ড. মইনুল ইসলাম
একটি জাতীয় দৈনিকে ২০২৩ সালের ১০ জুলাই মূল শিরোনাম ছিল: ‘২০২৫ সালে বিদ্যুৎ উৎপাদন সক্ষমতার প্রায় ৬০ শতাংশ অব্যবহৃত থাকবে’। এই নিউজ আইটেমের অতিগুরুত্বপূর্ণ তথ্য হলো, ২০২৩ সালের জুলাই মাসে ক্যাপটিভ বিদ্যুৎ বাদেই বিদ্যুতের ইনস্টল্ড ক্যাপাসিটি দাঁড়িয়েছে ২৪ হাজার ২৬৩ মেগাওয়াট। পিডিবির হিসাব অনুযায়ী, ২০২৫ সালে বিদ্যুৎ উৎপাদন সক্ষমতায় যুক্ত হবে আরও অন্তত সাড়ে ১৪ হাজার মেগাওয়াট, ফলে ওই সময়ে বিদ্যুৎ উৎপাদন দাঁড়াবে ৩৮ হাজার ৭০০ মেগাওয়াটেরও বেশি। অথচ ২০২৩ সালের জুলাইয়ে বিদ্যুতের চাহিদা রয়েছে গড়ে সাড়ে ১৩ হাজার মেগাওয়াট। এই চাহিদা যদি আগামী দুই বছরে গড়ে প্রতিবছর ১০ শতাংশ হারে বেড়েও যায়, তারপরও ২০২৫ সালে বিদ্যুৎ উৎপাদন সক্ষমতার ৬০ শতাংশই অব্যবহৃত থেকে যাবে। ফলে অব্যবহৃত বিদ্যুৎ প্ল্যান্টগুলোকে যে ‘ক্যাপাসিটি চার্জ’ দিতে হবে তার বোঝা বহন করা পিডিবির জন্য ‘মারাত্মক বিপজ্জনক’ হয়ে উঠবে। বেসরকারি বিদ্যুৎ প্ল্যান্টগুলোর কাছে পিডিবির মোটা অঙ্কের টাকা বকেয়া পড়ে গেছে ২০২৩ সালের জুলাই মাসেই, যা ২০২৫ সালে অসহনীয় বোঝায় পরিণত হয়ে যাবে। রামপালের ১ হাজার ৩২০ মেগাওয়াট, বাঁশখালীর ১ হাজার ৩২০ মেগাওয়াট, নারায়ণগঞ্জের মেঘনাঘাটে সামিটের ৫৮৩ মেগাওয়াট, ইউনিক গ্রুপের ৬০০ মেগাওয়াট, ভারতের রিলায়েন্সের ৭৫০ মেগাওয়াট, মহেশখালীর মাতারবাড়ীর ১ হাজার ২০০ মেগাওয়াট এবং সর্বোপরি রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ প্ল্যান্টের ২ হাজার ৪০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ ২০২৫ সালের মধ্যে দেশের বিদ্যুৎ উৎপাদন সক্ষমতায় যুক্ত হতে যাচ্ছে। চাহিদা ও সরবরাহের এত বড় ‘ভুল প্রাক্কলন’ যারা করেছে, তাদের সরকার জবাবদিহির আওতায় আনতে পারবে কি? জ্বালানিমন্ত্রী স্বয়ং মাননীয় প্রধানমন্ত্রী, প্রধানমন্ত্রীর জ্বালানি ও বিদ্যুৎ উপদেষ্টা ড. তৌফিক-ই-ইলাহী চৌধুরী আর জ্বালানি ও বিদ্যুৎ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ—তাঁরা কেউ তো ‘টেকনিক্যাল পারসন’ নন, তাহলে কে বা কারা বিদ্যুতের চাহিদা ও উৎপাদনের এত বড় ভুল প্রাক্কলন করে দেশকে এই মহাবিপদে ঠেলে দিয়েছে?
বর্তমান সরকারের অত্যন্ত প্রশংসনীয় অর্জনের অন্যতম হলো দেশের শতভাগ মানুষকে বিদ্যুৎ সুবিধার আওতায় নিয়ে আসা, কিন্তু ‘চাহিদা ও উৎপাদনের মারাত্মক ভুল প্রাক্কলনের’ ফলে সৃষ্ট বিদ্যুতের ক্রমবর্ধমান উদ্বৃত্ত ক্যাপাসিটি সরকারের এই সাফল্যকে ইতিমধ্যেই ম্লান করে দিয়েছে এবং ২০২৫ সালে অর্থনীতিকে বড়সড় বিপদে ফেলতে চলেছে। আমরা জানি, রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের ফলে জ্বালানি তেল, এলএনজি এবং কয়লার আন্তর্জাতিক বাজারে যে মারাত্মক মূল্যস্ফীতি ও জোগান-সংকট সৃষ্টি হয়েছে, সেটা বাংলাদেশের অর্থনীতিতেও বড়সড় বিপর্যয় ডেকে এনেছে; বিশেষত করে বাংলাদেশের বিদ্যুৎ উৎপাদন যেহেতু এক দশক ধরে আমদানি করা এলএনজি এবং কয়লার ওপর অতিমাত্রায় ‘পরিকল্পিত নির্ভরশীলতা’ সৃষ্টি করেছে, তাই আন্তর্জাতিক বাজারে এলএনজির দামের স্ফীতি এবং জোগান-সংকট বাংলাদেশের জ্বালানি ও বিদ্যুৎ খাতে ইতিমধ্যেই মারাত্মক বিপর্যয় সৃষ্টি করেছে। এর আগে ২০০১-০৬ মেয়াদে ক্ষমতাসীন বিএনপি-জামায়াতের বিদ্যুৎ উৎপাদনে অকল্পনীয় ব্যর্থতাকে কাটিয়ে ওঠার জন্য ২০০৯ সালে ক্ষমতায় আসার অব্যবহিত পর মহাজোট সরকার প্রাইভেট সেক্টরের সহযোগিতায় যে ডিজেল ও ফার্নেস অয়েলনির্ভর রেন্টাল ও কুইক রেন্টাল বিদ্যুৎ প্ল্যান্ট স্থাপনের ‘ক্র্যাশ প্রোগ্রাম’ নিয়েছিল, সেটা হওয়ার কথা ছিল স্বল্পমেয়াদি জরুরি ব্যবস্থা। এই জরুরি ব্যবস্থা গ্রহণ তখনকার বাস্তবতায় মোটেও অযৌক্তিক মনে হয়নি। কারণ ২০০১-০৬ মেয়াদের সরকার ২০০১ সালে আওয়ামী লীগ সরকারের রেখে যাওয়া ৪ হাজার ৩০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন-সক্ষমতাকে তাদের পাঁচ বছরের শাসনামল শেষে ৩ হাজার ২০০ মেগাওয়াটে নামিয়ে ফেলেছিল। বিএনপি-জামায়াতের ওই শাসনামলে টঙ্গীতে ৮০ মেগাওয়াট উৎপাদন ক্ষমতার একটি ‘পিকিং প্ল্যান্ট’ নির্মিত হয়েছিল, আর ঘরে ঘরে বিদ্যুৎ-সুবিধা সম্প্রসারণের অজুহাতে দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে শুধু বিদ্যুতের খাম্বা স্থাপনের একটি ‘লুটপাট যজ্ঞ’ সম্পন্ন হয়েছিল। অন্যদিকে, ওই পাঁচ বছরে অনেকগুলো পুরোনো বিদ্যুৎ প্ল্যান্ট স্বাভাবিক নিয়মে মেয়াদোত্তীর্ণ হওয়ায় উৎপাদন প্রায় ১ হাজার মেগাওয়াট কমে গিয়েছিল।
২০০৭-০৮ সালে ক্ষমতাসীন সেনা-সমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকার বোধগম্য কারণেই এহেন অকল্পনীয় ব্যর্থতার ভালো সমাধান দিয়ে যেতে পারেনি। ফলে ২০০৯ সালের জানুয়ারিতে যখন মহাজোট সরকার ক্ষমতা গ্রহণ করেছিল, তখনো বিদ্যুতের লোডশেডিং অসহনীয় মাত্রায় অবস্থান করছিল। এমনকি শিল্প খাতসহ পুরো অর্থনীতিতে তখন বিদ্যুতের এই মহাসংকট বিপর্যয় ডেকে আনবে বলে ওয়াকিবহাল মহল আশঙ্কা প্রকাশ করেছিল। এর পরিপ্রেক্ষিতেই গৃহীত হয়েছিল মহাজোট সরকারের বিদ্যুৎ উৎপাদনের উল্লিখিত ক্র্যাশ প্রোগ্রাম। প্রাইভেট সেক্টরে ৫৮টি ফার্মকে ডিজেল ও ফার্নেস অয়েলচালিত নানা উৎপাদন ক্ষমতার রেন্টাল ও কুইক রেন্টাল বিদ্যুৎ প্ল্যান্ট স্থাপনের জন্য সরাসরি লাইসেন্স দেওয়া হয় জরুরি ভিত্তিতে বিদ্যুৎ উৎপাদন বৃদ্ধির জন্য। কোনো স্বীকৃত টেন্ডার-প্রক্রিয়া ছাড়াই এসব ফার্মকে বাছাই করা হয়েছিল ইমার্জেন্সি মোকাবিলার কথা বলে। আদালতে মামলা করে যাতে ওই বাছাই-প্রক্রিয়াকে কেউ চ্যালেঞ্জ করতে না পারে, সে জন্য সরকার ‘ইনডেমনিটি অর্ডিন্যান্স’ জারি করে দায়মুক্তির ব্যবস্থা করায় এসব ফার্ম নির্বাচনে যে দুর্নীতি, স্বজনপ্রীতি ও দলীয়করণের মোচ্ছব চালানো হয়েছিল তার বিরুদ্ধে কোনো আইনি প্রতিকার পাওয়া যায়নি। ওই ‘ইনডেমনিটি অর্ডিন্যান্স’ এখনো চালু রয়েছে। একই সঙ্গে বিদ্যুৎ উৎপাদনের একটি মহাপরিকল্পনাও ঘোষণা করা হয়েছিল, যাতে দাবি করা হয়েছিল যে ইমার্জেন্সি মোকাবিলায় স্থাপিত রেন্টাল ও কুইক রেন্টাল বিদ্যুৎ প্ল্যান্টগুলোর উৎপাদিত বিদ্যুতের ইউনিটপ্রতি খরচ যেহেতু ২০০৯ সালেই ১৬-২০ টাকায় হিসাব করা হয়েছিল, তাই মধ্যমেয়াদি পরিকল্পনায় বিদ্যুৎ উৎপাদনের দায়িত্ব ক্রমান্বয়ে আমদানি করা এলএনজি ও কয়লাচালিত বিদ্যুতের বেশ কয়েকটি মেগা প্রজেক্ট স্থাপন করে ওগুলোর ওপর ছেড়ে দেওয়া হবে। তখন কয়লা ও এলএনজির আন্তর্জাতিক দাম যেহেতু অনেক কম ছিল, তাই ওই পরিকল্পনাকে তেমন অযৌক্তিক মনে হয়নি। বলা হয়েছিল, ওই পরিকল্পনা অনুযায়ী ইউনিটপ্রতি বিদ্যুৎ উৎপাদন ব্যয় মধ্য মেয়াদে পাঁচ-সাত বছরের মধ্যে ৭-৮ টাকায় নামিয়ে আনা যাবে। এর সঙ্গে দীর্ঘমেয়াদে বিদ্যুতের উৎপাদন ব্যয় আরও নামিয়ে আনার জন্য বাংলাদেশের ইতিহাসের সবচেয়ে ব্যয়বহুল প্রকল্প রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ প্ল্যান্ট নির্মাণের সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়েছিল। রাশিয়ার ১২ বিলিয়ন ডলার ঋণসহ মোট ১ লাখ ১৩ হাজার কোটি টাকা ব্যয়ে নির্মীয়মাণ রূপপুর প্ল্যান্ট ২০২৪ সালে উৎপাদনে গেলে বাংলাদেশ সেখান থেকে ২ হাজার ৪০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদনে সক্ষম হবে বলে সরকার দাবি করে চলেছে।
কিন্তু রেন্টাল ও কুইক রেন্টাল প্ল্যান্টগুলো থেকে বিদ্যুৎ উৎপাদন করে ক্রয় না করলে ওগুলোকে ‘ক্যাপাসিটি চার্জ’ দেওয়ার ব্যবস্থাটা কয়েক বছরের মধ্যেই সরকারের জন্য বড়সড় বোঝায় পরিণত হয়ে যায়। অনেকগুলো রেন্টাল ও কুইক রেন্টাল প্ল্যান্টের সঙ্গে সরকারের চুক্তি বাতিলের সময় হলেও লবিং করে ওই সব প্ল্যান্টের মালিকেরা তাদের চুক্তি নবায়ন করিয়ে নিয়েছেন। কিন্তু দেশের বিদ্যুতের চাহিদা বেড়ে দাঁড়িয়েছে শীতকালে ১১ হাজার থেকে ১২ হাজার মেগাওয়াটে এবং গ্রীষ্মকালে ১৫ হাজার থেকে ১৬ হাজার মেগাওয়াটে। ইতিমধ্যে এলএনজি ও তেলের আন্তর্জাতিক দাম বেড়ে যাওয়ায় দেশের এলএনজি ও তেল আমদানির সক্ষমতা ব্যাপকভাবে হ্রাস পেয়েছে। ফলে ডিজেলচালিত বিদ্যুৎ প্ল্যান্টগুলো ২০২২ সালের জুলাই থেকে বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে এবং ফার্নেস অয়েলচালিত প্ল্যান্টগুলোতেও উৎপাদন-সংকোচনের নীতি গ্রহণ করতে হয়েছে। একই সঙ্গে এলএনজিচালিত কয়েকটি বিদ্যুৎ প্ল্যান্টও পুরোপুরি ব্যবহার করা যাচ্ছে না আমদানির সক্ষমতা না থাকায়। কয়লাচালিত পায়রা ও রামপাল বিদ্যুৎ প্ল্যান্ট ইতিমধ্যে উৎপাদনে এসে যাওয়া সত্ত্বেও ওগুলো ঠিকমতো চালু করা যাচ্ছে না প্রয়োজনীয় কয়লা আমদানি করতে না পারায়। এসব এলএনজি এবং কয়লাচালিত প্ল্যান্টকেও ক্যাপাসিটি চার্জ দিতে হচ্ছে পিডিবিকে। পিডিবির একটি প্রতিবেদনে তথ্য দেওয়া হয়েছে, ২০২১-২২ অর্থবছরে বিদ্যুৎ ক্রয় বাবদ সংস্থাটির ব্যয় হয় ৭৪ হাজার ২২৩ কোটি টাকা, যা ২০২০-২১ অর্থবছরে ছিল ৫১ হাজার ৮৭৯ কোটি টাকা। এক বছরে উৎপাদন ব্যয় বেড়েছে ২২ হাজার ৩৪৪ কোটি টাকা। ২০২১-২২ অর্থবছরে বেসরকারি প্ল্যান্ট (আইপিপি) থেকে বিদ্যুৎ কিনতে পিডিবির ব্যয় হয়েছে ৪৯ হাজার ২১৩ কোটি টাকা, যা আগের অর্থবছরের চেয়ে ৭৭ শতাংশ বেশি।
২০২৩ সালে আইএমএফ থেকে আমরা যে ৪ দশমিক ৭ বিলিয়ন ডলারের ঋণ নিয়েছি তার শর্ত মেনে বিদ্যুৎ খাতের ভর্তুকি হ্রাস করতে আমরা অঙ্গীকারবদ্ধ, প্রতিটি কিস্তি ছাড় করার আগে আইএমএফ তার শর্তগুলো পালিত হয়েছে কি না, তা পরীক্ষা করবেই। ইতিমধ্যে দু-দুবার বিদ্যুতের দাম বাড়িয়ে ভর্তুকি কমানোর প্রয়াস নিয়েছে সরকার। ‘ইনডেমনিটি অধ্যাদেশ’ চালু রেখে প্রধানত সরকারের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ এসব রেন্টাল ও কুইক রেন্টাল প্ল্যান্টের মালিকদের চুক্তি নবায়নের বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থাকে সরকার বাধাগ্রস্ত করছে! কিন্তু কার স্বার্থে বিদ্যুতের চাহিদা ও উৎপাদনের প্রবৃদ্ধি সম্পর্কে এত ‘অবাস্তব উচ্চ-প্রাক্কলন’ করা হলো?
ড. মইনুল ইসলাম, অবসরপ্রাপ্ত অধ্যাপক, অর্থনীতি বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়
একটি জাতীয় দৈনিকে ২০২৩ সালের ১০ জুলাই মূল শিরোনাম ছিল: ‘২০২৫ সালে বিদ্যুৎ উৎপাদন সক্ষমতার প্রায় ৬০ শতাংশ অব্যবহৃত থাকবে’। এই নিউজ আইটেমের অতিগুরুত্বপূর্ণ তথ্য হলো, ২০২৩ সালের জুলাই মাসে ক্যাপটিভ বিদ্যুৎ বাদেই বিদ্যুতের ইনস্টল্ড ক্যাপাসিটি দাঁড়িয়েছে ২৪ হাজার ২৬৩ মেগাওয়াট। পিডিবির হিসাব অনুযায়ী, ২০২৫ সালে বিদ্যুৎ উৎপাদন সক্ষমতায় যুক্ত হবে আরও অন্তত সাড়ে ১৪ হাজার মেগাওয়াট, ফলে ওই সময়ে বিদ্যুৎ উৎপাদন দাঁড়াবে ৩৮ হাজার ৭০০ মেগাওয়াটেরও বেশি। অথচ ২০২৩ সালের জুলাইয়ে বিদ্যুতের চাহিদা রয়েছে গড়ে সাড়ে ১৩ হাজার মেগাওয়াট। এই চাহিদা যদি আগামী দুই বছরে গড়ে প্রতিবছর ১০ শতাংশ হারে বেড়েও যায়, তারপরও ২০২৫ সালে বিদ্যুৎ উৎপাদন সক্ষমতার ৬০ শতাংশই অব্যবহৃত থেকে যাবে। ফলে অব্যবহৃত বিদ্যুৎ প্ল্যান্টগুলোকে যে ‘ক্যাপাসিটি চার্জ’ দিতে হবে তার বোঝা বহন করা পিডিবির জন্য ‘মারাত্মক বিপজ্জনক’ হয়ে উঠবে। বেসরকারি বিদ্যুৎ প্ল্যান্টগুলোর কাছে পিডিবির মোটা অঙ্কের টাকা বকেয়া পড়ে গেছে ২০২৩ সালের জুলাই মাসেই, যা ২০২৫ সালে অসহনীয় বোঝায় পরিণত হয়ে যাবে। রামপালের ১ হাজার ৩২০ মেগাওয়াট, বাঁশখালীর ১ হাজার ৩২০ মেগাওয়াট, নারায়ণগঞ্জের মেঘনাঘাটে সামিটের ৫৮৩ মেগাওয়াট, ইউনিক গ্রুপের ৬০০ মেগাওয়াট, ভারতের রিলায়েন্সের ৭৫০ মেগাওয়াট, মহেশখালীর মাতারবাড়ীর ১ হাজার ২০০ মেগাওয়াট এবং সর্বোপরি রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ প্ল্যান্টের ২ হাজার ৪০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ ২০২৫ সালের মধ্যে দেশের বিদ্যুৎ উৎপাদন সক্ষমতায় যুক্ত হতে যাচ্ছে। চাহিদা ও সরবরাহের এত বড় ‘ভুল প্রাক্কলন’ যারা করেছে, তাদের সরকার জবাবদিহির আওতায় আনতে পারবে কি? জ্বালানিমন্ত্রী স্বয়ং মাননীয় প্রধানমন্ত্রী, প্রধানমন্ত্রীর জ্বালানি ও বিদ্যুৎ উপদেষ্টা ড. তৌফিক-ই-ইলাহী চৌধুরী আর জ্বালানি ও বিদ্যুৎ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ—তাঁরা কেউ তো ‘টেকনিক্যাল পারসন’ নন, তাহলে কে বা কারা বিদ্যুতের চাহিদা ও উৎপাদনের এত বড় ভুল প্রাক্কলন করে দেশকে এই মহাবিপদে ঠেলে দিয়েছে?
বর্তমান সরকারের অত্যন্ত প্রশংসনীয় অর্জনের অন্যতম হলো দেশের শতভাগ মানুষকে বিদ্যুৎ সুবিধার আওতায় নিয়ে আসা, কিন্তু ‘চাহিদা ও উৎপাদনের মারাত্মক ভুল প্রাক্কলনের’ ফলে সৃষ্ট বিদ্যুতের ক্রমবর্ধমান উদ্বৃত্ত ক্যাপাসিটি সরকারের এই সাফল্যকে ইতিমধ্যেই ম্লান করে দিয়েছে এবং ২০২৫ সালে অর্থনীতিকে বড়সড় বিপদে ফেলতে চলেছে। আমরা জানি, রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের ফলে জ্বালানি তেল, এলএনজি এবং কয়লার আন্তর্জাতিক বাজারে যে মারাত্মক মূল্যস্ফীতি ও জোগান-সংকট সৃষ্টি হয়েছে, সেটা বাংলাদেশের অর্থনীতিতেও বড়সড় বিপর্যয় ডেকে এনেছে; বিশেষত করে বাংলাদেশের বিদ্যুৎ উৎপাদন যেহেতু এক দশক ধরে আমদানি করা এলএনজি এবং কয়লার ওপর অতিমাত্রায় ‘পরিকল্পিত নির্ভরশীলতা’ সৃষ্টি করেছে, তাই আন্তর্জাতিক বাজারে এলএনজির দামের স্ফীতি এবং জোগান-সংকট বাংলাদেশের জ্বালানি ও বিদ্যুৎ খাতে ইতিমধ্যেই মারাত্মক বিপর্যয় সৃষ্টি করেছে। এর আগে ২০০১-০৬ মেয়াদে ক্ষমতাসীন বিএনপি-জামায়াতের বিদ্যুৎ উৎপাদনে অকল্পনীয় ব্যর্থতাকে কাটিয়ে ওঠার জন্য ২০০৯ সালে ক্ষমতায় আসার অব্যবহিত পর মহাজোট সরকার প্রাইভেট সেক্টরের সহযোগিতায় যে ডিজেল ও ফার্নেস অয়েলনির্ভর রেন্টাল ও কুইক রেন্টাল বিদ্যুৎ প্ল্যান্ট স্থাপনের ‘ক্র্যাশ প্রোগ্রাম’ নিয়েছিল, সেটা হওয়ার কথা ছিল স্বল্পমেয়াদি জরুরি ব্যবস্থা। এই জরুরি ব্যবস্থা গ্রহণ তখনকার বাস্তবতায় মোটেও অযৌক্তিক মনে হয়নি। কারণ ২০০১-০৬ মেয়াদের সরকার ২০০১ সালে আওয়ামী লীগ সরকারের রেখে যাওয়া ৪ হাজার ৩০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন-সক্ষমতাকে তাদের পাঁচ বছরের শাসনামল শেষে ৩ হাজার ২০০ মেগাওয়াটে নামিয়ে ফেলেছিল। বিএনপি-জামায়াতের ওই শাসনামলে টঙ্গীতে ৮০ মেগাওয়াট উৎপাদন ক্ষমতার একটি ‘পিকিং প্ল্যান্ট’ নির্মিত হয়েছিল, আর ঘরে ঘরে বিদ্যুৎ-সুবিধা সম্প্রসারণের অজুহাতে দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে শুধু বিদ্যুতের খাম্বা স্থাপনের একটি ‘লুটপাট যজ্ঞ’ সম্পন্ন হয়েছিল। অন্যদিকে, ওই পাঁচ বছরে অনেকগুলো পুরোনো বিদ্যুৎ প্ল্যান্ট স্বাভাবিক নিয়মে মেয়াদোত্তীর্ণ হওয়ায় উৎপাদন প্রায় ১ হাজার মেগাওয়াট কমে গিয়েছিল।
২০০৭-০৮ সালে ক্ষমতাসীন সেনা-সমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকার বোধগম্য কারণেই এহেন অকল্পনীয় ব্যর্থতার ভালো সমাধান দিয়ে যেতে পারেনি। ফলে ২০০৯ সালের জানুয়ারিতে যখন মহাজোট সরকার ক্ষমতা গ্রহণ করেছিল, তখনো বিদ্যুতের লোডশেডিং অসহনীয় মাত্রায় অবস্থান করছিল। এমনকি শিল্প খাতসহ পুরো অর্থনীতিতে তখন বিদ্যুতের এই মহাসংকট বিপর্যয় ডেকে আনবে বলে ওয়াকিবহাল মহল আশঙ্কা প্রকাশ করেছিল। এর পরিপ্রেক্ষিতেই গৃহীত হয়েছিল মহাজোট সরকারের বিদ্যুৎ উৎপাদনের উল্লিখিত ক্র্যাশ প্রোগ্রাম। প্রাইভেট সেক্টরে ৫৮টি ফার্মকে ডিজেল ও ফার্নেস অয়েলচালিত নানা উৎপাদন ক্ষমতার রেন্টাল ও কুইক রেন্টাল বিদ্যুৎ প্ল্যান্ট স্থাপনের জন্য সরাসরি লাইসেন্স দেওয়া হয় জরুরি ভিত্তিতে বিদ্যুৎ উৎপাদন বৃদ্ধির জন্য। কোনো স্বীকৃত টেন্ডার-প্রক্রিয়া ছাড়াই এসব ফার্মকে বাছাই করা হয়েছিল ইমার্জেন্সি মোকাবিলার কথা বলে। আদালতে মামলা করে যাতে ওই বাছাই-প্রক্রিয়াকে কেউ চ্যালেঞ্জ করতে না পারে, সে জন্য সরকার ‘ইনডেমনিটি অর্ডিন্যান্স’ জারি করে দায়মুক্তির ব্যবস্থা করায় এসব ফার্ম নির্বাচনে যে দুর্নীতি, স্বজনপ্রীতি ও দলীয়করণের মোচ্ছব চালানো হয়েছিল তার বিরুদ্ধে কোনো আইনি প্রতিকার পাওয়া যায়নি। ওই ‘ইনডেমনিটি অর্ডিন্যান্স’ এখনো চালু রয়েছে। একই সঙ্গে বিদ্যুৎ উৎপাদনের একটি মহাপরিকল্পনাও ঘোষণা করা হয়েছিল, যাতে দাবি করা হয়েছিল যে ইমার্জেন্সি মোকাবিলায় স্থাপিত রেন্টাল ও কুইক রেন্টাল বিদ্যুৎ প্ল্যান্টগুলোর উৎপাদিত বিদ্যুতের ইউনিটপ্রতি খরচ যেহেতু ২০০৯ সালেই ১৬-২০ টাকায় হিসাব করা হয়েছিল, তাই মধ্যমেয়াদি পরিকল্পনায় বিদ্যুৎ উৎপাদনের দায়িত্ব ক্রমান্বয়ে আমদানি করা এলএনজি ও কয়লাচালিত বিদ্যুতের বেশ কয়েকটি মেগা প্রজেক্ট স্থাপন করে ওগুলোর ওপর ছেড়ে দেওয়া হবে। তখন কয়লা ও এলএনজির আন্তর্জাতিক দাম যেহেতু অনেক কম ছিল, তাই ওই পরিকল্পনাকে তেমন অযৌক্তিক মনে হয়নি। বলা হয়েছিল, ওই পরিকল্পনা অনুযায়ী ইউনিটপ্রতি বিদ্যুৎ উৎপাদন ব্যয় মধ্য মেয়াদে পাঁচ-সাত বছরের মধ্যে ৭-৮ টাকায় নামিয়ে আনা যাবে। এর সঙ্গে দীর্ঘমেয়াদে বিদ্যুতের উৎপাদন ব্যয় আরও নামিয়ে আনার জন্য বাংলাদেশের ইতিহাসের সবচেয়ে ব্যয়বহুল প্রকল্প রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ প্ল্যান্ট নির্মাণের সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়েছিল। রাশিয়ার ১২ বিলিয়ন ডলার ঋণসহ মোট ১ লাখ ১৩ হাজার কোটি টাকা ব্যয়ে নির্মীয়মাণ রূপপুর প্ল্যান্ট ২০২৪ সালে উৎপাদনে গেলে বাংলাদেশ সেখান থেকে ২ হাজার ৪০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদনে সক্ষম হবে বলে সরকার দাবি করে চলেছে।
কিন্তু রেন্টাল ও কুইক রেন্টাল প্ল্যান্টগুলো থেকে বিদ্যুৎ উৎপাদন করে ক্রয় না করলে ওগুলোকে ‘ক্যাপাসিটি চার্জ’ দেওয়ার ব্যবস্থাটা কয়েক বছরের মধ্যেই সরকারের জন্য বড়সড় বোঝায় পরিণত হয়ে যায়। অনেকগুলো রেন্টাল ও কুইক রেন্টাল প্ল্যান্টের সঙ্গে সরকারের চুক্তি বাতিলের সময় হলেও লবিং করে ওই সব প্ল্যান্টের মালিকেরা তাদের চুক্তি নবায়ন করিয়ে নিয়েছেন। কিন্তু দেশের বিদ্যুতের চাহিদা বেড়ে দাঁড়িয়েছে শীতকালে ১১ হাজার থেকে ১২ হাজার মেগাওয়াটে এবং গ্রীষ্মকালে ১৫ হাজার থেকে ১৬ হাজার মেগাওয়াটে। ইতিমধ্যে এলএনজি ও তেলের আন্তর্জাতিক দাম বেড়ে যাওয়ায় দেশের এলএনজি ও তেল আমদানির সক্ষমতা ব্যাপকভাবে হ্রাস পেয়েছে। ফলে ডিজেলচালিত বিদ্যুৎ প্ল্যান্টগুলো ২০২২ সালের জুলাই থেকে বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে এবং ফার্নেস অয়েলচালিত প্ল্যান্টগুলোতেও উৎপাদন-সংকোচনের নীতি গ্রহণ করতে হয়েছে। একই সঙ্গে এলএনজিচালিত কয়েকটি বিদ্যুৎ প্ল্যান্টও পুরোপুরি ব্যবহার করা যাচ্ছে না আমদানির সক্ষমতা না থাকায়। কয়লাচালিত পায়রা ও রামপাল বিদ্যুৎ প্ল্যান্ট ইতিমধ্যে উৎপাদনে এসে যাওয়া সত্ত্বেও ওগুলো ঠিকমতো চালু করা যাচ্ছে না প্রয়োজনীয় কয়লা আমদানি করতে না পারায়। এসব এলএনজি এবং কয়লাচালিত প্ল্যান্টকেও ক্যাপাসিটি চার্জ দিতে হচ্ছে পিডিবিকে। পিডিবির একটি প্রতিবেদনে তথ্য দেওয়া হয়েছে, ২০২১-২২ অর্থবছরে বিদ্যুৎ ক্রয় বাবদ সংস্থাটির ব্যয় হয় ৭৪ হাজার ২২৩ কোটি টাকা, যা ২০২০-২১ অর্থবছরে ছিল ৫১ হাজার ৮৭৯ কোটি টাকা। এক বছরে উৎপাদন ব্যয় বেড়েছে ২২ হাজার ৩৪৪ কোটি টাকা। ২০২১-২২ অর্থবছরে বেসরকারি প্ল্যান্ট (আইপিপি) থেকে বিদ্যুৎ কিনতে পিডিবির ব্যয় হয়েছে ৪৯ হাজার ২১৩ কোটি টাকা, যা আগের অর্থবছরের চেয়ে ৭৭ শতাংশ বেশি।
২০২৩ সালে আইএমএফ থেকে আমরা যে ৪ দশমিক ৭ বিলিয়ন ডলারের ঋণ নিয়েছি তার শর্ত মেনে বিদ্যুৎ খাতের ভর্তুকি হ্রাস করতে আমরা অঙ্গীকারবদ্ধ, প্রতিটি কিস্তি ছাড় করার আগে আইএমএফ তার শর্তগুলো পালিত হয়েছে কি না, তা পরীক্ষা করবেই। ইতিমধ্যে দু-দুবার বিদ্যুতের দাম বাড়িয়ে ভর্তুকি কমানোর প্রয়াস নিয়েছে সরকার। ‘ইনডেমনিটি অধ্যাদেশ’ চালু রেখে প্রধানত সরকারের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ এসব রেন্টাল ও কুইক রেন্টাল প্ল্যান্টের মালিকদের চুক্তি নবায়নের বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থাকে সরকার বাধাগ্রস্ত করছে! কিন্তু কার স্বার্থে বিদ্যুতের চাহিদা ও উৎপাদনের প্রবৃদ্ধি সম্পর্কে এত ‘অবাস্তব উচ্চ-প্রাক্কলন’ করা হলো?
ড. মইনুল ইসলাম, অবসরপ্রাপ্ত অধ্যাপক, অর্থনীতি বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়
১০ বছর ধরে নিজের আত্মজীবনী লিখেছেন বরেণ্য অভিনেতা, নাট্যকার ও নির্মাতা আবুল হায়াত। নাম দিয়েছেন ‘রবি পথ’। অবশেষে প্রকাশ হচ্ছে তাঁর আত্মজীবনী। আগামী ২ নভেম্বর বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমিতে আয়োজন করা হয়েছে রবি পথের মোড়ক উন্মোচন অনুষ্ঠান।
১ ঘণ্টা আগেএকদিন ভোরবেলা জাকারবার্গ লক্ষ করলেন যে পৃথিবীতে একটা ছোট্ট দেশে তাঁর সবচেয়ে বেশি ব্যবসা হচ্ছে। সামনের ফ্লোরটায় দেখলেন দেশটা ছোট বটে, কিন্তু জনসংখ্যা বেশি। আর এই দেশের জনসংখ্যার মধ্যে প্রায় অর্ধেক মানুষ ফেসবুক ব্যবহার করে। ফেসবুকে দেখতে পেলেন অসংখ্য বার্তা—সবই রাজনৈতিক এবং ছবিতে এ বিষয়ে বিপুল জনগণের
২ ঘণ্টা আগেঅন্তর্বর্তী সরকারের স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের ২৩ অক্টোবর এক প্রজ্ঞাপনের মাধ্যমে বাংলাদেশ ছাত্রলীগকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হয়েছে। ওই সংগঠনের বিরুদ্ধে অভিযোগ—বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সময় তাদের নেতা-কর্মীরা ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে সশস্ত্র হামলা পরিচালনা করে অসংখ্য আন্দোলনকারীকে হত্যা ও অনেকের জীবন বি
২ ঘণ্টা আগেইংরেজি সাহিত্যের অন্যতম রোমান্টিক কবি ছিলেন জন কিটস। কবিতা ছাড়া কিটস কোনো গদ্য লেখার চেষ্টা করেননি। তাঁর কাব্যজীবন ছিল মাত্র ছয় বছরের। অর্থাৎ উনিশ থেকে চব্বিশ বছর বয়স পর্যন্ত। মৃত্যুর মাত্র চার বছর আগে তাঁর কবিতাগুলো প্রকাশিত হয়। তৎকালীন সমালোচকদের দ্বারা কিটসের কবিতা খুব একটা আলোচিত হয়নি। তবে মৃত্য
২ ঘণ্টা আগে