Ajker Patrika

বিত্তবান মানুষের দেশ

মামুনুর রশীদ
আপডেট : ২৬ অক্টোবর ২০২৩, ০৮: ০১
বিত্তবান মানুষের দেশ

বিত্ত এবং অস্ত্র দুটোই বিপজ্জনক। দুটিকেই অধিকাংশ মানুষ গোপন করে রাখতে চায়। কিন্তু প্রকাশ হয়ে যায় চালচলন ও কর্মকাণ্ডে। এ ঘটনা বাংলাদেশে খুবই অদ্ভুত।প্রতিবেশী ভদ্রলোক তেমন কিছুই করেন না, থাকেন ছোট্ট একটা টিনের ঘরে। মাঝে মাঝে বাইরে বের হন। টুকটুক করে সংসার চলে। হঠাৎ দেখা গেল টিনের ঘর ভেঙে ফেলা হচ্ছে। তার স্থানে গড়ে উঠছে একটা দালান। ওই বাড়ির ছেলেমেয়েদের পোশাক-আশাকের পরিবর্তন ঘটছে। বাড়িতে বাজার আসছে রিকশা বা ভ্যান বোঝাই করে। প্রতিবেশীদের মধ্যে কৌতূহল। কিন্তু কিছুদিন না যেতেই বাড়ির কর্তা মোটরসাইকেল নিয়ে বের হচ্ছেন। বছর দুয়েক না ঘুরতেই একটা গ্যারেজ হয়ে যাচ্ছে, সেখানে ঢুকছে একটি গাড়ি। গাড়ি ঢোকার পর দেখা গেল ভদ্রলোকের সালাম বেড়ে গেল। শুধু তা-ই নয়, বাড়িতে আরও গাড়ি ঢোকার শব্দ পাওয়া যাচ্ছে। যাঁরা এই বাড়িতে আসেন, তাঁদের চেহারায়ও বিত্তের ছাপ লক্ষ করা যায়।

বাড়ির ভদ্রমহিলা অসুস্থ হলেন। প্রথমে অ্যাম্বুলেন্সে করে ঢাকায়, পরে ঢাকা থেকে সিঙ্গাপুর নেওয়া হলো। এখন আর প্রতিবেশীরা কৌতূহলী হয় না। এমনকি প্রশ্নও করে না। এরপর এল ভদ্রলোকের বড় মেয়ের বিয়ে। চারদিকে বিয়ের আয়োজন। গায়েহলুদের রাতে আশপাশের মানুষের ঘুম নষ্ট হওয়ার উপক্রম। গানের সঙ্গে নাচ এবং একদিন সিনেমার এক নায়িকাকেও দেখা গেল। এরপরের ঘটনা খুব সংক্ষিপ্ত। ভদ্রলোক সপরিবারে চলে গেলেন ঢাকায়, বাড়িতে তালা। মাঝেমধ্যে বাড়িতে আসেন, থাকেন এক বেলা।

এটা হচ্ছে মফস্বলের চিত্র, ঢাকার চিত্র অন্য রকম। ফ্ল্যাটবাড়িতে কেউ কারও খোঁজ নেয় না। শুধু গাড়ির সংখ্যা বাড়লে আশপাশের ফ্ল্যাটের লোকেরা একটু ভ্রু কুঁচকায়। শহরে অ্যাপার্টমেন্টের সংখ্যা বেড়েই যাচ্ছে। সেই সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বিত্তবান লোকের সংখ্যাও বাড়ছে। প্রায়ই খবরের কাগজে সংবাদ আসে তিন বছর আগেও যিনি চেয়েচিন্তে খেতেন, সেই লোকটি ছোট্ট একটা দোকান করলেন, নামমাত্র দোকান। দোকানটি অধিকাংশ সময়ই বন্ধ থাকত। লোকটি মোটরসাইকেল চালান, দোকানে আসার কোনো ঠিকঠিকানা নেই, সঙ্গে একটা লোক থাকে আর থাকে একটা ছোট ব্যাগ। এরপর পৌরসভার নির্বাচন। নির্বাচনে অঢেল টাকা ব্যয় করে লোকটা এবং জয়ী হন।

এরপর আর দোকানে আসতে হয় না। শহরের উপকণ্ঠে দালান ওঠে এবং মানুষকে সালাম দেওয়ার দিন শেষ। এবার তাঁর সালাম পাওয়ার সময়। আসলে ওই ব্যাগটায় কী ছিল? একটু বাড়াবাড়ি করতে গিয়ে অতীতটা বেরিয়ে যায়, ওই ব্যাগের মধ্যে থাকত অস্ত্র। এই অস্ত্রই তাঁর কপাল খুলে দিয়েছে। বিত্তের দিক থেকে তিনি ১০ বছরে এরশাদ শিকদারের কাছাকাছি চলে গেছেন। কোনো কিছুই প্রকাশ পেত না। সমস্যা করেছেন তাঁর প্রথম স্ত্রী।

আরেকজন ছিলেন একটি অফিসের পিয়ন। সাহেবদের বাজারঘাট করে দেওয়া, বেগম সাহেবের ফুটফরমাশের কাজটা করেছেন অনেক দিন। সাহেব হঠাৎ করে পদোন্নতি পেয়ে এমন একটা জায়গায় যান, যেখানে ক্ষমতার অর্থই টাকা। এই টাকা নিয়ে সাহেব ও বেগম সাহেব খুব বিপদে পড়তেন। তাঁদের ভরসা হয়ে দাঁড়ালেন এই পিয়ন। শুধু তা-ই নয়, সাহেবের যাঁরা সহকর্মী, তাঁদেরও ভরসা ওই পিয়ন। পিয়ন এখান থেকে কিছু কিছু ভাগ পেয়ে যান। পাঁচ-ছয় বছরের মধ্যে গোটা দুয়েক ফ্ল্যাটের মালিক হয়ে যান। অফিসের কেরানি, ছোট ছোট অফিসার এবং তাঁর সহকর্মীরা ঈর্ষাবোধ করতেন। কিন্তু কিছুই করার নেই। তাঁরা মনে মনে লোকটির শাস্তি কামনা করেন। শাস্তি হয় না; বরং আরেকটি ফ্ল্যাট বাড়ে। এমনিই অসংখ্য পিয়ন এবং ড্রাইভারের কপাল গত ৫০ বছরে খুলে গেছে। কপাল খুলে গেছে, আঙুল ফুলে কলাগাছ হয়েছে।

নদীকে নাব্য করতে হবে, নদী থেকে বালু তোলা দরকার। রাতারাতি দেশটা বালুখেকোদের একটা প্রকল্প হয়ে দাঁড়াল। রাজনীতি এই বালুখেকোদের এমন বিত্তের সন্ধান দিল যে আবার টাকার কলাগাছ গজাতে শুরু করল। এমনিই কত হাজার হাজার বিত্তবান যে তৈরি হয়েছে, তার কথা বলে শেষ করা যাবে না। এসব বিত্তবান, বিশেষ করে পিয়ন, ড্রাইভার, আদম ব্যাপারীর মাধ্যমে যাঁরা টাকা উপার্জন করেন, তাঁরা আবার একটা পর্যায়ে টাকা দেশে রাখাকে আর নিরাপদ মনে করেন না। হুন্ডিওয়ালাদের দুর্নীতির বিদেশি পার্টনারদের দিয়ে দেশের বাইরে পাঠিয়ে দেন। উদ্দেশ্য অনেক ক্ষেত্রেই মহৎ—ছেলেমেয়েদের পড়ালেখা এবং বিদেশে সেকেন্ড হোম তৈরি করা!

ব্যবসায়ী বাণিজ্যমন্ত্রী দেশের অর্থনীতির সুনাম করতে গিয়ে বলেই ফেললেন, দেশের ৪ কোটি লোক এখন ইউরোপীয় মানের বড়লোক। ইউরোপীয় মান বলতে তিনি অতি বিত্তবানদের বুঝিয়েছেন। বাকি ১৪ কোটি মধ্যবিত্ত কীভাবে জীবনযাপন করে, এর কোনো ব্যাখ্যা তিনি দেননি। তিনি ঠিকই বলেছেন, এই ৪ কোটি লোকের জন্য বাকি ১৪ কোটি সত্যিই জর্জরিত। ইউরোপীয়রা যদি ইউরোর হিসাবে খরচপাতি করে, তাহলে তাদের কাছে ১ টাকা মানে ১০০ টাকার সমান। এ দেশে ১ টাকায় আজকাল আর কিছু পাওয়া যায় না। টাকার মান কমতে কমতে এমন জায়গায় এসেছে যে বাজারে হাজার টাকার নোটকে নিয়ে ভাবতে হবে কবে তা ৫ হাজার টাকার নোটে পরিণত হবে। মুদ্রাস্ফীতি এমন একটা নিয়ন্ত্রণহীন জায়গায় পৌঁছেছে যে ওই ১৪ কোটি সেই দৌড়ে মুখ থুবড়ে পড়ে গেছে।

বিত্তবানেরা সত্যি ইউরোপীয় স্ট্যান্ডার্ডেই বাজারঘাট করে। তাদের কাছে টাকা তুচ্ছ, ইউরো বা ডলারেরও কোনো গুরুত্ব নেই। কারণ অনেকেই ডলার-ইউরোতে ঘুষের টাকাটা পান। মুষ্টিমেয় লোক এই মুদ্রাস্ফীতির সুবিধাও পেয়ে যাচ্ছেন এবং এই সুবিধাভোগীদের জন্য বিদেশি মুদ্রার মূল্যমান কমানো যাচ্ছে না। কিছু কিছু ক্ষেত্রে এই ঘুষের টাকার কোনো নিয়ন্ত্রণও করা যাচ্ছে না। কারণ টাকাটি ক্ষমতার সঙ্গে সম্পর্কিত।

নিয়োগ-বাণিজ্য, ভর্তি-বাণিজ্য—এসব প্রমাণ করা খুব কঠিন। এসব দুর্নীতির ডালপালা এবং শিকড় বহু দূর পর্যন্ত বিস্তৃত। আগে পুলিশের একটা সুখ্যাতি ছিল যে দুর্নীতিতে তারা সেরা। কিন্তু অনেক দিন আগে থেকেই শিক্ষা ও স্বাস্থ্য তাদের অতিক্রম করে গেছে। দুর্নীতি যারা করে, তাদের বুকের পাটা শক্ত। তারা জানে কী করে আইনের চোখ ফাঁকি দিয়ে ঊর্ধ্বতনদের বশ করা যায়।

এতক্ষণ যা কিছু লিখলাম তা সবারই জানা। কিন্তু সাধারণ মানুষের যে সংকটটা তৈরি হয়েছে সেটা হলো, এই বিত্তবানদের সর্বক্ষেত্রেই ক্ষমতার দাপট। যেহেতু এভাবে গড়ে ওঠা বিত্তবানেরা অত্যন্ত সংগঠিত, তাই যেকোনো সময়ে তাঁরা একটা জনগোষ্ঠীকে জিম্মি করতে পারেন। তারা সব লজ্জা ও ঘৃণার ঊর্ধ্বে উঠে গেছেন। তাঁরা শহরের রাস্তায় সবচেয়ে দামি গাড়িগুলো চালান, যার জন্য কাউকেই তাঁর অর্থের উৎস বলতে হয় না।

বাংলাদেশে বিত্তবানদের আরও একটি শক্তি আছে তা হলো, আত্মীয়স্বজন। কোনো না কোনোভাবে সবাই ক্ষমতাবান আত্মীয়দের সঙ্গে সম্পর্ক বজায় রাখেন। আবার বিত্তবানেরা দেখেশুনে এমন আত্মীয়তা করেন যে তাঁদের জীবনে কোনো দুর্দিন আসার আশঙ্কা নেই। দেখা যায়, একই বাড়িতে বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের সদস্যরা আছেন। নিজের রক্ষাকবচ হিসেবে বিপদের দিনে একজন আরেকজনের পাশে এসে দাঁড়ান। ক্ষমতাবানদের আত্মীয়রা প্রায়ই বিত্তবানদের সঙ্গে সম্পর্ক স্থাপন করেন।

পুঁজিবাদী দেশগুলোতে সব সময়ই রাষ্ট্রের ক্ষমতাবানেরা দরিদ্র ও নিম্নবিত্তের কথা ভাবেন। তাঁদের জন্য ভাতা, বেতন সমন্বয়, পেনশন—এসবের কার্যকর ব্যবস্থা নিয়ে থাকেন। কিন্তু এখানে বিত্তবানেরা তাঁদের আয় থেকে একটি পয়সাও খসাতে চান না; বরং বিপুল পরিমাণে বিভিন্ন ট্যাক্স ফাঁকি দেন। সব ট্যাক্সের যন্ত্রণা পোহাতে হয় নিম্নবিত্ত মানুষদের। বিভিন্ন সেবামূলক প্রতিষ্ঠান দুর্নীতির আখড়ায় পরিণত হয়েছে। পৌরকর দিয়ে জনগণের কতটা লাভ হয় আর ক্ষমতাবানদের কতটা সুবিধা হয়, এটা দিনের আলোর মতো পরিষ্কার। একটা কথা এ দেশের আমলা, রাজনীতিবিদেরা ভুলেই যান যে দেশটা জনগণের ট্যাক্সের টাকায় চলে। তাঁদের ধারণা, দেশটা চলে বিদেশি টাকায় এবং ক্ষমতাবানদের অনুগ্রহে। তাই এমন সব লোককে এমন দায়িত্বে বসানো হয় যে তিনি ওই বিষয়ে একেবারে অজ্ঞ। অজ্ঞ, অনুপযুক্ত লোককে যেকোনো জায়গায় বসালে দুর্নীতিরই সুবিধা হয়।

একসময় বলা হতো এ দেশের সমস্যা দরিদ্র লোকদের নিয়ে। কথাটা ডাহা মিথ্যা প্রমাণিত হলো। আজকাল আর তেমন শোনা যায় না। বিত্তবান লোকেরাই যে এ দেশের সমস্যা, এটা আজ বলার অপেক্ষা রাখে না। দেশপ্রেমহীন এসব বিত্তবান ক্ষমতার চারদিকে অবস্থান করে দেশের ১৪ কোটির অনেক বেশি লোকের দুর্দশা ডেকে আনছেন। তাই প্রতিটি দলেরই জনকল্যাণের চিন্তার বাইরে শুধু একটাই চিন্তা, তা হলো ক্ষমতা। এর প্রতিকার কী হবে তা আমরা কেউ জানি না। সম্ভাব্য একটা প্রতিকার হতে পারে সুশিক্ষা। কিন্তু বিত্তবানেরা সেই ব্যবস্থা কি রাখবে?

লেখক: নাট্যব্যক্তিত্ব

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

আমিনুল ইসলাম নন, শিক্ষা উপদেষ্টা হচ্ছেন অধ্যাপক আবরার

গণপিটুনিতে নিহত জামায়াত কর্মী নেজাম ও তাঁর বাহিনী গুলি ছোঁড়ে, মিলেছে বিদেশি পিস্তল: পুলিশ

উপদেষ্টা হচ্ছেন প্রধান উপদেষ্টার বিশেষ সহকারী আমিনুল ইসলাম

বসুন্ধরায় ছিনতাইকারী সন্দেহে ২ বিদেশি নাগরিককে মারধর

বিএনপির দুই পেশাজীবী সংগঠনের কমিটি বিলুপ্ত

এলাকার খবর
খুঁজুন

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত