জীবন ও টাকা

বাসব রায়
প্রকাশ : ১৮ ফেব্রুয়ারি ২০২৪, ০৭: ৩৫

জীবনে টাকার দরকার খুব বেশি। টাকা ছাড়া জীবন পুরোপুরি অর্থহীন। ন্যূনতম শ্বাস-প্রশ্বাসটুকু চালু রাখতেও টাকার প্রয়োজন। ‘টাকা স্বর্গ টাকা ধর্ম টাকাহি পরমং তপঃ, যস্য গৃহে টাকা নাস্তি হা টাকা হা টাকা টকটকায়তি...।’ টাকা টাকা করতেই জীবন শেষ! মানুষ ছাড়া পৃথিবীতে আর কোনো প্রাণীর টাকার দরকার নেই। টাকা ছাড়া পলক নড়ে না। বেঁচে থাকতেও টাকা, মরণেও টাকা! টাকা আছে তো সম্মান আছে, টাকা নেই তো কিছুই নেই।

টাকার দরকার আছে এটি যেমন ঠিক, তবে এর সীমাবদ্ধতাও আছে; সীমিত টাকার মধ্যেও ভালো থাকা যায়। জীবনের চাহিদাগুলোকে নিয়ন্ত্রণে রাখতে পারলে টাকার সমস্যা না-ও হতে পারে; তবে টাকা লাগবেই। টাকা পাপ নিয়ে আসে, লোভ নিয়ে আসে, জিঘাংসার সৃষ্টি করে। আবার টাকা পুণ্য অর্জন থেকে সেবা বা মহৎ কাজেও ব্যবহৃত হয়ে থাকে। টাকা মানুষের মানসিকতার ওপর পরিচালিত হয়। মানুষের মানবিক বা অমানবিক আচরণের ওপর টাকার একটি বৃহৎ প্রভাব লক্ষণীয়।

ব্যক্তিজীবনে, সাংসারিক জীবনে, সামাজিক বা পেশাভিত্তিক জীবনে টাকার ব্যবহার উল্লেখ করার মতো। পৃথিবীর সবকিছুর মাপকাঠি বোধকরি একমাত্র টাকাই হয়। বিল গেটস, মুকেশ আম্বানি, বিরলা বা টাটাসহ বড় বড় ধনীর হাতের মুঠোয় গোটা পৃথিবী চলছে। কিন্তু টাকার সংকটে বা টাকার অভাবে কোটি কোটি মানুষ কোনোভাবে বেঁচে বা মরে আছে। এরপরও অর্থহীন মানুষেরা বাঁচতে চায়, বাঁচার সে কী লড়াই! মানুষ সুখী হতে চায়, মানুষ অনন্তকাল বেঁচে থাকতে চায় আর এর জন্য সর্বোপরি টাকার প্রয়োজনটাই বেশি পড়ে।

মানুষ টাকার জন্য চোর হয়, ডাকাত হয়, খুনি হয়, দুর্নীতিবাজ হয়, বিশ্বাসঘাতক হয়, নিমকহারাম পর্যন্ত হয়। আসলেই টাকা পৃথিবীকে দিন দিন অসহিষ্ণু করে তুলেছে। মানুষের অফুরন্ত চাহিদা, আত্মমর্যাদাকে সমুন্নত রাখা কিংবা সব সময় নিজেকে বিজয়ী করার মানসিকতা বা প্রতিযোগিতাই নষ্ট করছে মানুষের চরিত্র বা অন্তরকে। কেউ এক শ টাকার জন্য উপোসে মরে, কেউ কোটি টাকার মালিক হয়েও বিশ্বসেরা দুর্নীতিবাজের তালিকায় নাম লিখিয়ে চলছে। আজব বিশ্ব, আজব কারবার!

সামাজিক বা রাজনৈতিক মেরুকরণে বিশ্বব্যাপী টাকার প্রয়োজনীয়তা গুরুত্বপূর্ণ। মানুষ মানুষকে বা সভ্যতাকে ধ্বংস করতেও টাকাকে কাজে লাগায় আবার নিজেদের অস্তিত্বকে রক্ষা করতেও টাকার পেছনেই ছুটে বেড়ায়। কী অনবদ্য বৈপরীত্য! পৃথিবী সবভাবেই সর্বাধুনিক পরিস্থিতিতে বা প্রযুক্তিতে অগ্রসরমাণ। জেনারেশনভিত্তিক বিবেচনায় ‘ফাইভ-জি’ প্রক্রিয়ায় বর্তমান বিশ্ব। জ্ঞান-বিজ্ঞানের বিস্তর প্রসারসহ মহাজাগতিক বিস্ময়কে জয় করতে মরিয়া বিশ্বের শুধু টাকারই প্রয়োজন।

টাকা ব্যতিরেকে কিছুই হয় না। আর এই টাকার জন্যই বিশ্বজুড়ে আহাজারি, বিশ্বজুড়ে বিশৃঙ্খলা। লড়াই, যুদ্ধবিগ্রহ এখন নিত্যনৈমিত্তিক একটি গা-সয়ে যাওয়া বিষয় হয়ে গেছে। মানুষ কত অত্যাধুনিক অস্ত্র তৈরি করছে হাজার কোটি টাকার বিনিময়ে পাঁচ পয়সার জীবনটাকে শেষ করতে! মানুষ তো এমনিতেই মরবে, মরতে তাকে হবেই; কিন্তু প্রতিহিংসাপরায়ণ মানসিকতা টাকার কারণে কোনোভাবেই বাঁচতে দেবে না এবং কেউ কাউকেই ছাড় দিচ্ছে না, বাঁচতেও দিচ্ছে না। অসহনীয় এবং অসম প্রতিযোগিতায় মানুষ নিজেদের সমর্পণ করেছে এক জীবন-জীবন খেলায়, যেখানে নিঃসন্দেহে টাকার ভূমিকা মুখ্য।

শান্তি নির্ভর করে টাকার হিসাবে, আবার অশান্তির মূল কারণও এই টাকা। মানুষকে টাকা সৃষ্টি করেছে কি না, জানা নেই কিন্তু টাকার সৃষ্টি তো মানুষের হাতেই হয়েছে; সেই টাকার কাছে গোলাম হয়ে গেছে সব মানুষ, পুরো বিশ্ব। সমাজতান্ত্রিক বিপ্লব শুরু হয়েছিল মূলত মানুষের শ্রেণি-বিভাজন যেন না থাকে। পৃথিবী হবে শ্রেণিবৈষম্যহীন এবং মানুষ মানুষের অধিকার থেকে বঞ্চিত হবে না কখনো।

সোভিয়েত ইউনিয়ন, চীন প্রভৃতি দেশ নিজেদের সমাজতন্ত্রে বিশ্বাসী করতে সক্ষম হয়েছিল এবং সারা বিশ্বে ব্যাপক প্রভাবও ফেলেছিল।কিন্তু ধনিকশ্রেণি, বণিকশ্রেণিরা এ রকম তন্ত্র মেনে নিতে পারেনি কখনোই; ফলে শক্তিধর রাষ্ট্র সোভিয়েত ইউনিয়ন খণ্ড খণ্ড হয়ে যায়, চীনের সমাজতান্ত্রিক রীতিনীতিতেও অনেক পরিবর্তন আনতে হয়। পুঁজিবাদ বা টাকা-বাদের কাছে হেরে যায় সমাজতন্ত্রের ভাবনা বা ধারণা। সব ক্ষেত্রেই টাকার নানামুখী কাজ। মানুষ বা পৃথিবীর নিয়ন্ত্রণে টাকার ভূমিকাই প্রধান।

লেখক: কবি

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
খুঁজুন

সম্পর্কিত