একাত্তরে মালাকারটোলা গণহত্যা

বাবুল দে
প্রকাশ : ২৭ মার্চ ২০২৩, ১২: ৩২

একাত্তরের ২৫ মার্চ বাংলাদেশের মানুষের স্বাধীনতার আকাঙ্ক্ষা স্তব্ধ করে দিতে এই ঢাকা শহরে পাকিস্তানিরা নৃশংস গণহত্যা শুরু করেছিল। একের পর এক এলাকায় হামলা করে, মানুষ হত্যা করে পুরো ঢাকা শহরকে পরিণত করা হয়েছিল মৃত্যুপুরীতে। এমনি এক মৃত্যুপুরী ছিল ঐতিহ্যবাহী পুরান ঢাকার গেন্ডারিয়ার মালাকারটোলা।

একসময় ঢাকা শহরের প্রাণকেন্দ্র ছিল গেন্ডারিয়া। সেই গেন্ডারিয়ার একটি মহল্লা মালাকারটোলা। এই মালাকারটোলা পুরান ঢাকার একটি ঐতিহ্যবাহী মহল্লা। সেখানকার বাসিন্দাদের মধ্যে হিন্দু সম্প্রদায়ের লোকই বেশি। অনেক খ্যাতিমান লোক এই এলাকায় বসবাস করতেন, সাংস্কৃতিক তৎপরতাও এলাকায় ছিল বেশি।

পাকিস্তানের বর্বর সেনাবাহিনী ২৫ মার্চ ঢাকায় ‘অপারেশন সার্চলাইট’ নাম দিয়ে গণহত্যা শুরু করে। ঢাকা থেকে গণহত্যা ছড়িয়ে পড়ে সারা দেশের শহর-বন্দর-গ্রামগঞ্জে। ঢাকায় পাকিস্তানিদের টার্গেট ছিল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, পিলখানা এবং রাজারবাগ পুলিশ লাইনস। এর পরই তাদের লক্ষ্য ছিল ঢাকার হিন্দু-অধ্যুষিত মহল্লাগুলো। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পাকিস্তানিরা সবচেয়ে বেশি হত্যাযজ্ঞ চালায় হিন্দু ছাত্রদের আবাসিক হল জগন্নাথ হলে। একইভাবে তারা হামলা চালায় পুরান ঢাকার শাঁখারীবাজার, মালাকারটোলাসহ হিন্দু মহল্লায়।

পাকিস্তানিরা একাত্তরের ২৫ মার্চ রাতে গণহত্যা শুরুর পর ২৬ মার্চ সারা দিন পুরান ঢাকার বিভিন্ন এলাকায় বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান ও থানায় হামলা চালিয়ে যাকে যে অবস্থায় পেয়েছে, মেশিনগানের ব্রাশফায়ারে হত্যা করেছে। আমরা ভয়-আতঙ্ক আর কারফিউর কারণে বাড়ি থেকে বের হইনি। ২৭ মার্চ সকালে কারফিউ শিথিল হলে আমি আমাদের আশপাশের এলাকা দেখতে বের হই। বিধ্বস্ত চেহারা বিভিন্ন এলাকার। শাঁখারীপট্টিতে অনেক লাশ পড়ে থাকতে দেখি। আমাদের বাড়ির কাছেই সূত্রাপুর থানা, সেখানে গিয়ে দেখি পাকিস্তানিদের মর্টার আর মেশিনগানের গুলিতে পুরো ভবন প্রায় বিধ্বস্ত হয়ে আছে। থানার ভেতরে দেখি এক পুলিশের লাশ পড়ে আছে। পাকিস্তানি সৈন্যবোঝাই গাড়ি লোহারপুলের ওপর দিয়ে যাওয়া-আসা করছে। এরই মধ্যে দেখলাম একদল লোক বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান ও বাড়িতে লুটপাট করছে। অন্যদিকে অসংখ্য মানুষ ঊর্ধ্বশ্বাসে পালাচ্ছে শহর ছেড়ে।

শহরের এমন করুণ অবস্থা দেখে আমার মনে ভয় ধরে যায়। এরপর নিশ্চয়ই আমাদের পাড়ায়ও হামলা হবে। এমন ভাবতে ভাবতে বাড়ি ফিরে ঢাকা ছেড়ে পালানোর পরিকল্পনা করি। ঠিক করি আগামীকালই আমরা ঢাকা ছেড়ে বিক্রমপুরের দিকে চলে যাব। এসব ভাবনা-চিন্তার মধ্যেই ২৭ মার্চ রাত নেমে আসে। রাতে পাকিস্তানি বাহিনী হামলা করতে পারে ভেবে আমি পাশের এক বাড়িতে চলে যাই রাত কাটাতে। আমার বোনেরাও অন্য এক বাড়িতে গিয়ে আশ্রয় নেয়। বাড়িতে থেকে যায় বাবা, ভাই দুলাল ও বিপ্লব। সারা এলাকায় থমথমে, মানুষের সাড়াশব্দ নেই, শুধু পাকিস্তানি আর্মির গাড়ি চলাচলের আওয়াজ কানে আসে। সন্ধ্যা থেকে আবার কারফিউ শুরু হয়েছে।

পাকিস্তানি বাহিনী রাত ১১টার দিকে আমাদের বাড়ি ঘেরাও করে। দরজা ভেঙে তারা ঘরে ঢুকে আমার বাবা কালিপদ দে, ভাই দুলাল দে ও বিপ্লবকে ধরে নিয়ে যায়। নিয়ে যাওয়ার আগে পাকিস্তান আর্মি সবাইকে জেরা করে এবং কাপড় খুলে দেখে নিশ্চিত হয় যে তারা সবাই হিন্দু। ধরে নিয়ে যাওয়ার সময় আমার ভাই বিপ্লব করুণ কণ্ঠে বাবার কাছে জানতে চায়, বাবা, আমাদের কোথায় নিয়ে যাচ্ছে? বাবা কোনো উত্তর দিতে পারেননি, শুধু ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়ে ছিলেন। এসব কথা বাবা পরে আমাদের বলেছেন।

মধ্যরাতে বিভিন্ন এলাকা থেকে ধরে আনা সবাইকে নিয়ে যাওয়া হয় লোহারপুলে, সেখানে সবাইকে লাইন দিয়ে দাঁড় করিয়ে একসঙ্গে সবার দিকে মেশিন গান উঁচিয়ে গুলি করে পাকিস্তানি সৈন্যরা। গুলি খেয়ে সবাই লুটিয়ে পড়ে। তবে সৌভাগ্যক্রমে আমার বাবাসহ আরও দু-তিনজন বেঁচে যান। আমার বাবার হাতে ও বুকের পাশে গুলি লাগে, দু-একজনের গায়ে একেবারেই গুলি লাগেনি। তবে তারা ধোলাইখালের ময়লা পানিতে মরার মতো পড়ে থাকেন। পাকিস্তান আর্মি গুলি করার পর আহত শরীর নিয়ে আমার বাবাও মাটিতে শুয়ে থাকেন।

আহত হওয়ায় তাঁর ওঠার শক্তি ছিল না। কয়েক ঘণ্টা কেটে যাওয়ার পর খুব ভোরে ফজরের আজানের শব্দ শুনে বাবা উঠতে চেষ্টা করেন। উঠেই তিনি দেখেন আমার ভাই দুলাল দে শুয়ে আছে পাশেই। তিনি খুব মিহি কণ্ঠে দুলালকে ডাকেন, এই দুলাল ওঠ, চল পালিয়ে যাই। কিন্তু একটু পরই বুঝতে পারেন দুলাল বেঁচে নেই। এরপরই তিনি খুব ভয় পেয়ে যান। রক্তাক্ত শরীর নিয়ে তিনি আস্তে আস্তে ধোলাইখালের পাড় দিয়ে হেঁটে কাছেই আমাদের পরিচিত ডা. আজিজুন্নেসার বাড়িতে গিয়ে ওঠেন। ডা. আজিজুন্নেসা তাড়াতাড়ি একজন লোক দিয়ে বাবাকে মিটফোর্ড হাসপাতালে পাঠান।

মালাকারটোলা হত্যাকাণ্ডের পর অনেক বছর কেটে গেছে। আমার বাবা সেই গণহত্যার দুঃসহ স্মৃতি নিয়ে তিন বছর বেঁচে ছিলেন। তখন একটি বিষয় আমি লক্ষ করি তা হলো, বাবা প্রায় প্রতিদিন রাতে কাউকে না জানিয়ে লোহারপুলে যে স্থানে পাকিস্তানি আর্মি তাঁদের দাঁড় করিয়ে মেরে ফেলার জন্য গুলি করেছিল, ঠিক সে জায়গায় গিয়ে বেশ কিছুক্ষণ চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকতেন। তিনি সম্ভবত সেই দুঃসহ স্মৃতি ভুলতে পারতেন না। বাবাকে এভাবে দেখে প্রায়ই আমার চোখে জল আসত। আমিও একধরনের কষ্ট বুকে নিয়ে বাবার সেই অবস্থা অনুধাবন করার চেষ্টা করতাম।

দেখতে দেখতে আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধ ও স্বাধীনতার ৫২ বছর পেরিয়ে গেল। এই ৫২ বছরেও আমরা যারা ঐতিহ্যবাহী পুরান ঢাকার মালাকারটোলা মহল্লার অধিবাসী, তারা ভুলতে পারিনি একাত্তরে পাকিস্তান বাহিনীর গণহত্যার দুঃসহ স্মৃতি। ৫২ বছর ধরে সেই ভয়াবহ গণহত্যার স্মৃতি প্রতিনিয়ত আমাদের তাড়া করে বেড়ায়। একদিকে স্বজন হারানোর বেদনা, অন্যদিকে পাকিস্তানি বাহিনীর হাতে জীবন দিয়েও স্বাধীন দেশে শহীদের মর্যাদা না পাওয়া—সব মিলিয়ে মনে হয় কত অবহেলিত জীবন আমাদের শহীদ পরিবারগুলোর।

লেখক: রাজনৈতিক কর্মী

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

সরকারি চাকরিজীবীরা সম্পদের হিসাব না দিলে যেসব শাস্তির মুখোমুখি হতে পারেন

শেখ হাসিনাকে নিয়ে যুক্তরাজ্যে এম সাখাওয়াতের বিস্ফোরক মন্তব্য, কী বলেছেন এই উপদেষ্টা

শিক্ষকের নতুন ২০ হাজার পদ, প্রাথমিকে আসছে বড় পরিবর্তন

লক্ষ্মীপুরে জামায়াত নেতাকে অতিথি করায় মাহফিল বন্ধ করে দেওয়ার অভিযোগ

শ্রীপুরে পিকনিকের বাস বিদ্যুতায়িত হয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের ৩ শিক্ষার্থীর মৃত্যু, আহত ৩

এলাকার খবর
খুঁজুন

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত