শ্যামলীর টিবি হাসপাতালে অনিয়ম: ৩৬ হাজার স্টিলের আলমারির দাম লাখ টাকা

রাশেদ রাব্বি, ঢাকা
প্রকাশ : ২১ মে ২০২৪, ১১: ৪৯
আপডেট : ২১ মে ২০২৪, ১২: ০২

একটি স্টিলের আলমারির দাম ৯৬ হাজার টাকা! অবাক লাগলেও এই দরে ৯৬ লাখ টাকায় ১০০টি স্টিলের আলমারি কিনেছে রাজধানীর শ্যামলী ২৫০ শয্যার টিবি হাসপাতাল। অথচ ওই সময়ে বাজারে একটি স্টিলের আলমারির দাম ছিল সর্বোচ্চ ৩৬ হাজার ৮৫৫ টাকা। 

নিরীক্ষা অধিদপ্তর আপত্তি তুলে বলেছে, বাজারদরের চেয়ে উচ্চমূল্যের এই কেনাকাটায় সরকারের ৬৪ লাখ ২৫ হাজার টাকা ক্ষতি হয়েছে। ওই হাসপাতালে ২০২০-২১ ও ২০২১-২২ অর্থবছরে বিভিন্ন সরঞ্জাম কেনাকাটায় এমন অনেক অসংগতি পেয়েছে অধিদপ্তর।

নিরীক্ষা আপত্তির পরিপ্রেক্ষিতে স্বাস্থ্য ও পরিবারকল্যাণ মন্ত্রণালয়ের স্বাস্থ্যসেবা বিভাগ স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের হাসপাতাল সেবা ব্যবস্থাপনা কর্মসূচির লাইন ডিরেক্টরকে দেওয়া চিঠিতে দায়ী ব্যক্তিদের কাছ থেকে আপত্তিকৃত অর্থ আদায় করে সরকারি কোষাগারে জমা দিয়ে প্রমাণসহ জবাব দিতে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। 

মন্ত্রণালয়ের সূত্র জানায়, স্বাস্থ্যসচিবকে গত ২৮ ফেব্রুয়ারি দেওয়া চিঠিতে নিরীক্ষা (অডিট) অধিদপ্তরের উপপরিচালক মো. রিফাত ফারাবী সৌরভ উল্লেখ করেন, এই কেনাকাটার ক্ষেত্রে পিপিআর (পাবলিক প্রকিউরমেন্ট রুল) অনুযায়ী দাপ্তরিক ব্যয় প্রাক্কলন কমিটি যথাযথভাবে গঠিত হয়নি। ফলে বাজারদর নির্ধারণ সঠিক হয়নি। এ ছাড়া পিপিআর-২০০৮ অনুযায়ী সরবরাহকারীর দেওয়া দর অবশ্যই বাজারমূল্যের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ হতে হবে, এ ক্ষেত্রে তা মানা হয়নি। চিঠিতে আপত্তিকৃত অর্থ দায়ী ব্যক্তিদের কাছ থেকে আদায় করে সরকারি কোষাগারে জমা করতে সুপারিশ করা হয়। চিঠিটি ২৯ এপ্রিল স্বাস্থ্যসচিবের দপ্তর গ্রহণ করে। একই তারিখে মন্ত্রণালয়ের স্বাস্থ্যসেবা বিভাগের সহকারী সচিব এম ডি কামাল হোসেন স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের হাসপাতাল সেবা ব্যবস্থাপনা কর্মসূচির লাইন ডিরেক্টরকে চিঠি দেন। সেখানে দায়ী ব্যক্তিদের কাছ থেকে আপত্তিকৃত অর্থ আদায় করে সরকারি কোষাগারে জমা দিয়ে প্রমাণসহ জবাব দিতে নির্দেশ দেওয়া হয়। 

এ প্রসঙ্গে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের হাসপাতাল সেবা ব্যবস্থাপনা কর্মসূচির লাইন ডিরেক্টর অধ্যাপক নাজমুল ইসলাম বলেন, ‘আমরা এ বিষয়ে ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের সঙ্গে আলোচনা করে নির্দেশনা অনুসারে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেব।’ 

নিরীক্ষা প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, শ্যামলীর ২৫০ শয্যার টিবি হাসপাতালে ২০২১ সালের ২০ নভেম্বর ৫ হাজার রিব্রিদিং অক্সিজেন মাস্কের কার্যাদেশ দেওয়া হলে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান মুন্সি ট্রেড ইন্টারন্যাশনাল ১ হাজার রিব্রিদিং অক্সিজেন মাস্ক সরবরাহ করলেও পুরো বিল বাবদ ৬ লাখ টাকা পরিশোধ করা হয়। একই প্রতিষ্ঠান আরেক কার্যাদেশে ১৩ বক্স (প্রতি বক্সে ১২৫টি) সিটি স্ক্যান ফিল্ম সরবরাহের কাজ পেয়ে আট বক্স দিলেও সম্পূর্ণ বিল বাবদ ২ লাখ ৪৭ হাজার টাকা পরিশোধ করা হয়। এ দুই কার্যাদেশে সরকারের আর্থিক ক্ষতি ৫ লাখ ৭৫ হাজার টাকা। ওই সময়ে হাসপাতালের দায়িত্বে ছিলেন মো. আবু রায়হান এবং নিরীক্ষা পরিচালনা করেন উপপরিচালক সাখাওয়াত হোসেন মৃধা। 

২০২০-২১ ও ২০২১-২২ অর্থবছরের আরেক নিরীক্ষায় দেখা যায়, জেনারেল স্টোর যাচাই করে এমএসআর সামগ্রীর মধ্যে পালস অক্সিমিটার, বিপ্যাপ মাস্ক এবং মেডি গ্যাস সিলিন্ডার রেগুলেটর বিতরণের পর যে হিসাব দেখানো হয়েছে, তার সঙ্গে বাস্তব যাচাইয়ের মিল নেই। এতে ১৩ লাখ ৭৩ হাজার ৮৯৭ টাকার ক্ষতি হয়েছে। 

নিরীক্ষা অনুযায়ী, ২০২০-২১ অর্থবছরে অক্সিজেন প্ল্যান্টে ব্যবহারের জন্য ভ্যাকুয়াম যন্ত্র কেনা হয় ৭৬ লাখ টাকায়। অথচ তখন এর বাজারমূল্য ছিল ১০ থেকে ১৫ লাখ টাকা। একই অর্থবছরে হাসপাতালের জীবাণুমুক্ত বর্জ্য ধ্বংসের জন্য মেসার্স শাহিদা ট্রেডার্সের মাধ্যমে ২ কোটি ৭৩ লাখ টাকায় একটি ইনসিনেটর যন্ত্র কেনা হয়। একটি স্টিকারে কান্ট্রি অব অরিজিন জার্মানি লেখা। তবে প্রস্তুতকারক নিয়ে সন্দেহ প্রকাশ করে হাসপাতালের কর্মকর্তারা বলেছেন, ওই যন্ত্র কাজে লাগছে না। হাসপাতালের বর্জ্য প্রিজমের মাধ্যমে অপসারণ করে প্রতি মাসে বিপুল অঙ্কের বিল দিতে হয়। 

অনুসন্ধানে জানা গেছে, প্রমিজকো এন্টারপ্রাইজ, শাহিদা ট্রেডার্স এবং মুন্সি ট্রেড ইন্টারন্যাশনাল একই ব্যক্তির মালিকানাধীন ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান। তাঁর আরও দুটি (মেসার্স অনিক ট্রেডার্স, মেসার্স আহমেদ এন্টারপ্রাইজ) প্রতিষ্ঠান এর আগে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় এবং দুর্নীতি দমন কমিশনের কালো তালিকাভুক্ত হয়। 

অনুসন্ধানে জানা যায়, ২০২২ সালের ১০ জানুয়ারি ওই হাসপাতালের উপপরিচালক মো. আবু রায়হানের সই করা ছয়টি পৃথক কার্যাদেশে ভারী যন্ত্রপাতি সরবরাহের কাজ পায় গ্রিন ট্রেড নামের একটি প্রতিষ্ঠান। এর একটির আর্থিকমূল্য ৯ কোটি ৬৬ লাখ ৭৫ হাজার, একটির ৯ কোটি ৬৮ লাখ ৫০ হাজার, একটির ৯ কোটি ৬৫ লাখ ২৫ হাজার, একটির ৯ কোটি ৭৬ লাখ ৭০ হাজার এবং অন্যটির ৯ কোটি ৬৯ লাখ টাকা। এসব কার্যাদেশের বিপরীতে গ্রিন ট্রেডের পক্ষ থেকে একটি ব্যাংকে আর্থিক সহায়তা চাওয়া হয়। এতে ব্যাংকটি হাসপাতালের উপপরিচালকের কাছে ইন্টেরিম পারফরম্যান্স সার্টিফিকেট (আইপিসি) চায়। তবে হাসপাতালের উপপরিচালক তাঁর সই নকল করে কার্যাদেশ দেওয়া হয়েছে মর্মে থানায় সাধারণ ডায়েরি (জিডি) করেন। 

এসব বিষয়ে জানতে মো. আবু রায়হানকে ১৮ ও ১৯ মে কয়েকবার মোবাইলে ফোন করা হলেও তিনি ধরেননি। 

ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান বলেন, এখানে তিন ধরনের দুর্নীতি হয়েছে। সরকারি প্রতিষ্ঠানে কোনো ধরনের দুর্নীতি কাম্য নয়। এ ধরনের অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডে সংশ্লিষ্টদের জবাবদিহি নিশ্চিত করতে হবে। 

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
খুঁজুন

সম্পর্কিত