহমেদের সব পদ স্থগিত

টিআইএন নেওয়ার পরে কিন্তু ঘুমাইতে পারবেন না: এনবিআর চেয়ারম্যান

এলাকার খবর
খুঁজুন

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত