মোনায়েম সরকার
কোটা সংস্কার আন্দোলন ও পরবর্তী পরিস্থিতির কয়েকটি দিক নিয়ে আলোচনা করা প্রয়োজন বলে মনে করছি। যেহেতু সরকার দেশ চালায়, সেহেতু আলোচনায় সরকারের অবস্থান নিয়ে কথা হবে বেশি।
লক্ষ করা গেছে, কয়েক বছর ধরে যেকোনো দাবি নিয়ে কেউ সোচ্চার হলে দাবিটি ন্যায্য কি অন্যায্য, তা বিবেচনা না করেই সরকার বিরক্ত হয়। অধিকার আদায়ের জন্য মানুষ যখন বিক্ষোভ করে, তখন সরকারের পক্ষ থেকে তা বিবেচনার প্রয়োজন আছে। বিক্ষোভকারীদের সঙ্গে বসে তার একটা যুক্তিযুক্ত সমাধান খুঁজে বের করা দরকার হয়। কিন্তু এ সময়টায় দেখা গেছে, সরকার যেন সেই সব ব্যাপারে উদাসীন। কোটা সংস্কার আন্দোলনের ক্ষেত্রেও সেটা দেখা গেছে। আন্দোলন শুরু হওয়ার পর যদি আদালতের দোহাই না দিয়ে শিক্ষার্থীদের সঙ্গে আলোচনায় বসতেন সরকারের ঊর্ধ্বতন কেউ, তাহলে হয়তো এত প্রাণ ঝরত না, আন্দোলনের সুযোগ নিয়ে দুষ্কৃতকারীরা ভাঙচুর-আগুনের মতো দুর্ঘটনা ঘটাতে পারত না, পরিস্থিতি এতটা অস্বাভাবিক হতো না। আবার কেউ এটাও মনে করেন, সরকার শুরুতে উদ্যোগ নিলেও
পরিস্থিতি জটিল করার কোনো না কোনো উসিলা খোঁজা হতোই।
কী হতো তা নিয়ে গবেষণা না করে যা হয়েছে তা নিয়েই কথা বলি। বিপুলসংখ্যক শিক্ষার্থী যে প্রসঙ্গ নিয়ে মাঠে নেমেছিল, সেটা কোনো অযৌক্তিক আন্দোলন ছিল না। কেন কোটার পরিমাণ থাকবে মেধার চেয়ে বেশি, সে প্রশ্ন তো উঠতেই পারে। যখন আমরা উন্নয়নের কথা বলছি, তখন কি কর্মসংস্থান বেড়েছে? প্রতিবছর পরীক্ষা দিয়ে বের হচ্ছে যারা, তাদের কত শতাংশ বেকার থাকছে, সেই পরিসংখ্যান কি আছে আমাদের হাতে? বেকারত্বের গ্লানি সে-ই বোঝে, যে এই প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে যায়। কর্মসংস্থানের সুযোগ না বাড়ায় সরকারি চাকরির নিরাপদ আশ্রয়ের খোঁজ করাটা দোষের কিছু নয়। কিন্তু মেধার ভিত্তিতে সেই চাকরির নাগাল পেতে হলে কোটার পাহাড় অতিক্রম করে তারপর সেখানে পৌঁছাতে হবে। ফলে চাকরিক্ষেত্রে এত বিপুল পরিমাণ কোটার বিরোধিতা করা খুবই যৌক্তিক ব্যাপার।
আবার এ প্রশ্নও আছে, কোটা সমস্যার সমাধান হলেই কি সব ‘মেধাবী’র সরকারি চাকরি পাওয়ার সুযোগ হবে?
এবার দ্বিতীয় প্রসঙ্গ। আন্দোলন শুরু হওয়ার পর দুষ্কৃতকারীরা এই আন্দোলনে ঢুকে পড়তে পেরেছে সেটাও সরকারের ঔদাসীন্যের কারণেই নয় কি? প্রথম দিকে আদালতের রায়ের দোহাই দিয়ে তারা চুপচাপ বসে ছিল। বিপুলসংখ্যক শিক্ষার্থী যখন কোটা সংস্কারের দাবিতে রাজপথে, তখন এ রকম আচরণ মোটেই সরকারের সদিচ্ছার প্রকাশ নয়; বরং ছাত্রলীগকে লাঠিসোঁটা হাতে আন্দোলন প্রতিরোধের জন্য পাঠিয়ে সংকট আরও গভীর করা হয়েছে। ফল যা ঘটেছে, তা হলো আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত হয়েছে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা এবং তারই পথ ধরে স্কুল-কলেজের শিক্ষার্থীরাও। ছাত্রলীগের ডান্ডা যখন আন্দোলনকে ঠান্ডা করতে পারল না, তখন পুলিশ, বিজিবি নামল রাস্তায়। রক্ত ঝরল। তখন যে অস্থির সময়ের জন্ম হলো, তারই সুযোগ নিল দুষ্কৃতকারীরা। তারা রাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনাগুলোকে ধ্বংসের ষড়যন্ত্র করল। কোটা সংস্কার আন্দোলনকে তারা সরকারবিরোধী আন্দোলনের রূপ দেওয়ার চেষ্টা করল।
এখানে একটি বিষয়ে দৃষ্টি দিতে হবে। যারা রাষ্ট্রীয় স্থাপনায় হামলা চালিয়েছে, তারা নিছক দুষ্কৃতকারী নয়। এরা সরকারবিরোধী রাজনীতিরই অংশ। সুযোগ বুঝে এরা আন্দোলনের পথ ধরে জ্বালাও-পোড়াও শুরু করেছে। পরিস্থিতি অস্থিতিশীল করে দিয়ে সরকার পরিবর্তনের স্বপ্নও তারা দেখেছে। রাজনৈতিক ঘটনা নিয়মতান্ত্রিক পথে মোকাবিলা না করার যে অভ্যাস আমাদের সৃষ্টি হয়েছে, এটা তারই একটা দৃষ্টান্ত। ফলে সহিংসতার দায় বিরোধীদলীয় রাজনীতিকদের নিতে হবে।
ছাত্রলীগ যখন ডান্ডা মেরে আন্দোলন ঠান্ডা করার জন্য নামল, তখনকার অবস্থাটা কল্পনা করুন। সেতুমন্ত্রী এবং আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের ‘ছাত্রলীগই আন্দোলনকারীদের মোকাবিলায় যথেষ্ট’ বলে যে বক্তব্য দিয়েছেন, তাকে কোনোভাবেই দায়িত্বশীল বলা যায় না। ছাত্রলীগের নেতা-কর্মীরা এত বড় আন্দোলনকে কি সত্যিই মোকাবিলা করতে পারত? ভেবে দেখা যাক, কারা এই আন্দোলনে অংশ নিয়েছে। এরা বিপক্ষ রাজনৈতিক শক্তি নয়। যে সাধারণ শিক্ষার্থীরা কোনো দিন মিটিং-মিছিল করেনি, তারাও কেন এই আন্দোলনে শরিক হয়েছে, সেটা ছাত্রলীগের বোঝা উচিত ছিল। ছাত্রলীগের বোঝা উচিত ছিল, এই আন্দোলন আসলে তাদেরও আন্দোলন। ছাত্রলীগের একটা অংশ চাঁদাবাজি, টেন্ডারবাজির সঙ্গে যুক্ত হয়তো, কিন্তু ছাত্রলীগের বড় অংশকেই তো পড়াশোনা শেষ করে চাকরিতে ঢুকতে হবে। সুতরাং তারাও তো এই বিশাল কোটার কারণে ভুক্তভোগী হবে। তাই ঠান্ডা মাথায় বিবেচনা করলে ছাত্রলীগ তো এই আন্দোলনের শরিক পক্ষই হতে পারত। এখন এই ভয়ংকর দিনগুলো পার হওয়ার পর দেখা যাচ্ছে, ছাত্রলীগ সেদিন যে কারণে সাধারণ শিক্ষার্থীদের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়েছিল, সেটা ছিল নিছক আওয়ামী লীগের অবস্থান থেকে পরিস্থিতি বুঝতে না পারার খেসারত। এখন তো দেখাই যাচ্ছে, শিক্ষার্থীদের দাবি মেনে
নিয়েছে সরকার। কিন্তু এ জন্য দুঃখজনকভাবে এত রক্ত ঝরল।
প্রসঙ্গত আরও একটি বিষয় নিয়ে কথা বলা দরকার। শিক্ষার্থীদের এই সংকটকালে শিক্ষকদের ভূমিকারও বিশ্লেষণ করতে হবে। শিক্ষকদের নিজস্ব একটি অবস্থান থাকতে হবে। যা সত্য, যা যৌক্তিক, তার পক্ষেই থাকতে হবে তাঁর অবস্থান। কিন্তু আমাদের দেশে স্বাধীনতার পর থেকেই ধীরে ধীরে শিক্ষকরাজনীতি এতটাই শক্তিশালী হয়ে উঠেছে যে দলবাজ শিক্ষকেরাই বেশির ভাগ ক্ষেত্রে নিয়োগ পান। মেধার চেয়ে দলের প্রতি আনুগত্যই কখনো কখনো নিয়োগের ক্ষেত্রে প্রধান নিয়ামক হয়ে ওঠে। তাই বিভিন্ন ক্ষেত্রের মতো বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের মধ্যেও দলবাজ শিক্ষক খুঁজে পাওয়া বিচিত্র নয়। তার চেয়েও দুঃখজনক ব্যাপার হলো, যাঁরা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য হিসেবে নিয়োগ পান, তাঁদের যোগ্যতাও মূলত ক্ষমতাসীন দলের প্রতি আনুগত্য। এ কারণেই শিক্ষার্থীদের পক্ষে তাঁরা দাঁড়াতে পারেন না। শিক্ষকদের এমন নৈতিক দুর্বল অবস্থান সত্যিই দুঃখজনক।
এই আন্দোলনের একপর্যায়ে আমরা বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের খুব কমসংখ্যক শিক্ষককেই পরিস্থিতি স্বাভাবিক করার জন্য শিক্ষার্থীদের পাশে এসে দাঁড়াতে দেখেছি। সংখ্যায় তাঁরা কম হলেও তাঁদের মধ্যে যে দৃঢ়তা দেখা গেছে, তা সাধুবাদযোগ্য। সব শিক্ষকই তো পারতেন এ সময় তাঁদের সন্তানসম শিক্ষার্থীদের পাশে এসে দাঁড়াতে। কে তাঁদের বাধা দিল? বাধা দিল তাঁদের নিয়োগ-প্রক্রিয়া। দলের প্রতি আনুগত্য থাকলে শিক্ষক তাঁর শিক্ষকতার মূল দর্শনকেই অগ্রাহ্য করেন। বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসনিক কাজের সঙ্গে যুক্ত শিক্ষকেরা ব্যর্থ হয়েছেন শিক্ষক হিসেবে তাঁদের অবস্থান পরিষ্কার করতে।
উপাচার্য বলে যে প্রতিষ্ঠানটি আছে, সেটিও আজ প্রশ্নের সম্মুখীন। কোনো কোনো বিশ্ববিদ্যালয়ে উপাচার্যরাও নিয়োগের সময় এমন এক অবস্থান নেন, যা লজ্জাজনক। কেউ কেউ মেয়াদের শেষ দিনে এসে ইচ্ছামতো নিয়োগে সই করেছেন, এমন নজিরও তো আছে। এই আন্দোলনের সময় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য তো বলেই দিয়েছেন, পরিস্থিতি তাঁর নিয়ন্ত্রণে নেই। পরিস্থিতি যদি নিয়ন্ত্রণেই না থাকে, তাহলে তো এই দায় মাথায় নিয়ে তাঁর পদত্যাগ করার কথা। তিনি কেন পদত্যাগ করলেন না? বিশ্ববিদ্যালয়ের অভিভাবক হিসেবে দায়িত্ব পালন করতে না পারলে এই পদে আসীন থাকা কি উচিত তাঁর?
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যের বাড়িতে আশ্রয় নিল শিক্ষার্থীরা, তাদের ওপর হামলা হলো, অথচ উপাচার্য মহাশয় দরজা বন্ধ করে বসে থাকলেন। এটা কি সত্যিই কোনো শিক্ষকের কাজ হতে পারে?
শিক্ষকেরা দলদাস হলে শিক্ষার্থীদেরও মেরুদণ্ড থাকবে না। অভিভাবককে ক্ষমতাসীনদের কেরানি হিসেবে দেখলে শিক্ষার্থীরাও তো ধীরে ধীরে সেই কলা রপ্ত করে ফেলবে। এই অনৈতিকতা থেকে শিক্ষকদের বেরিয়ে আসতে হবে। ছাত্র-শিক্ষক সম্পর্কের ক্ষেত্রেই শুধু নয়, জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রেই নিজ মেরুদণ্ডের সন্ধান করতে হবে। হারানো মেরুদণ্ড খুঁজে পাওয়া প্রয়োজন।
শেষে আমার বলার কথা, শাসক দল আওয়ামী লীগ প্রসঙ্গে। টানা চার মেয়াদে ক্ষমতায় থেকে দলটি সাংগঠনিকভাবে শক্তিশালী না হয়ে বরং দুর্বল যে হয়েছে তা এবার স্পষ্ট হয়েই সামনে এল। আওয়ামী লীগ যদি জনসম্পৃক্ত রাজনৈতিক দল থাকত, জনবিচ্ছিন্ন হয়ে না পড়ত তাহলে হয়তো শিক্ষার্থীদের আন্দোলনকে কেন্দ্র করে উদ্ভূত পরিস্থিতিতে দলটির নেতা-কর্মীরা মাঠ ছেড়ে লাপাত্তা হতো না। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ২৪ জুলাই এডিটর গিল্ডসের সভায় বলেছেন, ‘জঙ্গিদের সুযোগ করে দেওয়ার জন্য আন্দোলনকারীদের জাতির কাছে একদিন জবাব দিতে হবে।’
প্রধানমন্ত্রীর দীর্ঘদিনের একজন সুহৃদ হিসেবে আমার বিনীত জিজ্ঞাসা, মানুষের মন-মেজাজ বুঝতে না পারার ব্যর্থতার জন্য আওয়ামী লীগ নেতৃত্ব কি কারও কাছে কোনো জবাবদিহি করবেন না?
লেখক: রাজনীতিবিদ, লেখক
কোটা সংস্কার আন্দোলন ও পরবর্তী পরিস্থিতির কয়েকটি দিক নিয়ে আলোচনা করা প্রয়োজন বলে মনে করছি। যেহেতু সরকার দেশ চালায়, সেহেতু আলোচনায় সরকারের অবস্থান নিয়ে কথা হবে বেশি।
লক্ষ করা গেছে, কয়েক বছর ধরে যেকোনো দাবি নিয়ে কেউ সোচ্চার হলে দাবিটি ন্যায্য কি অন্যায্য, তা বিবেচনা না করেই সরকার বিরক্ত হয়। অধিকার আদায়ের জন্য মানুষ যখন বিক্ষোভ করে, তখন সরকারের পক্ষ থেকে তা বিবেচনার প্রয়োজন আছে। বিক্ষোভকারীদের সঙ্গে বসে তার একটা যুক্তিযুক্ত সমাধান খুঁজে বের করা দরকার হয়। কিন্তু এ সময়টায় দেখা গেছে, সরকার যেন সেই সব ব্যাপারে উদাসীন। কোটা সংস্কার আন্দোলনের ক্ষেত্রেও সেটা দেখা গেছে। আন্দোলন শুরু হওয়ার পর যদি আদালতের দোহাই না দিয়ে শিক্ষার্থীদের সঙ্গে আলোচনায় বসতেন সরকারের ঊর্ধ্বতন কেউ, তাহলে হয়তো এত প্রাণ ঝরত না, আন্দোলনের সুযোগ নিয়ে দুষ্কৃতকারীরা ভাঙচুর-আগুনের মতো দুর্ঘটনা ঘটাতে পারত না, পরিস্থিতি এতটা অস্বাভাবিক হতো না। আবার কেউ এটাও মনে করেন, সরকার শুরুতে উদ্যোগ নিলেও
পরিস্থিতি জটিল করার কোনো না কোনো উসিলা খোঁজা হতোই।
কী হতো তা নিয়ে গবেষণা না করে যা হয়েছে তা নিয়েই কথা বলি। বিপুলসংখ্যক শিক্ষার্থী যে প্রসঙ্গ নিয়ে মাঠে নেমেছিল, সেটা কোনো অযৌক্তিক আন্দোলন ছিল না। কেন কোটার পরিমাণ থাকবে মেধার চেয়ে বেশি, সে প্রশ্ন তো উঠতেই পারে। যখন আমরা উন্নয়নের কথা বলছি, তখন কি কর্মসংস্থান বেড়েছে? প্রতিবছর পরীক্ষা দিয়ে বের হচ্ছে যারা, তাদের কত শতাংশ বেকার থাকছে, সেই পরিসংখ্যান কি আছে আমাদের হাতে? বেকারত্বের গ্লানি সে-ই বোঝে, যে এই প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে যায়। কর্মসংস্থানের সুযোগ না বাড়ায় সরকারি চাকরির নিরাপদ আশ্রয়ের খোঁজ করাটা দোষের কিছু নয়। কিন্তু মেধার ভিত্তিতে সেই চাকরির নাগাল পেতে হলে কোটার পাহাড় অতিক্রম করে তারপর সেখানে পৌঁছাতে হবে। ফলে চাকরিক্ষেত্রে এত বিপুল পরিমাণ কোটার বিরোধিতা করা খুবই যৌক্তিক ব্যাপার।
আবার এ প্রশ্নও আছে, কোটা সমস্যার সমাধান হলেই কি সব ‘মেধাবী’র সরকারি চাকরি পাওয়ার সুযোগ হবে?
এবার দ্বিতীয় প্রসঙ্গ। আন্দোলন শুরু হওয়ার পর দুষ্কৃতকারীরা এই আন্দোলনে ঢুকে পড়তে পেরেছে সেটাও সরকারের ঔদাসীন্যের কারণেই নয় কি? প্রথম দিকে আদালতের রায়ের দোহাই দিয়ে তারা চুপচাপ বসে ছিল। বিপুলসংখ্যক শিক্ষার্থী যখন কোটা সংস্কারের দাবিতে রাজপথে, তখন এ রকম আচরণ মোটেই সরকারের সদিচ্ছার প্রকাশ নয়; বরং ছাত্রলীগকে লাঠিসোঁটা হাতে আন্দোলন প্রতিরোধের জন্য পাঠিয়ে সংকট আরও গভীর করা হয়েছে। ফল যা ঘটেছে, তা হলো আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত হয়েছে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা এবং তারই পথ ধরে স্কুল-কলেজের শিক্ষার্থীরাও। ছাত্রলীগের ডান্ডা যখন আন্দোলনকে ঠান্ডা করতে পারল না, তখন পুলিশ, বিজিবি নামল রাস্তায়। রক্ত ঝরল। তখন যে অস্থির সময়ের জন্ম হলো, তারই সুযোগ নিল দুষ্কৃতকারীরা। তারা রাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনাগুলোকে ধ্বংসের ষড়যন্ত্র করল। কোটা সংস্কার আন্দোলনকে তারা সরকারবিরোধী আন্দোলনের রূপ দেওয়ার চেষ্টা করল।
এখানে একটি বিষয়ে দৃষ্টি দিতে হবে। যারা রাষ্ট্রীয় স্থাপনায় হামলা চালিয়েছে, তারা নিছক দুষ্কৃতকারী নয়। এরা সরকারবিরোধী রাজনীতিরই অংশ। সুযোগ বুঝে এরা আন্দোলনের পথ ধরে জ্বালাও-পোড়াও শুরু করেছে। পরিস্থিতি অস্থিতিশীল করে দিয়ে সরকার পরিবর্তনের স্বপ্নও তারা দেখেছে। রাজনৈতিক ঘটনা নিয়মতান্ত্রিক পথে মোকাবিলা না করার যে অভ্যাস আমাদের সৃষ্টি হয়েছে, এটা তারই একটা দৃষ্টান্ত। ফলে সহিংসতার দায় বিরোধীদলীয় রাজনীতিকদের নিতে হবে।
ছাত্রলীগ যখন ডান্ডা মেরে আন্দোলন ঠান্ডা করার জন্য নামল, তখনকার অবস্থাটা কল্পনা করুন। সেতুমন্ত্রী এবং আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের ‘ছাত্রলীগই আন্দোলনকারীদের মোকাবিলায় যথেষ্ট’ বলে যে বক্তব্য দিয়েছেন, তাকে কোনোভাবেই দায়িত্বশীল বলা যায় না। ছাত্রলীগের নেতা-কর্মীরা এত বড় আন্দোলনকে কি সত্যিই মোকাবিলা করতে পারত? ভেবে দেখা যাক, কারা এই আন্দোলনে অংশ নিয়েছে। এরা বিপক্ষ রাজনৈতিক শক্তি নয়। যে সাধারণ শিক্ষার্থীরা কোনো দিন মিটিং-মিছিল করেনি, তারাও কেন এই আন্দোলনে শরিক হয়েছে, সেটা ছাত্রলীগের বোঝা উচিত ছিল। ছাত্রলীগের বোঝা উচিত ছিল, এই আন্দোলন আসলে তাদেরও আন্দোলন। ছাত্রলীগের একটা অংশ চাঁদাবাজি, টেন্ডারবাজির সঙ্গে যুক্ত হয়তো, কিন্তু ছাত্রলীগের বড় অংশকেই তো পড়াশোনা শেষ করে চাকরিতে ঢুকতে হবে। সুতরাং তারাও তো এই বিশাল কোটার কারণে ভুক্তভোগী হবে। তাই ঠান্ডা মাথায় বিবেচনা করলে ছাত্রলীগ তো এই আন্দোলনের শরিক পক্ষই হতে পারত। এখন এই ভয়ংকর দিনগুলো পার হওয়ার পর দেখা যাচ্ছে, ছাত্রলীগ সেদিন যে কারণে সাধারণ শিক্ষার্থীদের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়েছিল, সেটা ছিল নিছক আওয়ামী লীগের অবস্থান থেকে পরিস্থিতি বুঝতে না পারার খেসারত। এখন তো দেখাই যাচ্ছে, শিক্ষার্থীদের দাবি মেনে
নিয়েছে সরকার। কিন্তু এ জন্য দুঃখজনকভাবে এত রক্ত ঝরল।
প্রসঙ্গত আরও একটি বিষয় নিয়ে কথা বলা দরকার। শিক্ষার্থীদের এই সংকটকালে শিক্ষকদের ভূমিকারও বিশ্লেষণ করতে হবে। শিক্ষকদের নিজস্ব একটি অবস্থান থাকতে হবে। যা সত্য, যা যৌক্তিক, তার পক্ষেই থাকতে হবে তাঁর অবস্থান। কিন্তু আমাদের দেশে স্বাধীনতার পর থেকেই ধীরে ধীরে শিক্ষকরাজনীতি এতটাই শক্তিশালী হয়ে উঠেছে যে দলবাজ শিক্ষকেরাই বেশির ভাগ ক্ষেত্রে নিয়োগ পান। মেধার চেয়ে দলের প্রতি আনুগত্যই কখনো কখনো নিয়োগের ক্ষেত্রে প্রধান নিয়ামক হয়ে ওঠে। তাই বিভিন্ন ক্ষেত্রের মতো বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের মধ্যেও দলবাজ শিক্ষক খুঁজে পাওয়া বিচিত্র নয়। তার চেয়েও দুঃখজনক ব্যাপার হলো, যাঁরা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য হিসেবে নিয়োগ পান, তাঁদের যোগ্যতাও মূলত ক্ষমতাসীন দলের প্রতি আনুগত্য। এ কারণেই শিক্ষার্থীদের পক্ষে তাঁরা দাঁড়াতে পারেন না। শিক্ষকদের এমন নৈতিক দুর্বল অবস্থান সত্যিই দুঃখজনক।
এই আন্দোলনের একপর্যায়ে আমরা বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের খুব কমসংখ্যক শিক্ষককেই পরিস্থিতি স্বাভাবিক করার জন্য শিক্ষার্থীদের পাশে এসে দাঁড়াতে দেখেছি। সংখ্যায় তাঁরা কম হলেও তাঁদের মধ্যে যে দৃঢ়তা দেখা গেছে, তা সাধুবাদযোগ্য। সব শিক্ষকই তো পারতেন এ সময় তাঁদের সন্তানসম শিক্ষার্থীদের পাশে এসে দাঁড়াতে। কে তাঁদের বাধা দিল? বাধা দিল তাঁদের নিয়োগ-প্রক্রিয়া। দলের প্রতি আনুগত্য থাকলে শিক্ষক তাঁর শিক্ষকতার মূল দর্শনকেই অগ্রাহ্য করেন। বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসনিক কাজের সঙ্গে যুক্ত শিক্ষকেরা ব্যর্থ হয়েছেন শিক্ষক হিসেবে তাঁদের অবস্থান পরিষ্কার করতে।
উপাচার্য বলে যে প্রতিষ্ঠানটি আছে, সেটিও আজ প্রশ্নের সম্মুখীন। কোনো কোনো বিশ্ববিদ্যালয়ে উপাচার্যরাও নিয়োগের সময় এমন এক অবস্থান নেন, যা লজ্জাজনক। কেউ কেউ মেয়াদের শেষ দিনে এসে ইচ্ছামতো নিয়োগে সই করেছেন, এমন নজিরও তো আছে। এই আন্দোলনের সময় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য তো বলেই দিয়েছেন, পরিস্থিতি তাঁর নিয়ন্ত্রণে নেই। পরিস্থিতি যদি নিয়ন্ত্রণেই না থাকে, তাহলে তো এই দায় মাথায় নিয়ে তাঁর পদত্যাগ করার কথা। তিনি কেন পদত্যাগ করলেন না? বিশ্ববিদ্যালয়ের অভিভাবক হিসেবে দায়িত্ব পালন করতে না পারলে এই পদে আসীন থাকা কি উচিত তাঁর?
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যের বাড়িতে আশ্রয় নিল শিক্ষার্থীরা, তাদের ওপর হামলা হলো, অথচ উপাচার্য মহাশয় দরজা বন্ধ করে বসে থাকলেন। এটা কি সত্যিই কোনো শিক্ষকের কাজ হতে পারে?
শিক্ষকেরা দলদাস হলে শিক্ষার্থীদেরও মেরুদণ্ড থাকবে না। অভিভাবককে ক্ষমতাসীনদের কেরানি হিসেবে দেখলে শিক্ষার্থীরাও তো ধীরে ধীরে সেই কলা রপ্ত করে ফেলবে। এই অনৈতিকতা থেকে শিক্ষকদের বেরিয়ে আসতে হবে। ছাত্র-শিক্ষক সম্পর্কের ক্ষেত্রেই শুধু নয়, জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রেই নিজ মেরুদণ্ডের সন্ধান করতে হবে। হারানো মেরুদণ্ড খুঁজে পাওয়া প্রয়োজন।
শেষে আমার বলার কথা, শাসক দল আওয়ামী লীগ প্রসঙ্গে। টানা চার মেয়াদে ক্ষমতায় থেকে দলটি সাংগঠনিকভাবে শক্তিশালী না হয়ে বরং দুর্বল যে হয়েছে তা এবার স্পষ্ট হয়েই সামনে এল। আওয়ামী লীগ যদি জনসম্পৃক্ত রাজনৈতিক দল থাকত, জনবিচ্ছিন্ন হয়ে না পড়ত তাহলে হয়তো শিক্ষার্থীদের আন্দোলনকে কেন্দ্র করে উদ্ভূত পরিস্থিতিতে দলটির নেতা-কর্মীরা মাঠ ছেড়ে লাপাত্তা হতো না। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ২৪ জুলাই এডিটর গিল্ডসের সভায় বলেছেন, ‘জঙ্গিদের সুযোগ করে দেওয়ার জন্য আন্দোলনকারীদের জাতির কাছে একদিন জবাব দিতে হবে।’
প্রধানমন্ত্রীর দীর্ঘদিনের একজন সুহৃদ হিসেবে আমার বিনীত জিজ্ঞাসা, মানুষের মন-মেজাজ বুঝতে না পারার ব্যর্থতার জন্য আওয়ামী লীগ নেতৃত্ব কি কারও কাছে কোনো জবাবদিহি করবেন না?
লেখক: রাজনীতিবিদ, লেখক
গাজীপুর মহানগরের বোর্ডবাজার এলাকার ইসলামিক ইউনিভার্সিটি অব টেকনোলজির (আইইউটি) মেকানিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের শিক্ষার্থীরা পিকনিকে যাচ্ছিলেন শ্রীপুরের মাটির মায়া ইকো রিসোর্টে। ঢাকা-ময়মনসিংহ মহাসড়ক থেকে বাসগুলো গ্রামের সরু সড়কে ঢোকার পর বিদ্যুতের তারে জড়িয়ে যায় বিআরটিসির একটি দোতলা বাস...
২ ঘণ্টা আগেঝড়-জলোচ্ছ্বাস থেকে রক্ষায় সন্দ্বীপের ব্লক বেড়িবাঁধসহ একাধিক প্রকল্প হাতে নিয়েছে সরকার। এ লক্ষ্যে বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে ৫৬২ কোটি টাকা। এ জন্য টেন্ডারও হয়েছে। প্রায় এক বছর পেরিয়ে গেলেও ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানগুলো কাজ শুরু করছে না। পানি উন্নয়ন বোর্ডের (পাউবো) তাগাদায়ও কোনো কাজ হচ্ছে না বলে জানিয়েছেন...
৪ দিন আগেদেশের পরিবহন খাতের অন্যতম নিয়ন্ত্রণকারী ঢাকা সড়ক পরিবহন মালিক সমিতির কমিটির বৈধতা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। সাইফুল আলমের নেতৃত্বাধীন এ কমিটিকে নিবন্ধন দেয়নি শ্রম অধিদপ্তর। তবে এটি কার্যক্রম চালাচ্ছে। কমিটির নেতারা অংশ নিচ্ছেন ঢাকা পরিবহন সমন্বয় কর্তৃপক্ষ (ডিটিসিএ) ও বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষের...
৪ দিন আগেআলুর দাম নিয়ন্ত্রণে ব্যর্থ হয়ে এবার নিজেই বিক্রির উদ্যোগ নিয়েছে সরকার। বাজার স্থিতিশীল রাখতে ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশের (টিসিবি) মাধ্যমে রাজধানীতে ভ্রাম্যমাণ ট্রাকের মাধ্যমে ভর্তুকি মূল্যে আলু বিক্রি করা হবে। একজন গ্রাহক ৪০ টাকা দরে সর্বোচ্চ তিন কেজি আলু কিনতে পারবেন...
৪ দিন আগে