স্বপ্নটাকে আরও বড় করে দিল সোনার মেয়েরা

নাজিম আল শমষের, ঢাকা
প্রকাশ : ২৪ ডিসেম্বর ২০২১, ০৪: ৪২
আপডেট : ২৪ ডিসেম্বর ২০২১, ০৮: ৫৬

বাংলাদেশ ফুটবল ফেডারেশন (বাফুফে) ভবনে গতকাল বৃহস্পতিবারের চিত্রটা একটু অন্যরকম ছিল। মারিয়া মান্ডা, আনাই মগিনিরা এসেছেন। সদ্য কৈশোর পেরোনো এই ফুটবলাররা এখন দক্ষিণ এশিয়ার চ্যাম্পিয়ন। নেতিবাচক খবরে ভরা ফুটবল ফেডারেশন ভবনটা গতকাল আলোকিত হলো চ্যাম্পিয়নদের পদচারণে। তাঁদের সবার মুখে গৌরবের হাসি।

ধুঁকতে থাকা বাংলাদেশের ফুটবলে হঠাৎ হঠাৎ যে আনন্দের জোয়ার আসে, তা অধিকাংশই নারী ফুটবলারদের সৌজন্যে। যদিও সেটা বয়সভিত্তিক ফুটবলে। তাতে কী? সাফল্য তো সাফল্যই। এই মেয়েরাই প্রমাণ করে যাচ্ছেন যে, সাফল্যের তরি বইতে বইতে একদিন হয়তো তাঁরা পৌঁছে যেতে পারেন বিশ্বমঞ্চেও। ভবিষ্যতের কথা ভবিষ্যতের জন্যই তোলা থাক। আপাতত বাংলাদেশ ফুটবল উদ্‌যাপন করছে মেয়েদের সাফ অনূর্ধ্ব-১৯ নারী চ্যাম্পিয়নশিপ জয়ের আনন্দ।

বয়সভিত্তিক সাফে এর আগে অনূর্ধ্ব-১৫ ও অনূর্ধ্ব-১৮ শিরোপা জিতেছে বাংলাদেশের মেয়েরা। কমলাপুরের বীরশ্রেষ্ঠ শহীদ সিপাহি মোস্তফা কামাল স্টেডিয়ামে গতকাল ভারতকে ১-০ গোলে হারিয়ে গত পরশু জয়ের মুকুটে যুক্ত হয়েছে সাফ অনূর্ধ্ব-১৯ শিরোপাও। ছোট এক আক্ষেপ, মূল সাফ জিততে না পারা। নারী ফুটবলাররা আত্মপ্রত্যয়ের সঙ্গে জানিয়ে দিলেন, খুব দ্রুত সেই শিরোপাও দেশে আনবেন তাঁরা।

বাফুফে ভবনে গতকাল সবচেয়ে বেশি ব্যস্তদের একজন ছিলেন খাগড়াছড়ির মেয়ে আনাই মগিনি। ৩০ গজ দূর থেকে তাঁর নেওয়া শটেই ভারতের বিপক্ষে শিরোপা জেতা গোল পেয়েছে বাংলাদেশ। খাগড়াছড়ির সাতভাইয়াপাড়া গ্রামে প্রতিবেশীদের নিয়ে মেয়ের জয়সূচক গোলটি দেখেছেন

এরপর পৃষ্ঠা ২ কলাম ৬

বাবা রিপ্রু মঘ আর মা আপ্রুমা মগিনীসহ পুরো পরিবার। খেলা শেষে পুরো গ্রামবাসীকে খাওয়াতে হয়েছে মিষ্টি। যমজ দুই মেয়ে আনাই ও আনুচিংয়ের ফুটবলের টাকায় নতুন তোলা আধপাকা বাড়িতে বসে বাবা রিপ্রু মঘ গতকাল বললেন, ‘চাই বাংলাদেশ এগিয়ে যাক। মেয়েরা বিশ্বকাপে খেলুক।’

কয়েক শ কিলোমিটার দূর থেকে বাবার কথা শোনে লাজুক হাসি মেয়ে আনাইয়ের মুখে। দুই মিনিটের ছোট আনুচিং আগের দিন রাতে উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষা দিতে চলে গেছে খাগড়াছড়ি। বোনকে পাশে না পেয়ে আনাই খানিকটা অপ্রতিভ, কিন্তু চোখেমুখে গর্ব। আজ যে বাড়িতে মগিনি পরিবারের সুখের সংসার, ফুটবলের পারিশ্রমিক দিয়েই পরিবারকে সেই মাথা গোঁজার ব্যবস্থা করে দিতে পেরেছে দুই বোন।

তাঁদের গল্পটা সব সময় যেন চ্যাম্পিয়নের। ২০১০ সালে পুরোনো বাড়িটা আগুনে পুড়ে যাওয়ার পর কখনো আধ পেটা খেয়ে জীবন পার হয়েছে আনাইদের। বাড়ি পুড়ে যাওয়ায় তিন দিন জঙ্গলেই রাত কেটেছে নয়জনের পরিবারের। এক ঘরে গাদাগাদি করে থেকেছে পুরো পরিবার। ‘দিন আনি, দিন খাই’ এ পরিবার থেকে বঙ্গমাতা টুর্নামেন্টের আবিষ্কার আনাই-আনুচিংয়ের উঠে আসা রীতিমতো বিস্ময়কর। দেশকে আরও বেশি কিছু দেওয়ার প্রত্যয় আনাইয়ের। বললেন, ‘যত দিন পারব তত দিন ফুটবল খেলব আর দেশকে এগিয়ে নিয়ে যাব।’

