জাহীদ রেজা নূর
হাটখোলার কাছে ‘দেশবন্ধু’ নামে যে রেস্তোরাঁটা আছে, তার পরোটা-ভাজির সুনাম বহুদিনের। করোনার সময় রেস্তোরাঁয় বসে খেতে একটা সংশয় কাজ করত। করোনা কমে যাওয়ায় এখন সাহস কিছুটা বেড়েছে। দেশবন্ধুর পরোটা-ভাজি খাওয়া হলো ওদের টেবিল-চেয়ারে বসেই।
দুটো পরোটা আর এক প্লেট ভাজির দাম রাখল ৪০ টাকা, অর্থাৎ পরোটা ১০ টাকা করে, ভাজি ২০ টাকা।
ঢাকা শহরে এখন প্রচুর সবজির আমদানি হয়েছে। দেশের কৃষকেরা কিন্তু অসাধ্যসাধন করেছেন। সবজি, ধান, মাছের চাষ খুলে দিয়েছে আশার দিগন্ত। কিন্তু সাধারণ খেটে খাওয়া মানুষ সেই সুফল কতটা পাচ্ছেন, তা প্রশ্নসাপেক্ষ।
সাধারণ খেটে খাওয়া মানুষ বলতে কৃষক, শ্রমিক, চাকরিজীবী—সব সম্প্রদায়ের মানুষকেই ধরছি। যাঁরা নির্দিষ্ট অর্থপ্রাপ্তির পর সেই টাকা দিয়ে মাস কাটাতে গলদঘর্ম হন, তাঁদের কথাই বলছি।
যে আকারের দুটো পরোটা দেওয়া হয়েছিল দেশবন্ধুতে, তা বহুকাল ধরেই ৫-৬ টাকায় ছিল সীমাবদ্ধ। ভাজিটাও ১০ থেকে বেড়ে ১৫ হতে পারত। কিন্তু যে অদ্ভুত কারণগুলো দাম বাড়িয়ে দিয়েছে, তার একটি হলো করোনাকালের ঝক্কি, অন্য একটি হলো রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ এবং তৃতীয়টি হলো ব্যবসায়ীদের লোভ। তৃতীয় কারণটি কোনো অংশে অন্য দুটো কারণের চেয়ে কম গুরুত্বপূর্ণ নয় এবং এখানে ঠিকভাবে বলা দরকার, পৃথিবীর বহু দেশের চেয়ে আমাদের দেশে এসব অসৎ ব্যবসায়ীর সংখ্যা বেশি। এসব ব্যবসায়ী শুধু পণ্যের দাম বাড়ান না, তাঁরা ওষুধেও ভেজাল দেওয়ার মতো সাহস রাখেন। একশ্রেণির সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীর আশীর্বাদ না পেলে তাঁরা অনায়াসে বাজার নিয়ন্ত্রণ করতে পারতেন না।
ময়দাসংশ্লিষ্ট যেকোনো তৈরি খাবারেরই দাম বাড়িয়ে দেওয়া হয়েছে বিপুলভাবে। ফাস্ট ফুডের দোকানে যে চিকেন র্যাপটি এই তো সেদিন ছিল ৭০ টাকা, আজ তার গায়ে দাম ঝুলছে ১০০ টাকা। এক লাফে কী করে ৩০ টাকা দাম বাড়তে পারে, সে প্রশ্নের উত্তর কে দেবে?
শিঙাড়া কিংবা পুরি—দুটো খাদ্যের জন্যই দরকার ময়দা আর তেল। যুদ্ধের কারণে এই দুটো পণ্যের দাম বেড়েছে বটে, কিন্তু যেভাবে খাবারের দাম বাড়ানো হয়েছে, তাকে যুক্তিসংগত ভাবার কোনো কারণ নেই। ৫ টাকা আকারের শিঙাড়া বা পুরি যদি ১০ টাকা দিয়ে কিনে খেতে হয়, তাহলে বুঝতে হবে, যুদ্ধ ছাড়াও একটা ‘এক্স’ ফ্যাক্টর এখানে কাজ করছে।
দুই. বাজারে যাঁরা নিয়মিত যান, তাঁরা খুব ভালো করেই বুঝতে পারছেন, কয়েক বছর আগেও যে টাকা পকেটে করে নিয়ে গেলে নিজেকে বেশ রাজা রাজা মনে হতো, আজ সেই টাকা নিয়ে বাজারে যেতে লজ্জা করে। গরুর মাংসের দাম যে আকাশছোঁয়া হয়ে গেল, সেটা মধ্যবিত্ত মানুষের সমস্যা। উচ্চবিত্ত মানুষের কাছে বাজারদর কখনোই খুব বেশি বড় সমস্যা নয়। নিম্নবিত্ত মানুষের পক্ষে এখন গরু বা খাসির মাংস কিনে খাওয়া প্রায় অসম্ভব ব্যাপার। এখনো গরিব মানুষের ঘরে প্রোটিনের জোগান দেয় যে মাংস, সেটা ব্রয়লার। কিছুদিন ধরে সেই মাংসের দামও নাগালের বাইরে চলে যাওয়ার সব প্রস্তুতি নিয়ে ফেলেছে।
মাছ নিয়ে কথা বলার জন্য হিম্মত থাকতে হয়। মাছের দাম এমন এক পর্যায়ে পৌঁছে গেছে, যা কল্পনায় আনতেও ভয় লাগে। ঢাকার টাউন হল বাজারে পুঁটি মাছ কিনতে গিয়ে দাম শুনতে হলো ১ হাজার টাকা কেজি। মাছগুলো একটু বড় আকারের বটে, কিন্তু কী কারণে সেই মাছের দাম চার অঙ্কের হবে, তা বুঝতে পারলাম না। কিন্তু কিছুক্ষণ আশপাশে দাঁড়িয়ে পর্যবেক্ষণ করে দেখা গেল, ১ হাজার টাকা দরে মাছ কেনার ক্রেতা বিরল নয়। তাঁদের হাতে কোত্থেকে টাকা আসে, তা নিয়ে গবেষণা করলে আরও কত নতুন গল্প এসে ভিড় জমাবে!
পাবদা একসময় অভিজাত মাছ হয়ে উঠেছিল। কিন্তু চাষের কারণে সহজলভ্য হয়ে পড়ায় পাবদা-কই-শিং-মাগুর বরং অন্য অনেক মাছের চেয়ে সস্তা। কাজরি মাছ কিংবা তপসে মাছের দাম জিজ্ঞেস করুন তো বাজারে গিয়ে। চমকে উঠবেন!
সবজির বাজারটা মাঝে মাঝে গরিবের ঘরের বউ হয়, তখনো হয় রাজকুমারী—দেমাকে পা মাটিতে পড়ে না। পেঁয়াজ-বেগুন-লাউ নিয়ে কত কিছু যে ঘটে যায়, তার নাটকীয় কাহিনি বাজার করতে যাওয়া প্রতিটি মানুষ জানে।
বাজার নিয়ন্ত্রণব্যবস্থাটা যদি চাহিদা-জোগানের ওপর নির্ভর করত, তাহলে হয়তো দাম বাড়া-কমার একটা চিত্র পাওয়া যেত, কিন্তু সবখানেই তো দেখা যায় সিন্ডিকেটের জয়জয়কার। কিছুদিনের জন্য পণ্য গায়েব করে দিলেই কোটি কোটি টাকা ঘরে তোলা যায়। এই হিসাব তো অহরহ দেখা যাচ্ছে এখন। ভারত থেকে পেঁয়াজ আমদানি বন্ধ করলে কিংবা ভারত তা রপ্তানি করতে না চাইলে কীভাবে দাম বেড়ে যায়, সেটা কি আমরা দেখিনি? মজুত পেঁয়াজ তখন ‘গায়েব’ হয়ে যায়। দাম আরেকটু বাড়লে পেঁয়াজগুলো হেসেখেলে আবার আসে দোকানে। দামের ওঠানামার ওপর ‘চোর-পুলিশ’ খেলা চলতেই থাকে।
তেলের কথাও একইভাবে বলা যায়। কয়েকটি প্রতিষ্ঠান সিন্ডিকেটের মতো পুরো বাজার থেকে তেল উধাও করে দিল, সেই ঘটনার দগদগে ঘা তো এখনো আমাদের শরীরে। এই সবকিছুর জন্য রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ দায়ী নয়। ব্যবসায়ী-শিল্পপতিশ্রেণির মানুষের নিদারুণ অসততা, মজুতদারিপ্রবণতা, গরিব মানুষের পকেট কেটে সম্পদ গড়ে তোলার অমানবিক কর্মপ্রয়াসই প্রধানত দায়ী।
তিন. তাহলে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে মূল্যবৃদ্ধি প্রসঙ্গটি কি ভুল?
না, একেবারেই ভুল নয়। তবে এখন যাকে যুদ্ধের ফল হিসেবে দেখাতে চাইছেন ব্যবসায়ীরা, সেটা মিথ্যে। যতটা দাম বাড়ানো হয়েছে, ততটা বাড়ানোর মতো কারণ ঘটেনি। কিন্তু ব্যবসায়ীরা সেই সুযোগ নিয়েছেন।
এই যুদ্ধ দীর্ঘস্থায়ী হলে যেভাবে মানুষের অর্থনৈতিক জীবন পাল্টে যাবে, সেটা এখন কল্পনায়ও আনা যাচ্ছে না। রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের গল্পটা আমরা কার কাছ থেকে শুনছি, সেটা খুব গুরুত্বপূর্ণ। পশ্চিমা দুনিয়া তাদের প্রচারণা যন্ত্রটিকে এতটাই শাণিত করে ফেলেছে এবং গরিব দেশগুলোর এতটাই আস্থাভাজন হয়ে উঠেছে তারা যে গরিব দেশগুলো পশ্চিমা বিশ্বের চশমা চোখে গলিয়েই পৃথিবীটাকে দেখে। নিজেদের কিছু বলার মতো রসদের অধিকারী তারা হয়ে ওঠে না।
রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ নিয়ে যদি শুধু পশ্চিমা প্রোপাগান্ডা শুনতে থাকে মানুষ, তাহলে সে বিশ্বাস করবে, সবকিছুর জন্য রাশিয়াই দায়ী। অথচ দনবাসের রুশ ভাষাভাষী নাগরিকদের প্রতি ইউক্রেন কতটা নৃশংস আচরণ করেছে, সে কথা পশ্চিমা প্রোপাগান্ডা কোথাও খুঁজে পাওয়া যাবে না। একটার পর একটা নিষেধাজ্ঞা দিয়েও যখন রাশিয়াকে দমানো যাচ্ছে না, তখন রাশিয়াকে নিয়ে আজগুবি সব গল্পও বানানো হচ্ছে। মার্কিন প্রেসিডেন্ট বিলিয়ন বিলিয়ন ডলার ঢালছেন ইউক্রেনে, অস্ত্র ব্যবসা করে যাচ্ছেন, ইউক্রেন কি জানে না, এর মাশুল একসময় তার দেশের মানুষকেই দিতে হবে?
অন্যদিকে, রাশিয়াকেও গণমানুষের বন্ধুরাষ্ট্র মনে করার কোনো কারণ নেই। এই যুদ্ধের পরিণতিতে সারা বিশ্বের মানুষ যে ক্ষতিগ্রস্ত হবে, সে কথা রাশিয়া কি জানত না? ভ্লাদিমির পুতিনকে কি জনদরদি নেতা বলে মান্য করতে হবে? তাঁর একনায়কতন্ত্রী আচরণে রাশিয়ার মানুষ যে ধুঁকছে, সে কথাও কি কারও অজানা? তবে আমাদের দুর্ভাগ্য, দুই পক্ষের কথা শোনার কোনো সুযোগ আমাদের নেই। বিদেশি কিছু নিরপেক্ষ পত্রপত্রিকায় যখন রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ নিয়ে কোনো লেখা পড়ি, তখন মনে হয়, এ হলো সাম্রাজ্যবাদীদের অভ্যন্তরীণ লীলাখেলা, যার কারণে ক্ষতিগ্রস্ত হয় সারা বিশ্বের সাধারণ শান্তিপ্রিয় মানুষ।
তাহলে যুদ্ধে লাভবান হলো কে?
এক অর্থে, এই যুদ্ধ চীনকে একটা শক্তিশালী রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক নেতৃত্বের পর্যায়ে নিয়ে এসেছে। ডলারকে হটিয়ে দিয়ে রুবল-ইউয়ান বাণিজ্যজগতে নতুন আন্তর্জাতিক মুদ্রা হিসেবে উঠে আসছে। ইউরোপ-আমেরিকাজুড়ে নতুন পৃথিবীর মুদ্রাব্যবস্থা পাল্টে যাবে কি না, তা নিয়ে শুরু হয়েছে হিসাব-নিকাশ।
কিন্তু তাতে কতটা ক্ষতি হচ্ছে খেটে খাওয়া মানুষের, সে অঙ্ক কেউ কষছে না।
চার. আপাত দূরের একটি বিষয়কে এখানে টেনে আনা হলো বলে মনে হতে পারে। কিন্তু একেবারেই তা নয়। রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের আলাপটা এখানে খুব জরুরি। রাশিয়ার তেল আর গ্যাস নিয়ে ইউরোপের নিষেধাজ্ঞার অভিঘাত কী হবে, সেটা এখনো পরিষ্কার নয়। তৃতীয় মাধ্যম হয়ে নিষেধাজ্ঞার মধ্যেও রাশিয়ায় রপ্তানির পথ খুঁজছে ইউরোপ, সেটাও তো দেখা যাচ্ছে। রাশিয়া আর ইউক্রেনের খাদ্যশস্য যদি রপ্তানি করা না যায়, তাহলে সমূহ বিপদে পড়তে যাচ্ছে—বিশেষ করে এশিয়া, আফ্রিকার মানুষেরা।
বিশ্ববাণিজ্য খুবই জরুরি একটা বিষয় এখানে। যত বড় শত্রুই হোক না কেন, বাণিজ্য-স্বার্থে এই শত্রুতার সময়ও তলে তলে ব্যবসাটা পাকিয়ে নেওয়া চলছে। পৃথিবীর সব পুঁজিপতিই ‘পুঁজি’কেই সর্বাগ্রে স্থান দেয়।
আমরা লক্ষ রাখছি, আমাদের প্রধানমন্ত্রীর আহ্বানের দিকেও। সংযত হয়ে প্রকল্প হাতে নিতে বলছেন তিনি। মেগা প্রজেক্টগুলো কাজের না হলে অকারণে ঋণের বোঝা যে বাড়ানো যাবে না, সে বার্তা কিন্তু দিয়েছেন তিনি। কিন্তু ভয় হলো, ‘খাই খাই পার্টি’ কি এই বিপৎসংকেত আমলে নেবে? শ্রীলঙ্কার পরিস্থিতির সঙ্গে আমাদের দেশের পরিস্থিতি মেলানো ঠিক হবে না, কিন্তু সরকারের নানা অলিতে-গলিতে ‘খাই খাই পার্টি’র উপস্থিতি থাকার আশঙ্কা কম নয় এবং তারা যেকোনো সময় জাতির দুর্দশার বড় কারণ হয়ে উঠতে পারে। আর তখনই আমাদের নিত্যদিনের বাজার জীবনে নেমে আসতে পারে আতঙ্ক, সে কথাটি বলার জন্যই এত কথা বলা।
হাটখোলার কাছে ‘দেশবন্ধু’ নামে যে রেস্তোরাঁটা আছে, তার পরোটা-ভাজির সুনাম বহুদিনের। করোনার সময় রেস্তোরাঁয় বসে খেতে একটা সংশয় কাজ করত। করোনা কমে যাওয়ায় এখন সাহস কিছুটা বেড়েছে। দেশবন্ধুর পরোটা-ভাজি খাওয়া হলো ওদের টেবিল-চেয়ারে বসেই।
দুটো পরোটা আর এক প্লেট ভাজির দাম রাখল ৪০ টাকা, অর্থাৎ পরোটা ১০ টাকা করে, ভাজি ২০ টাকা।
ঢাকা শহরে এখন প্রচুর সবজির আমদানি হয়েছে। দেশের কৃষকেরা কিন্তু অসাধ্যসাধন করেছেন। সবজি, ধান, মাছের চাষ খুলে দিয়েছে আশার দিগন্ত। কিন্তু সাধারণ খেটে খাওয়া মানুষ সেই সুফল কতটা পাচ্ছেন, তা প্রশ্নসাপেক্ষ।
সাধারণ খেটে খাওয়া মানুষ বলতে কৃষক, শ্রমিক, চাকরিজীবী—সব সম্প্রদায়ের মানুষকেই ধরছি। যাঁরা নির্দিষ্ট অর্থপ্রাপ্তির পর সেই টাকা দিয়ে মাস কাটাতে গলদঘর্ম হন, তাঁদের কথাই বলছি।
যে আকারের দুটো পরোটা দেওয়া হয়েছিল দেশবন্ধুতে, তা বহুকাল ধরেই ৫-৬ টাকায় ছিল সীমাবদ্ধ। ভাজিটাও ১০ থেকে বেড়ে ১৫ হতে পারত। কিন্তু যে অদ্ভুত কারণগুলো দাম বাড়িয়ে দিয়েছে, তার একটি হলো করোনাকালের ঝক্কি, অন্য একটি হলো রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ এবং তৃতীয়টি হলো ব্যবসায়ীদের লোভ। তৃতীয় কারণটি কোনো অংশে অন্য দুটো কারণের চেয়ে কম গুরুত্বপূর্ণ নয় এবং এখানে ঠিকভাবে বলা দরকার, পৃথিবীর বহু দেশের চেয়ে আমাদের দেশে এসব অসৎ ব্যবসায়ীর সংখ্যা বেশি। এসব ব্যবসায়ী শুধু পণ্যের দাম বাড়ান না, তাঁরা ওষুধেও ভেজাল দেওয়ার মতো সাহস রাখেন। একশ্রেণির সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীর আশীর্বাদ না পেলে তাঁরা অনায়াসে বাজার নিয়ন্ত্রণ করতে পারতেন না।
ময়দাসংশ্লিষ্ট যেকোনো তৈরি খাবারেরই দাম বাড়িয়ে দেওয়া হয়েছে বিপুলভাবে। ফাস্ট ফুডের দোকানে যে চিকেন র্যাপটি এই তো সেদিন ছিল ৭০ টাকা, আজ তার গায়ে দাম ঝুলছে ১০০ টাকা। এক লাফে কী করে ৩০ টাকা দাম বাড়তে পারে, সে প্রশ্নের উত্তর কে দেবে?
শিঙাড়া কিংবা পুরি—দুটো খাদ্যের জন্যই দরকার ময়দা আর তেল। যুদ্ধের কারণে এই দুটো পণ্যের দাম বেড়েছে বটে, কিন্তু যেভাবে খাবারের দাম বাড়ানো হয়েছে, তাকে যুক্তিসংগত ভাবার কোনো কারণ নেই। ৫ টাকা আকারের শিঙাড়া বা পুরি যদি ১০ টাকা দিয়ে কিনে খেতে হয়, তাহলে বুঝতে হবে, যুদ্ধ ছাড়াও একটা ‘এক্স’ ফ্যাক্টর এখানে কাজ করছে।
দুই. বাজারে যাঁরা নিয়মিত যান, তাঁরা খুব ভালো করেই বুঝতে পারছেন, কয়েক বছর আগেও যে টাকা পকেটে করে নিয়ে গেলে নিজেকে বেশ রাজা রাজা মনে হতো, আজ সেই টাকা নিয়ে বাজারে যেতে লজ্জা করে। গরুর মাংসের দাম যে আকাশছোঁয়া হয়ে গেল, সেটা মধ্যবিত্ত মানুষের সমস্যা। উচ্চবিত্ত মানুষের কাছে বাজারদর কখনোই খুব বেশি বড় সমস্যা নয়। নিম্নবিত্ত মানুষের পক্ষে এখন গরু বা খাসির মাংস কিনে খাওয়া প্রায় অসম্ভব ব্যাপার। এখনো গরিব মানুষের ঘরে প্রোটিনের জোগান দেয় যে মাংস, সেটা ব্রয়লার। কিছুদিন ধরে সেই মাংসের দামও নাগালের বাইরে চলে যাওয়ার সব প্রস্তুতি নিয়ে ফেলেছে।
মাছ নিয়ে কথা বলার জন্য হিম্মত থাকতে হয়। মাছের দাম এমন এক পর্যায়ে পৌঁছে গেছে, যা কল্পনায় আনতেও ভয় লাগে। ঢাকার টাউন হল বাজারে পুঁটি মাছ কিনতে গিয়ে দাম শুনতে হলো ১ হাজার টাকা কেজি। মাছগুলো একটু বড় আকারের বটে, কিন্তু কী কারণে সেই মাছের দাম চার অঙ্কের হবে, তা বুঝতে পারলাম না। কিন্তু কিছুক্ষণ আশপাশে দাঁড়িয়ে পর্যবেক্ষণ করে দেখা গেল, ১ হাজার টাকা দরে মাছ কেনার ক্রেতা বিরল নয়। তাঁদের হাতে কোত্থেকে টাকা আসে, তা নিয়ে গবেষণা করলে আরও কত নতুন গল্প এসে ভিড় জমাবে!
পাবদা একসময় অভিজাত মাছ হয়ে উঠেছিল। কিন্তু চাষের কারণে সহজলভ্য হয়ে পড়ায় পাবদা-কই-শিং-মাগুর বরং অন্য অনেক মাছের চেয়ে সস্তা। কাজরি মাছ কিংবা তপসে মাছের দাম জিজ্ঞেস করুন তো বাজারে গিয়ে। চমকে উঠবেন!
সবজির বাজারটা মাঝে মাঝে গরিবের ঘরের বউ হয়, তখনো হয় রাজকুমারী—দেমাকে পা মাটিতে পড়ে না। পেঁয়াজ-বেগুন-লাউ নিয়ে কত কিছু যে ঘটে যায়, তার নাটকীয় কাহিনি বাজার করতে যাওয়া প্রতিটি মানুষ জানে।
বাজার নিয়ন্ত্রণব্যবস্থাটা যদি চাহিদা-জোগানের ওপর নির্ভর করত, তাহলে হয়তো দাম বাড়া-কমার একটা চিত্র পাওয়া যেত, কিন্তু সবখানেই তো দেখা যায় সিন্ডিকেটের জয়জয়কার। কিছুদিনের জন্য পণ্য গায়েব করে দিলেই কোটি কোটি টাকা ঘরে তোলা যায়। এই হিসাব তো অহরহ দেখা যাচ্ছে এখন। ভারত থেকে পেঁয়াজ আমদানি বন্ধ করলে কিংবা ভারত তা রপ্তানি করতে না চাইলে কীভাবে দাম বেড়ে যায়, সেটা কি আমরা দেখিনি? মজুত পেঁয়াজ তখন ‘গায়েব’ হয়ে যায়। দাম আরেকটু বাড়লে পেঁয়াজগুলো হেসেখেলে আবার আসে দোকানে। দামের ওঠানামার ওপর ‘চোর-পুলিশ’ খেলা চলতেই থাকে।
তেলের কথাও একইভাবে বলা যায়। কয়েকটি প্রতিষ্ঠান সিন্ডিকেটের মতো পুরো বাজার থেকে তেল উধাও করে দিল, সেই ঘটনার দগদগে ঘা তো এখনো আমাদের শরীরে। এই সবকিছুর জন্য রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ দায়ী নয়। ব্যবসায়ী-শিল্পপতিশ্রেণির মানুষের নিদারুণ অসততা, মজুতদারিপ্রবণতা, গরিব মানুষের পকেট কেটে সম্পদ গড়ে তোলার অমানবিক কর্মপ্রয়াসই প্রধানত দায়ী।
তিন. তাহলে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে মূল্যবৃদ্ধি প্রসঙ্গটি কি ভুল?
না, একেবারেই ভুল নয়। তবে এখন যাকে যুদ্ধের ফল হিসেবে দেখাতে চাইছেন ব্যবসায়ীরা, সেটা মিথ্যে। যতটা দাম বাড়ানো হয়েছে, ততটা বাড়ানোর মতো কারণ ঘটেনি। কিন্তু ব্যবসায়ীরা সেই সুযোগ নিয়েছেন।
এই যুদ্ধ দীর্ঘস্থায়ী হলে যেভাবে মানুষের অর্থনৈতিক জীবন পাল্টে যাবে, সেটা এখন কল্পনায়ও আনা যাচ্ছে না। রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের গল্পটা আমরা কার কাছ থেকে শুনছি, সেটা খুব গুরুত্বপূর্ণ। পশ্চিমা দুনিয়া তাদের প্রচারণা যন্ত্রটিকে এতটাই শাণিত করে ফেলেছে এবং গরিব দেশগুলোর এতটাই আস্থাভাজন হয়ে উঠেছে তারা যে গরিব দেশগুলো পশ্চিমা বিশ্বের চশমা চোখে গলিয়েই পৃথিবীটাকে দেখে। নিজেদের কিছু বলার মতো রসদের অধিকারী তারা হয়ে ওঠে না।
রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ নিয়ে যদি শুধু পশ্চিমা প্রোপাগান্ডা শুনতে থাকে মানুষ, তাহলে সে বিশ্বাস করবে, সবকিছুর জন্য রাশিয়াই দায়ী। অথচ দনবাসের রুশ ভাষাভাষী নাগরিকদের প্রতি ইউক্রেন কতটা নৃশংস আচরণ করেছে, সে কথা পশ্চিমা প্রোপাগান্ডা কোথাও খুঁজে পাওয়া যাবে না। একটার পর একটা নিষেধাজ্ঞা দিয়েও যখন রাশিয়াকে দমানো যাচ্ছে না, তখন রাশিয়াকে নিয়ে আজগুবি সব গল্পও বানানো হচ্ছে। মার্কিন প্রেসিডেন্ট বিলিয়ন বিলিয়ন ডলার ঢালছেন ইউক্রেনে, অস্ত্র ব্যবসা করে যাচ্ছেন, ইউক্রেন কি জানে না, এর মাশুল একসময় তার দেশের মানুষকেই দিতে হবে?
অন্যদিকে, রাশিয়াকেও গণমানুষের বন্ধুরাষ্ট্র মনে করার কোনো কারণ নেই। এই যুদ্ধের পরিণতিতে সারা বিশ্বের মানুষ যে ক্ষতিগ্রস্ত হবে, সে কথা রাশিয়া কি জানত না? ভ্লাদিমির পুতিনকে কি জনদরদি নেতা বলে মান্য করতে হবে? তাঁর একনায়কতন্ত্রী আচরণে রাশিয়ার মানুষ যে ধুঁকছে, সে কথাও কি কারও অজানা? তবে আমাদের দুর্ভাগ্য, দুই পক্ষের কথা শোনার কোনো সুযোগ আমাদের নেই। বিদেশি কিছু নিরপেক্ষ পত্রপত্রিকায় যখন রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ নিয়ে কোনো লেখা পড়ি, তখন মনে হয়, এ হলো সাম্রাজ্যবাদীদের অভ্যন্তরীণ লীলাখেলা, যার কারণে ক্ষতিগ্রস্ত হয় সারা বিশ্বের সাধারণ শান্তিপ্রিয় মানুষ।
তাহলে যুদ্ধে লাভবান হলো কে?
এক অর্থে, এই যুদ্ধ চীনকে একটা শক্তিশালী রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক নেতৃত্বের পর্যায়ে নিয়ে এসেছে। ডলারকে হটিয়ে দিয়ে রুবল-ইউয়ান বাণিজ্যজগতে নতুন আন্তর্জাতিক মুদ্রা হিসেবে উঠে আসছে। ইউরোপ-আমেরিকাজুড়ে নতুন পৃথিবীর মুদ্রাব্যবস্থা পাল্টে যাবে কি না, তা নিয়ে শুরু হয়েছে হিসাব-নিকাশ।
কিন্তু তাতে কতটা ক্ষতি হচ্ছে খেটে খাওয়া মানুষের, সে অঙ্ক কেউ কষছে না।
চার. আপাত দূরের একটি বিষয়কে এখানে টেনে আনা হলো বলে মনে হতে পারে। কিন্তু একেবারেই তা নয়। রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের আলাপটা এখানে খুব জরুরি। রাশিয়ার তেল আর গ্যাস নিয়ে ইউরোপের নিষেধাজ্ঞার অভিঘাত কী হবে, সেটা এখনো পরিষ্কার নয়। তৃতীয় মাধ্যম হয়ে নিষেধাজ্ঞার মধ্যেও রাশিয়ায় রপ্তানির পথ খুঁজছে ইউরোপ, সেটাও তো দেখা যাচ্ছে। রাশিয়া আর ইউক্রেনের খাদ্যশস্য যদি রপ্তানি করা না যায়, তাহলে সমূহ বিপদে পড়তে যাচ্ছে—বিশেষ করে এশিয়া, আফ্রিকার মানুষেরা।
বিশ্ববাণিজ্য খুবই জরুরি একটা বিষয় এখানে। যত বড় শত্রুই হোক না কেন, বাণিজ্য-স্বার্থে এই শত্রুতার সময়ও তলে তলে ব্যবসাটা পাকিয়ে নেওয়া চলছে। পৃথিবীর সব পুঁজিপতিই ‘পুঁজি’কেই সর্বাগ্রে স্থান দেয়।
আমরা লক্ষ রাখছি, আমাদের প্রধানমন্ত্রীর আহ্বানের দিকেও। সংযত হয়ে প্রকল্প হাতে নিতে বলছেন তিনি। মেগা প্রজেক্টগুলো কাজের না হলে অকারণে ঋণের বোঝা যে বাড়ানো যাবে না, সে বার্তা কিন্তু দিয়েছেন তিনি। কিন্তু ভয় হলো, ‘খাই খাই পার্টি’ কি এই বিপৎসংকেত আমলে নেবে? শ্রীলঙ্কার পরিস্থিতির সঙ্গে আমাদের দেশের পরিস্থিতি মেলানো ঠিক হবে না, কিন্তু সরকারের নানা অলিতে-গলিতে ‘খাই খাই পার্টি’র উপস্থিতি থাকার আশঙ্কা কম নয় এবং তারা যেকোনো সময় জাতির দুর্দশার বড় কারণ হয়ে উঠতে পারে। আর তখনই আমাদের নিত্যদিনের বাজার জীবনে নেমে আসতে পারে আতঙ্ক, সে কথাটি বলার জন্যই এত কথা বলা।
গাজীপুর মহানগরের বোর্ডবাজার এলাকার ইসলামিক ইউনিভার্সিটি অব টেকনোলজির (আইইউটি) মেকানিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের শিক্ষার্থীরা পিকনিকে যাচ্ছিলেন শ্রীপুরের মাটির মায়া ইকো রিসোর্টে। ঢাকা-ময়মনসিংহ মহাসড়ক থেকে বাসগুলো গ্রামের সরু সড়কে ঢোকার পর বিদ্যুতের তারে জড়িয়ে যায় বিআরটিসির একটি দোতলা বাস...
৩ ঘণ্টা আগেঝড়-জলোচ্ছ্বাস থেকে রক্ষায় সন্দ্বীপের ব্লক বেড়িবাঁধসহ একাধিক প্রকল্প হাতে নিয়েছে সরকার। এ লক্ষ্যে বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে ৫৬২ কোটি টাকা। এ জন্য টেন্ডারও হয়েছে। প্রায় এক বছর পেরিয়ে গেলেও ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানগুলো কাজ শুরু করছে না। পানি উন্নয়ন বোর্ডের (পাউবো) তাগাদায়ও কোনো কাজ হচ্ছে না বলে জানিয়েছেন...
৪ দিন আগেদেশের পরিবহন খাতের অন্যতম নিয়ন্ত্রণকারী ঢাকা সড়ক পরিবহন মালিক সমিতির কমিটির বৈধতা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। সাইফুল আলমের নেতৃত্বাধীন এ কমিটিকে নিবন্ধন দেয়নি শ্রম অধিদপ্তর। তবে এটি কার্যক্রম চালাচ্ছে। কমিটির নেতারা অংশ নিচ্ছেন ঢাকা পরিবহন সমন্বয় কর্তৃপক্ষ (ডিটিসিএ) ও বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষের...
৪ দিন আগেআলুর দাম নিয়ন্ত্রণে ব্যর্থ হয়ে এবার নিজেই বিক্রির উদ্যোগ নিয়েছে সরকার। বাজার স্থিতিশীল রাখতে ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশের (টিসিবি) মাধ্যমে রাজধানীতে ভ্রাম্যমাণ ট্রাকের মাধ্যমে ভর্তুকি মূল্যে আলু বিক্রি করা হবে। একজন গ্রাহক ৪০ টাকা দরে সর্বোচ্চ তিন কেজি আলু কিনতে পারবেন...
৪ দিন আগে