আবু তাহের খান
মাথাপিছু আয় দিয়ে উন্নয়নের স্তর বোঝানোর চেষ্টা ও এর অনর্গল প্রচারণায় মানুষ এখন মহাবিরক্ত। অবশ্য বাংলাদেশে এই বিরক্তিকর প্রচারণা শুরু হওয়ার বহু আগেই বিশ্বের অর্থনীতিবিদ, গবেষক, শিক্ষক ও অন্যান্য পেশাজীবীরা উন্নয়নের পরিমাপক হিসেবে এ ধারণাকে প্রত্যাখ্যান করেছেন এবং সেই প্রত্যাখ্যান শুধু যে সাম্যবাদী চিন্তাবিদদের পক্ষ থেকেই হয়েছে তা-ই নয়, খোদ পুঁজিবাদী আদর্শে বিশ্বাসী অর্থনীতিবিদেরাও মাথাপিছু আয় দিয়ে উন্নয়নের স্তর নির্ধারণের ধারণাকে ভ্রান্তিপূর্ণ বলে মনে করেছেন। আর এরই ধারাবাহিকতায় ১৯৯০ সাল থেকে জাতিসংঘ উন্নয়ন কর্মসূচি (ইউএনডিপি) উন্নয়নের পরিমাপক হিসেবে মানব উন্নয়ন সূচকের (হিউম্যান ডেভেলপমেন্ট ইন্ডিকেটর—এইচডিআই) প্রবর্তন করে, যে ধারণার মূল উদ্ভাবক হচ্ছেন পাকিস্তানি অর্থনীতিবিদ মাহবুবুল হক।
উল্লিখিত এইচডিআইয়ের আওতাধীন সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ সূচকগুলোর অন্যতম হচ্ছে স্বাস্থ্য ও শিক্ষা, যা মানুষের বেঁচে থাকার জন্য সর্বজনস্বীকৃত পাঁচটি অত্যাবশ্যকীয় মৌলিক চাহিদারই অংশ। কিন্তু অতিদুর্বল স্বাস্থ্য অবকাঠামো ও চরম মানহীন জরাজীর্ণ শিক্ষাব্যবস্থার দিকে মনোযোগ না দিয়ে রাষ্ট্র কেবলই প্রচারণা চালাচ্ছে গুরুত্বহীন মাথাপিছু আয় নিয়ে, যার সঙ্গে সংখ্যাগরিষ্ঠ সাধারণ মানুষের স্বার্থের কোনোই সম্পর্ক নেই। এতে মানুষ যে শুধু বিরক্তই হচ্ছে তা-ই নয়, সরকারের চিন্তার অগ্রগামিতা ও গণমুখীনতা নিয়েও সন্দেহ তৈরি হচ্ছে।
তদুপরি এরূপ ভ্রান্তিপূর্ণ ধারণাকে উন্নয়নের সূচক হিসেবে রাজনৈতিকভাবে প্রচার করতে গিয়ে বস্তুত এটিকে তাঁরা রাষ্ট্রের নীতি হিসেবেও গ্রহণ করে ফেলছেন, যার ফলে রাষ্ট্রের উন্নয়ন-কৌশল ও কর্মসূচিতে জনস্বার্থের বিষয়টি ক্রমেই উপেক্ষিত হয়ে পড়ছে এবং এর বিপরীতে অগ্রাধিকার পাচ্ছে বিত্তবানের স্বার্থরক্ষার বিষয়টি। আর শেষোক্ত ওই কাজটি শ্রেণিস্বার্থ রক্ষার তাগিদ থেকে ঘটলেও প্রকারান্তরে তার পেছনে রয়েছে ক্ষমতা সুরক্ষার আকাঙ্ক্ষাও। কিন্তু রাজনৈতিক নীতিনির্ধারকেরা সম্ভবত ভুলে যাচ্ছেন যে রাষ্ট্রের নীতিকাঠামোর সুবিধা নিয়ে কার্যহাসিলের পর ক্ষমতা সুরক্ষার বাস্তব প্রয়োজনের সময় ওই চতুর বিত্তবানদের আর কাউকেই কখনো খুঁজে পাওয়া যাবে না, অতীতেও পাওয়া যায়নি।
সে যা হোক, উন্নয়নকে সংখ্যাগরিষ্ঠ সাধারণ মানুষের স্বার্থের অনুগামী করে তুলতে হলে অন্ন, বস্ত্র ও বাসস্থানের পাশাপাশি এইচডিআইয়ের অন্যতম দুই সূচক আয়ুষ্কাল (স্বাস্থ্য) ও শিক্ষাকেও সমান গুরুত্বের সঙ্গে গ্রহণ করতে হবে। আর বৃহত্তর জনগণের স্বার্থের দৃষ্টিকোণ থেকে এ বিষয়গুলোকে বিবেচনা করেই বস্তুত নির্ধারণ করতে হবে বর্তমানে আমরা উন্নয়নের কোন স্তরে বসবাস করছি, সে বিষয়টি। খাদ্য উৎপাদনের ক্ষেত্রে বাংলাদেশ এখন তার চাহিদার প্রায় কাছাকাছি পর্যায়ের উৎপাদন সক্ষমতা অর্জন করতে পেরেছে, যার মূল কৃতিত্ব এ দেশের পরিশ্রমী ও উদ্ভাবনাময় কৃষকের এবং রাষ্ট্রের ভূমিকা সেখানে খুবই নগণ্য।
তা, সেটি যার অবদানেই ঘটে থাকুক না কেন, রাষ্ট্রের দায়িত্ব হচ্ছে এর সুফল দেশের সব নাগরিকের জন্য যুক্তিসংগত হারে নিশ্চিত করা। কিন্তু অপ্রিয় হলেও সত্য, চাহিদার প্রায় কাছাকাছি পরিমাণের খাদ্য উৎপাদন করার পরও দেশের ৮৩ শতাংশ মানুষ এখনো পুষ্টিকর খাদ্য কেনার সামর্থ্য রাখে না। আর প্রায় ৪২ শতাংশ মানুষ বসবাস করছে দারিদ্র্যসীমার নিচে (এ পরিসংখ্যান নিয়ে বিতর্ক থাকলেও প্রকৃত তথ্য এর কাছাকাছি হবে বলেই ধারণা করা চলে)। তাহলে পাঁচ দশকের ব্যবধানে খাদ্যোৎপাদন যে প্রায় চার গুণ বৃদ্ধি পেল, তার সঙ্গে সংখ্যাগরিষ্ঠ সাধারণ মানুষের খাদ্যপ্রাপ্তির পরিসংখ্যানটি কি মিলল? যদি না মেলে, তাহলে মাথাপিছু আয় দিয়ে এর বিচার করা যাবে কীভাবে?
একইভাবে বস্ত্র উৎপাদনের ক্ষেত্রেও বাংলাদেশ প্রায় স্বয়ংসম্পূর্ণ। কিন্তু তারপরও মাঘের শীতে উত্তরের জনপদে কিংবা রাজধানীসহ অন্যান্য বড় শহরের বস্তিতে যে লাখ লাখ মানুষ শীতবস্ত্রের অভাবে চরম কষ্টে ভোগে, উন্নয়নের স্তর নির্ধারণে সে বিষয়টিকেও বিবেচনায় আনতে হবে। কারণ, উচ্চমাত্রার শৈত্যপ্রবাহের সেসব রাতে কষ্টে জবুথবু হয়ে পড়া সেখানকার প্রসূতি মা কিংবা অপুষ্ট শিশুর কাছে মাথাপিছু ২ হাজার ৮২৪ মার্কিন ডলার আয়ের ওই গল্প কেবলই অর্থহীন স্লোগান। আর তার চেয়েও বড় কথা, সে তো জানেই না যে ব্যাংকের ঋণের অর্থ লোপাট করে, কর-শুল্ক ফাঁকি দিয়ে, ভাগ-বাঁটোয়ারার ভিত্তিতে কয়েক গুণ বেশি ব্যয়ে উন্নয়ন প্রকল্প বাস্তবায়ন করে, করোনাকালে প্রণোদনার নাম করে রাষ্ট্রীয় তহবিল থেকে বিপুল অর্থ হাতিয়ে নিয়ে কিংবা টিকা ও অন্যান্য চিকিৎসাসামগ্রী আমদানি ও সংগ্রহের নামে লোপাট করে গড়ে উঠেছে মাথাপিছু আয়ের ওই উল্লম্ফিত হিসাব।
স্বাধীনতার গোড়ায় ১৯৭২ সালে দেশে খাসজমির পরিমাণ ছিল ৩০ লাখ একর, যার সিংহভাগই পরে রাষ্ট্রীয় প্রশ্রয়, সহযোগিতা ও পৃষ্ঠপোষকতায় আত্মসাৎ হয়েছে ভূমিদস্যু ও অন্যান্য লুটেরার দ্বারা। এরূপ লুণ্ঠনমূলক রাষ্ট্রব্যবস্থার পরিবর্তে রাষ্ট্রের আওতায় একটি যৌক্তিক বণ্টনব্যবস্থা প্রবর্তন করা গেলে এমনটি কখনোই ঘটত না এবং ভূমিহীনদের মধ্যে আজ যে নতুন করে ঘর বা খাসজমি বণ্টন করা হচ্ছে, তারও প্রয়োজন হতো না। প্রসঙ্গত বলা প্রয়োজন, ধনিকশ্রেণির বিত্তের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে এখন ভূমিহীনের কিংবা ভূমিতে অধিকতর প্রান্তিক হয়ে পড়া মানুষের সংখ্যাও দিন দিন বাড়ছে। কারণ, নব্য বিত্তবানেরা স্বল্পবিত্ত মানুষের ভূমিকে এখন লোলুপ হায়েনার মতো চতুর্দিক থেকে গ্রাস করে খাচ্ছে। আর এ খাওয়াকে অধিকতর নিরাপদ ও নির্বিঘ্ন করতে ভূমিদস্যুদের প্রতিনিধিত্বকারী সংগঠনগুলো রাষ্ট্রকে তাদের পক্ষে পাওয়ার জন্য নিয়তই নানা ফন্দি-ফিকির আঁটছে এবং বহু ক্ষেত্রে সফলও হচ্ছে।
স্বাস্থ্যব্যবস্থার ক্ষেত্রে বাংলাদেশের অবস্থা যে কতটা নাজুক, তা হাড়ে হাড়ে টের পাওয়া গেছে সাম্প্রতিক করোনার সময়। মানুষ তখন চরম হতাশা ও ক্ষোভের সঙ্গে লক্ষ করেছে, দীর্ঘ ৫০ বছরে এ দেশের স্বাস্থ্য খাত যে পরিসরে দুর্নীতি, অনিয়ম, অব্যবস্থাপনা ও অদক্ষতার জন্ম দিয়েছে, তা সত্যি বিস্ময়কর এবং এসব দেখে এ সময়ে সবার কাছেই এটি স্পষ্ট হয়েছে যে এ রকম একটি স্বাস্থ্যব্যবস্থার ওপর নির্ভর করে সর্বশেষ জনজরিপ অনুযায়ী প্রায় ১৭ কোটি জনসংখ্যার একটি দেশ কিছুতেই চলতে পারে না—মধ্যম আয়ের দেশ-উপযোগী স্বাস্থ্যব্যবস্থা তো অনেক পরের কথা। আর সে কারণেই রাজাপক্ষে ভ্রাতাদের পরিবারতান্ত্রিক রাষ্ট্র পরিচালন কৌশলের কারণে সাম্প্রতিক সময়ে শ্রীলঙ্কায় চরম অর্থনৈতিক বিপর্যয় নেমে আসার পরও এখনো এটাই সত্য যে সামগ্রিক জনস্বাস্থ্য পরিস্থিতির ক্ষেত্রে শ্রীলঙ্কার পর্যায়ে পৌঁছাতে বাংলাদেশকে আরও বহু বছর অপেক্ষা করতে হবে। তাহলে মাথাপিছু আয়ের বড়াই এ ক্ষেত্রে একেবারেই অর্থহীন হয়ে পড়ছে নাকি?
পরিশেষে শিক্ষার কথা। নানা ত্রুটিবিচ্যুতি, দুর্নীতি, অনিয়ম, অদক্ষতা ইত্যাদি সত্ত্বেও গত ৫০ বছরে বাংলাদেশের সব খাতেই কম-বেশি কিছু না কিছু উন্নতি ঘটেছে। ব্যতিক্রম শুধু শিক্ষা খাত, যেখানে গুণগত মানের কোনোরূপ উন্নতি ঘটা তো দূরের কথা, ক্রমাগতভাবে তা আরও নিম্নমুখী হয়ে পড়ছে। অথচ উন্নয়নের স্তর বোঝাতে শিক্ষা সেই মধ্যযুগ থেকেই উন্নয়নের অন্যতম নির্ণায়কের মর্যাদা ভোগ করে আসছে। কিন্তু বাংলাদেশ তার শিক্ষার মানটিকে স্বাধীনতা-পূর্বকালের পর্যায়েও টিকিয়ে রাখতে পারল না। আর মানহীন এই শিক্ষার কারণেই জাতিগতভাবে আমাদের কোনো উদ্ভাবনা নেই, নতুন জ্ঞান সৃষ্টি নেই, নতুন সাহিত্য নেই, নতুন গ্রন্থ নেই, এমনকি সংস্কৃতিরও কোনো বিকাশ নেই। আমরা কেবলই হয়ে উঠছি অন্যের উদ্ভাবনা ও সৃজিত জ্ঞানের একচ্ছত্র ভোক্তা, যে ভোক্তাবাজার আকারে বড় হলেও মর্যাদায় একেবারেই প্রান্তিক কিংবা মর্যাদাবিবর্জিত।
এই যখন পরিস্থিতি, তখন লুটেরা বিত্তবানের আয়ের সঙ্গে চা-শ্রমিকের আয়কে গড় করে মাথাপিছু আয়ের ভিত্তিতে উন্নয়নের স্তর নির্ধারণ শুধু ভ্রান্তিপূর্ণই নয়, চরম বিভ্রান্তিকরও। এই বিভ্রান্তি থেকে বেরিয়ে আসতে না পারলে বিত্তবানেরা শুধু ঘোলা পানিতে মাছ শিকারই করে যাবে, আর অসহায় সাধারণ মানুষের কাছে উন্নয়নের সোনার কাঠি হয়ে থাকবে কেবলই মরীচিকা। কিন্তু আমাদের মুক্তিযুদ্ধের মূল চেতনা তো ছিল এই যে বাংলাদেশ হবে খেটে-খাওয়া শ্রমজীবী মানুষের অংশগ্রহণভিত্তিক একটি বৈষম্যহীন রাষ্ট্র। তাহলে সে চেতনার সঙ্গে লুণ্ঠনকারীর আয়ের কল্যাণে সাধারণের মাথাপিছু আয় বেড়ে যাওয়াভিত্তিক উন্নয়নের ধারণা কি গ্রহণযোগ্য? আর ব্যক্তির আয়কে যদি উন্নয়নের নির্ণায়ক করতেই হয়, তাহলে সর্বাগ্রে বিবেচনা করতে হবে নাগরিকের সর্বনিম্ন আয়ের পরিমাণ কত সেটি।
লেখক: সাবেক পরিচালক, বিসিক, শিল্প মন্ত্রণালয়
মাথাপিছু আয় দিয়ে উন্নয়নের স্তর বোঝানোর চেষ্টা ও এর অনর্গল প্রচারণায় মানুষ এখন মহাবিরক্ত। অবশ্য বাংলাদেশে এই বিরক্তিকর প্রচারণা শুরু হওয়ার বহু আগেই বিশ্বের অর্থনীতিবিদ, গবেষক, শিক্ষক ও অন্যান্য পেশাজীবীরা উন্নয়নের পরিমাপক হিসেবে এ ধারণাকে প্রত্যাখ্যান করেছেন এবং সেই প্রত্যাখ্যান শুধু যে সাম্যবাদী চিন্তাবিদদের পক্ষ থেকেই হয়েছে তা-ই নয়, খোদ পুঁজিবাদী আদর্শে বিশ্বাসী অর্থনীতিবিদেরাও মাথাপিছু আয় দিয়ে উন্নয়নের স্তর নির্ধারণের ধারণাকে ভ্রান্তিপূর্ণ বলে মনে করেছেন। আর এরই ধারাবাহিকতায় ১৯৯০ সাল থেকে জাতিসংঘ উন্নয়ন কর্মসূচি (ইউএনডিপি) উন্নয়নের পরিমাপক হিসেবে মানব উন্নয়ন সূচকের (হিউম্যান ডেভেলপমেন্ট ইন্ডিকেটর—এইচডিআই) প্রবর্তন করে, যে ধারণার মূল উদ্ভাবক হচ্ছেন পাকিস্তানি অর্থনীতিবিদ মাহবুবুল হক।