মাত্র তিন ম্যাচ খেলেই সাফ অনূর্ধ্ব-১৯ চ্যাম্পিয়নশিপের সেরা খেলোয়াড় কক্সবাজারের মেয়ে শাহেদা আক্তার রিপা। উখিয়া উপজেলা সোনাইছড়ি গ্রামের দিন মজুর জালাল আহমেদের এই দ্বিতীয় কন্যাটি এক কালে বই আর অর্থের অভাবে বড় হয়েছে আপন মনে খেলে। সন্তানদের পড়ালেখার খরচ জোগাতে হিমশিম খাওয়া পিতা জালাল রিপাকে দিয়েছেন খেলার অবাধ স্বাধীনতা। বাড়ির সামনের মাঠে ছেলেদের সঙ্গে ক্রিকেট-ফুটবল আর মার্বেল খেলতেন রিপা। ‘খ্যাপ’ খেলেছেন ছেলেদের ম্যাচেও! ‘মানুষ বুঝতেও পারত না আমি ছেলে না মেয়ে!’—হাসতে হাসতে বলছিলেন রিপা। ২০১৬ সালে বঙ্গমাতা টুর্নামেন্টে সোনাইছড়ি প্রাথমিক বিদ্যালয়কে চট্টগ্রাম পর্যায়ের সেমিফাইনাল পর্যন্ত নিয়ে গিয়েছিলেন রিপা। হয়েছিলেন চট্টগ্রামের সেরা খেলোয়াড়ও। শিক্ষকের পরামর্শে পরের বছর বিকেএসপি ভর্তি হওয়া। সে বছরই ভারতের সুব্রত কাপে বিকেএসপির হয়ে প্রথম ম্যাচে মাত্র ৪০ সেকেন্ডে গোল করে জাতীয় দলের কোচদের নজর কাড়েন এই কিশোরী।

এর আগে সাফ অনূর্ধ্ব-১৫ ও ১৬ টুর্নামেন্টে খেললেও এটাই ছিল রিপার প্রথম সাফ অনূর্ধ্ব-১৯ টুর্নামেন্ট। ‘বড় বোনদের’ ভিড়ে খেলার সুযোগ পাবেন কিনা এমন সংশয়ে মাত্র ৫ মিনিট খেলার সুযোগ পান রিপা। পরের ম্যাচে ভুটানের বিপক্ষে খেলেছেন ৮৫ মিনিট। তাতেই করেছেন জোড়া গোল। আর পেছনে তাকাতে হয়নি। তিন ম্যাচে ৫ গোল করে সর্বোচ্চ গোলদাতা আর সেরা খেলোয়াড়ের পুরস্কার জেতা রিপার অবশ্য ভালো লাগে গোল করাতেই। বললেন, ‘ভুটানের বিপক্ষে খুব টেনশনে ছিলাম। কিন্তু এক গোল করতেই সব ভয় কেটে গেল। যদি সুযোগ পাই মূল দলেও গোল করব।’

সাফ অনূর্ধ্ব-১৫ শিরোপা জয়ী অধিনায়ক মারিয়া মান্ডার গল্পটা এখন অনেকেরই জানা। ছোটবেলায় বাবাকে হারানো মারিয়াদের আগলে রাখতেন মা এনাতো মান্ডা, সম্বল ছিল অন্যের বাড়িতে কাজ। আজ মেয়ে সামলাচ্ছেন জাতীয় দলকে। তাঁর হাতেই পরশু উঠেছে সাফের শিরোপা। শিরোপা জয়ের আনন্দে আজ গ্রামে বড়দিন পালন করতে যাবেন মারিয়া। পরিবারের জন্য নিয়ে যাবেন উপহার আর দেশের মানুষের ভালোবাসা, ‘আগে তো দেশ। দেশ যদি না জিতত তাহলে হয়তো বড়দিন করতে যেতাম না। গত বছরও যাইনি। এবার আনন্দ নিয়ে গ্রামে যেতে পারব।’

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

সরকারি চাকরিজীবীরা সম্পদের হিসাব না দিলে যেসব শাস্তির মুখোমুখি হতে পারেন

ভারতের পাল্টা আক্রমণে দিশেহারা অস্ট্রেলিয়া

ঢাকা কলেজে সংঘর্ষকালে বোমা বিস্ফোরণের ছিটকে পড়েন সেনাসদস্য—ভাইরাল ভিডিওটির প্রকৃত ঘটনা

ঐশ্বরিয়ার বিচ্ছেদের খবরে মুখ খুললেন অমিতাভ

লক্ষ্মীপুরে জামায়াত নেতাকে অতিথি করায় মাহফিল বন্ধ করে দেওয়ার অভিযোগ

এলাকার খবর
খুঁজুন

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত