মযহারুল ইসলাম বাবলা
১৯৬৯ সালের ২০ জানুয়ারি হরতালের দিন ছাত্র-সংগ্রাম পরিষদের মিছিলে পুলিশের গুলিতে আসাদ শহীদ হওয়ার পর আন্দোলনের গতি স্ফুলিঙ্গের মতো দেশব্যাপী ছড়িয়ে পড়ে। শেখ কাদেরের নেতৃত্বে আমরা আজিমপুর এলাকায় মিছিল বের করি। আজিমপুর শাহ সাহেব বাড়ি বটতলার পাশে আসাদের পারিবারিক বাসায় মিছিল নিয়ে পৌঁছাই। বাসার দোতলা থেকে আমাদের উদ্দেশে আসাদের ফ্রেমে বাঁধানো ছবি নামিয়ে দেয় তাঁর পরিবারের লোকেরা। এতে দ্রুত মিছিলটি জঙ্গিরূপ ধারণ করে। তীব্র স্লোগানে মিছিলটি ঝাঁজালো হয়ে ওঠে। আমরা মিছিল নিয়ে এলাকা প্রদক্ষিণ করে নীলক্ষেত হয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের দিকে এগিয়ে যাওয়ার মুহূর্তে পুলিশের গাড়ি এসে লাঠিপেটা করে আমাদের মিছিলটিকে ছত্রভঙ্গ করে দেয়।
উত্তাল উনসত্তরে স্কুলছাত্র আমি স্কুল থেকে বের হওয়া মিছিলের সঙ্গে বিশ্ববিদ্যালয়ের বটতলার সমাবেশে যোগ দিতাম। মিছিলে মহিউদ্দিন ইউসুফ মন্টু চাচা ও নাসির উদ্দীন ইউসুফ বাচ্চু চাচার নজরে আসার পর আমার নিরাপত্তার স্বার্থে আমাকে পুরানা পল্টন লেনে দাদির হেফাজতে পাঠানো হয়। একপ্রকার গৃহবন্দী করা হয় আমাকে। ২৪ জানুয়ারি মওলানা ভাসানীর ডাকে হরতালের দিন আমি দাদির হেফাজতে রয়েছি। পল্টন অঞ্চলের মিছিল, টিয়ার গ্যাস নিক্ষেপের তীব্র শব্দে একসময় কাউকে না জানিয়ে বেরিয়ে পড়ি। যোগ দিই প্রেসক্লাব থেকে মতিঝিলের পূর্ব দিকের সড়ক অভিমুখে যাওয়া জঙ্গি মিছিলে। ইতিমধ্যে পুলিশের গুলিতে নবকুমার ইনস্টিটিউটের ছাত্র মতিউরের নিহত হওয়ার সংবাদ ছড়িয়ে পড়েছিল। জঙ্গি মিছিলটি দৈনিক পাকিস্তান পত্রিকার মোড়ে যাওয়ামাত্র ক্ষিপ্ত ছাত্র-জনতা দৈনিক পাকিস্তান, মর্নিং নিউজ পত্রিকার কার্যালয়ে আগুন ধরিয়ে দেয়। পত্রিকার কার্যালয়ের বিপরীতের মুসলিম লীগার লস্করের পেট্রলপাম্পটিতেও আগুন দেওয়া হয়। চারদিকে আগুনের লেলিহান শিখা। যে যেদিকে পারে, নিরাপদ স্থানের খোঁজে এদিক-সেদিক ছোটাছুটি করছে, এমনি সময় পুলিশ টিয়ার গ্যাস এবং বেপরোয়া লাঠিপেটা শুরু করে। টিয়ার গ্যাসের তীব্র ধোঁয়া আর পুলিশের লাঠির আঘাত খেয়ে বহু কষ্টে দাদির বাড়িতে ফিরে আসি।
তিরস্কৃত হওয়ার মানসিক প্রস্তুতি নিয়ে দাঁড়াই দাদির সামনে। আমার বিধ্বস্ত অবস্থা দেখে গোসল করার আদেশ দেন তিনি। চোখে প্রচণ্ড জ্বালা-যন্ত্রণায় গোসলে কিছুটা স্বস্তি বোধ করি। নতমুখে পুনরায় দাদির সামনে দাঁড়াই। দাদির চোখের দিকে তাকানোর শক্তি ও সাহস কোনোটা আমার তখন ছিল না। দাদি বলেন, ‘তোমার কিছু হলে তোমার বাবা-মাকে আমি কী জবাব দিতাম? তুমি আজ যা করেছ, তা কি সঠিক বলে মনে করো?’ আমি নতমুখে বলি, ‘না’। তিনি বলেন, ‘এটা যদি বুঝে থাকো তবে ভবিষ্যতে নিশ্চয় এমনটি আর করবে না?’ আমি পুনরায় ‘না’ বললে আমাকে শোবার উপদেশ দিয়ে শেষে বললেন, ‘তুমি তো ফিরছ। আরেকজন কি ফিরবে, না লাশ হয়ে ফিরবে, জানি না।’ নাসির উদ্দীন ইউসুফ বাচ্চু চাচার উদ্দেশে শেষের আশঙ্কার কথাটি তিনি বলেছিলেন।
২৪ জানুয়ারি প্রতিবছর ঘুরেফিরে আসে। স্মৃতিতে আজও জ্বলজ্বল করে উনসত্তরের গণ-অভ্যুত্থানের ঘটনাবলি। যে অভ্যুত্থানে আমাদের মুক্তির সম্ভাবনা সৃষ্টি হয়েছিল। পতন হয়েছিল স্বৈরাচার সামরিক শাসক আইয়ুব খানের। নতুন সামরিক শাসক ইয়াহিয়া খান ক্ষমতায় বসে নির্বাচন দেওয়ার ঘোষণা দিয়ে পরিস্থিতি সামাল দিয়েছিলেন। সত্তরের নির্বাচনে আওয়ামী লীগ বিপুল বিজয় লাভ করলেও ক্ষমতা হস্তান্তরে পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠীর গড়িমসি পরিস্থিতি আবার উত্তাল করে তুলেছিল। শুরু হয়েছিল আমাদের স্বাধীনতা ও মুক্তির সংগ্রাম।
একাত্তরের গণহত্যা আমাদের পুনরায় মুক্তিযুদ্ধের দিকে ঠেলে দিয়েছিল। আমরা যুদ্ধে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীকে পরাভূত করে স্বাধীনতা অর্জন করলেও, সমষ্টিগত মানুষের বিজয় অর্জিত না হওয়ায় আমাদের মুক্তির লড়াই শেষ হয়ে যায়নি।
লেখক: নির্বাহী সম্পাদক, নতুন দিগন্ত
১৯৬৯ সালের ২০ জানুয়ারি হরতালের দিন ছাত্র-সংগ্রাম পরিষদের মিছিলে পুলিশের গুলিতে আসাদ শহীদ হওয়ার পর আন্দোলনের গতি স্ফুলিঙ্গের মতো দেশব্যাপী ছড়িয়ে পড়ে। শেখ কাদেরের নেতৃত্বে আমরা আজিমপুর এলাকায় মিছিল বের করি। আজিমপুর শাহ সাহেব বাড়ি বটতলার পাশে আসাদের পারিবারিক বাসায় মিছিল নিয়ে পৌঁছাই। বাসার দোতলা থেকে আমাদের উদ্দেশে আসাদের ফ্রেমে বাঁধানো ছবি নামিয়ে দেয় তাঁর পরিবারের লোকেরা। এতে দ্রুত মিছিলটি জঙ্গিরূপ ধারণ করে। তীব্র স্লোগানে মিছিলটি ঝাঁজালো হয়ে ওঠে। আমরা মিছিল নিয়ে এলাকা প্রদক্ষিণ করে নীলক্ষেত হয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের দিকে এগিয়ে যাওয়ার মুহূর্তে পুলিশের গাড়ি এসে লাঠিপেটা করে আমাদের মিছিলটিকে ছত্রভঙ্গ করে দেয়।
উত্তাল উনসত্তরে স্কুলছাত্র আমি স্কুল থেকে বের হওয়া মিছিলের সঙ্গে বিশ্ববিদ্যালয়ের বটতলার সমাবেশে যোগ দিতাম। মিছিলে মহিউদ্দিন ইউসুফ মন্টু চাচা ও নাসির উদ্দীন ইউসুফ বাচ্চু চাচার নজরে আসার পর আমার নিরাপত্তার স্বার্থে আমাকে পুরানা পল্টন লেনে দাদির হেফাজতে পাঠানো হয়। একপ্রকার গৃহবন্দী করা হয় আমাকে। ২৪ জানুয়ারি মওলানা ভাসানীর ডাকে হরতালের দিন আমি দাদির হেফাজতে রয়েছি। পল্টন অঞ্চলের মিছিল, টিয়ার গ্যাস নিক্ষেপের তীব্র শব্দে একসময় কাউকে না জানিয়ে বেরিয়ে পড়ি। যোগ দিই প্রেসক্লাব থেকে মতিঝিলের পূর্ব দিকের সড়ক অভিমুখে যাওয়া জঙ্গি মিছিলে। ইতিমধ্যে পুলিশের গুলিতে নবকুমার ইনস্টিটিউটের ছাত্র মতিউরের নিহত হওয়ার সংবাদ ছড়িয়ে পড়েছিল। জঙ্গি মিছিলটি দৈনিক পাকিস্তান পত্রিকার মোড়ে যাওয়ামাত্র ক্ষিপ্ত ছাত্র-জনতা দৈনিক পাকিস্তান, মর্নিং নিউজ পত্রিকার কার্যালয়ে আগুন ধরিয়ে দেয়। পত্রিকার কার্যালয়ের বিপরীতের মুসলিম লীগার লস্করের পেট্রলপাম্পটিতেও আগুন দেওয়া হয়। চারদিকে আগুনের লেলিহান শিখা। যে যেদিকে পারে, নিরাপদ স্থানের খোঁজে এদিক-সেদিক ছোটাছুটি করছে, এমনি সময় পুলিশ টিয়ার গ্যাস এবং বেপরোয়া লাঠিপেটা শুরু করে। টিয়ার গ্যাসের তীব্র ধোঁয়া আর পুলিশের লাঠির আঘাত খেয়ে বহু কষ্টে দাদির বাড়িতে ফিরে আসি।
তিরস্কৃত হওয়ার মানসিক প্রস্তুতি নিয়ে দাঁড়াই দাদির সামনে। আমার বিধ্বস্ত অবস্থা দেখে গোসল করার আদেশ দেন তিনি। চোখে প্রচণ্ড জ্বালা-যন্ত্রণায় গোসলে কিছুটা স্বস্তি বোধ করি। নতমুখে পুনরায় দাদির সামনে দাঁড়াই। দাদির চোখের দিকে তাকানোর শক্তি ও সাহস কোনোটা আমার তখন ছিল না। দাদি বলেন, ‘তোমার কিছু হলে তোমার বাবা-মাকে আমি কী জবাব দিতাম? তুমি আজ যা করেছ, তা কি সঠিক বলে মনে করো?’ আমি নতমুখে বলি, ‘না’। তিনি বলেন, ‘এটা যদি বুঝে থাকো তবে ভবিষ্যতে নিশ্চয় এমনটি আর করবে না?’ আমি পুনরায় ‘না’ বললে আমাকে শোবার উপদেশ দিয়ে শেষে বললেন, ‘তুমি তো ফিরছ। আরেকজন কি ফিরবে, না লাশ হয়ে ফিরবে, জানি না।’ নাসির উদ্দীন ইউসুফ বাচ্চু চাচার উদ্দেশে শেষের আশঙ্কার কথাটি তিনি বলেছিলেন।
২৪ জানুয়ারি প্রতিবছর ঘুরেফিরে আসে। স্মৃতিতে আজও জ্বলজ্বল করে উনসত্তরের গণ-অভ্যুত্থানের ঘটনাবলি। যে অভ্যুত্থানে আমাদের মুক্তির সম্ভাবনা সৃষ্টি হয়েছিল। পতন হয়েছিল স্বৈরাচার সামরিক শাসক আইয়ুব খানের। নতুন সামরিক শাসক ইয়াহিয়া খান ক্ষমতায় বসে নির্বাচন দেওয়ার ঘোষণা দিয়ে পরিস্থিতি সামাল দিয়েছিলেন। সত্তরের নির্বাচনে আওয়ামী লীগ বিপুল বিজয় লাভ করলেও ক্ষমতা হস্তান্তরে পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠীর গড়িমসি পরিস্থিতি আবার উত্তাল করে তুলেছিল। শুরু হয়েছিল আমাদের স্বাধীনতা ও মুক্তির সংগ্রাম।
একাত্তরের গণহত্যা আমাদের পুনরায় মুক্তিযুদ্ধের দিকে ঠেলে দিয়েছিল। আমরা যুদ্ধে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীকে পরাভূত করে স্বাধীনতা অর্জন করলেও, সমষ্টিগত মানুষের বিজয় অর্জিত না হওয়ায় আমাদের মুক্তির লড়াই শেষ হয়ে যায়নি।
লেখক: নির্বাহী সম্পাদক, নতুন দিগন্ত
ঝড়-জলোচ্ছ্বাস থেকে রক্ষায় সন্দ্বীপের ব্লক বেড়িবাঁধসহ একাধিক প্রকল্প হাতে নিয়েছে সরকার। এ লক্ষ্যে বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে ৫৬২ কোটি টাকা। এ জন্য টেন্ডারও হয়েছে। প্রায় এক বছর পেরিয়ে গেলেও ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানগুলো কাজ শুরু করছে না। পানি উন্নয়ন বোর্ডের (পাউবো) তাগাদায়ও কোনো কাজ হচ্ছে না বলে জানিয়েছেন...
৩ দিন আগেদেশের পরিবহন খাতের অন্যতম নিয়ন্ত্রণকারী ঢাকা সড়ক পরিবহন মালিক সমিতির কমিটির বৈধতা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। সাইফুল আলমের নেতৃত্বাধীন এ কমিটিকে নিবন্ধন দেয়নি শ্রম অধিদপ্তর। তবে এটি কার্যক্রম চালাচ্ছে। কমিটির নেতারা অংশ নিচ্ছেন ঢাকা পরিবহন সমন্বয় কর্তৃপক্ষ (ডিটিসিএ) ও বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষের...
৩ দিন আগেআলুর দাম নিয়ন্ত্রণে ব্যর্থ হয়ে এবার নিজেই বিক্রির উদ্যোগ নিয়েছে সরকার। বাজার স্থিতিশীল রাখতে ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশের (টিসিবি) মাধ্যমে রাজধানীতে ভ্রাম্যমাণ ট্রাকের মাধ্যমে ভর্তুকি মূল্যে আলু বিক্রি করা হবে। একজন গ্রাহক ৪০ টাকা দরে সর্বোচ্চ তিন কেজি আলু কিনতে পারবেন...
৩ দিন আগেসপ্তাহখানেক আগে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকে অনেকের ওয়াল বিষাদময় হয়ে উঠেছিল ফুলের মতো ছোট্ট শিশু মুনতাহাকে হত্যার ঘটনায়। ৫ বছর বয়সী সিলেটের এই শিশুকে অপহরণের পর হত্যা করে লাশ গুম করতে ডোবায় ফেলে রাখা হয়েছিল। প্রতিবেশী গৃহশিক্ষকের পরিকল্পনায় অপহরণের পর তাকে নির্মমভাবে হত্যা করা হয়...
৩ দিন আগে