সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী
মন্ত্রীরা যখন ক্ষমতা থেকে সরে যান, অর্থাৎ বাধ্য হন সরে যেতে, তখন তাঁদের কীই-বা করার থাকে? এমনকি বলার মতো বক্তব্যও ফুরিয়ে যায়। তবে সেটা যে সবার ক্ষেত্রে সত্য হবে বিধিবদ্ধ এমন কোনো নিয়ম নেই। ‘সম্মানজনক’ ব্যতিক্রম অবশ্যই ঘটা সম্ভব এবং সেটা ঘটেও।
কথা আমরা বলি না, এটা ঠিক নয়। অনেক সময়ই অনেক কথা বলি। এমনকি কোনো কথা না-বলেও; এটা আমাদের সংস্কৃতির ভেতরই রয়েছে। আর তাঁরা তো কথা ঠিকই বলেন, হরদম বলেন, যাঁদের হাতে ক্ষমতা আছে। তাঁরা বলেন, আমরা শুনি। অনেক সময় অবাক হয়েই শুনি। ওইটুকুই আমাদের অধিকার। স্বাধীন দেশের নাগরিক—স্বাধীনতা বলা যেতে পারে।
এই যে নানা রকমের সমস্যা ও সংকটের ভেতর দিয়ে চলেছি আমরা, এর মধ্যে মন্ত্রী মহোদয়রা যা বলেন তা বোধ করি তাঁদের পক্ষেই বলা সম্ভব। ডেঙ্গু সমস্যা? একজন মন্ত্রী বলেছেন, ‘আমাদের দেশে ডেঙ্গুতে মৃত্যুর হার অন্য অনেক দেশের তুলনায় কম।’ শুনে আমরা কী বলব? আমাদের অনুভূতিটা কি হবে দুঃখের, নাকি সুখের? অন্য অনেক ক্ষেত্রে আমরা হরহামেশা উন্নতি করছি, এ ক্ষেত্রে পারছি না। ডেঙ্গুতে মৃত্যুর ক্ষেত্রে আমরা এখনো বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন হতে পারলাম না, সেই দুঃখে কি বুক চাপড়াব? আমরা জানি না, বুঝি না; আমরা হতবাক হয়ে শুনি। ডেঙ্গু সম্পর্কে আরেক মন্ত্রী যা আমাদের জানাচ্ছেন, তা-ও কম চমকপ্রদ নয়। তাঁর পর্যবেক্ষণ এই রকম যে ডেঙ্গুর আক্রমণ আসলে আমাদের উন্নতিরই লক্ষণ। তাঁর কথাগুলো খুবই যৌক্তিক এবং উদ্ধৃতিযোগ্য: ‘ডেঙ্গুর বাহক এডিসের মতো “এলিট” মশা এসেছে। সিঙ্গাপুর, ব্যাংকক, কলকাতা শহরে এই মশা দেখা যায়। বাংলাদেশ যখন উন্নত হচ্ছে, তখন ডেঙ্গু এসেছে। মানুষের কত অর্থনৈতিক উন্নতি ঘটছে, দ্রুত নানা রোগে আক্রান্ত হচ্ছে।’ তিনি আরও বলেছেন, ‘সোনার বাংলা গড়ার দিকে আমরা এগিয়ে যাচ্ছি।’
বাংলাদেশে এলিটরা আছেন। বৃদ্ধির ক্ষেত্রে ডেঙ্গুবাহী এলিট মশা এডিসের সঙ্গে তাঁদের নীরব একটা প্রতিদ্বন্দ্বিতা চলছে কি না, জানি না; তবে তাঁরা সংখ্যায় যে বেশ দ্রুত গতিতে বাড়ছেন, সেটা আমাদের পক্ষে না জেনে উপায় নেই। মানুষ-এলিটরা এখন আর দেশে থাকা পছন্দ করেন না, শোনা যায় তাঁরা বিদেশে ঘরবাড়ি কেনার চেষ্টা করেন, অনেকেই ইতিমধ্যে কিনেও ফেলেছেন, অন্যরাও ওই পথে যাবেন ভাবেন, যেতে না পারলে আক্ষেপ করেন। তা মানুষ-এলিটরা যখন দেশছাড়া হচ্ছেন, তখন মশা-এলিটদের ঝাঁক বেঁধে আগমন কি এই ইঙ্গিতটাই দিচ্ছে যে ভবিষ্যতের সোনার বাংলায় রোগবাহী পোকামাকড়রাই এলিট হিসেবে রাজত্ব করবে এবং নন-এলিট সাধারণ মানুষ তাদের রক্ত শোষণে শোষণে আর্তনাদ করে নির্ঘুম দিবস-রজনী যাপন করবে, ভাববে মরলে বাঁচি, অনেকে আবার মরবেও? আমাদের প্রাণপ্রিয় এই জন্মভূমিতে ভদ্রলোক আর ছোটলোকের বিভাজন সেই আদ্যিকাল থেকেই। নাম বদলে এখন এসেছে এলিট ও নন-এলিটের বেশকম। এটা যে উন্নতির লক্ষণ মন্ত্রী মহোদয়ের সঙ্গে সে-ব্যাপারে আমরা অভিন্ন মত। বাংলাদেশে পুঁজিবাদ এসেছে নাকি এখনো ঘাড় ত্যাড়া সামন্তবাদই ছদ্মবেশে দেশ শাসন করছে, এই প্রশ্নের মীমাংসা যাঁরা করতে পারেননি, তাঁরা এলিটদের তৎপরতার দিকে তাকাতে পারেন, জবাব পেতে সেটা সহায়ক হবে। তবে লক্ষণ এ রকমের যে ভিন্ন কিছু না ঘটলে এলিটরা থাকবেনই এবং নন-এলিটদের কোনো রক্ষা নেই, তাদের রক্তশোষণ চলবেই চলবে।
আমাদের বিভক্ত ঢাকার দুই নগরপিতার মধ্যে ভীষণ মিল আছে, দুজনই সরকারি দলের লোক এবং উভয়েই ঢাকাবাসীকে এডিস মশার হাত থেকে বাঁচাবেন বলে কৃতসংকল্প।
ভরসা রাখি তাঁরা মিলেমিশে মশার বিরুদ্ধে কামান এবং বাক্যবাণ দুটোই দাগতে থাকুন। আমরা বড়ই কাতর আছি।
ভালো ভালো কথা বলার ব্যাপারে মন্ত্রীদের ভেতর মনে হয় একটা অলিখিত প্রতিযোগিতা আছে। খুবই সুন্দর একটা উপমা দিয়ে কথা বলেছেন আমাদের পররাষ্ট্রমন্ত্রী। তাঁর অন্য সব চমক লাগানো উক্তির ভিড়ে এটির হারিয়ে যাওয়া কোনোমতেই উচিত হবে না। মন্ত্রী হওয়ার পরে তিনি ভারতে গিয়েছিলেন সফরে। সেটি তাঁর প্রথম বিদেশ সফর।
স্বভাবতই দুই দেশের মধ্যে সম্পর্কের ক্ষেত্রে দ্বিপক্ষীয় সমস্যাগুলোর টানাপোড়েন নিয়ে আলোচনা হয়েছে। কতগুলো সমস্যা তো ভয়ংকর রকমের গুরুত্বপূর্ণ এবং সমাধানের জন্য অপেক্ষমাণ। আলোচনা শেষে আমাদের পররাষ্ট্রমন্ত্রীকে ভারতীয় সাংবাদিকেরা ঠিক ওই সব বিষয়েই প্রশ্ন করেছিলেন। জবাবে তিনি বলেছেন, ‘স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে পারস্পরিক সম্পর্ক ঠিক থাকলে ছোটখাটো সমস্যা বড় হয়ে ওঠে না। মিটমাট হয়ে যায়।’ তাঁর এই উক্তির কোনো প্রতিবাদ বাংলাদেশে হয়েছে কি না, জানি না। হয়ে থাকলেও হয়েছে নিম্নকণ্ঠে। আমরা জানি যে আমাদের সাবেক অর্থমন্ত্রীর প্রিয় শব্দাবলির মধ্যে দুটি ছিল ‘রাবিশ’ ও ‘ননসেন্স’; সেই দুটি শব্দ এ ক্ষেত্রে তিনি প্রয়োগ করেছেন বলেও আমরা শুনিনি। তবে সাবেক হয়ে গেলে মন্ত্রীদের উক্তির যে আর তেমন একটা কদর থাকে না, এটা সত্য। কিন্তু ভারতীয় মহল থেকেও তো ওই উক্তির একটা প্রতিবাদ হতে পারত। লজ্জানত বদনে তারা তো বলতে পারত, না না, ওটা ঠিক নয়, আমাদের পারস্পরিক সম্পর্কটা স্বামী-স্ত্রীর হবে কেন, ওটা তো ভাইয়ের সঙ্গে ভাইয়ের সম্পর্ক।
তবে ভাই-ভাই সম্পর্ক যে এখন মধুর থাকে তা অবশ্য নয়, ভাই ভাই ঠাঁই ঠাঁই এ প্রবাদটি অতীতে যতটা না সত্য ছিল, এখন সত্য তার চেয়ে অনেক অধিক। তবু ভদ্রতা বলে একটা জিনিস আছে না? আর আমাদের সমস্যাগুলো ছোটখাটো, এই উক্তি কি যথার্থ? তিস্তার পানি, অসম বাণিজ্য, বাংলাদেশ থেকে রেমিট্যান্স বৃদ্ধির কার্যকারণ, রোহিঙ্গা ইস্যুতে ভারতের ছলনাময় ভূমিকা, অবৈধ ঘোষণা করে ভারত থেকে মুসলমান বাঙালিদের ঘাড় ধরে বাংলাদেশে ঠেলে পাঠানোর শঙ্কা, সীমান্তে অনবরত মানুষ হত্যা—এগুলোকে ছোটখাটো হিসেবে বিবেচনা করাটা জবাবদিহিবিহীন বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রীর পক্ষে সম্ভব হলেও দেশের মানুষের পক্ষে তাদের ছোটখাটো বলে উড়িয়ে দিয়ে মন্ত্রীর আওয়াজে গলা মেলানো কিছুতেই সম্ভব নয়। গলা ধরে আসে উদ্বেগে, উৎকণ্ঠায়।
মন্ত্রীরা যখন ক্ষমতা থেকে সরে যান, অর্থাৎ বাধ্য হন সরে যেতে, তখন তাঁদের কীই-বা করার থাকে? এমনকি বলার মতো বক্তব্যও ফুরিয়ে যায়। তবে সেটা যে সবার ক্ষেত্রে সত্য হবে বিধিবদ্ধ এমন কোনো নিয়ম নেই। ‘সম্মানজনক’ ব্যতিক্রম অবশ্যই ঘটা সম্ভব এবং সেটা ঘটেও। যেমন আওয়ামী লীগের সঙ্গে ঐতিহাসিক কোলাকুলিতে আবদ্ধ হয়ে এবং নিজ নিজ দলের খাঁটি কর্মীদের পাবলিকের কাছে জবাবদিহির ধুলায়-ধূসর পথে বসিয়ে দিয়ে মন্ত্রী হয়েছিলেন যে দুজন বিপ্লবপন্থী বলে স্বঘোষিত নেতা, তাঁদের ক্ষেত্রে ঘটেছে, দেখতে পাচ্ছি। তাঁরা মোটেই কথা থামাননি। ১৪ দলের এক সভায় তাঁরা উভয়েই বলেছিলেন যে এখনকার মন্ত্রীরা কাজ করেন না; অর্থাৎ তাঁরা যখন মন্ত্রী ছিলেন, তখন খুব কাজ করতেন। সেই দাবি মোটেই অযথার্থ নয়। তাঁরা খুবই কাজের মানুষ ছিলেন এবং তাঁদের ওপর খুব বড় একটা দায়িত্ব ছিল, সেটা হলো প্রধান বিরোধী দল বিএনপির অনবরত সমালোচনা করা। দুজনের একজন ছিলেন তথ্যমন্ত্রী। তিনি তো মনে হতো সকাল, দুপুর ও রাতনির্বিশেষে অবিরাম তথ্য বিতরণ করেছেন এবং সেই সব তথ্যের কেন্দ্রে থাকত বিএনপি যে কতটা স্বাধীনতাবিরোধী এবং বিএনপির নেত্রী কেমন ভয়ংকর ও অঙ্গীকারবদ্ধ একজন দেশদ্রোহী, সেই তথ্য সর্বজনগ্রাহ্য করে তোলা।
আমরা ঠিক জানি না, তবে তথ্যপ্রযুক্তি অধিকার বিষয়ে আইন রয়েছে বলে শুনেছি, কিন্তু সেই আইনের বলে রাষ্ট্রীয় গোপন তথ্য জানতে চাওয়া যাবে—এমনটা নিশ্চয়ই সম্ভব নয়, চাইতে গেলে বিপদ হবে, এমন নিদর্শনই বরং দৃশ্যমান রয়েছে। পদ হারানো বিপ্লবপন্থী নেতারা হয়তো বলতে চাইছেন, এখনকার মন্ত্রীরা সবাই অপদার্থ, তাঁরা কাজ করেন না। আমাদের পুনরায় মন্ত্রী করুন, কাজ কাকে বলে দেখিয়ে দেব, আগের তুলনায় দ্বিগুণ, তিন গুণ, বহুগুণ বেগে কাজ করব। কিন্তু হায়, সরকার হয়তো ভাবছে তাঁরা যে কাজ করতে সক্ষম, যে কাজের জন্য তাঁদের মন্ত্রিত্ব দেওয়া হয়েছিল, সেই কাজ এখন আর তেমন নেই; যেটুকু অবশিষ্ট রয়েছে তার ভার আমরা নিজেরাই নিতে পারব, ভাড়া করা লোকের দরকার নেই। বাজে খরচে কী লাভ?
আর তথ্য জানতে চাওয়া? অত বড় প্রতিষ্ঠান জাতিসংঘ সে-ই হার মানে, আমরা কোন ছার। খবরে প্রকাশ, বাংলাদেশে গুমের তথ্য চেয়ে গত ৯ বছরে জাতিসংঘ দশ-দশটি চিঠি পাঠিয়েছে; জবাব পায়নি। তাগাদা দিয়েছে, অসন্তোষ প্রকাশ করেছে; কিন্তু সরকার সাড়া দেয়নি।
তা এসব বড় বড় ব্যাপারে নাক না হয় না-ই গলালাম, কিন্তু ছোট ছোট ব্যাপারেও তো ভীষণ ভয়াবহ। এই যে ডেঙ্গু, তার আতঙ্কে তো লোকে কোথাও স্থির থাকতে পারছে না।
না ঘরে, না বাইরে। ওদিকে শোনা যাচ্ছে ডেঙ্গু থাকবে, ‘ইট হ্যাজ কাম টু স্টে’। ‘পাকিস্তান হ্যাজ কাম টু স্টে’ বলে একদা ঘোষণা দিয়েছিলেন ‘জাতির পিতা’ কায়েদে আজম মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ। অতি ভয়ংকর সেই ভবিষ্যদ্বাণীকে মিথ্যা প্রমাণ করতে আমাদের যুদ্ধে যেতে হয়েছে, প্রাণ হারিয়েছে ৩০ লাখ ভাই-বোন; এখন ‘ডেঙ্গু হ্যাজ কাম টু স্টে’কে মিথ্যা প্রমাণ করতে না জানি কত মূল্য দিতে হবে। আমাদের বুক কাঁপে। নিজেদের যতই বীরের জাত বলি না কেন, মার খেয়ে খেয়ে ইতিমধ্যে আমরা বেশ ভিতু হয়ে পড়েছি, সন্ত্রস্ত থাকি। সর্বত্র সন্ত্রাসীদের দেখতে পাই। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী এসে হাজির হলে নিশ্চিন্ত হওয়ার পরিবর্তে দুশ্চিন্তাগ্রস্তই হই।
লেখক: সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী, ইমেরিটাস অধ্যাপক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
মন্ত্রীরা যখন ক্ষমতা থেকে সরে যান, অর্থাৎ বাধ্য হন সরে যেতে, তখন তাঁদের কীই-বা করার থাকে? এমনকি বলার মতো বক্তব্যও ফুরিয়ে যায়। তবে সেটা যে সবার ক্ষেত্রে সত্য হবে বিধিবদ্ধ এমন কোনো নিয়ম নেই। ‘সম্মানজনক’ ব্যতিক্রম অবশ্যই ঘটা সম্ভব এবং সেটা ঘটেও।
কথা আমরা বলি না, এটা ঠিক নয়। অনেক সময়ই অনেক কথা বলি। এমনকি কোনো কথা না-বলেও; এটা আমাদের সংস্কৃতির ভেতরই রয়েছে। আর তাঁরা তো কথা ঠিকই বলেন, হরদম বলেন, যাঁদের হাতে ক্ষমতা আছে। তাঁরা বলেন, আমরা শুনি। অনেক সময় অবাক হয়েই শুনি। ওইটুকুই আমাদের অধিকার। স্বাধীন দেশের নাগরিক—স্বাধীনতা বলা যেতে পারে।
এই যে নানা রকমের সমস্যা ও সংকটের ভেতর দিয়ে চলেছি আমরা, এর মধ্যে মন্ত্রী মহোদয়রা যা বলেন তা বোধ করি তাঁদের পক্ষেই বলা সম্ভব। ডেঙ্গু সমস্যা? একজন মন্ত্রী বলেছেন, ‘আমাদের দেশে ডেঙ্গুতে মৃত্যুর হার অন্য অনেক দেশের তুলনায় কম।’ শুনে আমরা কী বলব? আমাদের অনুভূতিটা কি হবে দুঃখের, নাকি সুখের? অন্য অনেক ক্ষেত্রে আমরা হরহামেশা উন্নতি করছি, এ ক্ষেত্রে পারছি না। ডেঙ্গুতে মৃত্যুর ক্ষেত্রে আমরা এখনো বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন হতে পারলাম না, সেই দুঃখে কি বুক চাপড়াব? আমরা জানি না, বুঝি না; আমরা হতবাক হয়ে শুনি। ডেঙ্গু সম্পর্কে আরেক মন্ত্রী যা আমাদের জানাচ্ছেন, তা-ও কম চমকপ্রদ নয়। তাঁর পর্যবেক্ষণ এই রকম যে ডেঙ্গুর আক্রমণ আসলে আমাদের উন্নতিরই লক্ষণ। তাঁর কথাগুলো খুবই যৌক্তিক এবং উদ্ধৃতিযোগ্য: ‘ডেঙ্গুর বাহক এডিসের মতো “এলিট” মশা এসেছে। সিঙ্গাপুর, ব্যাংকক, কলকাতা শহরে এই মশা দেখা যায়। বাংলাদেশ যখন উন্নত হচ্ছে, তখন ডেঙ্গু এসেছে। মানুষের কত অর্থনৈতিক উন্নতি ঘটছে, দ্রুত নানা রোগে আক্রান্ত হচ্ছে।’ তিনি আরও বলেছেন, ‘সোনার বাংলা গড়ার দিকে আমরা এগিয়ে যাচ্ছি।’
বাংলাদেশে এলিটরা আছেন। বৃদ্ধির ক্ষেত্রে ডেঙ্গুবাহী এলিট মশা এডিসের সঙ্গে তাঁদের নীরব একটা প্রতিদ্বন্দ্বিতা চলছে কি না, জানি না; তবে তাঁরা সংখ্যায় যে বেশ দ্রুত গতিতে বাড়ছেন, সেটা আমাদের পক্ষে না জেনে উপায় নেই। মানুষ-এলিটরা এখন আর দেশে থাকা পছন্দ করেন না, শোনা যায় তাঁরা বিদেশে ঘরবাড়ি কেনার চেষ্টা করেন, অনেকেই ইতিমধ্যে কিনেও ফেলেছেন, অন্যরাও ওই পথে যাবেন ভাবেন, যেতে না পারলে আক্ষেপ করেন। তা মানুষ-এলিটরা যখন দেশছাড়া হচ্ছেন, তখন মশা-এলিটদের ঝাঁক বেঁধে আগমন কি এই ইঙ্গিতটাই দিচ্ছে যে ভবিষ্যতের সোনার বাংলায় রোগবাহী পোকামাকড়রাই এলিট হিসেবে রাজত্ব করবে এবং নন-এলিট সাধারণ মানুষ তাদের রক্ত শোষণে শোষণে আর্তনাদ করে নির্ঘুম দিবস-রজনী যাপন করবে, ভাববে মরলে বাঁচি, অনেকে আবার মরবেও? আমাদের প্রাণপ্রিয় এই জন্মভূমিতে ভদ্রলোক আর ছোটলোকের বিভাজন সেই আদ্যিকাল থেকেই। নাম বদলে এখন এসেছে এলিট ও নন-এলিটের বেশকম। এটা যে উন্নতির লক্ষণ মন্ত্রী মহোদয়ের সঙ্গে সে-ব্যাপারে আমরা অভিন্ন মত। বাংলাদেশে পুঁজিবাদ এসেছে নাকি এখনো ঘাড় ত্যাড়া সামন্তবাদই ছদ্মবেশে দেশ শাসন করছে, এই প্রশ্নের মীমাংসা যাঁরা করতে পারেননি, তাঁরা এলিটদের তৎপরতার দিকে তাকাতে পারেন, জবাব পেতে সেটা সহায়ক হবে। তবে লক্ষণ এ রকমের যে ভিন্ন কিছু না ঘটলে এলিটরা থাকবেনই এবং নন-এলিটদের কোনো রক্ষা নেই, তাদের রক্তশোষণ চলবেই চলবে।
আমাদের বিভক্ত ঢাকার দুই নগরপিতার মধ্যে ভীষণ মিল আছে, দুজনই সরকারি দলের লোক এবং উভয়েই ঢাকাবাসীকে এডিস মশার হাত থেকে বাঁচাবেন বলে কৃতসংকল্প।
ভরসা রাখি তাঁরা মিলেমিশে মশার বিরুদ্ধে কামান এবং বাক্যবাণ দুটোই দাগতে থাকুন। আমরা বড়ই কাতর আছি।
ভালো ভালো কথা বলার ব্যাপারে মন্ত্রীদের ভেতর মনে হয় একটা অলিখিত প্রতিযোগিতা আছে। খুবই সুন্দর একটা উপমা দিয়ে কথা বলেছেন আমাদের পররাষ্ট্রমন্ত্রী। তাঁর অন্য সব চমক লাগানো উক্তির ভিড়ে এটির হারিয়ে যাওয়া কোনোমতেই উচিত হবে না। মন্ত্রী হওয়ার পরে তিনি ভারতে গিয়েছিলেন সফরে। সেটি তাঁর প্রথম বিদেশ সফর।
স্বভাবতই দুই দেশের মধ্যে সম্পর্কের ক্ষেত্রে দ্বিপক্ষীয় সমস্যাগুলোর টানাপোড়েন নিয়ে আলোচনা হয়েছে। কতগুলো সমস্যা তো ভয়ংকর রকমের গুরুত্বপূর্ণ এবং সমাধানের জন্য অপেক্ষমাণ। আলোচনা শেষে আমাদের পররাষ্ট্রমন্ত্রীকে ভারতীয় সাংবাদিকেরা ঠিক ওই সব বিষয়েই প্রশ্ন করেছিলেন। জবাবে তিনি বলেছেন, ‘স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে পারস্পরিক সম্পর্ক ঠিক থাকলে ছোটখাটো সমস্যা বড় হয়ে ওঠে না। মিটমাট হয়ে যায়।’ তাঁর এই উক্তির কোনো প্রতিবাদ বাংলাদেশে হয়েছে কি না, জানি না। হয়ে থাকলেও হয়েছে নিম্নকণ্ঠে। আমরা জানি যে আমাদের সাবেক অর্থমন্ত্রীর প্রিয় শব্দাবলির মধ্যে দুটি ছিল ‘রাবিশ’ ও ‘ননসেন্স’; সেই দুটি শব্দ এ ক্ষেত্রে তিনি প্রয়োগ করেছেন বলেও আমরা শুনিনি। তবে সাবেক হয়ে গেলে মন্ত্রীদের উক্তির যে আর তেমন একটা কদর থাকে না, এটা সত্য। কিন্তু ভারতীয় মহল থেকেও তো ওই উক্তির একটা প্রতিবাদ হতে পারত। লজ্জানত বদনে তারা তো বলতে পারত, না না, ওটা ঠিক নয়, আমাদের পারস্পরিক সম্পর্কটা স্বামী-স্ত্রীর হবে কেন, ওটা তো ভাইয়ের সঙ্গে ভাইয়ের সম্পর্ক।
তবে ভাই-ভাই সম্পর্ক যে এখন মধুর থাকে তা অবশ্য নয়, ভাই ভাই ঠাঁই ঠাঁই এ প্রবাদটি অতীতে যতটা না সত্য ছিল, এখন সত্য তার চেয়ে অনেক অধিক। তবু ভদ্রতা বলে একটা জিনিস আছে না? আর আমাদের সমস্যাগুলো ছোটখাটো, এই উক্তি কি যথার্থ? তিস্তার পানি, অসম বাণিজ্য, বাংলাদেশ থেকে রেমিট্যান্স বৃদ্ধির কার্যকারণ, রোহিঙ্গা ইস্যুতে ভারতের ছলনাময় ভূমিকা, অবৈধ ঘোষণা করে ভারত থেকে মুসলমান বাঙালিদের ঘাড় ধরে বাংলাদেশে ঠেলে পাঠানোর শঙ্কা, সীমান্তে অনবরত মানুষ হত্যা—এগুলোকে ছোটখাটো হিসেবে বিবেচনা করাটা জবাবদিহিবিহীন বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রীর পক্ষে সম্ভব হলেও দেশের মানুষের পক্ষে তাদের ছোটখাটো বলে উড়িয়ে দিয়ে মন্ত্রীর আওয়াজে গলা মেলানো কিছুতেই সম্ভব নয়। গলা ধরে আসে উদ্বেগে, উৎকণ্ঠায়।
মন্ত্রীরা যখন ক্ষমতা থেকে সরে যান, অর্থাৎ বাধ্য হন সরে যেতে, তখন তাঁদের কীই-বা করার থাকে? এমনকি বলার মতো বক্তব্যও ফুরিয়ে যায়। তবে সেটা যে সবার ক্ষেত্রে সত্য হবে বিধিবদ্ধ এমন কোনো নিয়ম নেই। ‘সম্মানজনক’ ব্যতিক্রম অবশ্যই ঘটা সম্ভব এবং সেটা ঘটেও। যেমন আওয়ামী লীগের সঙ্গে ঐতিহাসিক কোলাকুলিতে আবদ্ধ হয়ে এবং নিজ নিজ দলের খাঁটি কর্মীদের পাবলিকের কাছে জবাবদিহির ধুলায়-ধূসর পথে বসিয়ে দিয়ে মন্ত্রী হয়েছিলেন যে দুজন বিপ্লবপন্থী বলে স্বঘোষিত নেতা, তাঁদের ক্ষেত্রে ঘটেছে, দেখতে পাচ্ছি। তাঁরা মোটেই কথা থামাননি। ১৪ দলের এক সভায় তাঁরা উভয়েই বলেছিলেন যে এখনকার মন্ত্রীরা কাজ করেন না; অর্থাৎ তাঁরা যখন মন্ত্রী ছিলেন, তখন খুব কাজ করতেন। সেই দাবি মোটেই অযথার্থ নয়। তাঁরা খুবই কাজের মানুষ ছিলেন এবং তাঁদের ওপর খুব বড় একটা দায়িত্ব ছিল, সেটা হলো প্রধান বিরোধী দল বিএনপির অনবরত সমালোচনা করা। দুজনের একজন ছিলেন তথ্যমন্ত্রী। তিনি তো মনে হতো সকাল, দুপুর ও রাতনির্বিশেষে অবিরাম তথ্য বিতরণ করেছেন এবং সেই সব তথ্যের কেন্দ্রে থাকত বিএনপি যে কতটা স্বাধীনতাবিরোধী এবং বিএনপির নেত্রী কেমন ভয়ংকর ও অঙ্গীকারবদ্ধ একজন দেশদ্রোহী, সেই তথ্য সর্বজনগ্রাহ্য করে তোলা।
আমরা ঠিক জানি না, তবে তথ্যপ্রযুক্তি অধিকার বিষয়ে আইন রয়েছে বলে শুনেছি, কিন্তু সেই আইনের বলে রাষ্ট্রীয় গোপন তথ্য জানতে চাওয়া যাবে—এমনটা নিশ্চয়ই সম্ভব নয়, চাইতে গেলে বিপদ হবে, এমন নিদর্শনই বরং দৃশ্যমান রয়েছে। পদ হারানো বিপ্লবপন্থী নেতারা হয়তো বলতে চাইছেন, এখনকার মন্ত্রীরা সবাই অপদার্থ, তাঁরা কাজ করেন না। আমাদের পুনরায় মন্ত্রী করুন, কাজ কাকে বলে দেখিয়ে দেব, আগের তুলনায় দ্বিগুণ, তিন গুণ, বহুগুণ বেগে কাজ করব। কিন্তু হায়, সরকার হয়তো ভাবছে তাঁরা যে কাজ করতে সক্ষম, যে কাজের জন্য তাঁদের মন্ত্রিত্ব দেওয়া হয়েছিল, সেই কাজ এখন আর তেমন নেই; যেটুকু অবশিষ্ট রয়েছে তার ভার আমরা নিজেরাই নিতে পারব, ভাড়া করা লোকের দরকার নেই। বাজে খরচে কী লাভ?
আর তথ্য জানতে চাওয়া? অত বড় প্রতিষ্ঠান জাতিসংঘ সে-ই হার মানে, আমরা কোন ছার। খবরে প্রকাশ, বাংলাদেশে গুমের তথ্য চেয়ে গত ৯ বছরে জাতিসংঘ দশ-দশটি চিঠি পাঠিয়েছে; জবাব পায়নি। তাগাদা দিয়েছে, অসন্তোষ প্রকাশ করেছে; কিন্তু সরকার সাড়া দেয়নি।
তা এসব বড় বড় ব্যাপারে নাক না হয় না-ই গলালাম, কিন্তু ছোট ছোট ব্যাপারেও তো ভীষণ ভয়াবহ। এই যে ডেঙ্গু, তার আতঙ্কে তো লোকে কোথাও স্থির থাকতে পারছে না।
না ঘরে, না বাইরে। ওদিকে শোনা যাচ্ছে ডেঙ্গু থাকবে, ‘ইট হ্যাজ কাম টু স্টে’। ‘পাকিস্তান হ্যাজ কাম টু স্টে’ বলে একদা ঘোষণা দিয়েছিলেন ‘জাতির পিতা’ কায়েদে আজম মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ। অতি ভয়ংকর সেই ভবিষ্যদ্বাণীকে মিথ্যা প্রমাণ করতে আমাদের যুদ্ধে যেতে হয়েছে, প্রাণ হারিয়েছে ৩০ লাখ ভাই-বোন; এখন ‘ডেঙ্গু হ্যাজ কাম টু স্টে’কে মিথ্যা প্রমাণ করতে না জানি কত মূল্য দিতে হবে। আমাদের বুক কাঁপে। নিজেদের যতই বীরের জাত বলি না কেন, মার খেয়ে খেয়ে ইতিমধ্যে আমরা বেশ ভিতু হয়ে পড়েছি, সন্ত্রস্ত থাকি। সর্বত্র সন্ত্রাসীদের দেখতে পাই। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী এসে হাজির হলে নিশ্চিন্ত হওয়ার পরিবর্তে দুশ্চিন্তাগ্রস্তই হই।
লেখক: সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী, ইমেরিটাস অধ্যাপক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
ঝড়-জলোচ্ছ্বাস থেকে রক্ষায় সন্দ্বীপের ব্লক বেড়িবাঁধসহ একাধিক প্রকল্প হাতে নিয়েছে সরকার। এ লক্ষ্যে বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে ৫৬২ কোটি টাকা। এ জন্য টেন্ডারও হয়েছে। প্রায় এক বছর পেরিয়ে গেলেও ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানগুলো কাজ শুরু করছে না। পানি উন্নয়ন বোর্ডের (পাউবো) তাগাদায়ও কোনো কাজ হচ্ছে না বলে জানিয়েছেন...
৩ দিন আগেদেশের পরিবহন খাতের অন্যতম নিয়ন্ত্রণকারী ঢাকা সড়ক পরিবহন মালিক সমিতির কমিটির বৈধতা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। সাইফুল আলমের নেতৃত্বাধীন এ কমিটিকে নিবন্ধন দেয়নি শ্রম অধিদপ্তর। তবে এটি কার্যক্রম চালাচ্ছে। কমিটির নেতারা অংশ নিচ্ছেন ঢাকা পরিবহন সমন্বয় কর্তৃপক্ষ (ডিটিসিএ) ও বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষের...
৩ দিন আগেআলুর দাম নিয়ন্ত্রণে ব্যর্থ হয়ে এবার নিজেই বিক্রির উদ্যোগ নিয়েছে সরকার। বাজার স্থিতিশীল রাখতে ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশের (টিসিবি) মাধ্যমে রাজধানীতে ভ্রাম্যমাণ ট্রাকের মাধ্যমে ভর্তুকি মূল্যে আলু বিক্রি করা হবে। একজন গ্রাহক ৪০ টাকা দরে সর্বোচ্চ তিন কেজি আলু কিনতে পারবেন...
৩ দিন আগেসপ্তাহখানেক আগে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকে অনেকের ওয়াল বিষাদময় হয়ে উঠেছিল ফুলের মতো ছোট্ট শিশু মুনতাহাকে হত্যার ঘটনায়। ৫ বছর বয়সী সিলেটের এই শিশুকে অপহরণের পর হত্যা করে লাশ গুম করতে ডোবায় ফেলে রাখা হয়েছিল। প্রতিবেশী গৃহশিক্ষকের পরিকল্পনায় অপহরণের পর তাকে নির্মমভাবে হত্যা করা হয়...
৩ দিন আগে