উল্লিখিত এইচডিআইয়ের আওতাধীন সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ সূচকগুলোর অন্যতম হচ্ছে স্বাস্থ্য ও শিক্ষা, যা মানুষের বেঁচে থাকার জন্য সর্বজনস্বীকৃত পাঁচটি অত্যাবশ্যকীয় মৌলিক চাহিদারই অংশ। কিন্তু অতিদুর্বল স্বাস্থ্য অবকাঠামো ও চরম মানহীন জরাজীর্ণ শিক্ষাব্যবস্থার দিকে মনোযোগ না দিয়ে রাষ্ট্র কেবলই প্রচারণা চালাচ্ছে গুরুত্বহীন মাথাপিছু আয় নিয়ে, যার সঙ্গে সংখ্যাগরিষ্ঠ সাধারণ মানুষের স্বার্থের কোনোই সম্পর্ক নেই। এতে মানুষ যে শুধু বিরক্তই হচ্ছে তা-ই নয়, সরকারের চিন্তার অগ্রগামিতা ও গণমুখীনতা নিয়েও সন্দেহ তৈরি হচ্ছে।
তদুপরি এরূপ ভ্রান্তিপূর্ণ ধারণাকে উন্নয়নের সূচক হিসেবে রাজনৈতিকভাবে প্রচার করতে গিয়ে বস্তুত এটিকে তাঁরা রাষ্ট্রের নীতি হিসেবেও গ্রহণ করে ফেলছেন, যার ফলে রাষ্ট্রের উন্নয়ন-কৌশল ও কর্মসূচিতে জনস্বার্থের বিষয়টি ক্রমেই উপেক্ষিত হয়ে পড়ছে এবং এর বিপরীতে অগ্রাধিকার পাচ্ছে বিত্তবানের স্বার্থরক্ষার বিষয়টি। আর শেষোক্ত ওই কাজটি শ্রেণিস্বার্থ রক্ষার তাগিদ থেকে ঘটলেও প্রকারান্তরে তার পেছনে রয়েছে ক্ষমতা সুরক্ষার আকাঙ্ক্ষাও। কিন্তু রাজনৈতিক নীতিনির্ধারকেরা সম্ভবত ভুলে যাচ্ছেন যে রাষ্ট্রের নীতিকাঠামোর সুবিধা নিয়ে কার্যহাসিলের পর ক্ষমতা সুরক্ষার বাস্তব প্রয়োজনের সময় ওই চতুর বিত্তবানদের আর কাউকেই কখনো খুঁজে পাওয়া যাবে না, অতীতেও পাওয়া যায়নি।
সে যা হোক, উন্নয়নকে সংখ্যাগরিষ্ঠ সাধারণ মানুষের স্বার্থের অনুগামী করে তুলতে হলে অন্ন, বস্ত্র ও বাসস্থানের পাশাপাশি এইচডিআইয়ের অন্যতম দুই সূচক আয়ুষ্কাল (স্বাস্থ্য) ও শিক্ষাকেও সমান গুরুত্বের সঙ্গে গ্রহণ করতে হবে। আর বৃহত্তর জনগণের স্বার্থের দৃষ্টিকোণ থেকে এ বিষয়গুলোকে বিবেচনা করেই বস্তুত নির্ধারণ করতে হবে বর্তমানে আমরা উন্নয়নের কোন স্তরে বসবাস করছি, সে বিষয়টি। খাদ্য উৎপাদনের ক্ষেত্রে বাংলাদেশ এখন তার চাহিদার প্রায় কাছাকাছি পর্যায়ের উৎপাদন সক্ষমতা অর্জন করতে পেরেছে, যার মূল কৃতিত্ব এ দেশের পরিশ্রমী ও উদ্ভাবনাময় কৃষকের এবং রাষ্ট্রের ভূমিকা সেখানে খুবই নগণ্য।
তা, সেটি যার অবদানেই ঘটে থাকুক না কেন, রাষ্ট্রের দায়িত্ব হচ্ছে এর সুফল দেশের সব নাগরিকের জন্য যুক্তিসংগত হারে নিশ্চিত করা। কিন্তু অপ্রিয় হলেও সত্য, চাহিদার প্রায় কাছাকাছি পরিমাণের খাদ্য উৎপাদন করার পরও দেশের ৮৩ শতাংশ মানুষ এখনো পুষ্টিকর খাদ্য কেনার সামর্থ্য রাখে না। আর প্রায় ৪২ শতাংশ মানুষ বসবাস করছে দারিদ্র্যসীমার নিচে (এ পরিসংখ্যান নিয়ে বিতর্ক থাকলেও প্রকৃত তথ্য এর কাছাকাছি হবে বলেই ধারণা করা চলে)। তাহলে পাঁচ দশকের ব্যবধানে খাদ্যোৎপাদন যে প্রায় চার গুণ বৃদ্ধি পেল, তার সঙ্গে সংখ্যাগরিষ্ঠ সাধারণ মানুষের খাদ্যপ্রাপ্তির পরিসংখ্যানটি কি মিলল? যদি না মেলে, তাহলে মাথাপিছু আয় দিয়ে এর বিচার করা যাবে কীভাবে?
একইভাবে বস্ত্র উৎপাদনের ক্ষেত্রেও বাংলাদেশ প্রায় স্বয়ংসম্পূর্ণ। কিন্তু তারপরও মাঘের শীতে উত্তরের জনপদে কিংবা রাজধানীসহ অন্যান্য বড় শহরের বস্তিতে যে লাখ লাখ মানুষ শীতবস্ত্রের অভাবে চরম কষ্টে ভোগে, উন্নয়নের স্তর নির্ধারণে সে বিষয়টিকেও বিবেচনায় আনতে হবে। কারণ, উচ্চমাত্রার শৈত্যপ্রবাহের সেসব রাতে কষ্টে জবুথবু হয়ে পড়া সেখানকার প্রসূতি মা কিংবা অপুষ্ট শিশুর কাছে মাথাপিছু ২ হাজার ৮২৪ মার্কিন ডলার আয়ের ওই গল্প কেবলই অর্থহীন স্লোগান। আর তার চেয়েও বড় কথা, সে তো জানেই না যে ব্যাংকের ঋণের অর্থ লোপাট করে, কর-শুল্ক ফাঁকি দিয়ে, ভাগ-বাঁটোয়ারার ভিত্তিতে কয়েক গুণ বেশি ব্যয়ে উন্নয়ন প্রকল্প বাস্তবায়ন করে, করোনাকালে প্রণোদনার নাম করে রাষ্ট্রীয় তহবিল থেকে বিপুল অর্থ হাতিয়ে নিয়ে কিংবা টিকা ও অন্যান্য চিকিৎসাসামগ্রী আমদানি ও সংগ্রহের নামে লোপাট করে গড়ে উঠেছে মাথাপিছু আয়ের ওই উল্লম্ফিত হিসাব।
স্বাধীনতার গোড়ায় ১৯৭২ সালে দেশে খাসজমির পরিমাণ ছিল ৩০ লাখ একর, যার সিংহভাগই পরে রাষ্ট্রীয় প্রশ্রয়, সহযোগিতা ও পৃষ্ঠপোষকতায় আত্মসাৎ হয়েছে ভূমিদস্যু ও অন্যান্য লুটেরার দ্বারা। এরূপ লুণ্ঠনমূলক রাষ্ট্রব্যবস্থার পরিবর্তে রাষ্ট্রের আওতায় একটি যৌক্তিক বণ্টনব্যবস্থা প্রবর্তন করা গেলে এমনটি কখনোই ঘটত না এবং ভূমিহীনদের মধ্যে আজ যে নতুন করে ঘর বা খাসজমি বণ্টন করা হচ্ছে, তারও প্রয়োজন হতো না। প্রসঙ্গত বলা প্রয়োজন, ধনিকশ্রেণির বিত্তের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে এখন ভূমিহীনের কিংবা ভূমিতে অধিকতর প্রান্তিক হয়ে পড়া মানুষের সংখ্যাও দিন দিন বাড়ছে। কারণ, নব্য বিত্তবানেরা স্বল্পবিত্ত মানুষের ভূমিকে এখন লোলুপ হায়েনার মতো চতুর্দিক থেকে গ্রাস করে খাচ্ছে। আর এ খাওয়াকে অধিকতর নিরাপদ ও নির্বিঘ্ন করতে ভূমিদস্যুদের প্রতিনিধিত্বকারী সংগঠনগুলো রাষ্ট্রকে তাদের পক্ষে পাওয়ার জন্য নিয়তই নানা ফন্দি-ফিকির আঁটছে এবং বহু ক্ষেত্রে সফলও হচ্ছে।
স্বাস্থ্যব্যবস্থার ক্ষেত্রে বাংলাদেশের অবস্থা যে কতটা নাজুক, তা হাড়ে হাড়ে টের পাওয়া গেছে সাম্প্রতিক করোনার সময়। মানুষ তখন চরম হতাশা ও ক্ষোভের সঙ্গে লক্ষ করেছে, দীর্ঘ ৫০ বছরে এ দেশের স্বাস্থ্য খাত যে পরিসরে দুর্নীতি, অনিয়ম, অব্যবস্থাপনা ও অদক্ষতার জন্ম দিয়েছে, তা সত্যি বিস্ময়কর এবং এসব দেখে এ সময়ে সবার কাছেই এটি স্পষ্ট হয়েছে যে এ রকম একটি স্বাস্থ্যব্যবস্থার ওপর নির্ভর করে সর্বশেষ জনজরিপ অনুযায়ী প্রায় ১৭ কোটি জনসংখ্যার একটি দেশ কিছুতেই চলতে পারে না—মধ্যম আয়ের দেশ-উপযোগী স্বাস্থ্যব্যবস্থা তো অনেক পরের কথা। আর সে কারণেই রাজাপক্ষে ভ্রাতাদের পরিবারতান্ত্রিক রাষ্ট্র পরিচালন কৌশলের কারণে সাম্প্রতিক সময়ে শ্রীলঙ্কায় চরম অর্থনৈতিক বিপর্যয় নেমে আসার পরও এখনো এটাই সত্য যে সামগ্রিক জনস্বাস্থ্য পরিস্থিতির ক্ষেত্রে শ্রীলঙ্কার পর্যায়ে পৌঁছাতে বাংলাদেশকে আরও বহু বছর অপেক্ষা করতে হবে। তাহলে মাথাপিছু আয়ের বড়াই এ ক্ষেত্রে একেবারেই অর্থহীন হয়ে পড়ছে নাকি?
পরিশেষে শিক্ষার কথা। নানা ত্রুটিবিচ্যুতি, দুর্নীতি, অনিয়ম, অদক্ষতা ইত্যাদি সত্ত্বেও গত ৫০ বছরে বাংলাদেশের সব খাতেই কম-বেশি কিছু না কিছু উন্নতি ঘটেছে। ব্যতিক্রম শুধু শিক্ষা খাত, যেখানে গুণগত মানের কোনোরূপ উন্নতি ঘটা তো দূরের কথা, ক্রমাগতভাবে তা আরও নিম্নমুখী হয়ে পড়ছে। অথচ উন্নয়নের স্তর বোঝাতে শিক্ষা সেই মধ্যযুগ থেকেই উন্নয়নের অন্যতম নির্ণায়কের মর্যাদা ভোগ করে আসছে। কিন্তু বাংলাদেশ তার শিক্ষার মানটিকে স্বাধীনতা-পূর্বকালের পর্যায়েও টিকিয়ে রাখতে পারল না। আর মানহীন এই শিক্ষার কারণেই জাতিগতভাবে আমাদের কোনো উদ্ভাবনা নেই, নতুন জ্ঞান সৃষ্টি নেই, নতুন সাহিত্য নেই, নতুন গ্রন্থ নেই, এমনকি সংস্কৃতিরও কোনো বিকাশ নেই। আমরা কেবলই হয়ে উঠছি অন্যের উদ্ভাবনা ও সৃজিত জ্ঞানের একচ্ছত্র ভোক্তা, যে ভোক্তাবাজার আকারে বড় হলেও মর্যাদায় একেবারেই প্রান্তিক কিংবা মর্যাদাবিবর্জিত।
এই যখন পরিস্থিতি, তখন লুটেরা বিত্তবানের আয়ের সঙ্গে চা-শ্রমিকের আয়কে গড় করে মাথাপিছু আয়ের ভিত্তিতে উন্নয়নের স্তর নির্ধারণ শুধু ভ্রান্তিপূর্ণই নয়, চরম বিভ্রান্তিকরও। এই বিভ্রান্তি থেকে বেরিয়ে আসতে না পারলে বিত্তবানেরা শুধু ঘোলা পানিতে মাছ শিকারই করে যাবে, আর অসহায় সাধারণ মানুষের কাছে উন্নয়নের সোনার কাঠি হয়ে থাকবে কেবলই মরীচিকা। কিন্তু আমাদের মুক্তিযুদ্ধের মূল চেতনা তো ছিল এই যে বাংলাদেশ হবে খেটে-খাওয়া শ্রমজীবী মানুষের অংশগ্রহণভিত্তিক একটি বৈষম্যহীন রাষ্ট্র। তাহলে সে চেতনার সঙ্গে লুণ্ঠনকারীর আয়ের কল্যাণে সাধারণের মাথাপিছু আয় বেড়ে যাওয়াভিত্তিক উন্নয়নের ধারণা কি গ্রহণযোগ্য? আর ব্যক্তির আয়কে যদি উন্নয়নের নির্ণায়ক করতেই হয়, তাহলে সর্বাগ্রে বিবেচনা করতে হবে নাগরিকের সর্বনিম্ন আয়ের পরিমাণ কত সেটি।
লেখক: সাবেক পরিচালক, বিসিক, শিল্প মন্ত্রণালয়
ঝড়-জলোচ্ছ্বাস থেকে রক্ষায় সন্দ্বীপের ব্লক বেড়িবাঁধসহ একাধিক প্রকল্প হাতে নিয়েছে সরকার। এ লক্ষ্যে বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে ৫৬২ কোটি টাকা। এ জন্য টেন্ডারও হয়েছে। প্রায় এক বছর পেরিয়ে গেলেও ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানগুলো কাজ শুরু করছে না। পানি উন্নয়ন বোর্ডের (পাউবো) তাগাদায়ও কোনো কাজ হচ্ছে না বলে জানিয়েছেন...
২ দিন আগেদেশের পরিবহন খাতের অন্যতম নিয়ন্ত্রণকারী ঢাকা সড়ক পরিবহন মালিক সমিতির কমিটির বৈধতা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। সাইফুল আলমের নেতৃত্বাধীন এ কমিটিকে নিবন্ধন দেয়নি শ্রম অধিদপ্তর। তবে এটি কার্যক্রম চালাচ্ছে। কমিটির নেতারা অংশ নিচ্ছেন ঢাকা পরিবহন সমন্বয় কর্তৃপক্ষ (ডিটিসিএ) ও বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষের...
২ দিন আগেআলুর দাম নিয়ন্ত্রণে ব্যর্থ হয়ে এবার নিজেই বিক্রির উদ্যোগ নিয়েছে সরকার। বাজার স্থিতিশীল রাখতে ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশের (টিসিবি) মাধ্যমে রাজধানীতে ভ্রাম্যমাণ ট্রাকের মাধ্যমে ভর্তুকি মূল্যে আলু বিক্রি করা হবে। একজন গ্রাহক ৪০ টাকা দরে সর্বোচ্চ তিন কেজি আলু কিনতে পারবেন...
২ দিন আগেসপ্তাহখানেক আগে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকে অনেকের ওয়াল বিষাদময় হয়ে উঠেছিল ফুলের মতো ছোট্ট শিশু মুনতাহাকে হত্যার ঘটনায়। ৫ বছর বয়সী সিলেটের এই শিশুকে অপহরণের পর হত্যা করে লাশ গুম করতে ডোবায় ফেলে রাখা হয়েছিল। প্রতিবেশী গৃহশিক্ষকের পরিকল্পনায় অপহরণের পর তাকে নির্মমভাবে হত্যা করা হয়...
৩ দিন আগে