ষড়যন্ত্র ঘনিয়ে আসছিল

জাহীদ রেজা নূর, ঢাকা
আপডেট : ০৪ আগস্ট ২০২৩, ১০: ১২
Thumbnail image

বাংলাদেশের প্রতিরক্ষা বাহিনীর কতিপয় সদস্য যে মুজিব সরকারের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করছিল, সে কথা পরবর্তীকালে প্রকাশিত নথিপত্রে প্রমাণিত হয়েছে। কিন্তু বঙ্গবন্ধুর জীবদ্দশায় তাঁকে সতর্ক করে দেওয়া হয়েছিল বলেও কেউ কেউ উল্লেখ করেছেন। বিশেষ করে ভারতের দিক থেকে এ রকম একটি ইঙ্গিত দেওয়া হয়েছিল। বঙ্গবন্ধু তা বিশ্বাস করেননি।

কিছু বিষয়ে খোলাখুলি আলোচনা করলে দেখা যাবে, ‘কতিপয় বিপথগামী’ সেনাসদস্যই বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ড ঘটিয়েছে বলে যে প্রচারণা চলেছে, তা আসলে ঠিক নয়। এর সঙ্গে পালের গোদা হিসেবে বিদেশি কর্তাব্যক্তিদের পাশাপাশি এই দেশের ‘বিগ শট’দের নামও শোনা যায়।

‘ডাক্তার টু’ নামে লেখা এক বইয়ে মার্কিন মিশনারি চিকিৎসক ড. ভিগো অলসেন জানাচ্ছেন, ১৯৭৫ সালের শুরুর দিকেই ভারতীয় গোয়েন্দা সংস্থা ‘র’ বাংলাদেশের ঘটনাবলির দিকে গভীর দৃষ্টি রেখেছিল। বাংলাদেশে একটি অভ্যুত্থান ঘটানোর পাঁয়তারা চলছে, এ রকম একটি ইঙ্গিত তারা পেয়েছিল। ‘র’ এই সন্দেহের কথা শেখ মুজিবুর রহমানকে অবহিত করেছিল। কিন্তু শেখ মুজিব সে কথায় কর্ণপাত করেননি। ১৯৭৫ সালের মধ্য জুনেই নাকি ‘র’ মেজর ফারুক ও মেজর রশিদের নাম জানতে পেরেছিল। তাদের সঙ্গে জিয়াউর রহমানের বৈঠক হওয়ার খবরও নাকি ভারতীয় সংস্থাটির কাছে ছিল। ‘র’-এর পরিচালক আর এন কাও নিজেই নাকি এসে ঘণ্টাব্যাপী বৈঠক করেছিলেন বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে।

ফারুক-রশিদ নাম দুটি মার্কিনিরাও জানত বহু আগে থেকেই। ফারুক-রশিদ অস্ত্র কেনার মিশন নিয়ে মার্কিন দূতাবাসে গিয়েছিলেন। ১৯৭৩ সালের ১৩ জুলাই ঢাকার মার্কিন দূতাবাসের তৎকালীন চার্জ দ্য অ্যাফেয়ার্স ড্যানিয়েল ও নিউবেরি মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রীর কাছে এ বিষয়ে একটি বার্তা পাঠান। একই বিষয়ে দ্বিতীয় বার্তাটি তিনি পাঠান ২৭ আগস্ট। আবদুর রশিদ নাকি ১১ জুলাই মার্কিন দূতাবাসে হাজির হয়ে বলেছিলেন, সেনাবাহিনী অস্ত্র কিনবে, তাই একটি কমিটি করা হয়েছে। সেই কমিটির চেয়ারম্যান নাকি ছিলেন সেনাবাহিনীর তৎকালীন ডেপুটি চিফ অব স্টাফ ব্রিগেডিয়ার জিয়াউর রহমান।

বঙ্গবন্ধু হত্যার তিন দশক পর মার্কিন পররাষ্ট্র দপ্তরের দলিল অবমুক্ত করা হলে তখনকার সেনাপ্রধান মেজর জেনারেল কে এম সফিউল্লাহ বিস্মিত হন। কারণ সে সময় সেনাবাহিনীর অস্ত্র ক্রয়সংক্রান্ত কমিটির প্রধান ছিলেন তিনি। মার্কিন নথি যদি সত্য হয়ে থাকে, তাহলে ফারুক-রশিদ মার্কিন দূতাবাসে গিয়ে থাকলে তা ছিল সেনাশৃঙ্খলা ও আইনের পরিপন্থী।

মার্কিন নথিতে আছে ফারুক-রশিদ দুই ভায়রা ভাই মার্কিন দূতাবাসে আলাদাভাবে যান। রশিদ যান ১১ জুলাই, ফারুক যান ১২ জুলাই। দুজনেই ছিলেন সেনা পোশাকে এবং তাঁরা আগে থেকে অ্যাপয়েন্টমেন্ট নিয়েও যাননি।

১৯৭৪ সালের ১৩ মে ফারুক রহমান মার্কিন দূতাবাসের গণসংযোগ কর্মকর্তা উইলিয়াম গ্রেশামের বাড়িতে গিয়েছিলেন। বলেছিলেন, তিনি এসেছেন ‘উচ্চপর্যায়ের বাংলাদেশ সেনা কর্মকর্তা’র নির্দেশে। কী বিষয়ে জানতে গিয়েছিলেন ফারুক? তিনি জানতে গিয়েছিলেন, ‘যদি অভ্যুত্থান ঘটানো হয়, তাহলে যুক্তরাষ্ট্র সরকারের মনোভাব কী হবে?’

সামরিক বাহিনীর অভ্যন্তরে এই ‘উচ্চপর্যায়ের সেনা কর্মকর্তাটি’ কে? এর থেকেই তো বোঝাই যায়, ফারুক-রশিদও ছিলেন আরও বড় কোনো ষড়যন্ত্রকারীর খেলার পুতুল!

এত কিছু ঘটে চলছিল, অথচ বঙ্গবন্ধু তখনো থাকছিলেন অরক্ষিত নিজ বাড়িতে। ভাবছিলেন, কী করে দেশের অর্থনীতিকে চাঙা করা যায়, কীভাবে অস্থিরতা থেকে বের করে আনা যায় দেশকে। তিনি কল্পনাও করতে পারেননি, তাঁরই দেশের কিছু ষড়যন্ত্রকারী প্রস্তুত হচ্ছিল তাঁকে হত্যা করার জন্য।

তথ্যসূত্র: মিজানুর রহমান খান, মার্কিন দলিলে মুজিব হত্যাকাণ্ড

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
খুঁজুন

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত