সদিচ্ছার অভাবে ধ্বংস হয় শতকোটি ডলারের পণ্য

আব্দুর রাজ্জাক
প্রকাশ : ২৮ নভেম্বর ২০২২, ১০: ০৪

কয়েক মাস আগে চট্টগ্রাম কাস্টম হাউসের একটি নিলাম বিজ্ঞপ্তি হয়তো আপনারা লক্ষ করেছেন। সেখানে ৮৪ গাড়ির নিলাম হবে—এই বলে বিজ্ঞপ্তি দেওয়া হয়েছিল। আমি কৌতূহলবশত একটু খোঁজখবর নিয়ে জানলাম, এই গাড়িগুলো নামীদামি ব্র্যান্ডের অত্যাধুনিক এসইউভি গাড়ি ও কিছু কিছু অত্যাধুনিক মডেলের প্রাইভেট কার ছিল।

এই গাড়িগুলো আমদানি করতে শতকোটি টাকার ওপরে খরচ হয়েছে আমদানিকারকদের। আমদানিকারকের মিথ্যা ঘোষণা, ছলচাতুরী, সরকারের রাজস্ব ফাঁকি দেওয়ার প্রবণতার কারণে কাস্টমস কর্তৃপক্ষ এগুলো আটক করে রেখেছে। আমলাতান্ত্রিক জটিলতা, যা আমাদের রন্ধ্রে রন্ধ্রে প্রথিত হয়ে আছে, সে কারণে এই গাড়িগুলো সঠিক প্রক্রিয়া অবলম্বন করে আর খালাস দেওয়া হয়নি। গাড়িগুলো আমদানি করা হয়েছিল ২০০২ থেকে ২০১২ সালের মধ্যে। গাড়িগুলোর যখন ২০২২ সালে নিলাম ডাকা হয়, তখন এর ব্যবহার উপযোগিতা, কার্যকারিতা সবকিছুই শেষ প্রান্তে এসে দাঁড়িয়েছে।

দামি ব্র্যান্ডের ৩ হাজার থেকে ৪ হাজার সিসির এসইউভি গাড়িগুলোর প্রতিটির মূল্য ছিল দুই থেকে তিন কোটি টাকা। সেগুলো নিলামে বিক্রি হয়েছে ১০ থেকে ২০ লাখ টাকার মধ্যে। প্রাইভেট কারের অবস্থাও এ রকম পর্যায়ে দাঁড়িয়েছিল। এসব গাড়ি আমদানি হয়েছে ডলার বিনিময়ের মাধ্যমে। বাংলাদেশ থেকে কত মিলিয়ন ডলার এসব গাড়ির পেছনে ব্যয় হয়েছে, সেগুলো কর্তৃপক্ষ একটু হিসাব করলেই মোট অঙ্কটি বের করতে পারবে। আমার কথা হলো, গাড়িগুলো যথাযথ নিয়ম অবলম্বন করে আমদানি করা হয়নি। আমদানিকারকের এখানে ছলচাতুরী ছিল বলে প্রমাণিত। তবে কেন গাড়িগুলোকে জব্দ করার তিন থেকে ছয় মাসের মধ্যে কার্যকর পথ অবলম্বন করে, খোলাবাজারে টেন্ডারের মাধ্যমে বিক্রি করে, সরকারের রাজস্বসহ টাকাগুলো রাষ্ট্রীয় কোষাগারে জমা হলো না?

বৈদেশিক মুদ্রায় আমদানি করা গাড়িগুলো বছরের পর বছর পড়ে থাকার কারণে এর চালিকাশক্তি ও যন্ত্রশক্তি—সবকিছুই নিঃশেষ হয়ে গেল আইনের কার্যকর কোনো বিধান না থাকার কারণে, অর্থাৎ রাষ্ট্রের এবং রাষ্ট্রীয় কর্তাব্যক্তিদের সদিচ্ছা না থাকার কারণে।

বন্ধুবর একজন ঊর্ধ্বতন শুল্ক কর্মকর্তার কাছে প্রশ্ন করেছিলাম, ‘এ ধরনের অপচয় আপনাদের চোখের সামনে হলো কেমন করে?’ বন্ধুবর কর্মকর্তা বললেন, বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই এগুলো হয়েছে আইনি জটিলতা ও কর্মকর্তাদের অনিচ্ছার কারণে। এ কাজটি বড়ই অজনপ্রিয়। এ কাজটি যিনি করেন তাঁর ওপর নানান ধরনের চাপ আসে, অনেকে সন্দেহ করে এখানে দুর্নীতির মাধ্যমে এগুলো বিক্রি করা হয়েছে। এ কারণে অপ্রিয় কাজটি কোনো কর্মকর্তা সহজে করতে চান না। তিনি আরও বললেন, ১৯৮৭ সালে আটক করা অনেক পণ্য এখনো জব্দ অবস্থায় আছে, কোনো কারণবশত এগুলো নিলাম করা হয়নি। ৩০ বছরের পুরোনো পণ্য বহু আছে, যেগুলোর কোনো সুরাহা হচ্ছে না, শুধু দায়িত্ব না নেওয়ার কারণে এবং দায়িত্বে অবহেলা বা দায়িত্ব এড়িয়ে যাওয়ার কারণে। হিসাব করলে দেখা যাবে, চট্টগ্রাম কাস্টম হাউসেই শতকোটি ডলারের পণ্য এ রকম আটক অবস্থায় আছে।

গাড়ির কথা বাদ দিলাম; ভোগ্যপণ্য—যেমন ভোজ্যতেল, চাল, ডাল, চিনি, গুঁড়ো দুধসহ বহু পণ্য এ রকম জব্দ অবস্থায় পচে গেছে, যেগুলো সরানোর জন্য এখন উল্টো খরচ করতে হবে।

১৯৮৪ সালে সাবানের কাঁচামাল ট্যালো এখনো জব্দ অবস্থায়ই আছে। এগুলো ধ্বংস করতে অনেক টাকার প্রয়োজন হবে, অথচ সময়মতো নিলাম করলে সরকার কোটি টাকা আয় করতে পারত।

আব্দুর রাজ্জাক

অন্য একটি কাস্টম হাউসের এক কর্মকর্তা বললেন, ২০১৪ সালে গুঁড়ো দুধ, খেজুরসহ বিভিন্ন মসলা জব্দ অবস্থায় কাস্টম হাউসের ওয়্যারহাউসে এখনো পড়ে আছে। এগুলো পরিষ্কার করার জন্য এখন বাড়তি খরচ করতে হবে। সময়মতো এগুলো নিলাম করলে বা যেকোনো উপায়ে বিক্রি করলেও কোটি টাকা সরকারি কোষাগারে জমা হতো।

বিদেশি কোম্পানির দামি ওষুধ, যা কাস্টম হাউসে জব্দ করা হয়েছিল আইনি জটিলতার কারণে, ব্যবহারের সময় পার হয়ে যাওয়ার কারণে, এখন সেগুলো আর বিক্রি করা যাবে না। উল্টো এগুলো অপসারণ করতে এর পেছনে খরচ করতে হবে। সরকারি হাসপাতালে গরিব রোগীদের এসব ওষুধ বিনা মূল্যে দেওয়া যেত সদিচ্ছা ও আইনি জটিলতা না থাকলে।

বেনাপোল কাস্টম হাউসে আমার জানামতে এ রকম একটি ঘটনা ঘটেছিল। ভারত থেকে আমদানি করা হয়েছিল সালফিউরিক অ্যাসিড।কাস্টমস কর্তৃপক্ষ যে মূল্যমানের ওপর ট্যাক্স নির্ধারণ করতে চেয়েছে, সেই মূল্যমানের ওপর ট্যাক্স দিয়ে আমদানিকারক পণ্য ছাড় করাতে অস্বীকার করেছিলেন। পরে সেখানে এক বিপর্যয়কর পরিস্থিতির তৈরি হয়েছিল। সালফিউরিক অ্যাসিডের ড্রাম ব্লাস্ট হয়ে পরিবেশের মারাত্মক ক্ষতি হয়েছিল। অথচ যে কাস্টমস কর্মকর্তাদের গাফিলতিতে এটি হয়েছিল, তাঁরা যথানিয়মে চাকরিবাকরি করে, প্রমোশন পেয়ে উচ্চপদে আসীন আছেন।

বিভিন্ন সীমান্ত অঞ্চলে অনেক সময় চোরাচালানের সময় শাড়ি, লুঙ্গি, ভোগ্যপণ্যসহ নানান ধরনের পণ্য কাস্টমস কর্তৃপক্ষ জব্দ করে।সাধারণভাবে বলাই যায়, তারা প্রশংসার কাজটি করে। এই জব্দ করা মাল আসলেই চোরাচালান হয়ে পার্শ্ববর্তী দেশ থেকে আমাদের দেশে প্রবেশ করে। ওই আইনি জটিলতার কারণে এই পণ্যগুলোর বেশির ভাগ অংশ নিলাম করে বা অন্য কোনো উপায়ে ব্যবহার করার ব্যবস্থা হয় না। কাস্টমসের গুদামে সংরক্ষিত অবস্থায় নষ্ট হয়ে যায়। ১৫ থেকে ২০ বছর আগের শাড়ি, লুঙ্গি, ডাল, চিনিসহ বিভিন্ন ধরনের মসলা ও অন্যান্য পণ্য ব্যবহারের অনুপযোগী অবস্থায় পড়ে থাকে। যে কর্মকর্তা ওখানে দায়িত্বে থাকেন, তিনি তাঁর নিজের সময়টুকু কোনো রকম পার করে অপ্রিয় এ কাজটি না করে চলে যান। এ রকম বছরের পর বছর চলে যায়। মনে হয় আরও যাবে।

এ রকম চোরাই পণ্য ও সরকারি রাজস্ব ফাঁকি দিয়ে আমদানি করা পণ্য শুল্ক কর্তৃপক্ষ জব্দ করে তাদের দায়িত্বশীলতার পরিচয় দিচ্ছে, এটি একটি ভালো দিক। এসব পণ্যের যথাযথ মান ঠিক থাকা অবস্থায় নিলাম করে বা খোলাবাজারে বিক্রি করে যদি অর্থ সরকারি কোষাগারে জমা হতো, অথবা যেকোনো উপায়ে এসব পণ্য রাষ্ট্রের বা সমাজের কাজে লাগত, তাহলে রাষ্ট্রের অনেক অর্থ সাশ্রয় হতো।

এসব গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপারে কেউ তেমন জোরালো ভূমিকা রাখছে না বা এই অপ্রিয় কাজের দিকে মনোনিবেশ করছে না।যে বিষয়গুলোর ওপর আলোকপাত করলাম, আশা করি যথাযথ কর্তৃপক্ষ একটি কমিটি করে, বাংলাদেশের সব কাস্টম গোডাউন পরিসংখ্যান করে, যেসব পণ্য এখনো মানদণ্ডে ভালো আছে, সেগুলো খালাস করে এর সদ্ব্যবহার করার প্রক্রিয়া শুরু করবে এবং যেসব পণ্যের ইতিমধ্যেই মান উত্তীর্ণ হয়েছে, সেগুলো ধ্বংস করে গোডাউন খালি করবে।

এখন থেকে সবার দৃষ্টি দেওয়া উচিত কোনোক্রমেই কোনো পণ্যের ব্যবহার অনুপযোগী হওয়ার সুযোগ দেওয়া যাবে না। আইন করে এগুলো প্রথমে ব্যবহার উপযোগী করতে হবে। প্রয়োজন হলে নতুন আইন করতে হবে। আইন এবং সদিচ্ছার মাধ্যমে রাষ্ট্রীয় সম্পদের যথাযথ ব্যবহার নিশ্চিত করতে হবে। যদি এগুলো কেউ করতে ব্যর্থ হন, তাঁর বিরুদ্ধে বিভাগীয় ব্যবস্থাসহ অন্যান্য ব্যবস্থা নিতে হবে।

লেখক: প্রকৌশলী

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
খুঁজুন

সম্পর্কিত